আশার চরে আলেয়া

গ্রাম-বাংলা (নভেম্বর ২০১১)

মোঃ শামছুল আরেফিন
  • ৫৬
  • ৮২
নিতাই নদীর উপর বয়ে চলা হাওয়াগুলোর এতদিন কোন রঙ ছিলনা। তবে এখন শুধু তার গায়ে রঙধনুর সাত রঙা পোশাকই জড়ায়নি; তাতে যোগ হয়েছে কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ। বাসন্তী হাওয়া বলে কথা! সেই হাওয়াগুলো বয়ে চলে পথ-ঘাট-মাঠ-প্রান্তর- সবুজ বন-বনানী আর নিতাই নদীর উপর দিয়ে। বয়ে চলে দিবানিশি। সাদা মেঘেদের সাথে লুকোচুরি করতে করতে কাঁচা সোনা রোদগুলো যখন চুমো খায় নিতাই নদীর বুকে তখন স্বচ্ছ মিঠাপানির দুর্বল ঢেউগুলো সোনা রঙ ধারণ করে মুখে প্রশান্তির হাঁসি চেপে তিরতিরিয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। যে ঢেউ একবার গত হয় তার আর পেছনে ফিরে তাকানোর অবকাশ নেই। ছন্দ হারানো কিছু ঢেউ আবার আঁচড়ে পড়ে নদীর দুইকূলে। মাটি আর জ্বলের মধুর ঘর্ষণে এক মন্ত্রমুগ্ধ শব্দের আবির্ভাব হয় তখন।

নদীর ঐ তীরে যেখানে শুকনা কাশফুল সমেত মৃতপ্রায় কাশবন দাড়িয়ে আছে রাজ্য বিতাড়িত মুকুট বিহীন সম্রাটের মত সেখানে মানুষের পদচিহ্ন এখনো পড়েনি খুব একটা। তবে এই পাড়ের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। একসময়ের নিষ্প্রাণ শুষ্ক বালির চর কালের পরিক্রমায় এখন হাজার তিনেক মানুষের ঘনবসতিপূর্ণ গ্রামে পরিণত হয়েছে। গ্রামের নাম চর-পোয়া।

ভর দুপুরবেলায় এমন নির্জন আর শান্ত স্বভাবের গ্রাম প্রকৃতির কাছে খুব একটা ধরা দেয়না। গত একমাস আগেও গ্রাম যে এমন রূপে ধরা দিতে পারে তা কেউ কল্পনা করেনি। কেননা তখন ধানের চারা রোপনের সময়। একটি ঘরেও ব্যস্ততার অন্ত নেই। আজ নিজের গরু কিংবা অন্যের বলদ ভাড়া করে জমিতে হাল দাওতো কাল খাল সেঁচে পানি। তারপর পরিবারের ছোট্ট ছেলেটি সহ কোদাল হাতে জমি তৈরি করার পালা। গোয়াল ঘরের পেছনের স্তূপ থেকে অনেক দূরের মাঠে গোবরের বস্তা বয়ে নিয়ে যাওয়াও চারটিখানি কথা নয়।

ঘরের বউরা ঘরের কাজগুলো কোন মতে শেষ করে কোলের বাচ্ছাটিকে বুকে জড়িয়ে গামছা পেঁচানো খাবার নিয়ে যায় মাঠে। কিন্তু হাতের কাজটুকু শেষ না করে কাঁদা ছেড়ে উঠতে মন চায়না ঘরের স্বামীটির। কৃষাণীর কোলের বাচ্ছাটি ঘুমিয়ে পড়ে একসময়। তাকে শুইয়ে দেয়া হয় খেতের আইলে কিংবা অনতিদূরে কোন গাছের ছায়ায়। অথচ কৃষকটির মাঠে থেকে উঠার কোন নাম-গন্ধ নেই। একসময় পড়নের কাপড় সামান্য উপরের দিকে ভাঁজ করে মাঠে নেমে যায় ঘরের বউটিও। কেননা কাজ যে তখনও শেষ হয়নি!

কাজের মৌসুমে গ্রামে সবচেয়ে বেশি ব্যাস্ত থাকতে দেখা যায় গ্রামের উঠতি আর জোয়ান বয়সী ছেলেদের। নিজের জমিতে কাজ শেষে পরের জমিতেও গতর খাটে তারা। দিনশেষে যা আয় হয় ভালোভাবে দিনাবসনের জন্য তা যথেষ্ট। তাই মাঝের প্রায় এই পনেরটি দিন বেশ ভালোই কাটে তাদের। কিন্তু ধান রোপণ শেষ হলে গ্রামে কাজের মানুষের আর খুব বেশি প্রয়োজন হয়না। তখন গ্রামের আধ-বুড়া আর জোয়ান কিছু ছেলেরা কাঁথা-বালিশ নিয়ে পাড়ি জমায় শহরে; দারিদ্রের অভাব গোচানোর জন্য। সেখানে গিয়ে কেউ বনে যায় কোন বহুতল ভবনের নির্মাণ শ্রমিক কিংবা কাঁচা বাজারের কুলি, আবার কেউ স্থায়ীভাবে হয়ে যায় রিকশাচালক। তবে কিছু কিছু যুবক ওদের দলে পড়েনা, শহরের ধুলোয় পা ফেলার মত বিলাসিতা নেই তাদের। তাদের দিন কাটে গায়ে বাতাস লাগিয়ে, মফিজের টঙে বসে চা আর সিগারেটে, প্রশান্ত নিতাইয়ের তীরে বসে তাস খেলে খেলে। সন্ধ্যা পেরুলেই শুরু হয় তাদের বিশাল আলোচনা সভা। আলোচনার বিষয়বস্তু যখন অবধারিতভাবে সদ্য দেখা সিনেমার অশ্লীল কোন দৃশ্য কিংবা দুনিয়ার সবচেয়ে বাজে অথবা জঘন্য কিছু তখন আলোচনা বেশ ভালই জমে তাদের। তারপর তারি কিংবা ভাগ্যক্রমে পাওয়া বাংলামদ পেটে চালান দিয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে অনেক রাত হয়ে যায়। তারা সংখ্যায় খুব বেশি নয়, তবে দলভারী করার জন্য যথেষ্ট। ঐ দলের মধ্যে মুখচোরা টাইপের যে ছেলেটি তার নাম লিটন। এই বেলায় তার কাজী বাড়ির কাছারিতে থাকার কথা ছিল; কিন্তু এখন দুই হাতে লুঙ্গীর কাছা নাড়তে নাড়তে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে সে। তার গন্তব্য আলেয়াদের বাড়ি।

লিটনদের বাড়ি থেকে আলেয়াদের বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি নয়। মাঠে যখন ধান থাকেনা তখন মজু বেপারীর গোয়াল ঘরের পেছনদিক দিয়ে বেড়িয়ে দুটি ধানক্ষেত পেরুলেই আলেয়াদের শন পাতায় বাঁধানো রান্না ঘর চোখে পড়ে সবার আগে। তবে এখন অবশ্য অন্য কথা। দূরত্ব অনেক কাছের হলেও মেঠো পথ ধরে ঘুরে যেতে হয় অনেকটা পথ। পথের ধারের কৃষ্ণচূড়ায় একজোড়া কোকিলের কুহু কুহু ডাককে ছাড়িয়ে ঢেঁকির ধূম ধূম শব্দটা পথের ধারে এসে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। শব্দটা আসছে আলেয়াদের বাড়ি থেকেই।

ঢেঁকিটাকে মোটেও অবসর দিতে চায়না আলেয়া। ঢেঁকিতে চড়লে আর কোন খবর থাকেনা ওর। সকালে কলিম বেপারীর বউ আতপ চাল দিয়ে গেছে বার সের। সেগুলোকে ঢেঁকির নিচে চালাতে গিয়ে ভয়াবহ রকমের ঘেমেছে আলেয়া। তার পড়নের ভেজা জামাটা সারা শরীরে এমন আঁটসাঁট হয়ে লেগে গিয়েছে যে ভাঁজ খাওয়া চামড়াগুলো পর্যন্ত দূর থেকে চোখে পড়ছে। বুকের ওড়নাটা কখন যেন সরে গিয়ে পাগলা ঘোড়ার মত টগবগ করা রসাল যৌবন এই ঢেঁকি ঘরের পচা বাঁশের বেড়া আর লুকিয়ে থাকা মাকড়সা ও টিকটিকিদের কাছে আরো বেশি উন্মোচিত হচ্ছে। আলেয়ার দাদীও আছেন সেখানে। তিনি ঢেঁকির নিচ থেকে মিহি চালের গুড়াগুলো একটা চালুনিতে চেলে পাশের পাতিলে রাখছেন। কাজের ফাঁকে ভুলাক্ষরেও তাকাচ্ছেন না তার নাতনীর দিকে। পাছে নিজেই লজ্জা পেয়ে বসেন। তবে আলেয়ার এমন বেশ-ভুষা দেখে মনে মনে একশ একবার তাকে বেশরম-বেহায়া-বেলাজা বলে গালি দিয়েছেন। বৃদ্ধ বুড়ি। নিজেকে তাই সামলে রাখতে পারেননি একসময়। হঠাত করে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত কর্কশ গলায় বলে উঠলেন-
ঐ মাগী, তোর জ্বালা এত জ্বলে ক্যান? বুকে কাপড় দেওন যায়না?
ক্যান গো দাদী! আমার জ্বালা দেইখা তোমারো কী হিংসা হয়নি? আমার তো শুধু বুকে কাপড় নাই। তোমার তো বুকে পিঠে কিছুই নাই।
নাতনীর এমন কথায় দাদী তার ছোট্ট মুখখানা বিকৃত করে রাগের চোটে মুখের দুই পাটির দাঁতগুলো এমনভাবে ঘষতে লাগলেন যেন যে কয়টি দাঁত অবশিষ্ট আছে সেগুলো এক্ষুনি পড়ে যাবে।
আমার এখন তিনকাল যাইয়া এককাল বাকি আছে। আমার পর্দা করলেই কী আর না করলেই কী! যতদিন তোগোমত আছিলাম ততদিন করছি। আমাগোরে নিয়া কেউ কোনোদিন বাজে কথা কইতে পারেনাই।
হ গো দাদী, বুচ্ছি। তুমি একবার এইখানে আস। ঢেঁকিতে ভারা দাও। তহন দেখবা তোমার পড়নের কাপড় কই যায়!
বুড়ি যখন আবারো কিছু বলতে গেল তখন কোন পুরুষ মানুষের গলার খাঁকারি যেন কানে এলো। বুড়ি আর আলেয়া অবচেতনভাবেই তাদের কাপড় ঠিক করে নেয়। লিটন এসে দাঁড়িয়েছে ঢেঁকি ঘরের দরজায়। তাকে দেখে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল বুড়ির।
কি লিটন, দাড়ায়া ক্যান? ভিতরে আয়।
লিটন ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে গিয়ে বুড়ির কাছে বসার সময় একবার চোখ পড়ল আলেয়ার চোখে। দ্বিতীয়বার আর ফিরে তাকানোর সাহস পেলনা সে। আলেয়া তার খসে যাওয়া কাপড় ঠিক করে নিয়েছে ঠিকই তবে তা তার রূপ আর যৌবনের জোয়ার ঢেকে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। তার ঘর্মাক্ত দেহের পরতে পরতে আবেদনময়ী রেখার ভাঁজ, অর্ধ ভেজা চুল, কাজল বিহীন তার কাজল কালো দুটো চোখ আর ভ্রুযুগলের গোড়ায় জমে থাকা ঘামবিন্দু তাকে যেন এই বসুধার সবচেয়ে সুন্দরী রমণীটির প্রতিকৃতি দান করেছে। পূর্নিমা রাতে আকাশচারী পরীগুলোও যেন ওর কাছে হার মানতে বাধ্য এখন। মনের অজান্তেই আলেয়াকে নিয়ে এমনটি ভাবতে থাকে লিটন। তার ধ্যান ভাঙ্গে বুড়ির কথায়।
কি রে ভাই, আইজ আমার লাইগ্যা পান আনছ নাই?
ভুল হইয়া গেছে দাদী। আইজ না হাটবার! বিকালবেলা তোমারে আধ বিড়া পান আইন্যা দিমু নে।
আনন্দের হাঁসি ছড়িয়ে পড়ে বুড়িটির চোখে মুখে। লিটনকে আশীর্বাদ করে দেয়।
দাদী চাইল গুঁড়া করতেছো কার জন্য?
কলিম বেপারীর মাইয়া কাইল শ্বশুর বাড়িতে যাইব। আদরের মাইয়া। মেয়েরে খালি হাতে ক্যামনে দেয়! সন্ধ্যার পরে পিঠা বানাইবো। নকশী করা নানান রকমের পিঠা। আমারে আর আলেয়ারে যাইতে কইছে। আমি কি আর পারি এহন পিঠার মইধ্যে খেজুর কাটা দিয়া নকশা করতে? আলেয়ারে পাঠামু।
কথা শেষে কিছুক্ষন চুপ করে থাকে বুড়ি। খনিক পরে আবার বলে-
আমি থাকতে থাকতে যদি আলেয়ারে তোর হাতে উডাইয়া দিতে পারতাম রে ভাই!
লিটন যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেল। সে বলল-
দেওনা গো দাদী। আমার তো আর তাড়া সয়না।
এতক্ষনে আলেয়ার মুখে কথা ফুটতে শুরু করল।
দেখ দাদী, মুখ সামলাইয়া কথা কইবা। আমি ঐ বাদাইম্যারে বিয়া করতে যামু কোন দুঃখে? জগতে কি সুপুরুষের অভাব নাকি? তোমার ইচ্ছা হইলে তুমি যাও। ওর লগে যাইয়া ঘর কর।
লিটন কিছুই বলতে পারলোনা। মাথা নিচু করে রইল সে। কথা বলল দাদী।
লিটন আবার বাদাইম্যা হইল কবে? ওরে তো আমরাই কোলে পিঠে কইরা মানুষ করছি। ওরে আমি চিনিনা?
ক্যান দাদী তুমি কিছু দেখনা বুঝি? গেরামের বেবাক লোকের খোঁয়াড় থেইকা রাতের আঁধারে মুরগী চুরি হয়, আমাগো খোঁয়াড় থেইকা হয়না। মানুষের গাছের কাঁঠাল, নারিকেল, সুপারি, মাঠের ছাগল উধাও হইয়া যায়। কিন্তু আমাগো হয়? নিতাই নদীর ধারে জুয়া খেলে কারা? মদ খাইয়া কাজী বাড়ির কাচারিতে কারা পইড়া থাকে? এগুলা এখন গেরামের বেবাক লোকের জানা। যেদিন ধরা খাইবো সেদিন বুঝবো ঠেলা। আর সংসার কইরতে হলে ক্ষমতা লাগে, সংসারী হইতে হয়। ধামড়া গরুর মত কেবল রাস্তায় রাস্তায় গায়ে বাতাস লাগাইয়া ঘুরলে হয়না। কাম করতে হয়। এই ধামড়ার চেয়ে ঐ বুড়া কদম বেপারী অনেক ভালা। আমারে সুখে রাখবার পারবো। আমি তার ঘরেই যামু।
কথাগুলো লিটনের গায়ে খুব লাগলো।তবুও কোন প্রতিবাদ করলনা সে। সে মুখও তার নেই । শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল সে। নিজের প্রতি ঘৃণা হতে লাগলো তার। আর নিজেকে পাল্টানোর প্রতিজ্ঞাটা তখনই করলে সে। আলেয়াকে পাবার জন্য সব কিছু করতে পারবে সে।

গ্রামের দুষ্ট ছেলেদের পাল্লায় পড়ে লিটনের স্বভাবে অনেক পরিবর্তন হয়েছে এতদিনে। নিজে চুরি না করেও চোরের খাতায় নাম উঠেছে ওদের চক্করে পড়ে। ওদের জমানো টাকা যখন শেষ হয়ে যায় তখন নেশার খোরাকের জন্য ঐসব করে তারা। মাঝে মাঝে এমনিতেই চুরি করে মুরগী কিংবা কিংবা কলার ভেপো তাদের ভোজন পর্ব সারার জন্য। কদম বেপারীর দুটো ছাগলও হজম হয়েছে তাদের পেটে। তবে লিটন আগে এমনটি ছিলনা। ওর মা মারা গেল গত বর্ষায়। নিজেদের জমি যতটুকু ছিল বোনের স্বামী ফরিদ গাজী ওয়ারিশের নাম করে নিয়ে গেছে অনেকটা। সেগুলো বিক্রি করে ফরিদ পাড়ি চলে যায় দুবাইতে। বলেছিলো লিটনকেও নিয়ে যাবে সেখানে। তাই ভগ্নীপতির কথামত জমিজমা বিক্রি করে টাকা পাঠায় তার কাছে। অথচ এই পাঁচ বছর হয়ে গেল ফরিদ মিয়া আর কোন যোগাযোগ করেনি। জমি বিক্রি করা টাকাটা চোখ বন্ধ করে মেরে দিল। লজ্জায় লিটনের বোন এখন আর এ বাড়িতে আসেনা। লিটনও খবর নেয়না। বোন যে সুখে আছে সেটিই বড় ব্যাপার।

লিটন যে গ্রামের কারো উপকারে আসেনা এমন নয়। সপ্তাহে যেদিন হাঁট বসে সেদিন অনেকের বাজার সে করে দেয়। কেউ যখন তার কাছে আসে একটা চিঠি লিখে দেয়ার জন্য সে কখনও কাউকে নিরাশ করেনা। গ্রামে যখন যাত্রার আয়োজন হয় তাকেই অগ্রগামী হতে দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। যাত্রায় নায়কের রোলটি তার চাইয়ে চাই। তবে গ্রামের অন্যান্য পরিবার থেকে আলেয়াদের পরিবারই লিটনের দ্বারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়।

আলেয়াদের ঘরে পুরুষ মানুষ বলতে কেউ নেই। যে তিনজন সদস্য ঘরে থাকে তারা সবাই মহিলা। আলেয়া, তার বিধবা বোন আছিয়া আর দাদী। আলেয়ার বাবা মারা গেল তার জন্মেরো আগে। আছিয়ার স্বামীটা মারা গেল বিয়ের দুই বছরের পর না জানা রোগে। দাদা মারা গেল বুকে পানি আটকিয়ে। চৈত্রমাস তখন। খাঁ খাঁ রোদে মাঠ থেকে কাজ করে এসেছে আলেয়ার দাদা। তৃষ্ণায় তার বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। ঘরে ফিরে পানি চাইতেই আলেয়ার দাদী ঘোমটা মুখে পানি এগিয়ে দিলেন। যেইনা পানি গলা পেড়িয়ে বুকে গেল পানি আর যায়না। কিছুক্ষন ধড়ফড় করতে করতে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল আলেয়ার দাদা। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে গেলেন আলেয়ার দাদী। বাপের বাড়িতে আর ফিরে যাননি। সবাই স্বামীখেকো বলে কত অপবাদ দিয়েছে যা এই পরিবারের মেয়েদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত অভিযোগ। সবকিছু সয়ে আলেয়ার দাদী আগলে রেখেছেন স্বামীর ঘর, বসত ভাটি, ধানী জমি। সেই জমিতে এখনো ধান চাষ হয়। তবে সেগুলো সম্ভব হচ্ছে শুধুমাত্র লিটনের কারণে। লিটন যদি ওদের জমিতে বিনা পয়সায় গতর না খেঁটে, নিজের জমির মত শ্রম না দিয়ে ফসল না ফলাত তবে আলেয়াদের অবস্থা আরো করুণ হতে পারতো। লিটনের একটাই স্বভাব। ভবিষ্যৎ নিয়ে ও কোন চিন্তা করেনা। তবে এখন থেকে নিজেকে পালটে ফেলবে লিটন। তাকে সংসারী হতে হবে। তাকে টাকা উপার্জন করতেই হবে। তবে শহরে গিয়ে নয়। আলেয়াকে ছাড়া শহরে গিয়ে থাকতে পারবেনা সে। সে এখন থেকে গ্রামেই শ্রম দিবে। নিজ জমিতে কলা গাছ লাগাবে অনেকগুলো, সেই সাথে মৌসুমি সবজি। হলুদ, মরিচ, তিল, কলই, খেসারি আর মুগডাল ও লাগানো যেতে পারে। সেগুলো বিক্রি করে যে পয়সা আসবে তাতে ঢের চলে যাবে। তখন আর অভাব থাকবেনা তার। আলেয়াও তখন নিশ্চই তার ঘরের বউ হয়ে আসতে আপত্তি করবেনা।

দিন চলে যায় নিতাই এর বুকে বয়ে চলা ঢেউগুলোর মত। জ্যৈষ্ঠ মাস শেষ হয়ে আসে। ক্ষেতের ফসল উঠে গেছে কৃষকের ঘরে। বসন্তের যে আম্রকানন মুখরিত ছিল মুকুলের সুবাশ আর ভ্রমরের গুঞ্জনে সেখানে এখন পাকা মিষ্টি আমের ঘ্রাণ। হঠাৎ হঠাৎ আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামা শুরু হয়। সেই সাথে দমকা বাতাস। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তখন আকাশে বজ্রধ্বনি উপেক্ষা করে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে। কে কত বেশি আম কুঁড়াতে পারে সেই প্রতিযোগিতা চলতে থাকে তাদের মাঝে। ভূঁইয়াদের বাগানের বড় বড় কাঁঠালগুলোতেও পাকা রঙ পড়তে শুরু করেছে। গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত ঝুলে থাকা কাঁঠালগুলো পথচারীদের বিনোদনের জন্য যথেষ্ট। অমন সাধের ফলটির দিকেও এখন আর নজর যায়না লিটনের। অনেক পরিবর্তন হয়েছে তার। সে এখন সংসারী। কিছুদিন হল সে তার ঘরটিকে ঠিক করে বসবাসের আরো উপযোগী করে তুলেছে। সামনে শীত গেলেই বুড়ি দাদীর সাথে কথা বলে আলেয়াকে ঘরের বউ করে আনবে। তবে যার জন্য লিটনের এত পরিবর্তন সেই আলেয়াকে এখনো বুঝতে পারেনি লিটন। প্রতিদিনই তার চোখে চোখ পড়ে, কিন্তু সেই চোখের ভাষা লিটন বুঝতে পারেনা। যা কিছু কথাবার্তা চলে তার সাথে তা এতোটা আবেগ আর রসহীন কঠিন কথা যে মনে হয়না আলেয়ার বুকে লিটনের জন্য বিন্দু পরিমাণ ভালবাসা হিম বরফ খন্ডের মত জমাট হয়ে আছে।

দুইদিন আগের কথা। হাঁট থেকে বাজার সদাই করে লিটন যখন আলেয়াদের বাড়িতে আসল তখন সবেমাত্র সন্ধ্যার আকাশে তারারা উঁকি দিচ্ছে। চাঁদ উঠেছিল অনেক আগেই, কিন্তু চাঁদনী ছিলনা অতটা। অথচ আলেয়া আর তার বিধবা বোন আছিয়া তখনও কুলো হাতে ধান ঝেড়ে যাচ্ছে। দখিনা বাতাসেরা আজ ছলনা করেছে ওদের সাথে। বাতাসে তেজ থাকলে এত কষ্ট করতে হয়না। কুলো দিয়ে সেগুলো বাতাসে ওড়ালেই সোনাধানগুলো নিচে পড়ে যায় আর চিটা ধানগুলো পড়ে দূরে কোথাও। বুড়ির শরীরটাও তখন ভালো ছিলনা। তার পুরানো বাতের ব্যথাটা জেগে উঠেছে আবার। তিনি ঘরেই ছিলেন। শয্যাশায়ী। লিটন তাই বুড়িকে একনজর দেখে এসে যোগ দিল আলেয়ার সাথে। আছিয়া তখন রান্না ঘরে গেছে রান্না করতে। তার পিচ্ছি মেয়েটার কান্না শোনা যাচ্ছে সেখান থেকেই। লিটন কোন কথা না বলেই উঠোনের কোণে পড়ে থাকা খেড়ুলিগুলো উঠোনের মাঝখানে এনে একটা লাঠি দিয়ে সেগুলোকে এমনভাবে তুলোধুনা করতে লাগলো যেন গোছা থেকে ধান ছড়ানো একটা অতিচমৎকার আর্ট। তারপর সেই ছিন্নভিন্ন খেড়ুলিগুলোকে আবার নানা ভঙ্গিতে পায়ের নিচে দলিত মথিত করে সেগুলো থেকে ধান বের করে আনল। অথচ তা একটাবারও আলেয়ার দৃষ্টির গোছরে আসেনি। সে একমনে মথিত শীর্ণ খেড়ুলিকে চেলে অবশিষ্ট ধানগুলো বের করার চেষ্টা করছে। রাত তখনো খুব বেশি হয়নি। চাঁদের আলোয় কানায় কানায় পূর্ণ গ্রামের প্রতিটি মাঠ, ঘরবাড়ি, বাগান আর উঠোন। পুকুর পাড়ে তেতুল গাছে যে একজোড়া লক্ষ্মী পেঁচা বসে আছে তাদের চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে চাঁদের আলোতে। সারাদিনের ক্লান্ত আর ধূলাময় আলেয়াকে লাগছে চাঁদের দেশের অপ্সরাদের মত। লিটন বারবার দেখছে তাকে। এমন রাতে তাকে একা পাওয়ার পরেও লিটন তার সাথে অতি প্রয়োজনীয় কিছু কথাবার্তা ছাড়া মনের বিশেষ কথাগুলো তো বলতেই পারেনি বরঞ্ছ যা কিছু বলেছে তার প্রাপ্য উত্তরটাও পায়নি ঠিকমত। একটু আগে যখন বলল,
আলেয়া, তোমাগো টুকরি কই? ধানগুলা ঘরে নেওন দরকার।
আলেয়া উত্তর দিল গা ছাড়া ভাবে।
দাদীর চকীর নিচে আছে। ইচ্ছা হইলে আইনা নিলেই পারে।
সকল কাজ শেষ করে বিষণ্ণ চিক্তে লিটন যখন মুখে সিগারেট ধরাল মনে হল কেবলমাত্র তখনই যেন লিটনের শ্মশ্রুহীন মুখমন্ডলটি আলেয়ার চোখে ধরা পড়ল। সে এত কাছে এসে তাকে প্রত্যক্ষ করতে লাগলো যে মনে মনে লিটনের খুশি আর ধরেনা। খুব ভাব নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকতে লাগলো সে। আলেয়া সেই দিকেই গেল।
কি ব্যাপার লিটন ভাই! আপনার গোঁফ কামরাইছেন ক্যান! সিনেমার নায়ক হবেন নাকি?
লিটন এটা মধুর উপহাস ভেবে লজ্জা পেয়ে গেল।
কি যে বল আলেয়া? আমার কি আর সেই রকম চেহারা আছে?
আমি কি কইছি আপনার নায়কের চেহারা আছে! আপনার চেয়ে ঐ বুড়া কদম বেপারী অনেক সুন্দর। কি সুন্দর গোঁফ ওনার। দেখলেই পরান জুড়াইয়া যায়। গোল গোল চোখ। আর আপনার? এখন তো একদম আইশ ছোলা মরা হাঁসের মত লাগতেছে আপনারে।
আলেয়ার এমন কথায় মনে মনে অনেক কষ্ট পেল লিটন। আজ নগদ পনের টাকা দিয়ে মধুরাম নাপিতের দোকানে দাড়ি কামিয়েছে সে। তারপর কতকিছু লাগিয়েছে মুখে। এত কিছুর পর ঐ বুড়া কদম বেপারী কিনা তার চেয়ে সুন্দর হয়ে গেল! চোখে জ্বল এসে পড়ার চক্কর লিটনের। মুখের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে সে চলে যাচ্ছে। তেতুল গাছের ডালে বসে থাকা একটি পেঁচাও উড়াল দিল তার সঙ্গিনীকে ফেলে। পেছন থেকে আলেয়ার ডাক শুনা গেল আবার।
ভাতের ফ্যান ঝড়ছে। রাতের খাওনা না খাইয়া গেলে দাদী কিন্তু অনেক রাগ করবো।
আমার খুধা নাই। যার খুধা লাগছে সে খাক।
আলেয়াদের উঠোন ছাড়িয়ে মাঠে নেমে যেতে লাগলো লিটন। সে মনে মনে ভেবেছিল আলেয়া তাকে আবারো ডাকবে। কিন্তু কারো ডাক পড়েনি আর। সে চলে যাচ্ছে মাঠ পেড়িয়ে নিতাই এর তীরে। কিছু জোনাকিও পিছু নিয়েছে তার। আজকের রাতটা নিতাই এর তীরেই কাটিয়ে দিবে লিটন। সে যে চরম একা একজন আজ আবার তিল তিল করে বুঝতে পারবে সে।

যত নষ্টের মূল সব হল ওই বেটা কদম বেপারী। বছরের ভিবিন্ন সময়ে ভিবিন্ন সময়ে ভিবিন্ন ব্যবসা তার। নারিকেল সুপারির দিনে হাঁটে হাঁটে গিয়ে নারিকেল সুপারি কিনে। তারপর সেগুলো নিয়ে বিক্রি করে গঞ্জে। দুইটা পুকুরও নিয়েছে সে পাঁচ বছরের জন্য। আবার যখন কোরবানির ঈদ আসে তখন শুরু করে গরুর ব্যবসা। টাকা পয়সা ভালোই ইনকাম তার। পয়সার জোড়েই তাই বিয়ে করেছে এর আগে তিনটি। বেটার মাথায় চূল নেই চারটি অথচ সে কিনা খেপেছে চতুর্থ বিয়ে করার জন্য। তাও আবার আলেয়া সুন্দরীকে। যখনই দেখা হয় আলেয়ার সাথে পথ আগলে দাঁড়ায় তার।

আলেয়াদের সংসার চালানোর জন্য পুরাতন ঢেঁকিটাই একমাত্র অবলম্বন নয়। অনেক হাস-মুরগী আছে তার। ছাগলও আছে কয়েকটি। সেগুলো ছানা দিয়েছে। ছাগলের দুটো ছানাকে কোলে করে আজ মাথে এসেছে আলেয়া। কাস্তে দিয়ে ঘাস কাটছিল সে তার ছানা দুটোর জন্য। মাঠের আইল ধরেই যাচ্ছিলেন তখন যাচ্ছিলেন কদম বেপারী। আলেয়াকে দেখেই মুখের পান গিলে ফেলে কথা বলতে শুরু করেন তিনি।
আরে আলেয়া, পাখি। কি খবর তোর? দেখছস মনের মিল থাকলে কত কিছুই হয়। তুই যেখানে ঘাস কাটতে আইলি, আমিও সেইখানেই আইলাম।
কি যে কন কদম ভাই! আমিতো জানতাম আপনি আইজ এই পথেই আইবেন। তাইতো আমি আইলাম। কতদিন দেহিনা আপনেরে।
তুই তাইলে আমার বাড়িতে যাস না ক্যান আলেয়া। তোর লগে সুখ দুঃখের গল্প করতাম।
আমার কি আর সেই কপাল আছে গো ভাই। দাদী তো যাইতে দিতে চায়না।
ইস! তোর ঐ বুড়া দাদীটা যে কবে মরবো। ওনার ঝাড়ুর বাড়ির কথা আমার এখনো মনে পড়ে। ঐ বুড়ি মরলেই তো তোরে ঘরে বউ কইরা আনতে পারতাম।
একটা কথা বলি কদম ভাই। কষ্ট পাইয়েন না। আমাগো ঘরের কোন মেয়ের বিয়ার পরে স্বামীরা বাঁচেনা।
আমার দাদী যার হাতে আমারে তুইলা দিবো সেও দেখবেন বেশিদিন বাঁচবোনা। আমার প্রথম স্বামী যখন মরব তখন আপনার লগে হাঙ্গা বমু। ততদিন অপেক্ষায় থাকেন। ক্যামন! আমি গেলাম।
এই বলে চলে গেল সে। বুড়া কদম ন্যাড়া মাথা নিয়ে তাকিয়ে থাকল সেই দিকে।

কয়েকদিন হয়ে গেল লিটনের কোন খোঁজ খবর জানা নেই। আলেয়াদের বাড়িতে গত কয়েকদিনে আসা হয়নি তার। আলেয়ার দাদী রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলে চলছেন লিটনের কথা।
পোলাডা একবেলা রান্ধে, তিনবেলা খায়। কত কষ্ট করে। আমাগো বাড়ির পথটা ভুইল্যা গেছে মনে হয়। না জানি পোলাডার শরীর খারাপ করল। ওরে অ আলেয়া, লিটনের যদি একটু খবর নিতি রে।
আলেয়া কোন উত্তর দিলোনা। হঠাৎ করে কি অজানা শঙ্কা যেন তার কলিজা কুট কুট করে কাটতে লাগল।বাহিরে তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। রাত দুপুরে এমন বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বড় একটা পাতিল মাথায় দিয়ে সে বের হয়ে গেল লিটনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। গিয়ে দেখে সে যা ভেবেছে তাই সত্যি। জ্বরের তোপে লিটন কি সব আবোল তাবোল বকছে। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা আলেয়া। কোন উপায় না পেয়ে ঘরে যত কাঁথা ছিল সেগুলো দিয়ে তাকে মুড়ে দিয়েছে সবার আগে। তারপর পাতিলে করে পুকুর থেকে পানি নিয়ে আসল। বৃষ্টির পানি দিয়ে জলপট্টি দেয়া তো দূরের কথা, ছোয়ানোও যাবেনা। জ্বর বেড়ে যাবে তাতে। পরম যত্নে মাথায় জ্বলপট্টি দিতে শুরু করল সে। কখন যেন জ্বরের ঘোরেই আলেয়ার হাত চেপে ধরল লিটন। আলেয়া হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলোনা। এভাবেই কেটে গেল অনেকটা রাত। কিন্তু উক্তেজনাটা যখন হাত থেকে প্রসারিত হচ্ছে মাথার দিকে তখন একটানে হাত ছাড়িয়ে নিলো আলেয়া। আঁধার মাড়িয়ে ফজরের আযানের সুর যখন কানে এল লিটনের জ্বর তখনও নামেনি। তবুও ভোর হবার আগেই লিটনের ঘর থেকে বেড়িয়ে আসল আলেয়া। পাছে কেউ দেখে ফেললে অপবাদ ছড়ায়। দিনের আলো যখন ফুটবে তখন আবার আসবে সে।

ভীষণ রকম বিমর্ষ দেখাচ্ছে এখন আলেয়াকে। রাজ্যের সমস্ত চিন্তা যেন ভর করেছে তার উপরে। আনমনে বসে আছে সে সরিষা ক্ষেতের আইলে। তার দৃষ্টি শূন্যের দিকে। উদাসীন কালো চোখ জোড়া কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে অবিরত। যাকে আর কখনই ফিরে পাবেনা সে। ফিরে পাবেনা আর তার সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে।

ভয়াবহ রকমের শীত পড়েছে এইবার। টানা সাতদিন সূর্যের দেখা মিলেনি আকাশে। সারাদিনই খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বেলে আগুন পোহাত ছেলে বুড়ো সবাই। সকালবেলা একহাত দূরের মানুষকে পর্যন্ত তখন দেখা যেতোনা কুয়াশার কারণে। মতি মিয়া খেজুর গাছ থেকে হাড়িভর্তি রস মাটিতে নামাতো একটু বেলা করে। মক্তব থেকে বাচ্চা ছেলেমেয়দের সুললিত কন্ঠে কোরান তিলাওয়াত শুনা যেতনা খুব একটা। অমন একটা সকালে আলেয়া খেয়াল করল তার দাদীর তখনও ঘুম ভাঙেনি। সেই ঘুম যে আর কোনদিন ভাঙ্গবেনা এমনটি কখনই ভাবেনি আলেয়া। ওই একজন মানুষের মৃত্যুই যেন তার সমগ্র জগৎকে এলোমেলো করে দিল। দাদীর শেষ ইচ্ছেটা তিনি দেখে যেতে পারলেন না। এটাই আলেয়ার সবচেয়ে বড় আফসোস।

আলেয়ার দাদীর মৃত্যুর পর কদম বেপারীর উৎপাত যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেল অনেক। দিনে তিনবেলা এখন আলেয়াদের বাড়ি আসে সে। আলেয়ার খোঁজ খবর নেয়। বাজার সদাই করে আনে তাদের জন্য। শুধু তাইনা বুড়ির কুলখানির জন্য আস্ত একটা ছাগল দান করেছে সে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী মাসেই আলেয়াকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে চায় সে। কদম বেপারীর এমন কর্মকাণ্ড লিটনের একদম অপছন্দ। তাকে কয়েকবার বুঝানো হয়েছে যে আলেয়া শুধুই তার। আলেয়ার বিয়ে তার সাথেই হবে। এই নিয়ে কয়েক দফা তুমুল ঝগড়াও হয়েছে তাদের মাঝে। কিন্তু বেপারী কিছুতেই হাল ছাড়ার পাত্র নয়। বরঞ্ছ দ্বিগুণ বেগে আলেয়ার প্রতি আরো বেশি উৎসাহিত হচ্ছেন তিনি।
এত কিছু হচ্ছে! গ্রামে কত কথা রটাচ্ছে কদম বেপারী। অথচ আলেয়ার মুখে কোন ভাষা নেই। কোন কিছুর প্রতিবাদ করছেনা সে। তবে কী সে নীরবে কদম বেপারীকে সমর্থন করে যাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়না লিটন। তবে যা করার তাই করবে সে। পাগলের মাথায় যখন রক্ত উঠে তখন তাকে বেঁধে রাখা যায়না। দরকার হলে গ্রামে রক্তের বন্যা বইয়ে দিবে সে।

এক সপ্তাহ পর কথা ফুটল আলেয়ার মুখে। গ্রামের যাকেই পাচ্ছে তাকেই জিজ্ঞেস করছে লিটনের কথা। কিন্তু কেউই বলতে পারছেনা সে কোথায়। ভয়ে আলেয়ার মুখ পাংশু বর্ণ হয়ে গেছে। যখন সন্ধ্যা নামল তখন যেন তার দাদীর আশীর্বাদে তার দেখা পেল আলেয়া। নিতাই এর বুকে মাছ চাষ করা জেলেদের একটা টঙ এর উপর শুয়ে আছে সে। তাকে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে তাকে শক্ত করে ধরল আলেয়া।
আপনি এমন কাজ করতে গেলেন ক্যান? এখন পুলিশ আপনেরে খোঁজতেছে।
জানে তো মারি নাই। ভয় নাই। পুলিশে নিলেও সাজা দিয়া আবার ছাইড়া দিবো একসময়।
আমি অতকিছু বুঝিনা। আপনারে এখন গ্রাম ছাইড়া পালাইয়া যাওন লাগবো। কদম বেপারীর অবস্থা ভালা না। শুনলাম মারাও যাইতে পারে।
আমি পারমুনা গ্রাম ছাইড়া পালাইতে। যা হবার তা হইব। পুলিশে ধরব, কাটবো, মারবো, ফাঁসি হইবো। তবুও এই গ্রাম ছাইড়া যামুনা কোথাও আমি। তোমারে ছাড়া আমি কোথাও যাইতে পারমুনা।
আমারে ছেড়ে যেতে বলেছে কে! আমি কি তোমাকে একা ছাড়মু নাকি আর। কি না কি কইরা বস আবার!
লিটন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলনা। তার চোখে মুখে হাঁসির ঝিলিক বইতে লাগলো। পরম নির্ভরতায় আলেয়া লিটনের হাতদুটো ধরল শক্ত করে। সেই রাতেই নিতাই এর তীর ধরে তারা হেঁটে যেতে লাগলো দূরের কোন অজানা যাত্রায়। পিছনে পড়ে রইল চাঁদের আলোয় ঝলসানো বিস্তীর্ণ মাঠ আর প্রান্তর। দূরের লক্ষ্মী পেঁচা দুটিই কেবল মুহূর্তটির সাক্ষী হয়ে রইল। একসময় তারা চলে গেল দৃষ্টি সীমানার বাইরে। তারা তখন হেঁটে এসেছে অনেকটা পথ। তাদের হাত দুটো তখনও ঝুলছে একসাথে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ শামছুল আরেফিন ম্যারিনা নাসরীন সীমা আপু, অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার এত বড় গল্পটি পড়েছেন এবং কমেন্ট করেছেন বলে। আপনাদের সামান্য ভাললাগাই আমার জন্য অনেক অনুপ্রেরণা।
মোঃ শামছুল আরেফিন মুকুল ভাইয়া আপনার কমেন্ট আমার সবসময় ভাল লাগে। প্রতিবার আপনি আমার ভুলত্রুটি গুলো ধরিয়ে দেন। তাই আপনার কমেন্ট এর প্রতীক্ষায় থাকি। কিন্তু এইবার আমাকে সেইদিক দিয়ে ফাঁকি দিলেন। তবুও আমার গল্প যে পড়েছেন এবং কমেন্ট করেছেন এবং আমার গল্পকে পূর্ণতা দান করেছেন তার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ম্যারিনা নাসরিন সীমা তোমার লেখা আমার সবসময় ভাল লাগে এটাও তার ব্যতিক্রম নয় ।সাবলীল উপস্থাপনা । গ্রামের ছোট ছোট বিষয় গুলো উঠে এসেছে । শুভকামনা রইল ।
মনির মুকুল গ্রামীণ জীবনযাত্রা প্রকৃতির সবচেয়ে বড় অংশ। এই গ্রামীণ পরিবেশের প্রতি আমার দুর্বলতা সব সময়ই থাকে। অথচ নানান ঝামেলার কারণে সেই কাঙ্ক্ষিত ‘গ্রাম-বাংলা’ সংখ্যাতেই আমি লেখা পড়তে পেরেছি অনেক কম। আপনার লেখায় প্রকৃতির বর্ণনাগুলো সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে, তাই ধরেই নিয়ে... আরও দেখুনগ্রামীণ জীবনযাত্রা প্রকৃতির সবচেয়ে বড় অংশ। এই গ্রামীণ পরিবেশের প্রতি আমার দুর্বলতা সব সময়ই থাকে। অথচ নানান ঝামেলার কারণে সেই কাঙ্ক্ষিত ‘গ্রাম-বাংলা’ সংখ্যাতেই আমি লেখা পড়তে পেরেছি অনেক কম। আপনার লেখায় প্রকৃতির বর্ণনাগুলো সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে, তাই ধরেই নিয়েছিলাম এই সংখ্যায় আপনার লেখাটা পড়তে না পারলে কখনোই পূর্ণতা আসবে না। অবশেষে সেই ক্ষণটা পার করলাম। বরাবরের মত এবারও মন ছুঁয়ে গেল। আলেয়ার চরিত্রটা বেশ ভালো লাগলো। বিশেষ করে লিটনের জীবন-জীবিকায় পরিবর্তন আনার জন্য তার কথাগুলো বুদ্ভিমত্তার পরিচয় দেয়। আপনার লেখনী আপনাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে তা বলতে দ্বিধা নেই মোটেও।
মোঃ শামছুল আরেফিন সোহেল সামি...... ভাই গল্প পড়ে যদি সত্যিই যদি অসাধারণ লেগে থাকে তবেই আমি ধন্য। ধন্যবাদ আপনাকে।
মোঃ শামছুল আরেফিন প্রজ্ঞা আপু শেষ পর্যন্ত আপনার দেখা পেলাম তাহলে আমার গল্পে। চেষ্টা করেছিলাম ভাল লিখতে। আপনার কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়ে ভাল লাগলো।
মোঃ শামছুল আরেফিন ভাই খোরশেদ আলম এবং আপু প্রজাপতি মন অনেক ধন্যবাদ গল্পে এসেছেন বলে।
প্রজ্ঞা মৌসুমী গ্রামের বর্ণনাগুলো এত সুন্দর হয় তোমার গল্পে। লিটনের "নিজেকে পাল্টানোর প্রতিজ্ঞা' আর চেষ্টা মুগ্ধ করেছে; শেষটা খুব ভালো লেগেছে। শুভকামনা থাকলো।

৩১ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪