নিষ্ঠুর নীরবতা

গ্রাম-বাংলা (নভেম্বর ২০১১)

risha naznin
  • ১৮
  • 0
  • ২৯
অনেকবার যাই যাই করেও দাদু বাড়ি যাওয়া হয়নি । পাঁচ বছর বোধ হয় হয়ে গেছে গ্রামে যাওয়া হয় না । শেষ বার যখন গ্রামে গিয়েছিলাম তখন বোধ হয় আমার বয়স ছিল এগার কি বারো । শহরের এই ব্যাশ্ত জীবনের মাঝে গ্রামে যাউয়ার জন্য একটু সময় বের করাও দায় । তারপরও এস এস সি পরীক্ষার অবশেষে গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা ভালো ভাবেই নেয়া হল । আমার পিচ্চি বোন ইরা তো গ্রামে যাওয়ার জন্য অনেক উৎসুক ছিল কারন ও যখন গ্রামে গিয়েছিল তখন ওর বয়স ছিল তিন কি চার । তাই বলতে গেলে এটাই ওর প্রথম দাদু বাড়ি যাওয়া ।
আমার দাদু নেই। তাকে আমি কখনো দেখি নি । আমার জন্মের অনেক আগেই তিনি গত হয়েছেন । দাদু বাড়িতে এখন বলতে গেলে এখন কেউ নেই । আছেন আমার বুড়ো দাদী ,যার বয়স এখন নব্বই এর কোঠায় । তিনি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। আর আছেন আমার বড় চাচা আর চাচী আর তার দুই ছেলে মেয়ে। তাও তো ভাইয়া ভার্সিটিতে উঠার পর তিন বছর হল ঢাকায় থাকে । আর বাকি সব চাচা ফুপুরা ঢাকায় বসতি গড়েছেন । তিনি একাই গ্রামে আছেন । আমার দাদু বাড়ি বলতে গেলে একদম গ্রাম এলাকার ভেতরে । তাই বলতে গেলে শহরের মানুষদের জন্য থাকা একটু কষ্ট কর ।
অবশেষে শনিবার দিন ভোঁর বেলা আমার গ্রামের উদ্দেশে রউনা হলাম । মাইক্রতে বসে এসির বাতাসে অনেক আরামেই যাচ্ছিলাম কিন্তু এর মাঝেই সকল শান্তি ধূলিসাৎ করে ড্রাইভার আঙ্কেল বললেন, “ সামনে রাস্তা অনেক চাপা এখান দিয়ে গাড়ি ঢুকবে না ।” কি আর করা গাড়ি থেকে নামলাম। সাথে সাথে সূর্যের উত্তপ্ত রশ্মি আমার উপরে এসে পরল । দুটো রিক্সা ভাড়া করা হল সেখানে আমাদের মালপত্র সমেত আমরা উঠলাম । রাস্তার দু পাশেই খাদ । আমারা একটু ভয় ভয় লাগছিল। তার মধ্যে আবার উঁচু নিচু রাস্তা । যাই হোক এত কষ্টের পর অবশেষে আমরা দাদু বাড়িতে এসে পৌছলাম । চাচা চাচী আমাদের দেখে কাছে আসলেন । চাচী আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন , “ ভালানি? কত দিন পরে আইছ তোমরা ।আমগর কথা তোমগর মনে পরে না? আমরা তো সব সময় তোমগোর কথা কই।” আমি একটু ভদ্রতার হাসি দিয়ে বললাম , “চাচী আপনারা ভালো আছেন?” চাচী আদরের সুরে বললেন, “জী চাচী । আমরা ভালা আছি ।”
এরপর ভেতরে গেলাম । দাদীকে সালাম করলাম । বার্ধক্য বেড়ে গিয়েছে দাদীর । তারপরও দাদী কিছুক্ষন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বিভিন্ন রকমের দোয়া করলেন । আমার চাচাতো ভাই বোনদের সাথে দেখা হল । আমার চাচাতো বোনটাকে তো চিনতেই পারলাম না । পাঁচ বছর অনেক কিছু বদলে গেছে । আমার আসার পর পরই আসে পাশের বাসা থেকে মানুষ আসা শুরু করলো আমাদের দেখার জন্য । লক্ষ্য করলাম আম্মু সবাইকেই চিনে । কিছু কিছু মহিলা অন্যদের বলছে , “এই সেই ভাবি যার কথা কইছিলাম” । কিছুক্ষন পর আমি আমার মায়ের বিশেষত্ব বুঝতে পারলাম । আম্মু একজন শিক্ষিত চাকুরীজীবী মহিলা । তাই এই গ্রামের মহিলারা তাকে একজন জ্ঞানী গুণী মানুষ হিসেবে গণ্য করেন । কিছু মহিলা এসে আমাকে বলতে লাগলেন , “কত্ত ছোট্ট দেখছিলাম গো তোমারে । কত্ত বড় হইয়া গেছ ।আমারে চিন্তা পারছ? ” কিন্তু দুর্ভাগ্য বসত আমি কাউকেই চিনতে পারছিলাম না ।
দুপুরে খাওয়ার সময় আপ্যায়নের কোন কমতি রাখেননি চাচী। তিনি আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন এর বললেন। “খাউ মা খাউ । শহরের মানসে দি খাইতেই পারে না” আর আমি আমার প্লেটের উপর রাখা ভাতের স্তূপটা দেখে ভাবছিলাম এটা কি আমার পক্ষে গলধকরন করা সম্ভব । তবে এই খাবারের মধ্যে যে ভালোবাসা ছিল সেটা অনুভব করতে অনেক বেশি ভালো লাগছিল । অনেক ক্লান্ত ছিলাম সে দিন ।তাই দিনটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম । রাতে ভাইয়া বলল পর দিন যেন ভোঁরে ঘুম থেকে উঠি । ভোঁরের গ্রাম নাকি অনেক সুন্দর ।
পর দিন ভোঁরে ঘুম থেকে উঠলাম কেবল ভোঁরের আলো ফুটবে ফুটবে। উঠানে গিয়ে দাড়ালাম । কিছুক্ষন পর টক টকে লাল সূর্যটাকে দেখা গেল পূর্বের দিগন্তে । কি অপূর্ব ! শহরের মানুষের পক্ষে তো লাল সূর্য দেখা দুরহ ব্যাপার । শহরের বিরাট দালান কোঠা পার হয়ে সূর্যটা দৃশ্যমান হতে হতে সেটা হলুদ রঙ ধারন করে । চাচা চাচী ঘুম থেকে উঠে পরেছেন।আম্মুও উঠে পড়েছে চাচী আমাদের চা বানিয়ে খাওয়ালেন ।
দেখতে দেখতে দিনটা কেটে গেল । বিকেল বেলা দেখলাম আম্মু, চাচী আর কয়েক জন মহিলা বসে গল্প করছেন । আম্মুর পাশে দেখলাম একজন মহিলা বসে আছেন যিনি সবে মেয়ে থেকে মহিলা হয়েছেন । মানে বয়স তার বোধ হয় আমার সমান কিন্তু তার বিয়ে হয়ে গেছে। সেই মেয়ে বয়সি মহিলাটি আম্মুকে বলল, “আহারে আফা, আপনের কুনো ছেলে নাই।”
আম্মু বলল, “তো কি হয়েছে । এখন তো এর মেয়ে ছেলে পার্থক্য নেই । আমার ছেলে থাকলে যা করত আমার মেয়েরাও তা করতে পারে। আমি মেয়ে ছেলে পার্থক্য করি না ।” আম্মুর উত্তরটা মহিলাটির কাছে যে একটুও গ্রহনযোগ্য মনে হল না বোঝা গেল ।
কিছুক্ষণ পর ভাইয়া এলো । আমাকে এর ইরাকে বলল, “চল তোমাদের গ্রাম ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।” ভাইয়ার সাথে আমি আর ইরা বেড়িয়ে পড়লাম গ্রাম দেখতে । খোলা আকাশ নির্মল বাতাস সব কিছুই কেমন যেন সাহিত্যময় । জসীমউদ্দিন এর কথা মনে পরে গেল । তিনি যে কেন সারা জীবন পল্লী নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন সেটা বুঝতে পারছিলাম । ভাইয়া আমাদের ধান ক্ষেতে নিয়ে গেল , আমার বাশের সাকো পার হলাম । আমার খুব ভয় করছিল । ইরাকে ভাইয়া কোলে করে পার করলো । একটা পিচ্চি দেখলাম লাফিয়ে লাফিয়ে সেই সাঁকো পার হয়ে গেল ।
হাঁটতে হাঁটতে একটি বাড়ির সামনে এসে ভাইয়া দাঁড়াল । দেখলাম বাড়ির উঠোনে দুই জন বুড়ো বুড়ি বসে আছে । বুড়ো লোকটির একটি হাত নেই । বুড়ো বুড়ির দিকে তাকিয়ে ভাইয়া বলল, “এই লোকটা একজন মুক্তিযোদ্ধা বুঝছ। যুদ্ধে তিনি তার একটা হাত হারিয়েছেন তার বাবা মাকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্থানীরা । তার এক মাত্র বোনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো । যুদ্ধের পর তিনি বিয়ে করেন । অনেক কষ্টে তিনি তার এক মাত্র মেয়ের বিয়ে দেন। আর এখন ঐ পোষা গরু আর মুরগি দিয়ে যা আসে তা দিয়ে বুড়া বুড়ির দিন চলে । তবে তিনি সহজে কাউকে বলতে চান না যে তিনি মুক্তিযোদ্ধা। ” আমি বললাম, “কেন?” ভাইয়া বলল , “তার ভাষ্যমতে ,এত কষ্ট করে দেশ স্বাধীন করলাম আমরা আর গাড়িতে পতাকা লাগায়ে মুক্তিযোদ্ধার খেতেবে ঘুরে রাজাকাররা । নিজেকে মুক্তি যোদ্ধা বলতে নিজের কাছেই খারাপ লাগে।”
“সরকার থেকে কোনও সাহায্য পায় নি?”আমি বললাম ।
“সরকার আর সাহায্য” ব্যাঙ্গাত্বক একটা হাসি দিল ভাইয়া ।
ইরা সাথে সাথে প্রশ্ন করলো, “কেন আপি? সরকার সাহায্য করে না কেন? উনি না মুক্তি যোদ্ধা । উনাদের জন্য না আমরা স্বাধীন বাংলা পেয়েছি ।আমি তো বইয়ে পড়েছি।”
ইরা ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছে যে, “মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম ত্যাগের ফলে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি , মুক্তিযোদ্ধারা ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা । ” কিন্তু আজ সেই মুক্তিযোদ্ধাদেরই এক জনের এই নির্মম অবস্থা দেখে ইরার ছোট মন সেটাকে মেনে নিতে পারছে না । বাস্তবতা যে বড়ই কঠিন। আমি ভাবলাম, কেন আমরা একটু উদ্বিগ্নতা দেখিয়ে সরকারকে দুটো গালি দিয়ে আমার আবার এটাকে সহজ ভাবে মেনে নেই । আমাদের কি আর কিছুই করার নেই । বাস্তবতা কি আসলেই অনেক কঠিন । নাকি আমাদের এই নিষ্ঠুর নীরবতা একে কঠিন বানিয়ে ফেলছি ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
sakil ইরার মত আমরা ও কি মেনে নিতে পারি এমন কিছু
রোদের ছায়া অনেক কথা সুন্দর করে বলেছ গল্পটিতে, কিন্তু গ্রামের নামটিও যদি উল্লেখ করতে আরো বেশি ভালো হত/ অনেক ভালো লাগলো.
সালেহ মাহমুদ risha নাজনীন খুব ভালো লাগলো | লিখে যাও আরো আরো অনেক লেখা লিখতে হবে এবং সফল হবে | ধন্যবাদ |
সূর্য গল্পে পরিণতি (যাকে বা যে ঘটনাকে আশ্রয় করে গল্পটা) খুব বেশি প্রয়োজন। গল্প সুন্দর হয়েছে, শেষের খোঁচাটা অনেক স্থুলভাবে আমার এবারের গল্পেও আছে। আসলে আমরা লেখকদের- এর চেয়ে বেশি কিছুই করার নেই। গল্পগুলো আরো পরিণত হয়ে আমাদের কাছে আসুক সেই কামনায় ভোট করলাম।
ঘাসফুল খুব ভালো।
প্রজাপতি মন অনেক ভালো লাগল গল্পটি । যেন জীবন থেকে তুলে নেওয়া।
M.A.HALIM মিষ্টি ভাষায় খুব সুন্দর করে দেশ -জাতি ও সমাজের প্রতি একটা ম্যাসেজ বন্ধুর গল্পে ফোটে উঠেছে। শুভ কামনা বন্ধুর জন্য। ঈদ মোবারক।
Lutful Bari Panna লেখাটি ভাল লাগল। বাস্তবতা সত্যি কঠিন। কারণ ঔদাসীন্য নয়। আমাদের সবকিছুতে পচাগলা রাজনীতি ঢুকে গেছে। কে মুক্তিযোদ্ধা কে নয় সেটাও নির্ধারিত হয় স্বার্থ আর রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশে।

২৪ জুন - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪