তাহার নাম বাঘা।সেই ছোট বেলাই যখন লুলুদের বাসায় আসিল,লুলু তাহাকে দেখিয়া পছন্দ করিয়া ফেলিল।যদিও বাড়ির অন্য সদস্য সকল, তাহাকে পছন্দ করিল না;তবুও লুলু বাড়ির ছোট ছেলে বলিয়া, তাঁহার আবদার কেহু অবহেলা করিল না।বাঘা লুলুদের বাড়িতে রহিয়া গেল।বাঘা নামটি লুলুর মেঝ দাদা তহিদুর রহমানের দেওয়া।বাঘা দেখিতে বাঘের মত না হইলেও, তাহার আচার-আচরণ বাঘের মত বলিয়া, তাহার নাম বাঘা রাখা হইল।বাঘা ছোট বেলা হইতেই সারাদিন ঘুমাইত আর রাতের বেলা জাগিয়া, বাড়ি পাহারা দিত।ইহা দেখিয়া তাহার প্রতি সকলেরই দয়া হইল এবং তাহার আদর যত্ন বাড়িয়া গেল।
বাঘা খুব প্রভু ভক্ত এবং চতুর।প্রভুর আপদ-বিপদ যাহাতে না আসে সেই বিষেয় সদা সর্তক থাকিত।সারা রাত বাড়ির চারিদিক ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিত;নতুন কাহুকে দেখিলে ঘেউ ঘেউ করিয়া,প্রভুকে সতর্ক করিয়া দিত।সকালে সে সকালের নাস্তা খাইয়া নিজের ঘরে ঘুমাইয়া যাইত-এই ভাবেই তাহার দিন চলিয়া যাইতে লাগিল।
কার্তিক মাস।আশ্বিনের বৃষ্টির পানি গা শিন শিন পার করিয়া;কার্তিকে হালকা ঠান্ডা পড়িয়াছে।এরই মধ্যে বাঘা Puberty period পার করিয়াছে, কয়েক মাস হইল।তাহার শরীরে Sexual অনুভূতি একটু একটু করিয়া প্রকাশ পাইতে থাকিল। Sexual অনুভূতি তাহাকে তাড়া করিয়া বেড়াইতে লাগিল।রাত্রি জাগরণের পরেও দিনের বেলায় তাহার ঘুমের ব্যঘাত ঘটিল।কিন্তু বাঘা নিজেকে ছাড়া স্বজাতীয় অন্য কাহকেই দেখে নাই।তবুও তাহার মধ্যে প্রেম আকাংখা জাগিয়া উঠিল।
লুলুদের বাড়ির পাশেই রহিম বক্সের বাড়ি।এতদিন হইয়া গেল, বাঘা নিজ গৃহ ছাড়া, অন্য দিকে নজর দিবার ইচ্ছাই পোষন করে নাই।হঠাৎ করিয়াই আজ রহিম বক্সের বাড়ির দিকে, তাহার নজর পড়িয়া গেল।দেখিল, অপূর্ব এক অপ্সরী রহিম বক্সের বারান্দায় শুইয়া আছে।বাঘার মন উদ্বেলিত হইল।ইন্দ্রীয় অনুভূতি তাহার হৃদয় কাঁপিয়া দিল।এই ত, এই ত আমার স্বপ্নের রানী, যাহাকে আমি অন্তরে,ভিতোরে-বাহিরে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি।বাঘা তাহার দিকে তাকিয়াই রহিল।
বাঘার মধ্যে প্রেম উদ্দীপক, এমন ভাবে ইন্দ্রীয় অনুভূতি ঠেলা মারিল, যাহা স্নায়ুবিক প্রবাহ আকারে মস্তিস্কে পৌঁছাল।বাঘার মস্তিস্ক বিড়বিড় করিতে লাগিল।সেই সুদর্শনার সহিত কীভাবে সাক্ষাত ঘটানো যায়,এই চিন্তায় তাহার নিন্দ্রা হারাম হইয়া গেল।
রহিম বক্সের বাড়িতে বাঘা যাহাকে দেখিয়াছে,তাহার নাম কুন্তি।কুন্তি বাঘার চাইতে তিন বছরের বড়।কুন্তির আগের বছরগুলির দুইজন সোহাগ রহিয়াছে।কার্তিক মাস আসিলেই তাহারা কুন্তির কাছে আসিয়া হাজির হয়।এমনিতে আসে না বলিলেই চলে,তবে মাঝে-মধ্যে আসিয়া দেখা করিয়া যায়।একজনের নাম লালটু এবং অপর জনের নাম পল্টু।
বাঘা সারা রাত জাগিয়া মনস্থির করিল,সকালে যে ভাবেই হউক, সে কুন্তির সঙ্গে দেখা করিবে,তাহাকে প্রেম নিবেদন করিবে।কিন্তু সকালে উঠিয়া, সে যাহা দেখিল,তাহা যে কেহু দেখিলেই,তাহার মস্তিস্ক বিগড়াইয়া যাইবে,গরম হইয়া যাইবে।বাঘা দেখিল, দুইজন বয়স্ক পুরুষ কুনিতর পাশে শুইয়া আছে,কথা বলিতেছে এবং দাঁত বাহির করিয়া হাসিতেছে।প্রথমে,বাঘা মনে করিল, তাহার কোন আত্বীয় হইবে,কিন্তু তাহাদের আচরণ দেখিয়া বাঘা বুঝিল,ঐ দুইজনও তাহার মতই।তাহার মনে হইল,এখনই যাইয়া তাহাদের দুইজনেরই ঘাড় মটকাইয়া দিই।
বাঘার বন্ধু বলিতে কেহু নাই।কাহার সাথে এই বিষয়ে আলাপ করিবে,সে বুঝিয়া উঠিতে পারিল না।সে,তাহার মনের মধ্যে, বন্ধু অনুভব করিল।এতদিনে সে বুঝিতে পারিল,প্রত্যেকেরই বন্ধু থাকা প্রয়োজন।বন্ধু থাকিলে মনের ভাব আদান-প্রদান করা যায়; মনের অনেক দুঃখ-কষ্ট ইহাতে লাঘব হয়।কিন্তু আমার ত কোন বন্ধু নাই,আমি কাহার সহিত আলাপ করিব।বাঘা বিড়বিড় করিয়া বলিয়া উঠিল।
সকাল বেলায় লুলু দেখিল বাঘা ঝিমাইতেছে।লুলু ভাবিল,বাঘার অসুখ করিয়াছে বোধ হয়!তাহার মন খারপ হইল।বুকে জড়িয়া,ধরিয়া কতাদিতেঁ লাগিল।ইহা দেখিয়া বাঘা অবাক হইয়া গেল।তাহার বোধ হইল,আমার মনিবই ত আমার সব চাইতে বড় বন্ধু!যে আমার সুখের সময় ও দুঃখের সময়ে ব্যাথিত।আনন্দে বাঘার মন নাচিয়া উঠিল।তাহার চোখে পানি আসিল।সে লেজ লড়াইয়া বন্ধুর অনুভূতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিল।
এতদিন বাঘা জানিত তাহার কোন বন্ধু নাই।আজ বুঝিল,তাহারও বন্ধু আছে,এই ভাবিয়া তাহার মনটা পুলকিত হইল।তাহার প্রেম-উন্মদনার কথা কহিবার বন্ধু পাইতেছিল না।বন্ধুকে পাইয়া আনন্দে আত্মহারা হইয়া গেল।বিলম্ব না করিয়া ঘেউ-ঘেউ করিয়া,তাহার প্রেম-উন্মাদনা প্রকাশ করিল।লেজ নাড়াইয়া,লুলুকে বোঝানোর চেষ্টা করিল।বার বার রহিম বক্সের বাড়ির দিকে তাকাইয়া, ঘেউ-ঘেউ করিয়া কুন্তিকে দেখাইতে লাগিল।
লুলুর বয়স নয় বছর।লুলু এই সবের কিছুই বুঝিল না।লুলুর বোঝার কথাও না।বাঘার মধ্যে যে প্রেম উন্মাদনার প্রকাশ ঘটিয়াছে, তাহা বয়সের দোষে,এই বয়সে Sexual অনুভূতি প্রাণীকে জ্ঞানশূন্য করিয়া তোলে।কিন্তু লুলুর বয়স ত নয় বছর;এই সব বুঝিবার বয়সই তাঁহার হয়নি,বিধায় সে বুঝিতে পারিল না।লুলু বাঘার ঘেউ-ঘেউ আর লাফা-লাফি দেখিয়া বুঝিল,তাঁহাকে দেখিতে না পাইয়া,বাঘার এমন দশা হইয়াছে,তাঁহাকে পাইয়া সে খুশি হইয়াছে।তাই,লুলু বাঘাকে কিছুক্ষণ আদর করিয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল।
বাঘার মন খারাপ হইল।সে মনে মনে ভাবিল,এই কর্মটির প্রতি তাহার বন্ধুর সমর্থন নাই,কেন নাই, বাঘা বুঝিতে পারিল না।কিন্তু সে মনে মনে স্থীর করিয়া ফেলিল,সেই দুইজনের সহিত যুদ্ধ করিয়াই,অপ্সরী জয় করিতে হইবে।
বাঘা সকালের খাবারের দিকে তাকাইয়া রহিল।সকালের খাবার খাইয়া,গায়ে একটু জোর বাড়াইয়া লইতে হইবে,তাহার পর,যুদ্ধে নামিতে হইবে।লুলু সকালে খাবার লইয়া আসিল।প্রতিদিন যাহা খাই,তাহা হইতে আজকের খাবার ব্যতিক্রম দেখিল।খাদ্যের সঙ্গে উচ্ছিষ্ট গো-মাংস ও হাড় দেখিতে পাইল।বাঘা মনে মনে ভাবিল,ইহাই ত প্রয়োজন এখন।কোন দিকে না তাকাইয়া বাঘা গপ-গপ করিয়া খাইতে লাগিল।
বাঘা এখন তাহার শরীরে বেশ শক্তি অনুভব করিল।দুইজনকে পরাস্ত করিবার জন্য ইহায় যথেষ্ট।রহিম বক্সের বাড়ির দিকে তাকাইল।কাহুকে সে দেখিতে পাইল না।আস্তে আস্তে হাটিয়া সে রহিম বক্সের বাড়ির দিকে রওনা হইল।রহিম বক্সের বাড়ির কাছে পৌঁছাইয়া,এই দিক ওই দিক তাকাইতে লাগিল।সে কুন্তিকেও দেখিতে পাইল না আবার তাহার শত্রু যুগলকেও দেখিল না।ইহাতে তাহার মনে অস্থিরতা বাড়িল।সে এখন কী করিবে ভাবিতে লাগিল,এমন সময় সে দেখিল,রহিম বক্সের বাড়ি হইতে কুন্তি বাহির হইয়া আসিতেছে।ইহা দেখিয়া তাহার হৃদয় ধুক ধুক করিয়া কাপিঁয়া উঠিল আবার মুখে হাসিও ফুটিল।কিন্ত হাসি স্থায়ী হইল না।
দূরে লালটু ও পল্টু দাঁড়াইয়া ছিল। কুন্তিকে বাড়ি হইতে বাহির হইতে দেখিয়া,তাহারও কুন্তির কাছে আসিল।বাঘা ইহা দেখিয়া, তাহার সামনের পা দুইটি দিয়া, মাটি হাছড়াইয়া গর্জণ করিতে লাগিল।লালটু-পল্টু,বাঘার এমন আচরণ দেখিয়া থতোমতো খাইয়া গেল,কিছু বুঝিয়া উঠিবার আগেই,বাঘা তাহাদের উপর ঝাপিয়া পড়িল।
বয়স ভারে আজ,তাহারা পরাস্ত হইয়া পলাইয়া গেল বটে;কিন্তু বাঘার অবস্থা এমন হইল যে,রহিম বক্সের বাড়ি হইতে,নিজ গৃহ পর্যন্ত আসিবার ক্ষমতা লোপ পাইল।লালটু-পল্টু পলাইয়া গেল,কিন্তু কুন্তি তাহার দাঁত বাহির করিয়া বাঘাকে তাড়া করিল।বাঘা কনো রকম ছ্যাচড়াইয়া ছ্যাচড়াইয়া দৌড়িয়া নিজ গৃহে প্রবেশ করিল।কুন্তি নারী জাতী,বিধায় বাঘার এইরুপ অবস্থা দেখিয়া,তাহার মায়া হইল।
সন্ধ্যার একটু পরে,কুন্তির বাঘার কথা মনে হইল।বেচারা, না জানি কেমন রহিয়াছে?একবার দেখিয়া আসিলে মন্দ হয় না,তাছাড়া এই সময় কুন্তির কাছে,কত পুরুষই ত আসে,বাঘা আসিলে দোষের কী-এই সব ভাবিয়া,কুন্তি বাঘার উদ্দেশ্যে রওনা হইল।কুন্তি বাঘার গৃহে আসিয়া দেখিল,বাঘা মড়ার মত পড়িয়া আছে।ইহা দেখিয়া কুন্তির আরও দুঃখ হইল।সে বাঘার পাশে গিয়া বসিল এবং চমকিয়া উঠিল।বাঘার শরীর হইতে পল্টুর শরীরের গন্ধ বাহির হইয়া আসিতেছে।তাহার বুঝিতে দেরী হইল না,বাঘা পল্টুরই সন্তান এবং কুন্তি তাহার গর্ভধারিনী মা।
কুন্তি বিলম্ব না করিয়া উঠিয়া পড়িল।তাহার জ্ঞান শূন্য হইল।কনো কিছু না ভাবিয়া, সে সামনের দিকে দোড়াইতে লাগিল।সামনে বড় রাস্তা।প্রতিনিয়ত গাড়ি চলাচল করিতেছে।কুন্তি সেই দিকে নজর না দিয়া, রাস্তা পার হইতে গেল।একটি ট্রাক আসিয়া কুন্তিকে চাপা দিয়া চলিয়া গেল।কুন্তির জীবনাবসন হইল।(ইহা দূঘর্টনা না আত্মহত্যা,একমাত্র ওপরওয়ালাই বলিতে পারিবে!)
সকাল বেলাই লুলু বাঘার গৃহে আসিল।দেখিল,বাঘা ঘুমাইতেছে।আর তাহার সারা শরীরে মাছির মিছিল চলিতেছে।ইহা দেখিয়া,লুলু অবাক হইয়া গেল।বাঘার সারা শরীরে মাছি বসিয়া ভন ভন করিতেছে,অথচ বাঘা কিছুই বলিতেছে না?লুলর মনে সন্দেহ হইল,সে বাঘার শরীরে ধাক্কা মারিল,বাঘা নড়াচড়া করিল না।লুলু আবার ধাক্কা মারিল,এইবারও সে একটুও নড়িল না।লুলু বুঝিল,বাঘা মরিয়া গিয়াছে।লুলুর চোখে জল আসিল।
বয়সন্ধি প্রেম বাঘাকে পাগল করিয়া তুলিয়াছিল।তাহাকে জ্ঞানভ্রষ্ট করিয়াছিল।ইহকালে বাঘার আর বন্ধু হইল না।বাঘা মরিবার আগে জানিতে পারিল না,সে কোন পাপে তাহার মৃত্যু ঘটিল .........