পরীক্ষার আর মাত্র মাস দুয়েক বাকি। মা’র অসুস্থতা হঠাত বেড়ে যাবে এটা ভাবে নি মিতা। শেষবার স্ট্রোক হবার পর থেকে বাঁ হাত-পা অবস হয়ে গেলেও নিজের চেষ্টায় বিছানা থেকে উঠে দেয়াল ধরে ধরে এদিক ওদিক যাওয়া আসা করতে পারত। বাথরুমে যেতো, রান্নাঘরে গিয়ে দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে কাজের বুয়ার সাথে একটু কথা বলত। রান্নার ব্যাপারে কোন নির্দেশ দিতোনা, শুধু নিজের পছন্দ অপছন্দের কথা বলত। একমাত্র সামনের বাগানে বা বারান্দায় যেতে হলে মিতার হাত ধরে যেত। কিন্তু আজ পাঁচ দিন হল, মা যেন আরো দুর্বল হয়ে গেছে, বিছানা থেকে উঠলেই যেন টলতে থাকে। অষুধ পত্রে কোন অনিয়ম হতে দেয়নি মিতা। ডাক্তার এসে দেখে গেছে, দুশ্চিন্তা করতে মানা করেছে। বলেছে ঠিক হয়ে যাবে। সত্যি কি ঠিক হবে? না হোক, এভাবেই মা থাকুক, মিতা যতদিন বেঁচে আছে ততদিন থাকুক।
মার মুখের বাম দিকের কোনাটা একটু বেঁকে গেছে, মনে হয় সে যেন ব্যাঙ্গ করছে। কথা সামান্য একটু জড়িয়ে যাচ্ছে। সেটা সে জানে, তাই হয়তো খুব ধীরে ধীরে আলাদা আলাদা ভাবে প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করার চেষ্টা করে।
তবু সেটা ভাল ছিল। কলেজ যাওয়া দরকার হলেও মাকে রেখে সে আর বলতে গেলে বাইরে কোথাও যায়না। তবে আজকে ভেবেছিল একটু খোঁজ খবর নিতে যাবে। গত রাতেই সে বুয়াকে বলেছিল, তার ফিরে না আসা পর্যন্ত যেন সে থাকে। কিন্তু...।
মিতা থাকে মায়ের সাথে, তার বইপত্র সব এঘরেই নিয়ে এসেছে। বাবা সামনের ঘরটাতে। আজ সকাল ছ’টায় যখন সে কাজের বুয়ার জন্য গেট খোলার জন্য উঠেছে, তখন মা জেগে, তবে চোখ বুঁজে ছিল। মিতা মশারি তুলে ভাঁজ করে রেখে বের হল। বাবা বারান্দায় বসে দাঁত মাজছে।
‘কিছু আনতে হবে রে, মিতা?’ তার বাবা বলল। বাজার মাত্র মিনিট পাঁচেকের পথ, জরুরী কিছু থাকলে বাবা এখনি এনে দিয়ে যাবে।‘তোর মায়ের ওষুধ সব আছে তো?’ এটা অবশ্য এই সময় পাওয়া কঠিন।
‘হ্যা বাবা, কিছু লাগবে না। তবে আমাকে গোটা পঞ্চাশেক টাকা দিও, স্কুলে যাব আর কয়েকটা খাতা কিনব।‘
‘আচ্ছা নিস।‘
বাজার ঘাট বাবা রাত্রে করে নিয়ে আসে, তারপরও বাড়িতে হাজার খানেক টাকা রাখা আছে। কখন কী দরকার পড়ে কে জানে। সকাল আটটার সময় বের হয়, ফিরতে ফিরতে সেই রাত আটটা। এই টাকাটার হিসাব নেওয়া হয়না। কয়েক মাস পরে খুব বেশি কমে গেলে মিতা বলে, তখন আবার দেওয়া হয়। যদিও তাকে মানা করা হয়নি, তবু সেখান থেকে মিতা একটা পয়সাও খরচ করবেনা। সে হয়েছে তার বড় বোনের ঠিক বিপরীত। বিয়ের পরে যে এখন গাজীপুরে। মায়ের এই অবস্থা, কিন্তু ন’মাসে ছ’মাসেও তার ঢাকা শহরের এই খিলগাঁও ও আসা হয়ে ওঠেনা। একটা বাচ্চা নিয়ে সে দারুণ ব্যাস্ত।
বুয়া হাড়ি পাতিল মাজার জন্য কল ঘরে ঢুকতেই মিতা বাবার ঘরে ঢুকে বিছানা গোছগাছ করতে লাগল। বাবা ঢুকল। মানি ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে টেবিলের উপরে রেখে মিতার দিকে তাকাল। চোখে প্রশ্ন।
‘এতেই হবে,’ মিতা বলল।
বাবা লুঙ্গি গামছা নিয়ে বের হল। গোসলখানায় ঢোকার আগে মিতার মায়ের সাথে কথা বলবে। বাবা সেখান থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত না ডাকলে মিতা সাধারনত সেখানে যায়না। তবে সেটা দশ পনের মিনিটের বেশি হয়না।
বাবার নাস্তা খাওয়া প্রায় শেষ, মিতা চায়ের কাপ হাতে করে বারান্দা দিয়ে যাওয়ার সময় খোলা দরজা দিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। সেই একই ভাবে চোখ বুঁজে শুয়ে আছে মা। বাবার সাথে কথা বলেছে তো? জানালা দিয়ে একফালি হালকা রোদ এসে মায়ের সাদা সাড়িটাকে আরো সাদা করে দরজার চৌকাঠ পর্যন্ত এসে পড়েছে।
বাবার সাথে কথা হয়েছে প্রায় এক ঘণ্টা। মা বাথরুমে যাবেনা? নাস্তা খাবে কখন, ওষুধ খেতে হবেনা? ভাবল, সে বাবাকে চা দিয়ে এসে মাকে তুলবে।
‘মা, উঠবেনা?’ সে খাটের কিনারায় উবু হয়ে দাঁড়িয়ে ডান হাতের তালু মায়ের কপালে রাখল। ঠান্ডা। মায়ের মুখের বিকৃতিটা আর নেই, কিন্তু সারাটা মুখ জুড়ে হালকা একটা যন্তণার ছাপ। মায়ের ডান হাতের আঙ্গুলগুলো মুঠো করে চেপে ধরল। ঠান্ডা। বুকের ওঠানামা নেই, নিথর। কয়েকটা মুহূর্ত বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল মিতা।
‘মা, মা... মাগো...!’ একটা আর্ত চিৎকার করে সে সামনের দিকে পড়ে গেল। কপালটাকে তার মায়ের কোমল কাঁধ আশ্রয় দিচ্ছিল, কিন্তু মিতার তল পেটটাকে খাটের প্রান্তটা সজোরে আঘাত করে মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে যেতে বাধ্য করল।
‘কী হয়েছে, মিতা মা?’ বারান্দার প্রান্তের রান্নাঘর থেকে এক নিমেষে ছুটে এলো বুয়া। ‘হায়! হায়! কি সর্বনাশ!’ সে মেঝেতে বসে দু’হাত দিয়ে মিতার মাথাটা কোলে তুলে নিতে নিতে আর্তনাদ করে উঠল। ‘...এই যে, শুনছেন?’ কিন্তু ততক্ষণে মিতার বাবা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হতভম্ভ।...
...মিতার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। খুব একটা খারাপ হয়নি। তবে আরো ভাল হতে পারত। মা মারা যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর থেকে সে নিজের দেহের কিছু অসংগতিতে অস্বস্তিভোগ করতে শুরু করেছিল। সামান্য হালকা রক্তপাত ছাড়া তার শ্রাব বন্ধ হয়েগেছিল। সকালে বমি বমি ভাব। তারপরে স্তনে ব্যাথা। সে ভেবেছিল সেটা তার তল পেটের আঘাতের কারণে ঘটেছে। সে কাউকে কিছু বলার সাহস পায়নি। আর পরীক্ষার পড়াশুনার চাপের কারণে সেসব ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামানোরও সময় পায়নি।
এখন তার যখন তখন ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাচ্ছেও। কিন্তু রাতে ঘুমাতে সমস্যা। তার তল পেটের স্ফিতি...। শুনে আর দেখে যা জেনেছ সেই অভিজ্ঞতায় অনুভব করতে পারছে তার পাওয়া আঘাতটা তার দেহে নিঁখুত একটা গর্ভধারণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। হয়তো কোন টিউমার! সে নিশ্চিত যে সে এমন কিছু করেনি যার ফলে ‘অন্যকিছু’ হতে পারে । কিন্তু সে এখন কী করবে? বাবাকে বলবে? অন্তত বুয়াকে...? না, সে মরে গেলেও সেটা পারবেনা। নিজেই ডাক্তারের কাছে যাবে? তারপরে? বুয়া এবাড়িতে পুরোটা সময় থাকে না আর তার বাবা বাড়িতে থাকে আরো কম সময়। মা মারা যাওয়ার পরে তার বোন মাত্র কয়েকটা দিন ছিল। তার সমস্যাটা তাই হয়তো এখনো গোপন আছে। সে এটাকে গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিল। সে এখন থেকে শাড়ি পরবে।
কিন্তু সপ্তাহ দুয়েকের ভিতরেই তাকে তার বাবার সাথে ডাক্তারের কাছে যেতে হল। ততদিনে মিতা নিজের পেটে কিছু একটার নড়াচড়া অনুভব করতে শুরু করেছে। বুয়ার নিজের তিনটে ছেলেমেয়ে আর বেশ কিছু নাতিপুতি আছে। তবে বুয়া মিতার বাবাকে নিজের সন্দেহের কথা না বলে শুধু ‘অসুস্থ মিতাকে’ ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দিয়েছিল।
মিতার কপাল অন্তত এদিক দিয়ে ভাল যে তার বাবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সব ঝামেলা মিটিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেছে। সেখানে তার কিছু জরুরি কাজ পড়ে আছে, যেতেই হবে। পরিচিত ডাক্তার, কাজেই কোন ঝামেলা পোহানোর সম্ভবনা নেই।
সব শেষে ডাক্তারের চেম্বারে মিতাকে ডেকে পাঠানো হল। ‘তোমার বাবা জানে?’ মিতা মাথা নাড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডাক্তার। ‘কোন ছেলের খোঁজ করতে বলতে হবে তোমার বাবাকে?’ আবার মিতা মাথা নাড়ল। ‘কী করতে চাও?’
‘জানিনা,’ এবার মিতা বলল।
‘ঠিক আছে, তোমার আরো কিছু চেকাপের ব্যাপার আছে।‘ কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করে টেবিল থেকে রিপোর্টটা তুলে নিতে নিতে বলল,’এবারসন?’
কেঁপে উঠল মিতা। ‘না।‘
রাত্রে মিতা তার বাবাকে খেতে দিল। সে নিজে আগেই খেয়ে নেয়, কিন্তু আজ তার খাবার রুচী ছিল না।
‘ডাক্তার কী বলল?’
‘তুমি খেয়ে নাও, রিপোর্ট দিচ্ছি। আরো চেকাপের দরকার আছে, দুদিন পরে আর একবার যেতে বলেছে।‘ মিতার কান্না পাচ্ছে।
খাবার পরে নিজেই মিতার ঘরে এলো। মিতা শুয়েছিল, উঠে টেবিলের বইয়ের নিচে থেকে কাগজটা বের করে তার বাবার হাতে দিল। তারপর সরে গিয়ে বিছানার উপরে বসে পড়ল।
এক মুহূর্ত দেখার পরে যেন ধাক্কা খেয়ে কেঁপে উঠল। মাথা ঘুরিয়ে মিতার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকাল। ‘এটা তুমি কী করলে, মিতা?’ তার কন্ঠে বেদনা ছাড়া আর কিছু নেই। মিতা কিছু বলল না। ‘কে? মানুষটা কে?’ কোন জবাব নেই। ‘কে তোর এই সর্বনাশটা করল?’ তার কন্ঠে হাহাকার।
‘কেউ না, বাবা?’
‘তারমানে? আমাকে সব খুলে বল।‘
‘জানিনা কীভাবে হল...।‘
‘জানোনা? শয়তান মেয়ে!’ তার বাবা রাগে ফেটে পড়ল। ‘কচিঁ খুকি, কিছু জানোনা?’
‘না বাবা, সত্যি কিছু জানিনা।‘ মিতা যন্ত্রের মত বলতে লাগল। ‘তুমি জানো, আমি মিথ্যা কথা বলি না, বাবা।‘
‘তাই তো জানতাম, মিথ্যা কথা বল না। কিন্তু...।‘
‘না, বাবা। এক কাজ কর, আমকে গলা টিপে মেরে ফেল, না হয় বিষ এনে দাও, খেয়ে মরি। না হয় যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই।‘ সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ‘তোমার মান সম্মান...।‘
মিতার বাবা মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। ‘না মা, তোমাকে আমি অবিশ্বাস করব না। তুমি জানো, এই ব্যাপারে মিথ্যা টিকিয়ে রাখা যায় না। তুমি হয়তো বলতে মরে গেলেও তার পরিচয় তুমি দেবেনা। আর তুমি মরবে কেন? তুমি মরলে আমারও মরা হবে। কী নিয়ে থাকব আমি? তবে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। থাক, এ নিয়ে আমি ভাবব না। এখন আমাদের ভাবতে হবে কী করা যায়। ডাক্তার কী বলেছে?’
‘যা বলেছে সেটা আমি করতে পারবনা, আমি মরে যাব।’
‘ওহ!’ তারপরে একটু চিন্তা করে বলল,’ঠিক আছে মা, তুমি কিছু চিন্তা কোরনা। একটা না একটা উপায় ঠিকই বের হবে। খাওয়া দাওয়া ঠিকমত কোর, শরীরে যত্ন নিও।‘
...তার বেখেয়াল ভাবটা বড় সাহেবের নযরে পড়তে খুব একটা বেশি সময় লাগল না। তার চেম্বারে ডেকে পাঠানো হল। টেবিলের উপরে গোটা ছয়েক ফাইল, আর সামনে আর একটা খোলা।
‘বসুন,’ সামনের একটা চেয়ারের দিকে ইশারা করে তার বড় কর্তা বলল। বসল সে। ‘আপনার কি বাড়িতে কোন সমস্যা হয়েছে?’
‘হ্যা,’ একটুঁ ইতস্তত করে জবাব দিল মিতার আব্বা।‘আমাকে কয়েক দিনের ছুটি দিলে ভাল হত... দিন তিনেকের।’
‘সামনে কয়েকটা শিপমেন্ট আছে, রফিক সাহেব টুরে। দিন পনের পরে নিলে হয় না?’
‘একটা... মানে, পারিবারিক একটা সমস্যায় পড়েগেছি...।’
বড়সাহেব সামনের দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাল, একটা বেজে বিশ। ‘এই ছ’টা ফাইল আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি, আধা ঘণ্টার ভিতরে হয়ে যাবে আশা করি। যে কটা হয় পাঠিয়ে দেবেন আর ঠিক দুটোর সময় আমার সাথে দেখা করবেন। তখন কথা হবে।’ মিতার আব্বা বেশ অবাক হল, বোর্ড মিটিং বা একান্ত জরুরি কিছু না হলে এরা দুই ভাইয়ের একজনও লাঞ্চের সময় লাঞ্চ ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু এ নিয়ে কোন প্রশ্ন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে মাথা ঝুঁকিয়ে বের হয়ে এলো।
ফাইলের কাজ শেষ করে পাঠিয়ে দিয়ে নামাজ পড়ে বের হতে হতেই তার দুটো বেজে গেল। ক্যান্টিনে খেতে যাওয়ার আর সময় নেই। দেখা করে এসে খাওয়ার কাজ সারবে ভাবতে ভাবতে সে বড় সাহেবের ঘরে ঢুকল। সেখানে তখন দুই ভাই বসে। তাকে দেখার সাথে সাথে তারা উঠল। ‘আসেন,’ বড়জন বলল। তারা তিনজন বের হল।
ক্যান্টিনে দুই সাহেব আর বিশেষ কোন অতিথির জন্য একটা কামরা আলাদা করে রাখা হয়েছে। তাদের সাথে সেখানে ঢুকে দেখতে পেল তাদের দিন জনের খাবার টেবিলে দেওয়া হয়েগেছে।
‘দেখেন রফিক সাহেব,’ বড়জন বলতে শুরু করল। ‘প্রায় বিশ বছর আগে এটা যখন ছোট একটা প্রতিষ্ঠান ছিল, বাবা চালাতেন, তখন আপনি এখানে কাজে ঢুকেছিলেন।’ ছোটজন মুখে খাবার তুলতে তুলতে মাথা ঝাকালো। ‘আমাদের পারিবারিক প্রায় সব অনুষ্ঠানে আপনি আসতেন, আপনাদের কয়েকটাতে আমরা গেছি।’ মিতার আব্বা ভেবে পেলনা তাকে কেন এখানে লাঞ্চের জন্য আনা হয়েছে আর এসব কথা বলা হচ্ছে। ‘আমরা জানি, আপনি কয়েকবার অন্যখানে আরো বেশি বেতনের অফার পেয়েও যান নি। কেন?’
‘আপনাদের বাবার কাছে কাজ করে আমি যে সাচ্ছন্দ পেয়েছিলাম, সেটা হয়তো অন্য কোথাও পাওয়া যাবেনা ভেবেছিলাম।’ সে বিব্রতভাবে জবাব দিল।
‘আমাদের মা’কে আপনি ভাবি বলে ডাকতেন। আর আমরা দু’জন এই চেয়ারগুলোতে বসার আগ পর্যন্ত আমাদেরকে তুমি করে বলতেন।’ তাদের দু’জনের মুখে হাসি ফুটে উঠল। মিতার আব্বা লাজুক হেসে মুখ নিচু করল। ‘আপনি আমাদেরকে যাই মনে করেন না কেন, আমরা আপনাকে আমাদের পরিবারের একজন বলে মনে করি।’ মিতার আব্বা কিছু বলতে গেল, কিন্তু বড়জন হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিল। ‘আপনাকে ছুটি যদি নিতেই হয়, আমরা সেটা আপনাকে দেব আর কোন না কোন একভাবে আমাদের কাজ চালিয়ে নেব, কাজেই এটা মনে করবেন না যে, আপনাকে আমরা ছুটি না দেওয়ার জন্য এই সব বলছি। আমরা চাই, আপনি আমাদেরকে আপনার সমস্যার কথা বলুন। আমরাও সেটা নিয়ে মাথা ঘামাব।’
‘আমার মেয়ে সন্তান সম্ভবা।’
‘কংগ্রাচুলেশনস,’ তার দু‘জনে প্রায় একই সাথে বলে উঠল। তারপরে বড়জন হাসতে হসাতে বলল,‘কিন্তু আমরা সম্ভবত তার বিয়ের দাওয়াত পাইনি।’
‘তার বিয়ে হয়নি।’
‘ওহ!’তাদের মুখে আষাঢ়ের মেঘ নেমে এলো। সবকিছু খুলে বলল মিতার বাবা। বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল।
‘এই মেয়েটা ছাড়া আমি আর কী নিয়ে থাকব? আমি ভাবছি, বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এদিকে কোথাও একটা বাসা ভাড়া করে নিয়ে থাকব। এটা না করা পর্যন্ত আমি কাজে মন বসাতে পারছি না।’
দুইভাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। ‘আমি একটা প্রস্তাব দিতে পারি,’ বড়জন বলল। ‘বাড়িটা এখনি বিক্রি না করে ভাড়া দিতে পারেন। কমলাপুরের কন্টেনার ডিপোর কাছাকাছি আমরা একটা গোডাউন জাতীয় কিছু ভাড়া নেবার কথা ভাবছিলাম, এতে আমাদের সুবিধা সেটা আপনিও জানেন।’ ছোটজন সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল। ‘পরে ইচ্ছা হলে আপনি সুবিধামত বিক্রি করেও দিতে পারবেন, আমাদেরকে মাস খানেকের নোটিশ দিলেই চলবে। কী বলেন?’
‘হয়তো আমরাও কিনে নিতে পারি।’ ছোটজন বলল।
‘এর চেয়ে ভাল প্রস্তাব আমি আর কী আশা করতে পারি?’
‘তাহলে এটাই ঠিক থাকল। আপনার ঐ এলাকা হিসাবে আপনার পুরো বাড়িটার যা ভাড়া হতে পারে বলে মনে করেন, আমাদে লিগাল এডভাইজারকে দিয়ে একটা ডিড করিয়ে নেবেন। এক তারিখ থেকে সেটা কার্যকারী হবে। তবে আপনি ইচ্ছা করলে সেখানে আমাদের কাজ শুরু না হওয়া পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের কর্মী হিসাবে থাকতে পারবেন।’
‘না, আর বার দিন আছে। আমি এর মধ্যেই এখানে একটা ঘর ভাড়া করে উঠে আসব।’
‘ঠিক আছে। আর হ্যা, কাগজে কলমে আমাদের মা আমাদের প্রতিষ্টানের ডাইরেক্টর, তাকে এটা জানাতে হবে। আমি যদি তাকে আপনার মেয়ের পুরো ব্যাপারটা বলি তাতে কি আপনার কোন আপত্তি আছে?’
‘না। তবে আমার একটা অনুরোধ, মিতাকে যেন এই একটা ব্যাপারে কোন প্রশ্নের মুখোমুখি না হতে হয়। যদিও এর কোন সম্ভবনা নেই।’
‘সেটা নিয়ে ভাববেন না। আমাদের মা কৌতূহলী হতে পারে, কিন্তু অবিবেচক নয়।’
...প্রথম সাক্ষাৎকারেই ডাইরেক্টর মিসেস মাহমুদা মিতার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন আর সেটা পেয়েও গেলেন।
‘আমার তিনটে ছেলে,’ তিনি মিতার বাবাকে বললেন। ‘ওর কী যে ইচ্ছা ছিল একটা মেয়ের। ভেবেছিলাম হয়তো হবে। কিন্তু কপালে নেই। তাছাড়া কী যে কাজের নেশা। আমাকে শুদ্ধু কাজে লাগিয়ে দিল। তবে ছেলেদের কিন্তু লেখা পড়া শেষ হবার আগে এদিকে ভিড়তেই দিল না। ছোটটাতো এখনো বিলাতে ডাক্তারি পড়ছে। ছেলেটা আসছে দুই মাস পরে। তবে সেটাকে আর এই জোয়ালে আটকাবোনা, তার মতই থাকবে সে। নান্টু মিন্টুরও মত তাই।’ এবার তিনি মিতার দিকে ফিরলেন। ‘কিন্তু তুমি তো আমার মেয়েই, মা। গত তিনটে বছর ছাড়া তোমাকে তো আমি প্রতি বছরই দু’চারবার করে পেতাম। উনিও তোমাকে খুব পছন্দ করতেন। উনি থাকলে যে কী খুশিই হতেন!’ তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘যাকগে, তোমার ডাক্তারের কাগজ পত্র সব দেখিও। আজ বিশ্রাম নাও, কাল তো হবেনা, পরশু আমরা ডাক্তারের কাছে যাব...।’
‘...মিতা জন্মের সময় ঠিক এই রকম ছিল,’ মিতার মেয়েকে দেখে মিতার বাবা বলল।
মিতা গভীর চোখে তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেখানে উদ্বগের মাঝেও যেন একটু খুশির ছোঁয়া, সে চোখ বন্ধ করল।
কিন্তু মাস ছয়েক পর থেকে বাচ্চাটার কিছু কিছু জটিলতা দেখা দিতে শুরু করল। প্রথম দিকে কেউ গা না করলেও পরে তাকে হলিক্রসের চাইল্ড স্পেশালিষ্টের কাছে নেওয়া হল।
‘আমরা বাচ্চার বাবা আর মায়ের রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে চাই।’ প্রাথমিক পরীক্ষার রিপোর্ট দেখার পরে মিতার বাবাকে বলা হল।
‘মা আছে, কিন্তু বাবাকে পাওয়া যাবে না।’ বিব্রত বাবা তার সাথে আসা সদ্য বিলেত ফেরত ডাক্তার সেন্টুর দিকে তাকল।
‘ওহ? ঠিক আছে, তার মায়েরটা...।’ স্পেশালিষ্ট কিছুটা হতাশ।
সাতদিন পরে মিতার বাবা আর সেন্টুকে রিসেপশন থেকে সোজা স্পেশালিষ্টের রুমে যেতে বলা হল।
‘আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই...একা হলেই ভাল।’ তারা বসতেই ডাক্তার সেন্টুর দিকে তাকিয়ে বলল। সেন্টু সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল।
‘আপনি সাচ্ছন্দে ওনার সামনে বলতে পারেন। আপনি বসুন।’
‘বাচ্চার বাবাকে পাওয়া যায়নি, কারণ সেই জাতীয় কিছুর অস্তিত্ব আছে বলে আমার মনে হয় না।’ মিতার বাবার ফ্যাল ফ্যাল করে একবার ডাক্তার আর একবার সেন্টুর দিকে তাকাতে লাগল। সেন্টুর বিস্মিত লৃষ্টি ডাক্তারের দিকে। ‘বাচ্চা আর তার মায়ের জিনের নকসা একরকম।’
‘ক্লোন?’ এই প্রথম সেন্টু কথা বলল।
‘অনেকটা...সেটাই বলতে পারেন।’
‘সঠিক ভাবে বলতে গেলে আরো অনেক কিছু পরীক্ষা করে দেখতে হবে, যেটা এখানে সম্ভব নয়।’ ডাক্তার তাদের দিকে ঝুঁকে বসল। ‘আমরা বাচ্চাটার ট্রিটমেন্টের একটা ক্লু পেয়েগেছি, সময় লাগলেও আমরা পারব। আর আপনারা যদি আরো গভীরে যেতে চান, বিদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা খুব আগ্রহের সাথে এগিয়ে আসবে। সমস্ত মিডিয়ার নযর পড়বে বাচ্চা আর তার মায়ের উপরে। কিন্তু এরা দুজন গিনিপিগ নয়, মানুষ।’
মিতার আব্বা আবার সেন্টুর দিকে তাকাল।
‘আমি ক্লোনের ব্যাপারটা কিছুটা জানি, কিন্তু এটা বোধ হয় অন্য কিছু হবে...।’ সেন্টু বলল।
‘সহজে বললে, পুরুষের শুক্রকীট আর স্ত্রীর ডিম্বের মিলনে সন্তান জন্ম নেয়। দেখা গেছে দুইজন নারীর ডিম্বের মিলনের ফলেও সন্তান জন্ম নিতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে একমাত্র মেয়ে সন্তানই জন্ম নেবে। আমি গাইনি নই, কাজেই খুব বেশি ব্যাক্ষা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আমি যতদূর জানি সেভাবেই বলছি। একটা ডিম্ব একটা নিদৃষ্ট সময়ে নিদৃষ্ট স্থানে মিলনের জন্য নিদৃষ্ট সময় অপেক্ষা করে বিফল হলে দেহ থেকে বের হয়ে যায়। এখন কোন একটা ডিম্ব যদি যে কোন কারণেই হোক সেখানে আটকা পড়ে যায় আর পরবর্তী ডিম্ব এসে তার সাথে মিলিত হয় তাহলে এর ফলেও সন্তান জন্ম নিতে পারে...।’
‘পৃথিবীতে এই ধরণের ঘটনার একটাও নজির নেই, এটা সম্ভব নয়...।’ সেন্টু বাধা দিয়ে বলল।
‘না, নেই। কিন্তু আজ পর্যন্ত কতগুলো কুমারী মেয়ের সন্তানের ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে? এটা মানতেই হবে দুর্ঘটনার ফলে যে কোন কিছুই হতে পারে।’
‘তাহলে মেরী...।’
‘প্লিজ,’ সেন্টুকে সাথে সাথে থামিয়ে দিল ডাক্তার। ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, প্রতি রবিবার গির্জায় যাই প্রার্থনা করি। জাগতিক নিয়মের বাইরেও তিনি যা খুশি করতে পারেন। তিনি মাদার মেরীকে বিশেষ অনুগ্রহ দিয়েছিলেন, জগতের অন্য কোন কিছুর সাথে তার কোন তুলনা চলতে পারেনা। লর্ড যীশু ছিলেন অনুগ্রহ প্রপ্ত সুস্থ্য সবল পুরুষ। সেটা ছিল ঈশ্বরের ইচ্ছা, আর আমাদের এটা একটা দুর্ঘটনা।’
‘দুর্ঘটনা বলছেন কেন? সবই তো তার ইচ্ছায় হয়, নাকি?’
‘তিনি সবার জন্য আইন করে দিয়েছেন, আর চান সবাই নিজ নিজ আইন মেনে চলুক। কেউ আগুনে পড়ে গেলে আগুন তাকে পোড়াবে- আগুনের জন্য এটাই আইন- সে উদ্ধার পেলেও চিহ্ন থেকে যাবে। এটা একটা দুর্ঘটনা। আবার দেখেন, আপনাদের পবিত্র গ্রন্থে আছে, ইব্রাহীম(আঃ)কে আগুনে ফেলা হয়েছিল, তার শরীরে পোড়ার কোন চিহ্ন ছিলনা, এটা ইশ্বরের অনুগ্রহ, আগুনের আইনকে তিনি সাময়িক ভাবে বাতিল করেছিলেন।’
‘আমাদের এখন কী করতে বলেন?’ মিতার বাবার এসব ভাল লাগছিলনা।
‘বাচ্চাটাকে এখানে রেখে চিকিৎসা করান আর অন্য কোন কিছু নিয়ে ভাবতে বা কথা বলতে যাবেন না। এর চিকিৎসার বিষয় ছাড়া অন্য সমস্ত কাগজ পত্র আমি নষ্ট করার ব্যবস্থা করছি।’
‘ঠিক আছে, সেটাই হোক। আমার মেয়েটা একটু শান্তিতে থাকুক...।’
...এই কাহিনীর স্থান, কাল, পাত্র বা ঘটনা বাস্তব নয়, কাল্পনীক। -লেখক।