হাবিলের বাবা রিক্সা চালায় । সেটা নিয়ে হাবিলের কোন আক্ষেপ নেই । আক্ষেপ একটাই, তার বাবা তাকে আদর করে না । হাবিলদের সাথের ছলিমের বাবাও রিক্সা চালায় । কিন্তু ছলিমের বাবা প্রতি রোজার ঈদে তাকে শার্ট, প্যান্ট আর জুতা কিনে দেয় । হাবিলের বাবা দেয় না । হাবিলের গায়ে এখন যে গ্যান্জ্ঞিটা আছে সেটা সে চুরি করেছিল একটা বাসার বারান্দা থেকে । কাপড় ধুয়ে শুকাতে দিয়ে বুয়া যখনই ভেতরে ঢুকল, তখনই হাতটা বাড়িয়ে নিয়ে নেয় হাবিল । গ্যান্জ্ঞিটার গায়ে টম এন্ড জেরি আঁকা । কিন্তু সে এগুলোর নাম জানে না । শুধু অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখে । যেদিন প্রথম সে গ্যান্জ্ঞিটা পরে ওইদিন তার সাথের সব ছেলেরা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল । তখন হবিলের মনে একটা অহংভোধ হয় । গ্যান্জ্ঞিটা পরতে পরতে এখন বেশ নোংরা হয়ে গেছে । আর একটা থাকলে সুবিধা হত । মাঝে মাঝে হাবিলের মন চায় জামা চুরি করতে । কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা করে, চুরি করবে না । সে জানে চুরি করা পাপ কাজ । পরনের প্যান্টটা অবশ্য চুরি করা না । সে একবার একটা হোটেলে কাজ পেয়েছিল । রাস্তার পাশের ছোটখাট খাবার হোটেল । ওখানে কাজ করতে গিয়ে আগের প্যান্টটা ছিঁড়ে যায় । তখন হোটেলের ম্যানেজার তাকে একশ টাকা দিয়ে বলে 'যা একখান ফ্যান কিননা ল' । সে সত্তর টাকা দিয়ে একটা প্যান্ট কিনে নেয় এক ভ্যানওয়ালা থেকে । ভাল জিনিস । গার্মেন্টেসের রিজেক্টেড মাল । এইগুলোর ভাল কপি বড়লোকের ছেলেরা পরে । কিন্তু আজ হাবিলের নিজের বাবার প্রতি খুব রাগ হচ্ছে । অনেকদিন থেকে বাবাকে বলছে এবার ঈদে নতুন জামা কিনে দিতেই হবে । কিন্তু তার বাবা কথাটা কানেই তুলে না । কালকের পরদিন ঈদ । তার সাথের অন্য ছেলেমেয়েদের বাবা মা কিছু না কিছু কিনে দিয়েছে । হাবিলের মা নেই । বাবার কাছে চাইলেও বাবা দেয় না । রাতে শুয়ে শুয়ে আকাশ কুসুম চিন্তা করা হাবিলের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে । প্রায় রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবে সে একটা হোটেলের মালিক । হোটেলে নানান লোকের আনাগোনা । প্রচুর বেচা বিক্রি । মাঝে মাঝে কিছু সুন্দরী মেয়েও খেতে আসে । ভাবতে ভাবতে হাবিল গুমিয়ে পড়ে । রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে থাকে সে । একটা পুরোনো কাঁথা আছে তার । ওটা বিছিয়ে শুয়ে পড়ে । আর ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে । সকালে স্টেশনের গেটম্যানের পুঁ পুঁ বাঁশির শব্দে আর লাঠির দাবড়ানি খেয়ে ঘুম ভাঙ্গে । একটা সাদা প্লাস্টিকের বস্তায় কাঁথাটা ঢুকিয়ে হালিমা খালার বস্তিতে রেখে আর একটা বস্তা নিয়ে বের হয় । আগের দিনের আট-দশ টাকা যা থাকে সেটা দিয়ে একটা কলা আর একটা রুটি খায় । মাঝে মাঝে তার চা খেতে ইচ্ছা করে । টাকার সংকুলান হলে সে চা খায় । চা খাওয়ার সময় সে খুব শব্দ করে চুমুক দেয় । এটা সে ইচ্ছা করেই করে । আশেপাশের লোকজনকে জানান দেয় যে সে চা খাচ্ছে । আগামীকাল ঈদ । তাই আজকে একটু বেশি ইনকাম করা লাগবে । প্রতিদিন কাগজ প্লাস্টিক বেচে সে ষাট সত্তর টাকা পায় । কিন্তু আজকের টার্গেট একশ । অবশ্য ঈদের মৌসুমে খাবার নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হয় না । শহরের বড় বড় মানুষগুলো তখন বস্তিতে খাবার বিতরণ করে । এ সময় বেশ ভাল খাওয়া দাওয়া হয় । কিন্তু আজ সে ভাবছে একশ টাকা জমাতে পারলে একটা জামা কিনবে । বাবা কিনে দিক বা না দিক নিজেই এখন কিনতে পারে সেটা সে দেখিয়ে দেবে । খুব ভোর বেলাতেই বেরিয়ে পড়ে সে । বেরুনোর সাথে সাথে বেশ খানেক কাগজ একসাথে পেয়ে যায় । আনুমানিক দুই কেজি তো হবেই । দিনটা ভালই যাবে মনে হয় । কাগজ আর প্লাস্টিক দশ কেজির মতো জমাতে পারলে সে একশ টাকা পাবে । কাগজ খুঁজতে খুঁজতে সে অনেক দূর এসে পড়ে । সে ভাবে যা জমেছে তা তো পাঁচ-ছয় কেজি হবেই । এখনো সবে মাত্র সকাল । সারাদিন পড়ে আছে । এবেলা এগুলো বিক্রি করে কিছু খাওয়া দরকার । সে তার মহাজনের দোকানে যায় বিক্রি করার জন্য । কিন্তু মহাজনের দোকানের সামনে এসে ওর মাথায় যেন বাজ পড়ে । কাল ঈদ তাই দোকান বন্ধ করে মহাজন বাড়ি চলে গেছে । সে আশেপাশের দোকান গুলোতে ছুটে যায় । নাহ্ সব দোকান বন্ধ । সে মাটিতে বসে পড়ে । প্রবল বেগে কান্না আসে । জমানো কাগজ প্লাস্টিক কেনার মত কেউ নেই । সে এ কাজে নতুন । তাই তার জানা ছিল না যে ঈদের আগের দিন দোকান বন্ধ থাকে । সকল আশা ভেঙ্গে যায় তার । হাবিলের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে থাকে । সে অনেক কষ্টে কান্না থামায় । সে ভাবে, তার জামা কেনার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে । হঠাত একটা জামা চুরির কথা মনে পড়ে । কিছু করার নেই । পরদিন যখন সবাই নতুন জামা পরবে তখন সে পুরোনো জামা পরে থাকলে মুখ দেখাবে কিভাবে । চুরি করার উদ্দেশ্যে সে একটা এলাকায় ঢুকে পড়ে । ঘুরতে ঘুরতে হঠাত একটা বাড়ির সামনে এসে তার চোখ আটকে যায় বাড়িটার দোতলার বারান্দায় । সুন্দর একটা শার্ট শুকাতে দেয়া । হাবিল ভাল পাইপ বাইতে জানে । পাইপ বেয়ে তরতরিয়ে দোতলায় উঠে পড়ে । সে শার্টটা টেনে হাতে নেয় । ভাবে ওটা তার সাইজেরই হবে । তাড়াতাড়ি নেমে আসে শার্টটা নিয়ে । শেষ ধাপে লাফ দেয় । সাথে সাথে বাড়ির দারোয়ান খপ করে ধরে ফেলে তাকে । অকথ্য গালি আর চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে । তাকে একটা মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে বাড়ির সামনের রাস্তায় ফেলে রাখে । লোকজনের ভীড় বাড়তে থাকে । কেউ কেউ তাকে দু'চারটা লাথি আর কিল দিতে থাকে । সে যেন একটা রাস্তার কুকুর এমন নির্মম ভাবে মারতে থাকে । অঘাতের দরুন শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত জমে কালো হয়ে যায় । কিছু জায়গা কেটে গিয়ে রক্তও বের হয়ে আসে । বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে সে । সারাদিনে একটা কলা আর একটা রুটি ছাড়া কিছু খাওয়া হয়নি । অসহায় হাবিল পড়ে থাকে রাস্তায় । সারা শরীর কাঁপতে থাকে । লোকজনের ভীড় ক্রমে কমে যায় । দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয় । কিন্তু তখনো তাকে ছেড়ে দেয় না । সন্ধ্যাবেলার দিকে দারোয়ান এসে ছেড়ে দিয়ে বলে 'কাইল ঈদ । তাই ছাইরা দিলাম । আর কুনুদিন এ কাম করবি না' । হাবিল উঠে দাঁড়ায় । আবার থপাস করে পড়ে যায় । বড় অসহায় ভোধ করে । অনেক কষ্টে আবার উঠে দাঁড়ায় । আশপাশের বাড়ি গুলোর দেয়াল ধরে ধরে হাঁটতে থাকে । কিন্তু বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হয় । একসময় হামাগুড়ি দিতে থাকে । রাস্তার পাশে শুয়ে পড়ে । আর শক্তি কুলোয় না । হঠাত হাবিলের খুব কান্না পায় । ক্ষুধা বা শরীরের যন্ত্রনার জন্য নয় । হাবিল ভাবে, কাল ঈদ ।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খন্দকার নাহিদ হোসেন
বাহ। গল্পের হাবিবের ছেলেমানুষি মনটার বর্ণনা গল্পকার এতো সুন্দর করে বলছে যে আমি যেন ছেলেটাকে দেখতে পেলাম। এই গল্পটার জন্য ৫ কম হয়ে গেলো। সৌরভ, এ ভুবনে স্বাগতম আর লেখালেখি যদি না থামাও এবং যদি ভাগ্যটা খুব খারাপ না হয় তো তুমি অনেক উপরে উঠবে। দোয়া রইলো।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।