জনাব জুবায়ের আলী বাবুল পাঠান- মি জেডএবিপি।
ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা সুঠাম দেহের মানুষটা যখন দুই পা ফাঁক করে কোমরে দুই হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ান, তখন মনে হয় যেন পশ্চিমের বিলি দ্যা কিড প্রতিপক্ষের সামনে হাত ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তেই তার হাতটা সাঁপেরমত ছোবল দিয়ে কোমরের হোলষ্টার থেকে রিভলভারটা তুলে এনে আগুন ঝরাতে শুরু করবে।
ইনি আফগান নন, খাঁটি বাংগালী।
পেশা- ইয়ে, মানে সেটা না হয় থাক। নেশা- অল্পসল্প গল্প আর বেশি বেশি কবিতা লিখে গল্প কবিতা ডট কমে পাঠান, যার অনেকগুলোই প্রশংসা পেয়েছে। এতেই তাঁর নামকরণের (শেষ অংশের) সার্থকতা প্রমাণিত। এটা এমন একটা নেশা, যাতে সমাজে বিব্রত হতে বা সমাজকে বিব্রত করার কোন কারণের উপলক্ষ হতে হয় না। বরং...।
গকডক’র এবারের বিষয় সাইন্স ফিকশন। ভাল। কিন্তু সময় মাত্র ছাব্বিশ দিন? আর তার অর্ধেকের বেশি বিগত? কর্তাদের পক্ষ এটা কেন বুঝতে চান না যে, সাইন্সকে দিন মাস বছর, এমন কি শতাব্দী দিয়েও সীমায়িত বা হীমায়িত করা যায় না। তার উপরে এর সাথে আবার ফিকশন জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাহলে?
তবে সমস্যাটা আপাতত সেখানে ঠেকে নেই। কবিতা- সেটা গিন্নির সকাল বেলায় ধরিয়ে দেওয়া বাজার লিষ্ট মূখস্থ করার ছলে সেটার পিছনেই লিখে ফেলা যাবে। আসলে পাঁচ পাঁচটা গল্পের প্লট মাথায় ঘুরছে, যার কোনটার চেয়ে কোনটা কম নয়। সেটা থেকে কোন একটাকে বেছে বের করাটাই আসল সমস্যা। বউকে বলতে গেলে মুখ ঝামটা। বুলবুলিরমত বোল মিষ্টি ফোটানো মেয়েটা থাকলেও হত, কিন্তু সে আবার খালা বাড়ি যাওয়ার আর সময় পেলনা। ক’দিন পরে পরীক্ষা। ছেলে? সে এই পাঁচ গল্পের উপরে একটা পূর্ণাঙ্গ থিসিস লিখে দেবে। কিন্তু সেটা দু’চার বছরে বা ইহজীবনে হাতে আসবে কিনা সন্দেহ। অফিসে চেষ্টা করতে যাওয়া বৃথা, সবাই কাজে (অকাজে) ব্যস্ত। অবশ্য ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি বলে লটারি করা যায়, কিন্তু সেটা অবৈজ্ঞানিক। সাইন্স ফিকশন না হলে সেটাই করা যেত।
সে চিন্তা করতে করতে যখন প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে তখনই তার মাথায় ধারণাটা গুঁতো দিয়ে গেল- অসুস্থতার জন্য এক সপ্তাহের ছুটি। থারমোফ্লাক্স, ল্যাপটপ, কয়েক দিস্তা কাগজ আর কলম নিয়ে সোজা গ্রামের বাড়ি। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারলেই খাঁটিটা বের হয়ে আসবে। তারপরে লিখে ফেলতে আর কতক্ষণ? বেশ কয়েক বছর সেখানে যাওয়াও হয়না। গিন্নিকে জমি সংক্রান্ত জরুরী কাজের কথা বলা যেতে পারে। আর অতি অবশ্যই মোবাইলটা ‘ভুলে’ রেখে যেতে হবে।
তার দেহটা পালকেরমত আর মনটা বাতাশেরমত হালকা মনে হতে লাগল।
...ট্রেন থেকে নেমে তিন মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য তাকে একটা ভ্যান ভাড়া করতে হল। সেটা তাকে যখন বাঁশের চটা আর স্থল কলমির জ্যান্ত ডাল দিয়ে তৈরী বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা বাড়ির বিশাল উঠোনে নিয়ে এলো, তখন সন্ধ্যার আজান শুরু হয়েছে।
ডান দিকে প্রায় মাঝামাঝি পূব মুখি দুই কামরার সেমি পাকা বাড়িটার সামনে বেশ চওড়া একটা বারান্দা। বারান্দার ডান কোনাটাকে ঘিরে আরো একটা ঘরের আকার দেওয়া হয়েছে। বাম প্রান্তে একটা টেবিলের তিন দিকে চারটে চেয়ার আর তার এপাশে একটা হাতলঅলা কাঠের বেঞ্চ। বারান্দায় একটা বাল্ব জ্বলছে দেখে সে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল।
সামনে রান্নাঘর, সেটার বামে একটু দূরে পাকা পায়খানা আর কাছেই সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো একটা টিউবয়েল। বাম দিকের প্রায় শেষ প্রান্তে গোয়ালঘর, মুরগির খোয়াড় আর খড়ের গাদা। সেগুলোর পরে বেড়ার উপর দিয়ে দৃষ্টি পাঠিয়ে দিলে গাছপালার দঙ্গল, আর তাদের বামদিক ঘেসে এক চিলতে ফাঁকের ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে ‘তাদের’ নদী- সন্ধ্যার কারণে যার ঝিকিমিকি এখন রূপালী নয়, পারদ শুভ্র। তার ইচ্ছা হতে লাগল, এখনই এক ছুটে সে সেখানে চলে যায়। মাটি যদি মা হয়, নদী তাহলে তার বুক। সেখানে ঝাপিয়ে পড়ায় যে কী শান্তি!
টিউবয়েলের কাছে বসে বাবুলের প্রায় সমবয়সী যে মানুষটা ওজু করছিল সে মুখ তুলে তাকাল। তাড়াহুড়া করে ওজু শেষ করে বদনা উল্টে ফেলে ছুটে এলো।
‘বাবুল ভাই!’ তার কন্ঠের উচ্ছাস আন্তরিক। ‘এতদিন পরে আমাদের কথা মনে পড়ল?’
‘কেমন আছিস, রমিজ?’ বাবুল পকেটে হাত ভরতে ভরতে বলল।
‘ভাল,’ সে বাবুলকে জড়িয়ে ধরল। ‘তুই বারান্দায় মাল সামান নামিয়ে রেখে এখন যা,’ সে ভ্যান অলাকে বলল। ‘পরে দোকান থেকে তোর ভাড়া নিয়ে যাস।’
ভ্যান অলাকে মনে হল না, এতে সে অখুশি। তাদের বাবুল ভাইকে সে আগে চিনতে পারেনি।
ততক্ষণে ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি দিতে শুরু করেছে রমিজের বৌ। তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তার ছেলে আর কোমরের কাছে একটা মুখ দেখা যাচ্ছে, তার মেয়ে।
সকালে সে ইচ্ছা করেই দেরীতে উঠেছে। গ্রামের সকাল আটটা মানে অনেক বেলা। সে বারান্দার ঘরটাতে থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু স্বামী স্ত্রী জোর করে ভিতরের তাদের পাশের ঘরে তাকে ঢুকিয়েছে- যদিও তার দুই হাত ধরে টেনে সেই ঘরে নিয়ে গেছে মিতু আর রনি।
‘তোমাদের জন্য ঘরটাকে আমরা রোজ ঝেড়ে পুছে রাখি, আর তুমি থাকবে বাইরের ঘরে, বাবুল ভাই?’ রমিজের বৌ ইমু অনুযোগের সুরে বলেছিল। ‘এটাতো তোমারই বাড়ি, তুমি অসুবিধা মনে করলে আমরাই না হয় বাইরের ঘরে থাকব।’
‘না না,’ বাবুল অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিল। ‘বাইরের ঘরটা হলে আমার সুবিধা হয় রে।’ সে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলেছিল। ‘আমি তো ঘুরতে এসেছি, যখন তখন হুট হুট করে যাব আর আসব, দরজা খোলার...।’
‘ঠিক আছে ঠিক আছে, দরজা সব সময় খোলাই পাবে...।’
...ছেলে মেয়ে দুটো স্কুলে চলে গেছে। রমিজ অপেক্ষা করছিল। অন্য সময় হলে সে এতক্ষণে দোকানে। তারা দুজনে মুরগির মাংস আর চালের আটার পিঠে দিয়ে পেট ভরে নাস্তা করল। তারপর বের হল। ফ্লাক্সটা আনেনি, আর চায়ের কথা তার মনেও পড়লনা।
‘ডিঙ্গি নৌকাটা আছে নারে?’
‘হ্যা, বাবুল ভাই, একেবারে সাজিয়ে গুছিয়ে বাগানের ঘাটে রেখেছি।’ তাকে একটু উৎকণ্ঠিত মনে হল, যার কোন কারণ থাকা উচিৎ নয়। ‘বৈঠা বাইবার জন্য একটা ছোড়া টোড়া ডাকব নাকি?’
‘আরে না,’ বাবুল জোর দিয়ে বলল। ‘আমি নৌকায় বসে একটু লেখালেখি করব, নদীতে ঘুরব না।’
‘মানে, বাবুল ভাই,’ রমিজ একটু ইতস্তত করে বলল। ‘কিছুদিন ধরে আমাদের এখানকার কোন নৌকা নদীতে নামছে না।’
‘বলিস কী?’ বাবুল তার দিকে ঘুরে তাকাল।
‘হ্যা। কয়েক মাস ধরে আমাদের নদীটা ত আর নদী নেই, মৎস খামার। পুরো নদীটাকে বেড়া দিয়ে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। জেলেদের মাছ ধরা শিকেয় ঊঠেছে। তারা নাকি সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়েছে। টুকটাক কাজে কেউ কেউ নৌকা ভাসাতো। এখন আর তাও হয় না। তবে কারণটা বললে তুমি হাসবে।’
‘বল, শুনি।’
‘সপ্তা খানেক ধরে আমাদের এখানে, বিশেষ করে নদীর উপরেই এটাকে দেখা যায়। কয়েকজন মাঝি দেখেছে।’
‘কী দেখেছে?’
‘বিশাল আকারের চাকারমত একটা কিছু।’
‘গড়িয়ে যায়, নাকি পানিতে ভাসে?’
রমিজ সোজাসুজি তার ভায়ের মুখের দিকে তাকাল। ‘বাতাসে ভাসে।’
‘তাহলে তো সবারই দেখতে পাওয়ার কথা, তোরও। তুই দেখিস নি?’
‘না। আর আমার দেখার কোন শখ নেই। আসলে যে নদী লিজ দেওয়া হয়েছে, সেই নদী দেখার আমার কোন ইচ্ছা নেই।’
‘আমার আছে। চল।’
‘তুমি নদীতে গেলেও দেখতে পাবে কিনা সন্দেহ আছে।’ রমিজ মুখ নিচু করে হাটতে হাটতে বলল।
‘তার মানে?’
‘এটা নদীর উপরে হঠাৎ হঠাৎ আসে। কোন কিছু নাই, হঠাৎ বাতাশ থেকে বের হয়ে আসে। আবার হঠাৎই বাতাশে মিলিয়ে যায়।’
বাবুল ভেবে পেল না কী বলা যেতে পারে। ‘কত জন দেখেছে?’
‘পাঁচজন। প্রথম তিনজন, একই নৌকার, এক সপ্তাহ আগে...।’
তারা নদীর পাড়ে চলে এসেছিল। পানির দিকে ঝুঁকে পড়া একটা বিশাল আম গাছের একটা শিকড়ের সাথে লম্বা রশি দিয়ে নৌকাটা বেধে রাখা হয়েছে। পাটাতনে একটা পরিষ্কার মাদুর বিছানো, পাশে একটা বৈঠা আর প্রান্তের দিকে একটা জলচৌকি। সাজানো গোছানো বলতে এতটুকুই। তারা দুজনে গাছটার নিচে দাঁড়াল।
‘পানি থেকে মাত্র কয়েক হাত উঁচুতে বাতাশে সেটা সৃষ্টি হয়ে তাদের দিকে ছুটে এলো আর তারা পানিতে লাফিয়ে পড়ল। তারা সেভাবেই দেখল, সেটা তাদের নৌকাটা পার হওয়ার পরপরই আবার বাতাশে মিলিয়ে গেল। কোন শব্দ না, কোন ঢেউ না কিছু না।’
‘হ্যালুনেশন... দৃষ্টি বিভ্রম।’
‘কীভাবে? তিন জনের একসাথে?’
‘হয়তো ঘণ বাতাশের কারসাজি। জানিনা।’
‘পরের বার তিন দিন আগে, ঐ খানে...,’ সে হাত তুলে তাদের সামনে নদীর মাঝখানটা দেখাল। ‘এরা ছিল দুইজন। সেই একই কাহিনী। দুটো ঘটনাই সকাল নটা দশটার দিকে।’
‘তুই আর আমি সেখানে হলে হয়তো সেই একই জিনিস দেখতাম। হয়তো হাত দিয়ে ধরতে গেলে দেখতাম, কিছুই না, বাতাশ।’ সে একটু থামল। ‘নৌকা বা কোন মানুষের কোন ক্ষতি?’
‘না।’
‘গ্রামের মানুষজন কী বলছে?’
‘নেশা টেশা করে এইসব দেখছে। চেয়ারম্যান বলেছে, পাঁচটাকেই ধরে চাবকাতে হবে।’
‘তোর কী ধারণা?’
‘কী জানি। আমি তাদের দুই জনের সাথে কথা বলেছি। তারা কিছু একটা দেখেছে সেটা নিশ্চিত। তারা এটাও বলেছে, এটা তাদের কোন ক্ষতি করতে চায়নি। যদি চাইত, তাহলে সহজেই তাদের ধ্বংশ করে দিতে পারত।’
‘একটা চাকার চাওয়া না চাওয়া? ঠিক আছে। তুই এখন দোকানে যাবি?’
‘তাদের সব বুঝিয়ে দিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের ভিতরেই ফিরে আসব। বাড়ি হয়ে এখানে আসব?’
‘তোকে আর এখানে আসতে হবে না। আমি দুই তিন ঘণ্টা পরে যাব। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে কাগজ পত্র এনে দিনের বাকিটা এখানেই কাটাব। তুই এখন যা।’
বাবুল সেখানে দাঁড়িয়ে চারিপাশটা দেখতে লাগল। নদীটা চওড়ায় বুড়িগঙ্গার তিনভাগের দুই ভাগেরমত হবে। পানি ঘোলা কিন্তু আবর্জনায় ভরা নয়। প্রায় সমান্তরাল ঢালু পাড় দুটো তিন মিটারেরমত উঁচু আর বেলে মাটির। দুই তীরেই প্রচুর গাছপালা। যতদুর দেখা যায়, ক্ষেত খামার দেখা যাচ্ছে না। ডানে বামে দু’দিকেই অনেকটা দূরে নদীতে সেই ‘বাঁশের বেড়াও’ তার নজরে পড়ল।
সামান্য শ্রোত, ঢেউ নেই বললেই চলে। একটাও নৌকা নেই। তাদেরটা ছাড়া তীরে বাধা আর একটাও নয়, অবশ্য এই জংলা এলাকায় কেইবা কীসের জন্য আসতে যাবে। সে নেমে গিয়ে নৌকায় বসলো। ঝিরঝিরে হালকা বাতাশ তার শরীর জুড়িয়ে দিল।
একটু পরেই তার ঝিমুনি এসে গেল। মনে হতে লাগল তার শরীর খুবই দুর্বল। অবাক কান্ড। খুব সম্ভব গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাশের ভারী অক্সিজেন তার সহ্য হচ্ছে না। সে সোজা হয়ে বসল।
কতক্ষণ কেটেছে জানেনা। সূর্য বেশ অনেকটা উপরে উঠেছে। সে সোজা নদীর অপর তীরের দিকে তাকিয়েছিল। এদিকেরমত সেদিকেও গাছপালার ভিড় দেখতে তার ভাল লাগছে। সে তীরে নেমে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছিল। কিন্তু তার অবচেতন মন হয়তো তাকে সেখানে আটকে রেখেছিল।
হঠাৎ তার চোখের কোনায় বাম দিকে নদীর মাঝ বরাবর শ’খানেক মিটার দূরে বাতাশে বাদামী ধূসর কিছু একটা জমে ওঠার দৃশ্য ধরা পড়ল। সে সেদিকে তাকাল। মুহূর্তেই সেটা সত্যিই একটা চাকার আকার ধারণ করে পানিতে ভেসে থাকা চাক্তিরমত সোজা তার দিকে প্রচন্ড গতিতে ছুটে আসতে শুরু করল। সে নিজের অজান্তেই পিছনে হেলে পড়ল। কোন শব্দ নেই। এমন কি, সেটার কাছাকাছি পানিতে বিন্দুমাত্র আলোড়ন নেই। তার মানে সেটা বা সেটার গতি বাতাশকে কিছু মাত্র প্রভাবিত করছে না।
বাবুল হতভম্বের মত আড়ষ্ঠ হয়ে বসে সেটার এগিয়ে আসা দেখতে থাকল।
সেটা তার দুই মিটারেরমত দূরে থাকতেই এমন ভাবে থেমে গেল, যেন সেটা কখনই গতিশীল ছিলনা। পাঁচ মিটারেরমত ব্যাসের জিনিসটার নিচের অংশটা চাকারমত হলেও উপরের দিকটা কিছুটা বাটির আকারে ঢালু। তার উপরে মাঝখানে মিটার খানেক ব্যাসের একটা গম্বুজ। এটার নিচের অংশটার পেটের মাঝখানে একটা ফাটলের সৃষ্টি হল, তারপরে সেটা পরিণত হল একটা পথে।
বাবুলের আড়ষ্ঠ ভাব কেটে গেছে। মনটা আফসোসে ভরে গেছে- কেন মোবাইলটা রেখে এলো।
পথটার প্রান্তে এবার যেটা এসে দাঁড়াল, সেটাকে কী বলা যেতে পারে সেই বিষয়ে তার কোন ধারণা নেই। তিন ফুটেরমত দৈর্ঘের একটা বাচ্চা ছেলেরমত আকারের সেটার পায়ের তলা থেকে মাথার উপর পর্যন্ত রূপালী রংগের নমনীয় ধাতব ধরণের পোশাক। মুখের অংশটা অর্ধ গোলাকার কাঁচ বা প্লাস্টিকের। সেটা দিয়ে যতটুকু দেখা যাচ্ছে- রেখা আর লোম বহুল গোলাকার একটা মুখ আর বড়বড় গোলাকার দুটো চোখ। নাক নাই বললেই চলে।
সেটা ডান হাতটা ভাঁজ করে পাঞ্জাটা কাঁধের কাছে তুলে আবার নামিয়ে নিল।
এটা নিশ্চত যে, এটা তার কোন ক্ষতি করতে যাচ্ছে না। বাবুলের বেশ মজা লাগতে শুরু করেছে। সেও একই ভাবে হাত তুলে নামিয়ে নিল। সেটার মুখের ভাবের পরিবর্তন দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে এটা পছন্দ করেছে।
‘...পানি থেকে মাত্র কয়েক ...।’ তাদের কন্ঠস্বরে তাদের কথপোকথনটা সেটার মুখ দিয়ে নির্ভুলভাবে বের হয়ে আসছে। সে একবার পিছন ফিরে গাছটার নিচে তাকাল।
‘তোমার...তোর..তোর...আপনাদের কোন ক্ষতির জন্য আমি...আমি... আমরা আসিনি...।’ সেটা এক মুহূর্ত থামল। ‘খুব জটিল... ভাষাটা...।’ বাবুল অবাক হল- এটা তার সবচেয়ে প্রিয় কন্ঠস্বর, তার মেয়ের কন্ঠস্বর !
‘যেটা সহজ হয় মনে করেন সেটাই বলে যান, আমার বুঝতে অসুবিধা হবেনা।’ বাবুল বলল। ‘আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?’
‘সবচেয়ে কাছের তারা... তারকা...।’ সেটা বলতে লাগল। ‘সেটার একটা গ্রহে আমরা থাকি। সেখান থেকে এখানে আসতে আপনাদের গ্রহটা সূর্যটাকে ছয়বার ঘুরেছে।’
‘কেন এসেছেন?’
‘দেখ্ত। আর, সম্ভব হলে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য।’
‘খুব খুশির কথা। কার কার সাথে যোগাযোগ হয়েছে?’
‘একমাত্র আপনার সাথে। আমরা ভুল করেছি। প্রথমে আমরা ভয় পেয়েছি, তারপরে আপনারা ভয় পেলেন।’
‘আমি আপনাকে সাহায্য করব। এখন আর কেউ কাউকে ভ্য় পাবেনা। কী করতে চান, আমাকে বলবেন।’
‘এখন আর আমাদের হাতে সময় নেই। আমাদের শক্তির উৎস ফুরিয়ে আসছে। আমাদের ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।’
‘আমরা যে কোন ধরনের শক্তির ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য করতে পারব।’
‘এখান থেকে অণু পরিমাণ একটা কিছু আমাদের সাথে যুক্ত করাটা আমাদের জন্য আত্মঘাতী হবে। আমরা সেটা পারিনা।’
‘কারণ?’
‘আমাদের আসতে হয়েছে আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে। সেই জন্য আমাদের বাহনটাসহ সমস্তকিছু পারমাণবিক পর্যায়ে স্ক্যান করে ডাটা ষ্টোর করে বিশ্লিষ্ট করার পর পাঠানো হয়েছে। এখন যদি অণু পর্যায়েরও কিছু একটা এতে যুক্ত হয় বা বাদ পড়ে তাহলে ফিরে যাওয়ার পরে কোন একটা একক- জীব বা যন্ত্র- হয়তো অকেজো হয়ে যাবে। যন্ত্র আমাদের কাছে কোন ব্যাপার নয়, কিন্তু জীবের বিষয়ে আমরা কোন রকমের ঝুঁকি নিতে পারিনা।’
বাবুলের মনে হল, এটা যুক্তি সম্মত হতে পারে না। এটার খোলা পথ দিয়ে ধূলিকনা, জলীয়বাষ্প আর হয়তো আরো অনেক কিছু ঢুকেছে। এসবের একটা অণুও এটাতে থেকে যাবেনা সেটা বিশ্বাস হয় না।
‘আমিসহ এসবের সমস্ত কিছুই বলতে পারেন একটা ইমেজ।’ সে যেন বাবুলের মনের কথাটা জেনে বলল।
‘হলোগ্রাফিক?’
‘তারচেয়েও সহজ কিছু একটা।’ সে আবার বলতে শুরু করল। ‘আপনাদের চাঁদের পিছনে আমাদের আসল বাহনটা আছে। সেখান থেকেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।’
‘আসলে আপনারা আমার কোন কথা শুনছেন না বা কিছু বলছেন না। আমার মগজটাকে স্ক্যান করে... টেলিপ্যাথি জাতীয় কিছু একটা...।’
‘ঠিক তাই। কিন্তু আমরা আপনার মনের উপরে বিন্দুমাত্র প্রভাব বিস্তার করছি না। আমাদের দরকার প্রকৃত তথ্য, সেটা প্রভাব বিস্তার করে পাওয়া সম্ভব নয়। আপনার কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু পেলাম। আপনাকে আগে পেলে আমাদের বাকিটুকুও হয়তো পূরণ হয়ে যেত। আমাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদেরকে এই জায়গাটার উপর নির্ভর করতে হয়েছে। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সঠিক মান, আর বাতাশের সঠিক ঘণত্বের প্রয়জনে অন্য কোথাও আমরা সুযোগ পাইনি। ভবিষ্যতে আমরা হয়তো এই বাধাটা কাটিয়ে ওঠার উপায় পেয়ে যাব। তখন আবার হয়তো আসব আর আপনি যেখানেই থাকেন না কেন, আপনার সাথে যোগাযোগ করব। কিন্তু এখনই আমাদেরকে আপনাকে বিদায় জানাতে হচ্ছে...।’ তার কন্ঠস্বর কাঁপতে শুরু করল, আর সেই সাথে বাহনটার সমস্ত কিছু। আর পর মুহূর্তেই পুরোটাই এমন ভাবে মিলিয়ে গেল, যেন সেখানে কিছুই ছিল না।
বাবুল দুই হাত দিয়ে চোখ কচলালো। সে কি সত্যিই এসব দেখেছে, নাকি সবই তার কল্পনা?
‘বাবুল ভাই?’ পিছনে গাছপালার ভিতর দিয়ে রমিজের ডাক শোনা গেল...।
-পুরোপুরি কাল্পনিক কাহিনী। বাস্তব কিছুর সাথে মিলে গেলে সেটা কাকতালীয়।