কুশলের দোলনাটা দেখলেই আমার ছোট বেলার কথা মনে পরে যায়।বদ্ধ ঘরে একটু বাতাস পেলেই নেচে উঠছে ঠিক আমার মতো।ছোট বেলায় আমার দুলতে খুব ভালো লাগতো।দিনরাত আমি মার কোলের কাছে দুলতাম। একটু বাতাস পেলেতো কথাই ছিলোনা। মা বার বার আমাকে নিষেধ করতেন।সব চাইতে মজা হত আমার জন্মদিনে।জৈষ্ঠ্য মাসের পূর্ণিমা রাতে।পাশের বাড়ির কাকির সারা শরীর লাল হয়ে যেতো।আমি মার কোলের কাছে দুলতাম আর অবাক হয়ে দেখতাম। কত মানুষ আসতো।সুন্দর সুন্দর মেয়েরা মাথায় সিঁদুর দিয়ে পুজো করতে আসতো।তারা লাল রঙের সুতো কাকির গায়ে বেঁধে দিতো।আমি তখন খুব অবাক হতাম আর ভাবতাম মা আর কাকিতো প্রায় দেখতে একই, তা হলে সবাই কেন কাকির কাছে আসে, মার কাছে কেন আসেনা। একদিন মা বুঝিয়ে দিয়েছিলো।আমরা ভিন্ন ধর্মের।তাই কেউ আমাদের গায়ে লাল সুতো বাঁধে না।
মা খুব গল্প করতে পছন্দ করতো। তার কাছেই শোনা, আমার দাদাজান নাকি অনেক বিখ্যাত ছিলেন ।শহরের রেল ষ্টেশনের নাম আমার দাদাজানের নামে রাখা হয়েছে।আমাদের বংশের অনেক নাম ডাক আছে পুরো শহরজুড়ে।।দাদা-বাবারা সারা জীবন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন।মার মুখে শুনেছিলাম একবার খুব ঝড় হয়েছিলো। পানিও উঠেছিলো। আস পাশের অনেক মানুষ,পশু পাখি সেবার মা আর কাকির কাছে আশ্রয় নিয়েছিলো। এখনো প্রতি দিন নিশ্চয় অনেকে মার কাছে যায় কেবল আমিই যেতে পারি না। আমিই বন্ধি হয়ে আছি এই চার দেয়ালের কারাগারে।
একদিন দুপুরে মা আর আমি খেলছিলাম। কাজল ওর বন্ধুদের নিয়ে গাড়ি করে যাচ্ছিলো। আমাকে দেখে ওর এতো ভালো লেগেছিলো যে মার কাছ থেকে আমাকে নিয়ে এসেছিলো। “মা! মা!” বলে আমি এতো কাদলাম কিন্তু মা আমাকে একটুও সাহায্য করলো না। গাড়িতে আমি খুব কেদেছিলাম। কাজল যখন বাসায় এনে সুন্দর একটা ঘরে থাকতে দিলো তখনও আমি কাঁদছিলাম । মার উপর খুব অভিমান হচ্ছিলো।মা তো কাজল থেকে অনেক বড় ।তবে কেন মা আমকে কাজলের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তার ঝুড়ির ভেতর লুকিয়ে রাখলো না।এইসব কথা ভেবে খুব কান্না পাচ্ছিলো।পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সূর্যকে দেখে মার সেই কথাটা মনে পরেছিলো।বুঝতে পারলাম কেন মা আমকে রক্ষা করেনি। মা আমাকে আগেই বলেছিলেন, একদিন এমন কিছু হতে পারে।কেউ এসে মার কাছ থেকে আমাকে নিয়ে যেতে পারে। আমার অন্য ভাই বোনদের ও নিয়ে গেছে।মা বলেছিলেন এই রকম কিছু হলে আমি যেনো ভেঙ্গে না পরি।তখন আমি যেন মাকে মনে মনে ডাকি।আর যেন মাটিতে পা রাখি। কারন মাটি হল আমাদের আদি মা। মাটিতে পা রাখলেই আমি মার গন্ধ পাবো, স্পর্শ পাবো। একথা মনে পরতেই আমি মাটিয়ে পা ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওই কালো মাটিতে কেমন যেনো বোটকা গন্ধ ছিলো। এতো ছোট জায়গাতে পাও ঠিক মত মেলতে পারছিলাম না।
তারপর থেকে আমি আর কখনো হাত পা ছড়িয়ে দুলতে পারিনি।মার গায়ের গন্ধও পাইনি।কিছুদিন পর কাজল আমাকে অন্য এক জায়গায় সরিয়ে নিয়েছিলো। ওখানেও আমি মার গন্ধ পেলাম না।পা মেলতে গিয়ে দেখি শক্ত একটা কিছুর সাথে পা আটকে যাচ্ছে।তবে কাজল খুব মজার মজার খাবার দিতো।খুব যত্ন করতো। ঘরে আলো বাতাসের ও কোন কমতি ছিলো না।আমি তখন একটু একটু ওই জায়গাটাতে অভ্যস্ত হতে শুরু করলাম। শরীরে ও মেদ জমতে শুরু করলো।মাঝে মাঝে একটা কাক এসে বসতো কুশলের জানালায়। এক এক সময় মনে হত এই কাকটাই ছোট বেলার সেই কাকটা, যে মার কাছ থেকে সব সময় খাবার খেতো। জানালা দিয়ে বসন্তকালে অনেক বাতাস আসতো। যেখানে মাঝে মাঝে মার গন্ধ পেতাম। একদিন দেখি কাজল কতগুলো তার নিয়ে এলো। তারপর তার গুলো আমার সারা গায়ে পেচিয়ে দিলো। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আমি যন্ত্রনায় ছটফট করছিলাম। কিন্তু কাজল তারপরও থামেনি।সেই থেকে শুরু হলো আমার পরাধীন জীবন।
দেখতে দেখতে অনেক বছর পার হয়ে গেছে।মা বলেছিলো আমি নাকি জৈষ্ঠ্য মাসের পুর্ণিমা রাতে জন্মেছিলাম। আজ আমার জন্মদিন।১৮তম জন্মদিন।মাকে দেখিনা কত দিন হয়ে গেলো। শরীরে এখন আর তার নেই। পরে বুঝতে পেরেছিলাম আমি যেনো মার মতো বড় হতে না পারি তাই কাজল এই কাজটা করেছিলো।ও আমাকে এই ছোট্ট ঘরে বামন করে রাখতে চেয়েছিলো। একসময় কত মানুষ আসতো আমাকে দেখতে। একদিন একটা মেয়ে এসেছিলো,রোগা মতো, নাম রিমি। পরে দেখি ওই মেয়েটা কাজলের সাথে থাকছে।।তাও এক যুগ হয়ে গেল। আগে আমি ছিলাম কাজলের ঘরে। এক দিন রিমি আমাকে বের করে দিলো ওদের ঘর থেকে। এখন আমি থাকি কুশলের ঘরে।ছেলেটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেলো।আমি শুধু রয়ে গেলাম সেই ছোট্টটি।
মাঝে মাঝে রেগে গেলে ইচ্ছে করে ঝুড়িগুলো কাজলের গায়ে ছুড়ে মারি। কালকেই শুনছিলাম কাজল কাকে যেনো বলছে আমার পা গুলো কেটে দেবে। একটা মানুষ কী করে এমন কাজ করতে পারে আমি বুঝি না।আমার পা না থাকলে কি করে আমি মাটিতে পা দিয়ে মার স্পর্শ নিবো।কি করে নিজের পায়ে দাঁড়বো!আমার দাদা-বাবারা সারাজীবন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন আর আজ আমকে থাকতে হচ্ছে অন্যের আশ্রয়ে।নিজের উপর খুব রাগ হল। আরাম আয়েশ পেয়ে আমি এই দম বন্ধ করা পরিবেশে জীবন পার করে দিচ্ছি।কিন্তু এই জীবন তো আমি চাইনি।হঠাৎ করে কোথা থেকে যেনো পায়ে শক্তি এসে ভর করলো । বা পাশের পাটা দিয়ে শরীরের সমস্থ শক্তি একত্র করে লাথি মারতে শুরু করলাম।সারা রাত ধরে আঘাতের পর আঘাত করেও কোন লাভ হলোনা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিথর হয়ে পরে রইলাম।প্রতি জন্মদিনের মতো এইবারও মাকে ছুতে পারবোনা ভেবে চোখ ভিজে গেলো।
আজকাল সকালে রিমি আর কাজলের ঝগড়া শুনে ঘুম ভাঙ্গে। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। ঝগড়া করতে করতে কাজল কুশলের রুমে এসে দাড়ালো।পেছন পেছন রিমিও এলো। কাজল তখন আমাকে হাতে নিয়ে দেখছিলো।কাজলের হাতে আমাকে দেখে রিমি আরও রেগে গেলো। হাত থেকে আমাকে কেড়ে নিয়ে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি কি হয়েছে। পাখির মতো উড়তে উড়তে গিয়ে পড়লাম রাস্তায়।দম বন্ধ করে পরে রইলাম কিছুক্ষণ। দূরের ডাষ্টবিন থেকে কাকের ডাক শুনে চোখ মেলতেই দেখি আমি রাস্তায় পরে আছি।রাস্তার পাশেই সবুজ ঘাস।সারা গায়ে ব্যাথা।পা মেলতে গিয়ে দেখি শক্ত টবটা পাশেই ভেঙ্গে পরে আছে।অনেক বছর পর আমি আবার পা মেলতে পারলাম।প্রানভরে শ্বাস নিতে গিয়ে দেখি মায়ের গায়ের সেই পরিচিত গন্ধ।ব্যাথায় কাতর বনসাই বট গাছটা তাকিয়ে আছে ঘাসের দিকে যেখানে গেলে সে পাবে তার মায়ের গন্ধমাখা মাটির স্পর্শ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আচ্ছা! তাহলে আপনার সাদা কালো গল্পটা আমি আগেই পড়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিলো আমি বনসাই নিয়ে আগে একটা গল্প পড়েছি। কিন্তু কোথায় পড়েছি বা পুরো গল্পটা কি ছিলো একদম মনে করতে পারছিলাম না। আবার পরতে হবে!
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।