দূর থেকে দেখলাম জলিল ভাই মামুর দোকানে বসে চা খাচ্ছেন । পাশে একটা বড় ব্যাগ । কাছে এসে বুঝলাম তিনি ভালোই সমস্যায় পড়েছেন । কারণ তার কপাল জুড়ে ৬টা ভাঁজ । ২টা ভ্রুর মাঝে আর ৪টা উপরের কপালে । জলিল ভাই হলেন মেডিকেলের ছাত্রদের বিপদের বন্ধু । যদিও তিনি এই মেডিকেলের কর্মচারী নয় কিন্তু ‘সকল কাজের কাজী’ টাইপ একজন । গত ৩৫ বছর ধরে তিনি এই মেডিকেলে আছেন । আমাদের অনেক স্যার ও উনাকে সম্মান দেখান । সাধারনত যারা সারাক্ষ্ণ অন্যের বিপদে আপদে সাহায্য করে তারা খুব হাশি খুশি হয় কিন্তু জলিল ভাই একদম তার বিপরীত। আমি ইন্টার্নি করছি । তাই উনাকে অনেক দিন ধরে চিনি । আজকে নাইট ছিলো । তাই অনেক ক্লান্ত । ঘরে ফেরার আগে মামুর দোকানে এক কাপ চা খেতে বসলাম।
এমন সময় ৩ জন হিজড়া এলো । ওরাও চা চাইলো । চা খেতে খেতে ওরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিলো । ইদানিং পথে ঘাটে প্রায়ই ওদের দল বেঁধে টাকা চাইতে দেখা যায় । দেখে কষ্ট লাগে । বিব্রতকর অবস্থা থেকে বাঁচতে খুব দ্রুত টাকা দিয়ে দিই । তাড়াতাড়ি করে চা শেষ করে চলে যাবো ভাবছিলাম । এমন সময় দেখি জলিল ভাই ওদের সাথে কথা বলছেন।
জলিলঃ আপনাদের সাথে কি একটু কথা বলতে পারি? আমার নাম জলিল । আমি এই মেডিকেলেই থাকি। হিজড়াদের কেউ আপনি করে বলে না । ওরা তাই খুব অবাক হলো । মাঝের জন কথা বলে উঠলো,’আমার নাম বেদানা । বলুন, কি জানতে চান?” জলিলঃ আপনারা কোথায় থাকেন ? বেদানাঃ জয়নগরের পেছনে হিজড়া পাড়ায় থাকি। জলিলঃ আপনাদের পাড়ায় কি বয়স্ক কেউ আছে যে যুদ্ধ দেখেছে? বেদানাঃ কলিম হিজড়া আছে। কেনো? জলিলঃ আমি কি উনার সাথে কথা বলতে পারি? বেদানাঃ তিনি তো যক্ষা রুগী । হাঁটতে পারে না । পাড়ার বাইরে যেতে পারেনা । কথা বলতেও কষ্ট হয়। জলিলঃ আমি কি আপনাদের পাড়ায় যেতে পারবো ? বেদানাঃ কেনো পারবেন না, কিন্তু আপনি আমাদের ওখানে যাবেন ?
বেদানা ওর কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না । শুধু বেদানা নয় আমি , মামু আর ২ জন হিজড়াও অবাক হয়ে এই কথোপকথন শুনছিলাম । জলিল ভাইয়ের কি হলো ? তাকিয়ে দেখি উনার ৬ স্তরের কুচকানো কপাল এখন ৩ স্তরে এসে ঠেকেছে। ঘটনা কি খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো । কিন্তু আমি একজন ভদ্রলোক , কয়েকদিন পর ডাক্তার হবো । বি সি এস ভাইভা দিলেই সরকারি ডাক্তার । এইসব জায়গায় যাওয়া কি ঠিক হবে ? তাছাড়া তমা জানতে পারলে খুব রাগ করবে । দোনামনা করছি। এর মধ্যে দেখি জলিল ভাই তার ব্যাগ নিয়ে হিজড়াদের সাথে চলে যাচ্ছে। আমি ও রওনা দিলাম।
রিক্সায় যেতে যেতে জলিল ভাই আমাকে হিজড়া পাড়ায় যাবার কারণ জানালো। কিছুদিন আগে একজনের কাছে তিনি একটা মেয়ের কংকাল বিক্রি করেন । কিন্তু ছেলেটি পরদিন তা ফেরত দেয় । কারন ওটা নাকি ছেলের কংকাল। জলিল ভাই খুবই আবাক হন কারন এতো বড় ভুল তো তার হবার কথা না। তিনি ভালো কোরে আবার কংকাল টা পর্যবেক্ষন করলেন এবং দেখলেন কংকালটার চোয়াল, খুলি ও পেলভিস অনেকটা মেয়েদের মতো হলেও তাতে ছেলেদের গঠন ও রয়েছে । তিনি তখন তার রেজিঃ খাতা বের করে দেখলেন কয়েকদিন আগে হিজড়াপাড়ার পাশে যে বধ্যভূমি পাওয়া গিয়েছিলো তা থেকে তিনি এ কংকালটা পেয়েছেন।
বেশির ভাগ হিজড়াই রাতের বেলা সমাজের সুস্থ মানুষদের শরীরের আনন্দ দিয়ে টাকা রোজগার করে । তাই পাড়া এখনো নিঝুম । সরু গলি । ২জন মানুষ পাশাপাশি হাঁটতে পারে না । পাশের খাল থেকে পঁচা গন্ধ আসছে । অনেকক্ষ্ণ হাঁটার পর একটা ঘরের কাছে এসে থামলাম । ভেতর থেকে কাশির শব্দ আসছিলো । বেদানা দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো । দমবন্ধ করা পরিবেশ । মাটিতে বুড়ো একজন কংকালসার মানুষ শুয়ে আছে । চোখ বন্ধ । থেমে থেমে কাশছে। আমাদের দেখে আবাক হবার মতো অবস্থাও নেই।
একটুপরে কাশি বন্ধ হলে কলিম হিজড়া চোখ মেলে তাকালেন । ভাবলেশহীন চাহনি । জলিল ভাই বধ্যভূমিতে কংকাল পাওয়ার কথা ও তার ধারনার কথা বললেন এবং জানতে চাইলেন তিনি এ সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা । কিছুক্ষ্ণ চুপকরে থেকে তিনি বললেন,”৭১ রে আমরা খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম । তখন এতো বড় পাড়া ও ছিলোনা । আমারা ১০/১২ ঘর হিজড়া ছিলাম । সুস্ত মানুষ বিপদে পড়লে লোকজন সাহায্য করে না আর আমরা তো হিজড়া । আমরা ৪/৫ জন ছাড়া আর সবাই নদীর ওপাড়ে চলে গিয়েছিলো । আমি আর শরিফা ছিলাম সই । আমরা বুদ্ধি হবার পর থেকে এই পাড়ায় আছি । শরিফা নিজের বাড়ি ছেড়ে যেতে চায়নি । আমি ও থেকে গেলাম ।
একদিন কলোনির রাজাকার উজির মোল্লা এসে আমাদের ৪ জন কে নিয়ে গেলো । পাকিস্তানি অফিসাররা নাকি বাঙ্গালী মেয়ে দেখে দেখে ক্লান্ত । এখন অন্যরকম কিছু চাই । শুরু হলো অমানুষিক নিপিড়ণ । ওই ক্যাম্প ৩২ জন পাকিস্তানি ছিলো । একের পর এক সবাই আসতে থাকতো । আমরা ছিলাম ৯ জন । বাকি ৪ জন ছিলো ভদ্র ঘরের বউ ও একজন ছিলো ১৪ বছরের এক কিশোরী । আমরা তো এই কাজ কোরেই খেতাম তাই অনেকটা সামলাতে পারতাম । কিন্তু অন্যরা পারতো না । একদিন সকালে দেখি ১৪ বছরের মেয়েটা বারান্দায় মরে পরে আছে । রক্তাক্ত । গায়ে মাছি ভনভন করছে । মুখটা হাসি হাসি । মরে গিয়ে যেনো বেঁচে গেলো । তাই হয়তো এতোটা খুশি ।
শরিফা আর রাগ সামলাতে পারলো না । রাতে যখন ডাক পরলো, খালি একটা মদের বোতল ভেংগে ঐ অফিসার কে মাথায় আঘাত করলো । অফিসার মারা গেলো কিন্তু অন্যরা তাকেও বাঁচতে দিলো না । ১৬ ডিসেম্বরের পর আমরা সবাই ওই ক্যাম্প থেকে বের হলাম কিন্তু এতো লাশের ভেতর থেকে ওর লাশ খুঁজে পাইনি । পেলেও বা কি করতাম ? কোথায় কবর দিতাম ?” আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম । জলিল ভাই তার ব্যাগ থেকে কংকালটা বের করে তাকে দিলো । বেদানারা নিরবে কাঁদছিলো । কলিম হিজড়া ও কাঁদছিলো, কংকালটা বুকে জড়িয়ে ধরে, নিঃশব্দে । আমি আর জলিল ভাই বের হয়ে এলাম... ওই নোংরা,সরু পাড়া থেকে মুক্ত আকাশে, যে আকাশ পেতে অন্যদের সাথে একদিন শরিফারাও তাদের জীবন দিয়েছিলো । যাদের আমরা কখনোই মনে রাখি না বা রাখতে চাই না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জুয়েল দেব
হিজড়াদের সাথে ভালো ব্যবহার করলে, তারাও অত্যন্ত ভদ্রভাবে কথা বলে। আমি বেশীরভাগ সময় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি বলে এই ব্যাপারগুলি লক্ষ্য করি খুব। যাই হোক, এইটা অপ্রাসঙ্গিক কথা ছিল। আসল ব্যাপার হল, আপনার লেখায় ধার এসে গেছে সেটা কি বুঝতে পারছেন? ছোটগল্পে চমক থাকতে হয়, সেটা মোটামুটি চলে এসেছে। নিজে খুব একটা লিখতে পারি না বলে হয়তো হিংসুক হয়ে যাচ্ছি, তবে আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, একজন লেখককে জন্ম হতে দেখা। ভালো লিখছেন।
প্রজ্ঞা মৌসুমী
নাম পড়ে মনে হচ্ছিল হয়ত ভিন্ন কিছু পাব। হতাশ হয়নি; ভিন্ন প্রেক্ষাপট। লেখনীও চমৎকার। হিজড়া বেশি দেখিনি। কলেজের সামনে একজনকেই দেখতাম দোকান ঝাট দিতেন; অনেক ভদ্র ছিলেন। ওঁদের নিয়ে কিছু পড়লাম,জানলাম।"তমা জানতে পারলে খুব রাগ করবে"পড়ে বুঝলাম খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয়না। চারিত্রিক দূর্বলতার কথা বললেন রানা ভাই, ওঁদের বোধহয় চরিত্র গঠনের সুযোগ তেমন নেই। স্বভাবের অসুস্থ একটা ধারা তৈরি হয়ে গেছে তাঁদের মধ্যে, আর আমাদের মধ্যে ধারণা। সেই ধারণা খানিকটা হলেও বদলে দিয়েছেন গল্পে। তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।