গাড়ি ছাড়ার কথা সোয়া দশটায়। মফিজ ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়ির কাটা থেমে নেই। পৌণে বারটা বাজে। ঈদ! তাই বলে এত সময়!! না এটা মানা যায় না। মাথার ভেতোরটা রে-রে করে উঠল। রাগে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। তেড়ে গেল কনডাকটরের কাছে। কনডাকটরকে দেখে,তার রাগ এমনি এমনি মাটিতে গড়িয়ে পড়বে, সে ভাবতেই পারেনি।
খুউব আস্তে করে বলল,বড় ভাই, আর কত দেরী?
কনডাকটর বত্রিশ দাঁত বের করে বলল, কই আর হল.....এখনও সিরিয়ালের অনেক দেরী।
মফিজের রাগটা আবার বৃদ্ধি পেল।কিন্তু প্রকাশ ঘটাল না। মনে পড়ে গেল,এর আগের ঘটনায়,তার দুটি দাঁত হারিয়ে গেছে। শুধু মাথাটা নিচু করে নিল।
মফিজ ঘড়ির দিকে আবার তাকাল। ঘড়ি তাকে জানিয়ে দিল, এখন সোয়া একটা। পেটটা মোচড় দিয়ে উঠল। পিপাসাটা এমনভাবে তাকে জানিয়ে দিল যে,এক কলস পানি তার গলধঃকরণ করলেও পিপাসা মেটবে না। সামনে পানের দোকান। সেখানে পান পাওয়া যায়।কিন্তু পানি! তবুও মফিজ এগিয়ে গেল। আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল,বড় ভাই, একটু পানি....
জ্বি না,পান আছে।দেব?
তাই দিন।
মফিজ পান পেয়ে ছাগলের মত চিবুতে লাগল। তার মনে হল, এটা পান নয়;যেন অমৃত সুধা।মুখ হতে কোনরুপ পিক না ফেলে,সমস্ত টুকুই গিলে ফেলল। মুখ হতে এমনি এমনিই বেরিয়ে এল,এ যাত্রা বাঁচা গেল!
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মৌওলনা সাহেব বললেন, নির্লজ্ব দেখেছি,কিন্তু আপনার মত নির্লজ্ব দেখিনি! এমন ভাবে পান চাবাচ্ছেন,দেখে ত মনে হচ্ছে,আস্ত একটা ভেঁড়া।রোজার মাসে এ অভ্যাস পরিহার করা উচিত।
মফিজের বোধ হল। সে ও ত রোজা আছে!তবে!পরক্ষনেই বোধটা হারিয়ে গেল। মনে মনে বলল,খাব.....পান খাব আরও বেশী করে খাব। শালা ঘুস খাব, সুদ খাব, রোজাও খাব,সব খাব! বলেই মফিজ দোকানীকে বলল, বড় ভাই, আর একটা পান দিন ত। এবার বেশী করে মসলা দিবেন। দু’টাকা বেশী দেব।
দু’টাকা নয়;পনের টাকা লাগবে।এমন মসলা দেব না........এক দমে বাড়ি।
তাই নাকি ? তাই দিন।
মৌওলনা সাহেব ছি: ছি: রবে,মফিজের পাশ হতে চলে গেল। মফিজ তার সংগ্রহে থাকা ত্রিশটি দাঁত বের করে হাসতে লাগল।
দোকানী বলল, হাসছ কেন ভাই, ধর্ম হাসি তামাশার বিষয় নয়।
শালা মাথায় টুপি পরে ওজু করতে করতে যদি ঘুষের টাকা গ্রহণ করে ধর্ম হয়,তবে পান খেয়েও হবে। দাও দাও, তাড়াতাড়ি পান দাও।
মফিজদের জীবনটা বোধ হয় এ রকমই হয়। মাঝে মাঝে মফিজ তার নাম নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায়। তখন তার খুব রাগ হয়।বাবা-মাকে গালিগালাজ করে। বলে, দুনিয়াতে এত সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে আর তার বাবা-মা কিনা বেছে বেছে মফিজ রেখেছে। শালা কর্মটাও যদি ভাল হত!করি ত পিয়নের চাকরি!!
মফিজের কোনো ছেলে-পুলে নেই। সংসারটাও ভালভাবে যায় না। মোটে একত্রিশ শ পঞ্চাশ টাকা বেতন ।মাষ্টাররোলের চাকরী। চাকরীটা পারমামেন্ট হলে বেতনটা বাড়ত। বস বলে, হয়ে যাবে, হয়ে যাবে।কিন্তু এ করে পাঁচ বছর বেরিয়ে গেল,কোনো ব্যবস্থায় হল না।
মফিজ যেদিন চাকরিটা পেল,তার এক সপ্তাহ পরেই বিয়ের প্রস্তাব এল। জীবনে প্রথমবার তাকে, সে মনে করেছিল,সেও দামি লোক! মফিজ দেরী করেনি। বিয়ের প্রস্তাবের তিনদিনের মাথায় রেহেনা বেগমকে বিয়ে করল।
এ পাঁচ বছর বিবাহিত জীবনে রেহেনা বেগম, মুখফুটে কখনই কিছু চায়নি। আবার চায়নি বলেলও ভুল হবে। তার চওয়াটা ছিল অন্যরকম। যেমন বলত, আজ অমককে দেখলাম, হাতে ঝুলিয়ে ইলিশ মাছ নিয়ে যেতে। বাজারে ইলিশের অনেক দাম! তাই না গ ? মফিজ বোঝ ত । সবই বোঝ ত। কিন্তু ইলিশ কেনার সামর্থ তার নেই।
এ রকম চাওয়ার মধ্যে ছিল, জামদানি শাড়ি। ঈদ এলেই বল ত, পল্টুর বৌ, এবারও জামদানি নিয়েছে। কী রুচি! বারবার একই শাড়ি নিতে হয়! কিন্তু মফিজ বোঝ ত, পল্টুর বৌ জামদানি শাড়ি নেয়নি। পল্টু তার চাইতে একটু বেশী ঘুষ পায় বটে; কিন্তু তারও ত তার মত ভালভাবে সংসার চলে না।
মফিজের কাছে এবারের ঈদটা অন্য রকম। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত। তার হাতে যখন নগদ চারহাজার টাকা এসে পড়ল; তার মুখ হতে অনেক্ষণ কথা বের হয়নি।শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্য দেখেছে। বারবার দেখেছে। না, সূর্য ঠিকই আছে,ঠিক দিকেই উঠেছে।
তার বস, সরদার জমির উদ্দিন নতুন তাবলীক হয়েছে। মাথায় টুপি পরে থাকে সবসময়। ঘুষের টাকা গুলো দান করে দিয়েছে না,সে টাকাতে তার দিন চলে,সেটা জানবার আগ্রহ মফিজের নেই। সে নগদ চার হাজার টাকা পেয়েছে এটাই তার কাছে বড় বিষয়।
মফিজ চার হাজার টাকা পেয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল;অনেকক্ষণ পর তার চেতন এল।তার মনের মধ্যে একটু একটু করে আনস্দের বিস্তার ঘটল।তার আনন্দ আর ধরে না। তার মাথায় একটা চিন্তায় ঘুরপাক খেতে লাগল। কখন অফিস ছুটি হবে। অফিস ছুটি হলেই সোজা বাজারে।তারপর বৌ এর জন্য ঢাকাই জামদানী!
বস জমির উদ্দিন মফিজকে ডেকে বলল,যাও তোমার ছুটি।মার্কেটে যাও,ঈদের মার্কেট কর;আগামীকাল বাড়ি রওনা দিয়ে দাও।
মফিজ কিছুই বোঝে উঠতে পারল না।তার আত্ম জিজ্ঞাসা, বস কী বেশী মৌলবী হয়ে গেছে?নাকি পাগল হয়ে গেছে?......মফিজ আর বেশি কিছু ভাবল না।সে যখন সুযোগ পেয়েছে আর দেরী করবে কেন?সে দেরী করেওনি।অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা মার্কেটে।
শাড়ির দাম কত হবে,মফিজের জানা নেই;তার জানার কথাও নয়।যে শাড়িটি তার পছন্দ হল,সে শাড়িটির দাম এগার হাজার পাঁচশ টাকা।দাম শোনে,তার জিহ্বায় যে টুকু জল অবশিষ্ঠ ছিল,তাও শুকিয়ে গেল।তার কাছে যে টাকা আছে,তা দিয়ে শাড়ি কেনা যাবে বটে;কিন্তু ঈদ আর আনন্দ হবে না!
অবশেসে মফিজ যে শাড়িটা কিনল,তার দাম দুই হাজার আটশ আশি টাকা।সঙ্গে একটা পাঞ্জাবিও কিনল, চারশ সত্তর টাকা দিয়ে।
পরের দিন সকালে সোজা রওনা দিল গাবতলি।সেখান থেকে বাস ধরে সোজা বাড়ি।কিন্তু বাসের বিড়ম্বনা,মফিজের কপালের হল কাল...........!
মফিজ পনের টাকা দামের পান মুখে দিয়ে,খুব তৃপ্তি সহকারে চিবুতে লাগল।পানটি তার এত ভাল লাগল যে,পানের প্রথম পিক না ফেলে,সে সমস্ত টুকুই গলধঃকরণ করল।তার শরীর আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে থাকল।এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ল।
মফিজের ঘুম ভাঙ্গল যখন;তখন পূর্ব দিকে সূযর্টা কেবল উঁকি দিচ্ছে।মফিজ নিজেকে একটা নির্জন ধান ক্ষেতে আবিস্কার করল।যেদিকে তাকায় সে দিকেই শুধু ধান ক্ষেত আর ধান ক্ষেত।দু চার পাঁচ মাইলের মধ্যে কোনো বাড়ি ঘর আছে বলে, তার মনে হল না।তার মাথাটা ঝিমঝিম করছে তখনও।অনেকক্ষণ সে ধান ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে রইল;সে বোঝে উঠতে পারল না,এখানে সে কী ভাবে এল।
মফিজ উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল।কিন্তু তার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল।বসে পড়ল।অনেকক্ষণ ধরে সে নিজেকে জানবার চেষ্টা করল; কিন্তু কোন ভাবেই সে বোঝে উঠতে পারল না,সে কে?কেন?বা কোথায়?
সূযর্টা অনেক ওপরে উঠে গেছে।তার প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে।মুখগহ্বরে যে অবশিষ্ঠ জল ছিল,তাও তা এখন নেই।ধান ক্ষেতের জল গুলো ছল-ছল করছে।সে লোভাতুর দৃষ্টিতে ধান ক্ষেতের জলের দিকে তাকিয়ে রইল।জল গুলোও যেন তাকে ডাকছে, নে প্রাণ ভরে আমাকে পান কর।মফিজ ধান ক্ষেতের জল ঠিক যেন গরুর মত করে পান করল।কিছুটা জল চোখে-মুখে দিল,মাথায় ছিটাল।আগের চেয়ে অনেক বেশী তাকে স্বাচ্ছন্দবোধ মনে হচ্ছে।সে আকাশের দিকে তাকাল।হাজারও চোখ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।প্রতিটি চোখই অনেক বড়।এত বড় চোখ,মফিজ এর আগে কখনও দেখেনি।সব চেয়ে বড় যে চোখ, সেটি মফিজের ঠিক চোখের উপর চোখ রাখল।তারপর সে জিজ্ঞাসা করল,মফিজ, তুমিএখন কোথায়?মফিজ কোনো উত্তর দিল না।সে আবার বলল, মফিজ, তুমি এখন কোথায়? মফিজ এবারও কোন উত্তর দিল না।সে এবার চিৎকার করে বলল, মফিজ, তুমি এখন কোথায়?মফিজ আস্তে করে বলল,জানি না.................!