ইতি, রুনু।

বাবা দিবস (জুন ২০১৩)

মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন
  • 0
  • ১৬৬
রবিবার,১৬ই জুন, ২০১৩।
বাবা,
তুমি কেমন আছো? কোথায় আছো?
তোমার কি মনে আছে বাবা, তোমার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আজ্ ঠিক এক বছর পুরো হল? হ্যা বাবা, আমার একটুও ভুল হচ্ছে না। কি করে ভুল হতে পারে, আমার জন্মদিনের পাঁচদিন পর কত রাতে তুমি তাড়াহুড়া করে বাড়িতে এলে, মা উঠল, কাপড়চোপড় তোমার ব্যাগে গুছিয়ে দিল। খেতে বলল, কিন্তু তুমি না খেয়ে বের হলে। আমার মাথায় আলগা করে হাত বুলিয়ে দিলে, যেন আমি জেগে না যাই। আমার কপালে চুমু খেলে, তারপর চলে গেলে। আমি কিন্তু বাবা, জেগেছিলাম। হারিকেনটা তো মিটমিট করে জ্বলছিল, তাই তুমি আমার চোখের পানি দেখতে পাওনি। নাকি দেখতে পেয়েছিলে?

চারদিন হল আমার জন্মদিন গেল। এবার কিন্তু কিছুই হল না, না মিষ্টি না পায়েশ। মা বলেই নি যে আমার জন্মদিন। আমি কিন্তু জানি। তোমার খাতায় লেখা আছে না? আমি মাঝে মাঝে বাক্স থেকে বের করে তোমার খাতাটা দেখি, দেওয়ালে ক্যালেন্ডার ঝুলছে, মিলিয়ে দেখি- রাগ কোরনা বাবা। তুমি থাকতেও তো আমি পড়তাম, কই রাগ করতে না তো। আমি কিন্তু কাউকেই বলিনি, ডাক্তারকেও না। ও, ডাক্তারকে তো তুমি চেনোনা। কী যে একজন ভাল মানুষ!

তুমি চলে যাওয়ার পরে কী হল, জান বাবা? মা গালে হাত দিয়ে বসে থাকল, দোর থাকল খোলা। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাংল মুংলির ডাকে। তার দুধ দোয়ানোর সময় বয়ে যায়, সকাল হয়েছে তো। তুমি নেই, কে দোয়াবে? মা পারে, কিন্তু সে তো সেই গালে হাত দিয়ে বসেই থাকল।

আমি হিসু করতে বের হলাম। দেখি কি, রঞ্জু চাচা বাড়ির দিকে আসছে। তার পিছনে হিরন, সাবু আর মাসুম আরো কে কে যেন। সবার হাতে লাঠি। আমি বাবা ভয়ে গোয়ালের পিছনে লুকালাম। উঁকি দিয়ে দেখি, তারা ঘরের ভিতরে ঢুকল।
‘হারামজাদাটা কই?’ চাচা মাকে বলল। মা কি বলল শুনতে পেলাম না।
‘শুওরের বাচ্চার সাহস কত! আমার জমিতে কোদাল চালায়?’ মা কি বলল, চাচা আরো খেপে গেল। ‘ওর বাপ ওকে দিয়েগেছে? ঐ কুপুত্তুরকে কেউ কিছু লেয়? সব আমাকে দিয়ে গেছে। এই ভিটেটাও। হারামজাদাটাকে বলিস, আজকের মধ্যে এখান থেকে না গেলে এই ঘরের ভিতরে তোদের সবকটাকে পুড়িয়ে মারব।’ মা আবার কি বলল। ‘থানায় কেস করে দিয়েছি, দারগাকে আজকের দিনটা সময় দিতে বলেছি, পুড়ে যদি নাও মরিস, কালকে তোদের কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় টেনে নিয়ে যাবে। তখন মজা দেখিস।’ তারপর তারা চলে গেল। মা বসেই থাকল।

আচ্ছা বাবা, চাচাদের তো কত জমি। কত বড় বাড়ি। ধানের গোলা, পুকুর বাগান। আমাদেরকে এই চোট্ট বাড়িটা দিয়ে দিলেই তো পারে। তুমি তো তার ভাই, তাইনা? তুমি যেখানে কোদাল নিয়ে গেছিলে সেটা তো জংগল, পড়েই আছে- পড়েই আছে, কেউ সেখানে উঁকি দিতেও যায় না। আচ্ছা বাবা, আমাদেরকে কেন তাড়িয়ে দিতে চায়? বাবা, আমরা কোথায় যাব, কোথায় থাকব? পিরোজপুরে আমাদের নানা বাড়িতে কেউ নেই, বব্রিশালে মামাবাড়িতে মায়ের যাওয়া সম্ভব না। মা বলে। এখানে এই আশ্র্যটা না পেলে যে কী হত!

আমি ঘরে এলাম। মা উঠল। বালতি নিয়ে গাই দুইয়ে মঙলি আর বাছুরটাকে ছেড়ে দিয়ে দুধ নিয়ে এল। তারা বাবা, বাগানটাকে তছনছ করতে লাগল। বাগানটা ছোট হলেও এটা তোমার শখের বাগান না? মা’টা যে কি!

আমাকে খেতে দিল। ঘরগুলো গোছগাছ করল। দুটো ঘর, রান্নাঘর বারান্দা উঠোন সব ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করল।

মা রান্না করল্।আমাকে গোসল করিয়ে দিল, নিজে করল। তারপরে আমরা খেলাম।

মা সারাদিন শুয়ে থাকল। বিকালে তোমার বাক্সে কাপড়চোপড় আরলে কীকী সব ভরল। বাবা, আমার মা’টা না খুব ভাল। জানো, আমার পুতুলগুলো আর বইও বাক্সে ভরল। থ্রির বই। এক বছর আগের। তুমি তো বাবা, আমাকে ফোরে ভর্তি করিয়ে দাওনি, ফোরের বইও আর কেনা হয়নি।

মা নিজে সাজল না, কিন্তু আমাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। তারপর বসেই থাকল, বসেই থাকল। ঐ সাজ পোশাকেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

সন্ধ্যের সময় মা আমাকে ডেকে তুলল। ‘যা, হাত মুখ ধুয়ে আয়।’ মা বলল। ধুয়ে এলাম। আমাকে খেতে দিল, মাও খেল। সন্ধ্যার সময় কি কিছু খাওয়া যায় বল? এখন তো আর রোজার মাস না। কিন্তু কি করব, তুমি না আমাকে বারবার বলতে, লক্ষ্মীমেয়ে হয়ে থাকতে, মায়ের সব কথা শুনেতে?
‘রুনু, হাটতে পারবি মা? আমরা এখান থেকে চলে যাব।’ খাওয়ার পরে মা বলল।
‘হ্যা, মা।’ আমার কিন্তু ভয় লাগছিল, এই সন্ধ্যের সময় মা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে? তুমি আসতে পারবে না, তোমার কাছেও যাওয়া যাবেনা, মা বলেছে। আবার দেখ বাবা, আমরা যদি এই বাড়ি ছেড়ে চলেই যাব, তাহলে মা কেন শুধু শুধু কষ্ট করে তখন ঘর বাড়ি পরিষ্কার করতে গেল? তখনও তো মা জানতো, আমরা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব! নাকি?

ফুল আর লতাপাতা আঁকা খয়েরি রঙ্গের বিছানার চাদরটা মা গায়ে জড়িয়ে নিল। বাক্সটা বাঁহাতে নিয়ে চাদরের আড়ালে রাখল। অন্ধকার ঘর থেকে আমরা বাইরে এলাম। মা দরজাটা টেনে বন্ধ করল, কিন্তু তালা দেওয়া তো দূরে থাক, শেকলও তুলে দিলনা। তারপরে আমরা বাড়ির পিছন দিক দিয়ে পুকুরের পাড় ঘুরে ফসলের ক্ষেতে নেমে এলাম। তখন তো আর চাষাবাদের সময় নয়, আমরা ইচ্ছামত হাটতে পারলাম। আমাদের বাড়ির পিছন থেকে দূরের যে কাল কাল মেঘেরমত পাহাড় দেখা যায়, মা আমাকে সেদিকে নিয়ে যেতে লাগল। চাঁদ ছিলনা, কিন্তু কত তারা। মনে হচ্ছিল যেন পাহাড়ের মাথার কাছে অনেক তারা ঝুলে আছে। যতই আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম ততই তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকল। ঐ পাহাড়গুলোর উপরে উঠতে পারলে কি মজাই যে হোত, আমি তারাদের ধরে ধরে কোঁচড়ে ভরতাম। বাবা, তুমি আর আমি একদিন পাহাড়ে উঠব।

আমি আর হাঁটতে পারিনা। শুধু পিছিয়ে পড়ি। মা থেমে আমার হাত ধরল। একটু পরে আমরা ডানে ঘুরে অনেকটা হেটে রাস্তা পেলাম। সেটা পার হয়ে আবার হাঁটা। আমি আর পারিনা। এবার আর চাষের জমি নয়, ছোটছোট টিলা আর ঝোপ জংগল। অন্ধকার। পায়ে চলার পথটা গেছে এঁকেবেঁকে, এটাই শুধু আবছা দেখা যায়। কত আর হাঁটতে পারা যায় বল? মা আমাকে টেনে নিয়ে চলল। তারপরে একটা টিলাকে আমরা ডানে রেখে বামে ঘুরতেই একটা মাঠেরমত জায়গায় এলাম, সেটা যেন সামনের দিকে উঁচু হয়ে গেছে। উপরের দিকে মিটিমিটি করে অনেকগুলো আলো জ্বলছে। এক জায়গায় না, অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে। মা সেখানেই বসে পড়ে আমাকে কোলে টেনে নিল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

আমি স্বপ্ন দেখলাম, আমি যেন একটা পরী হয়ে গেছি। কি সুন্দর দুটো ডানা! ধপধপে সাদা পোশাক। আমি একটা ফুল বাগানের উপরে ঘুরে ঘুরে উড়ছি। মা আর তুমি হাসি মুখে আমকে দেখছে। একটু দূরে একটা ফলের বাগান, সেখান থেকে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। পাখির ডাকের শব্দ বেড়ে গেল, আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাখি ডাকছে, সকাল হচ্ছে। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে।

আমরা শুয়ে আছি সেই পায়েচলা পথের উপরে। সেটা এঁকেবেঁকে মাঠটার উপর দিয়ে গিয়ে অনেক লম্বা কিন্তু নিচু পাঁচিলের মাঝামাঝি একটা কাঠের গেটের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে।

পিছনে মানুষের শব্দ পেলাম। মাঝ বয়সী একজন উপজাতী আমার চেয়েও ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে কোলে করে আমরা যে পথে এসেছি, সেটা দিয়ে আসছে। সে আমাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল, একবার শুধু আমাদের দেখল। মনে হল না যে, আমাদের এভাবে পথের উপরে পড়ে থাকতে দেখে খুব একটা অবাক হয়েছে। আমি মায়ের কাঁধ ধরে নাড়া দিলাম, মা ধড়মড় করে উঠে বসল। পিছনে আরো মানুষজনের সাড়া শব্দ। আমরা পাশে সরে গেলাম। নানান বয়সের আর নানান ধরণের মানুষ আসতে লাগল। দেখলাম, অন্যান্য দিক থেকেও অনেকে এসে সেই গেটটার কাছে জমা হচ্ছে।

আমার খুব হিসি পেয়েছিল। মাকে সাথে নিয়ে আমি একটা ঝোঁপের দিকে গেলাম।

উপজাতী দু’জন। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা। অনেক বয়স হবে। খুব অসুস্থ্য মনে হল মহিলাকে, পুরুষটার কাঁধে ভর দিয়ে চলছে। আমরা তাদের পিছু পিছু চললাম।

কাঠের গেটের ডানে বামে পাঁচিল চলেগেছে অনেক দূর, তারপরে পিছনে বেঁকে গেছে। লম্বা লম্বা সব কাঠের বাড়ি। উপরে শনের চাল। দরজা জানালা যা চোখে পড়ল, সবই বড় বড়, কিন্তু একটাতেও কপাট নেই। কোন কোনটার ভিতর দিয়ে পুতুলেরমত মানুষজন হাটা চলা করছে। বেশীরভাগই মহিলা। সাদা পোশাকের। ফাঁকা জায়গাগুলো সব ভরে আছে নানান আকারের আম কাঁঠাল মেহগিনি আর সেগুন গাছে। তুমি আমাকে গাছপালা চিনিয়েছিলে না?

আমরা কাছে পৌছনোর আগেই গেট খুলে গেল। পনের বিশ জনেরমত মানুষ দাঁড়িয়েছিল, তার ঢুকে গেল। আমরাও ঢুকলাম।

ডানদিকে প্রথমে যে ঘরটা পড়ল, সেটাতেই সবাই ঢুকছে। আমাদের বাড়ির তিনগুণ লম্বা একটা ঘর। বাম দিকে বেড়ার কাছ থেকে কয়েক সারিতে কাঠের বেঞ্চি পাতা আছে। মাঝের দিকে একটা টেবিল। টেবিলের উপরে ডাক্তারদের রোগী দেখার যন্ত্র পাতি, কাগজ পত্র খাতা কলম আর পেন্সিল। পানি ভর্তি একটা কাঁচের জগ আর একটা গ্লাস। সেটা দেখেই আমার পিপাসা পেল। সেটার চার দিকে মাত্র চারটে চেয়ার। কোনটাতে কেউ নেই।

সেটার বাম দিকে ঘরের প্রায় মাঝামাঝি বিশাল আর একটা টেবিল। বাব্বা, সেটার উপরে কত অষুধ! সাদা পোশাকের একজন মহিলা সেখানে বসে আছে। আমরা গিয়ে পিছন দিকের একটা বেঞ্চিতে বসলাম, কেউ কিছু বলল না।

বিপরীত দিকে সাদা পরদা টানা আর একটা দরজা সেদিকে কি আছে বুঝলাম না।

আমাদেরমত একই পথে ডাক্তার এলো। তার পিছনে এল আর এক মহিলা ডাক্তার, নাকি নার্স। ঢিলেঢালা সাদা পোশাক পরা বিদেশী ডাক্তার। চুল দাঁড়ি ভ্রু সব সোনালি। চোখে চশমা। আর বাবা, তোমার চেয়েও লম্বা। সাথের ডাক্তারও ফর্সা। কীযে মিষ্টি চেহারা বাবা। তবে উপজাতী হবে হয়তো। না হয় বিদেশী।

সব রুগী দেখা শেষ হল বাবা। মাত্র একজনকে পরদাটানা রুমে পাঠানো হল, সেই মহিলাটা, আমরা যার পিছন পিছন এসেছিলাম। আমি আর মা জবুথবু হয়ে বসেই থাকলাম। আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে ডাক্তার তার সাথিকে কিছু বলল। সে আমাদের কাছে এলো।
‘আপনাদের কার অসুখ?’ কি মিষ্টি করে বলল। তবে পরিষ্কার বাংলা বলতে পারেনা। মা মাথা নাড়াল। সে একবার ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল,’তাহলে?’
‘আমাদের থাকার জায়গা নেই,’ মার কন্ঠস্বর কাঁপাকাঁপা। ‘আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে।’ সে আবার ডাক্তারের দিকে তাকাল।
‘ইয়েস?’
‘দে আর আস্কিঙ ফর শেল্টার।’
‘ওহ!’ এবার ডাক্তার নিজেই উঠে এল।
‘টোমাডের বারি কোটায়?’ ডাক্তার জানতে চাইল।
মা তাকে বলতে শুরু করল। ডাক্তার একটা কথাও না বলে শুনে যেতে লাগল। এমন কি সে বসলোও না।
‘ওহ, ভেরি স্যাড,’ ডাক্তার সব শুনে বলল। তারপর মহিলার দিকে তাকাল। ‘ইরা?’
‘আমাদের কাজের লোকের দরকার আছে,’ মহিলা ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলাতে বলল। ‘কিন্তু আমরা বেতন দিতে পারিনা। সেটা আমাদের ক্ষমতার বাইরে। তবে এদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
‘আই সি,’ এবার ডাক্তার আমাদের সামনের বেঞ্চিতে বসল। ‘এরা যদি এভাবে থাকতে চায়, ব্যবস্থা করতে পারবে?’
‘পারা যাবে।’
‘তোমরা এখানে কাজ করবে থাকবে, খাবে,’ সে ভঙ্গা বাংলায় বলল। ‘কিন্তু তোমরা কোন বেতন পাবে না, সেটা আমরা দিতে পারিনা। তবে আমি সেই ব্যপারে চেষ্টা করব।’
‘বেতন চাইনা, শুধু থাকতে আর খেতে পারলেই হবে।’ মায়ের চোখ পানিতে ভরে উঠল। ‘আমার জন্য নয়, এই মেয়েটাকে নিয়ে আমিই কোথায় যাব?’
‘ইরা, নার্সদের সাথে এদের থাকার ব্যবস্থা করে দাও। এর কাছ থেকে একটা দরখাস্ত লিখে নাও। তারপর এক মাস এর কাজ দেখে এর উপযুক্ত হয় এমন একটা পোষ্টের জন্য হোমে একটা চিঠি লিখে দাও। আর পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য এখনি একটা চিটি পাঠিও...।‘ মা এমন ভাবে কেঁপে উঠল যে সবাই তার দিকে তাকাল। ‘নো নো, লেডি,’ডাক্তার মা’কে বলল। ‘ভয় পাবার কিছু নেই। আমার মনে হয়না তারা সত্যিই কেস করেছে। অন্তত তোমাদের দু’জনের নামে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে কমিশনারকে তোমাদের ব্যাপারটা দেখতে বলব। তার সাথে আমার পরিচয় আছে। তোমাদের আর আমাদের সবার নিরাপত্তার জন্য এটা দরকার। তাছাড়া তোমার হাজবেন্ড যদি ফিরে এসে তোমাদের খোঁজ করে তাহলে তার জানার একটা পথ থেকে যাবে।’ তারপর আমার দিকে ফিরে বলল,’ইয়ং লেডি, তোমার কাজ হবে এখানকার লোকজনদের সাথে হাসি মুখে আলাপ করা আর সময় পেলে আমার সাথে গল্প করা। আমার মেয়েটাকে খুব মিস করছি। সে পড়ে আছে ক্যালিফোরনিয়ায়। কয়েকটা দিন তুমি তার প্রক্সি দিতে পারবে না?’ আমি হাসলাম, কিন্তু তার কথার অর্ধেকই বুঝতে পারিনি। আমাদের তারা থাকতে দিচ্ছে, তারা যা কিছু বলুক সব কিছুতেই আমি খুশি। ‘আর হ্যা, আমরা খুব শীঘ্রই একটা স্কুল খুলতে যাচ্ছি, সেটার প্রথম স্টুডেন্ট হবে তুমি। কি, রাজী তো?’ রাজি মানে! আমি মায়ের মুখের দিকে তাকালাম, অদ্ভুত একটা আনন্দ যেন সেখানে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। আমি ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে লাজুক ভাবে হাসলাম। ‘গুড।’

সেদিন আমাদের বিশ্রাম নিতে বলা হল, কিন্তু মা সেদিনই কাজে লেগে গেল। আমি আমাদের আস্তানায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

বিকালে একজন মহিলা আমাকে ডাক্তারের কুঁড়েঘরে নিয়ে গেল। কাঠের ঘর, শনের ছাউনি, কুঁড়েঘর ছাড়া আবার কি? তবে মেঝেটা পাকা। আমাকে অবশ্য ভিতরে যেতে হল না। সামনে ছোট একটা ফুলের বাগান, ডাক্তার সেখানে একটা গোল টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে আছে। সামনে আর একটা চেয়ার। টেবিলে একটা ফটো এলবাম, একটা গোলাপ ফুলের ছবির পোষ্টকাড, চায়ের সরঞ্জাম আর বিস্কুট। ডাক্তার আমাকে দেখে উঠে দাড়াল।

‘প্লিজ বি সিটেড, ইয়ং লেডি।’ হাত দিয়ে চেয়ারটা না দেখিয়ে দিলে বুঝতামই না আমাকে কি বলছে। ইতস্তত করে বসলাম। ‘সি, হোয়াট মাই...?‘ সে কার্ডটা তুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল। আমি সেটা নিলাম। তারপরে একটুঁ থেমে ভাঙ্গা বাংলায় আবার শুরু করল,’আমার মেয়ে আমাকে কি লিখেছে জান? ফাদার’স ডে’র উইস...। ফাদার’স ডে কি, তুমি জান?’
আমি মাথা নাড়ালাম। বাবার দিন। সেটা আবার কি? কিন্তু সাথে সাথেই তোমার কথা মনে পড়ল। আমি কেঁপে উঠলাম। ‘ওহ, নো নো, মাই ইয়ং লেডি...।’ডাক্তার ব্যস্তভাবে হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধে একটু চাপ দিয়ে বলল। ‘আই বেট, ইওর ফাদার উইল কাম।’তারপর হাত টেনে নিল। ‘একটু চা খাওয়া যাক, কি বল? না?’ আমাকে ইতস্তত করতে দেখে বলল,’তাহলে তোমার জন্য মিল্ক বিস্কুট আর আমার জন্য চা। ঠিক আছে?’ আমি হেসে ফেললাম। ‘দ্যাটস মাই নাইস লেডি।’

আমাকে তার মেয়ের, বউ আর বাড়ির ছবি দেখালো। মেয়েটা আমার চেয়ে বড়, কিন্তু কী সুন্দর! তার মাও। আদের বাড়িটা ছোট একটা দোতালা বাড়ি। সমনে ফুলের বাগান। সাদা রং করা কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সুন্দর। সামনে রাস্তা। সব কিছু ঝকঝকে তকতকে। মনে হয় যেন এই মাত্র ঝাড়ু দিয়ে পানি দিয়ে মুছে রেখেছে কেউ। সে কার্ডটা হাত থেকে নিল।

‘তোমার মত একটা মেয়ে... না, সে তোমার চেয়ে বড় একটা মেয়ে একাই এই বাবা দিবস শুরু করেছিল।’ সে আমার দিকে তাকাল। বাবা দিবস নয়, বরং একটা মেয়ে এটা শুনে আমার আগ্রহ হচ্ছিল। এটা তাকে খুশি করল।

‘এখন থেকে অনেক আগে, সেই ১৯১০এ। আরকানসাসের সোনোরা স্মার্ট ডড। মেয়েটার নাম। সে তখন স্পোকানি, ওয়াশিংটনের ওয়াইএমসিএ’র সাথে যুক্ত।’ ডাক্তার চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল। ‘তার মা ছিল না। বাবা উইলিয়াম জ্যাকশন স্মার্ট। ডডের কথা হল, মায়ের জন্য যদি মাদার’স ডে থাকতে পারে তাহলে বাবা কি দোষ করল? তাদের প্যাষ্টর- চার্চের দিকটা যার দায়িত্বে ছিল, সেই মানুষটাকে মেয়েটা বলল। ‘বাবাদের সম্মান দেখানোর জন্য বছরে কেন একটা ছুটির দিন থাকবে না?’ খাঁটি কথা। মানুষটা এই বিষয়ে চার্চে একটা বিবৃতি পাঠ করতে রাজি হল। মেয়েটা চেয়েছিল তার বাবার জন্মদিন জুনের ৫ তারিখ রবিবারে সেটা হোক, কিন্তু লোকটা সময় দিতে পারলনা। সে সেটাকে জুনের তৃতীয় রবিবারে পাঠ করল। তারপর ডড চলেগেল আর্ট ইন্সটিটিউট অফ সিকাগোতে। তার কাজটা থেমে থাকল। কত দিন? ১৯৩০এ তার আবার স্পোকানিতে ফিরে না আসা পর্যন্ত। সে সেই সমস্ত ব্যবসায়ী দলগুলোর সমর্থন পেল, যারা বেশিরভাল ক্ষেত্রে ছুটির দিনগুলোর উপহারের ব্যবসায় লাভবান হোত। ডড ১৯৩৮সাল পর্যন্ত নিউইয়র্ক আসোসিয়এটেড মেনস ওয়ার রিটেলারস এর প্রতিষ্ঠিত ফাদার’স ডে কাউন্সিলের সহায়তা পেয়ে এসেছিল। আমেরিকানরা কয়েক দশক ধরে খবরের কাগজের মাধ্যমে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের করে করে এর বিরোধীতা করে আসছিল। কিন্তু সেই দলটা কোন কিছুতে না দমে এর উন্নতিতে পুরোদমে কাজ চালিয়ে যেতে লাগল। তারা এমনকি, পত্রিকার কিছু কিছু ব্যাংগ নিজেদের বিজ্ঞাপনে জুড়ে দিতে থাকে। কত ব্যাঙ্গ করবি কর। ১৯৮০র দিকে ফাদার’স ডে কাউন্সিল লিখল, “এটা সমস্ত উপহার দেওয়া সংক্রান্ত শিল্প জগতে একটা দ্বিতীয় বড়দিনে পরিণত হয়েছে।“ ১৯১৬তে উড্রো উইলসন, ১৯২৪এ ক্যালভিন কুলি, ১৯৬৬তে লিন্ডন বি জনসন- আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা এই দিনটার পক্ষে সাফাই গেয়ে গেছে। ১৯৫৭তে সিনেটর মারগারেট চেইজ স্মিথ কংগ্রেসের প্রতি এই দোষারোপ করে লেখে যে, ৪০ বছর ধরে তারা মাদার’স ডে পালন করে আসছে অথচ পিতার দিকটাকে সম্পূর্ণ আবহেলার সাথে দেখছে। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচারড নিক্সন স্বাক্ষ্রর করে এটাকে আইনে পরিণত করে।‘

ডাক্তার এবার সামনে ঝুঁকে সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’ইয়ং লেডি, অনেক দেশে আবার ১৯শে নভেম্বর ইন্টারন্যাশানাল মেন’স ডে পালন করা হয়। এটা আবিবাহীত পুরুষ আর ছেলেদের জন্য। দেখোতো, অবিবাহীত মহিলা আর মেয়েদের জন্য ডডেরমত তুমি ইন্টারন্যাশানাল ওঁমেন’স ডে জাতীয় কিছু একটার চিন্তা করতে পার কিনা। আমি তোমার সাপোর্টে থাকছি। আমার মেয়েটাও নিশ্চয় তোমাকে সাহায্য করতে পারলে খুশি হবে।‘

বাবা, তখন আমি কিছু বুঝলাম না, মজা পেয়ে হাসলাম। আমরা আশ্রয় পেয়েছি, আমার মায়ের একটা চিন্তা দূর হয়েছে। আমি খুব খুশি, হাসবো না? মানুষটা খুশি হল। এখন কিন্তু সব বুঝি।
‘এ বছর তো তুমি আর পারলেনা, আগামী বছর তাকে তুমি অন্তত একটা চিঠি লিখো,’ ডাক্তার আমাকে বলেছিল। ‘আমি কথা দিচ্ছি, তার হাতে যেন সেটা পৌছায়, আমি তার জন্য চেষ্টা করব।‘

তাই তোমার কাছে চিঠিটা লিখলাম। এটা আমি ডাক্তারের কাছে দেব। বাবা, কথা দাও, অন্তত এটা তোমার হাতে না পৌঁছানো পর্যন্ত তুমি ভাল থাকবে!

ইতি,
তোমার লক্ষ্মী মেয়ে,
রুনু।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ইমরানুল হক বেলাল রনুর চিঠির আদলে কাব্যময় ভাবনাকে অনেক সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পটি। একটি ভিন্ন স্বাদের লেখা। ভালো লাগলো ধন্যবাদ
সূর্য রুনুর চিঠি পাঠক আমাকেও আবেগাপ্লুত করলো ওয়াহিদ ভাই। গল্পের সময়কালটা জানতে চাইছিলাম খুব করে একটা মিশনারী কার্যক্রম থাকায়ই্এটা জানার আগ্রহ হচ্ছিল। খুব সুন্দর লিখেছেন।

০৪ জুলাই - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪