ছোট এক রুমের এই বাসাটাতে রাত ১০.০০টার পরে বাতি জ্বালানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের চেয়ে অর্থ সাশ্রয়-ই এর পিছনের মূল কারণ। তবুও আজ রাত ১২.০০টার পরেও সেই ঘরে ১০০ ওয়াটের হলুদ বাল্বটি আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোতে একটি মেয়ে বই খুলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাল তাকে যে
করেই হোক ক্লাস টেস্টে সর্বোচ্চ নম্বর পেতে হবে। কিন্তু, পদার্থবিজ্ঞান তার কাছে একটু কঠিনই মনে হয়। আর সবার মতো সে তো আর স্যারের বাসায় প্রাইভেট পড়তে পারে না। তার বাবা সানাউল সাহেব তাকে বলেছে, “যারা প্রাইভেট পড়ে তাদের মেধার বিকাশ ঘটে না”। তাই, মেয়েটি ঘরে বসেই প্রতিনিয়ত তার মেধার চর্চা করে যাচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে একটা কঠিন সমস্যার সমাধান করার পরে তার মুখটি আনন্দে ভরে উঠে। তার জীবনের সমস্ত ভালোবাসা, সুখ, দুঃখের সাথী তার বই। হঠাৎ তার বাবা জেগে উঠে তার মেয়ের জ্ঞান সাধনা দেখে বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠে, “এত রাতে বই পড়ে পড়ে চোখগুলো নষ্ট করার বুদ্ধি করেছিস বুঝি!! যা শুয়ে পড়”। মেয়েটি বুঝতে পারে আজ রাতে আর তার পড়া হবে না। বাধ্য হয়ে সে শুয়ে পড়ে।
পরেরদিন ক্লাসে টিফিন আওয়ারে মেয়েটি সমরেশ মজুমদারের গর্ভধারিণী পড়ছিল। পিছন থেকে তার বান্ধবী সোমা তাকে ডেকে উঠে, “কিরে অহনা, শেষের ম্যাথটা সলভ করতে পেরেছিলি?”
“হুম, সোজাই তো ছিল। স্যার বানিয়ে দিয়েছে, ঐ নিয়মের একটা অংক তো বইয়ে দেয়া ছিল”।
“তুই তো পারবিই, তুই হচ্ছিস বিদ্যাসাগরিকা। চল মাঠ থেকে হেঁটে আসি, নিদ্রিতা আর শিমুলও ওখানেই আছে”।
অহনা, সোমা, নিদ্রিতা আর শিমুল চার বান্ধবী। কিন্তু, অহনা তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অহনা বাদে ওদের বাকি তিনজনেরই বয়ফ্রেন্ড আছে। সারারাত মুঠোফোনে গল্প আর প্রেম করা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু, অহনা ব্যাপারটা একদম বুঝতে পারে না- একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ের কি এত কথা
থাকতে পারে! আর একসাথে ঘুরতে যাওয়া- সে তো ভয়ংকর ব্যাপার। একদিন সোমা তার বয়ফ্রেন্ড রোহানের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। ছেলেটাকে তার মোটেও পছন্দ হয়নি। ছেলেটা কিভাবে যেন বারবার তার দিকে তাকাচ্ছিল আর দাঁত বের করে জোরে জোরে হেসে উঠছিল। অহনা মা’র অসুস্থতার মিথ্যে অজুহাত দিয়ে দ্রুত পালিয়ে আসে।
অহনা দেখতে যথেষ্ট রূপবতী। বড় বড় চোখে সে যখন কারো দিকে তাকায় তখন মনে হয় অনেক না বলা কথা তার ভিতরে জমে আছে। শুধুমাত্র ক্লাসের ফাস্টগার্ল বলে কোনো ছেলে তার সামনে দাঁড়াতে সাহস পায়না। অহনা ঠিক করে আজ বাসায় গিয়ে তার মায়ের কাছে একটা আবদার করবে। এই পৃথিবীতে একমাত্র মা’য়ের কাছেই সে সব খুলে বলতে পারে। সামনে টেস্ট পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। একটা ভালো স্যারের বাসায় পরতে যাওয়া তার খুবই দরকার। বাসার সামনে এসেই সে শুনতে পায় তার মা- বাবার ঝগড়া। ছোটবেলা থেকেই এসব দেখে সে অভ্যস্ত। বাবার সামান্য উপার্জনে তাদের পরিবারের খরচের কিছুই হয় না। এসব দেখে প্রথম দিকে তার খুব কষ্ট হতো। তাই সে চুপ করে বই নিয়ে বসে থাকতো। বই অন্য কারো প্রকৃত বন্ধু না হলেও তার জীবনে অনেক ভাল একটা বন্ধু। প্রায়ই তাদের বাসায় রাতে রান্না হয় না। যখন তার খুব ক্ষুধা লাগতো তখন সে মায়ের কাছে দৌড়ে গিয়ে বলতো, “মাগো কিছু খেতে দাও না”। তার মা তখন খুব আদরের গলায় বলতো, “শোন, মনোযোগ দিয়ে পরতে বস। পড়ায় মন থাকলে আবার ক্ষুধা লাগে কিভাবে!” সরল বিশ্বাসে সে তার মায়ের কথা মেনে নিয়ে পড়তে বসে। কিন্তু, সে পড়বে কি, তার তো ঠাট দুটো খুলে সামান্য আওয়াজ বের করার মতোও শক্তি থাকে না গায়ে। তখন সে চুপ করে তাকিয়ে থাকতো বইয়ের দিকে। এভাবে একসময় তার মনে হতো বইয়ের প্রতিটি অক্ষর থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে। সে স্পট শুনতে পেতো। যখনই কোথাও বুঝতে পারত না- সে একটানা তাকিয়ে থাকতো বইয়ের দিকে। তখন বইয়ের শব্দগুলো বিভিন্ন রকমের ছবি হয়ে ভেসে বেড়াতো। সেই ছবি দেখে দেখে সে একসময় তার সমস্যার সমাধান বের করে ফেলত। এভাবে ক্ষুধার সাথে সংগ্রামে সে ঠিকই সবসময় জয়ী হতো। আর, সবাই কিনা ভাবে সে খুব মেধাবী। বরং তাকে অভাবী ছাত্রী বলা উচিত। অহনা বুঝেত পারে, মায়ের সেই অযৌক্তিক কথা আর তার সরল বিশ্বাসীই আজ তাকে মেধাবী ছাত্রী হিসাবে গড়ে তুলেছে। সেদিন রাতে অহনা বিছানার এক কোণে বসে পড়ছিল। তার বাবা তখনো অফিস থেকে ফিরেনি। মা পাশে এসে বসে, “কিরে তোর পড়াশুনা ভালোভাবে হচ্ছে তো?” তখন অহনা বলে, “মা সামনে টেস্ট পরীক্ষা, প্রাইভেট পরতে যাওয়া খুব দরকার”। মেয়ের কথা শুনে মায়ের চেহারায় চিন্তার সুস্পষ্ট ছাপ পড়ে। তবু ও
মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলে, “তুই কাল থেকে পড়তে যাস, আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করবো”।
এভাবেই সময় কাটতে থাকে অহনার। টেস্ট পরীক্ষা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে সে। পাশাপাশি প্রাইভেটে পড়তে যাবার সুবাদে রেজাল্ট নিয়ে তার মনে আর কোনো ভয় থাকে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই রেজাল্ট নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দেয়া হবে। ক্লাসের সবার মাঝেই চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। এমন সময় হেডস্যার ক্লাসে আসেন- রেজাল্ট ঘোষণা করা হয়। প্রতিটি বিষয়ে A+ পেয়ে টেস্ট পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে অহনা। একথা শুনার সাথে সাথে খুশিতে তার মন ভরে উঠে। হেডস্যার তাকে অভিনন্দন জানায়। ক্লাসের সবাই তাকে বাহবা দিতে থাকে। সে ঠিক করে আজ বাসায় গিয়ে মাকে বলবে, তাকে লাল রঙের একটা জামা কিনে দিতে। লাল রঙটা যে তার ভীষণ প্রিয়।
স্কুল থেকে অহনা স্যারের বাসায় যায়। আজ পড়া শেষ হলে স্যার তাকে বসতে বলে। সবাই চলে গেলে স্যার তাকে বলে, “কি ব্যাপার অহনা! মাস তো শেষ হয়ে গেছে সেই কবে? আমার টাকা এখনও পাইনি কেনো?
তুমে তো জানো আমি সবকিছু সময়মত করতে পছন্দ করি। এরপর থেকে যেনো এরকম আর না হয়”। অহনা বলে, “স্যার আমি পরেরদিনই আপনার টাকা নিয়ে আসবো”। “সে কথা তো কবে থেকেই বলছো। যাও আজকে তোমাকে ছেড়ে দিলাম। কাল যেভাবেই হোক আমার টাকা দিয়ে দিবে। না হলে অন্য কিছু দিয়ে শোধ করেত পারো”–বলে স্যার কিভাবে যেন তার দিকে তাকায়। অহনার গলা শুকিয়ে যায়। সে কোনমতে সোজা উঠে চলে আসে। বাসায় এসে শুনে তার বাবা আজ অফিস থেকে আসার সময় বাসের সাথে এক্সিডেন্ট করেছে। সে ওখান থেকে সোজা মেডিক্যালে চলে যায়। তার বাবার অফিসের কিছু লোক
এক্সিডেন্টের পরে তার বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে যায়। সে কি করবে বুঝতে পারে না। তার মা বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। কিছুক্ষণ পড়ে ডাক্তার এসে দেখে বলে তার বাবার পা কেটে ফলতে হবে। হাতে বেশি সময় নাই। কিন্তু তাদের কাছে তো কোন টাকা নাই। মাকে বাবার পাশে রেখে অহনা দ্রুত বেরিয়ে পড়ে টাকার ব্যবস্থা করার জন্য। আত্নীয়- স্বজন বলতে তাদের তেমন কেউ নাই। আর যারা আছে তারাও এই বিপদে পাশে এসে দাঁড়াতে অনীহা প্রকাশ করে। অহনা তার বাবার অফিসের স্যারের সাথে কথা বলে কিছু টাকা পাবার নিশ্চয়তা পায়। কিন্তু বাকি টাকা যোগাড় করবে কিভাবে? সে শুনেছে, সোমার নাকি
অনেক বড়লোক। সে সব খুলে বলে সোমাকে। সোমা বলে, “চিন্তা করিস না। আমার এক আঙ্কেল এক N.G.O. তে কাজ করে। সেখান থেকে তোকে আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ওরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে”। অহনা এরপর দিন সোমার আঙ্কেলের সাথে দেখা করে। সবকিছু শুনে সেই লোক বলল, “তুমি তো এস.এস.সি. পাস করার আগে আমাদের এখান থেকে কোনো সহযোগিতা পাবে না। তবে তোমার কথা শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছে। আম ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে সাহায্য করতে চাই, যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে”। সোমা সাথে সাথে বলে, “আঙ্কেল আমার কোন আপত্তি নাই।আপনি
আমাদের এই বিপদে সাহায্য করতে চান এটাই তো বড় কথা”।
“ঠিক আছে তুমি কাল এই ঠিকানায় একবার এসো”।
“কখন আসবো আঙ্কেল?”
“আমার তো অফিস থেকে ফিরতে বিকাল হবে তুমি না হয় সন্ধ্যার দিকে আসো, দেখি তোমার জন্য কি করতে পারি”। কিছুটা নিশ্চয়তা পেয়ে অহনা হাসপাতালে ফিরে আসে। মাকে সব জানিয় সান্ত্বনা দেয়।
এরপর দিন সন্ধ্যায় সে কথামতো সোমার আঙ্কেলের বাসায় যায়। দারোয়ান তাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে দিয়ে যায়। সে রুমের চারপাশে অবাক চোখে দেখতে থাকে। বাড়িটা একদম ফাঁকা। কিছুক্ষণ পরে, সোমার আঙ্কেল এসে বলল , “আরে তুমি এখানে বসে আছো কেনো! যদিও টাকাটা আমিই দিচ্ছি তাও কিছু কাগজপত্রে তোমার সিগনেচার লাগবে। তুমি ভিতরের রুমে আসো”। অহনা কি করবে বুঝতে পারে না, লোকটি প্রায় জোর করে তাকে ভিতরে নিয়ে যায়। “তুমি বিছানায় বোস। আমি টাকাটা নিয়ে আসছি”। বলে লোকটি রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পরে এসে সোজা দরজা আটকে দেয়। অহনা সাথে সাথে দাঁড়িয়ে যায়,
“আঙ্কেল আমাকে যেতে হবে”। “কি যে বলো? মাত্রতো আসলে, কাজটা শেষ করে টাকাটা নিয়ে চলে যেও।আমি তো আর সারাজীবন আটকে রাখবো না তোমাকে”। “মানে? আঙ্কেল আপনি কি বলছেন এইসব?......”
সেই রাতে অহনার আর ফিরে আসা হয় না। কারো ক্ষুধা মেটানোর জন্য সারারাত তাকে বন্দি থাকতে হয়। সকালে লোকটি তার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলে, “আরো লাগলে এসো, টাকা নিয়ে যেও”- বলে লোকটি হাসতে থাকে। অহনা আস্তে আস্তে হেঁটে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। হাসপাতালে পৌঁছানোর পরে তার মা জিজ্ঞাসা করে, “সারারাত কই ছিলি রে মা?” অহনা কিছু বলে না , চুপ করে থাকে। হঠাৎ তার প্রচণ্ড বমি পায়। সে হরহর করে বমি করতে থাকে। এর আগের দিন কিছুই পেটে পড়েনি, কিইবা আর বের হবে। তারপরও সে অনেকক্ষণ ধরে বমি করার চেষ্টা করে- ভিতরের সব নোংরা- যন্ত্রণা বের করে দিতে চায়। দু’চোখ বেয়ে পানি নেমে যায়, কিন্তু কান্নার আওয়াজ শোনা যায় না- ঠোঁট দু'টো খুলে সামান্য আওয়াজ বের করার মতো শক্তিও যে তার শরীরে আর অবশিষ্ট নেই।
সানাউল সাহেবের চিকিৎসার টাকা অফিস থেকে শেষপর্যন্ত পুরোটাই দেয়। কিন্তু তিনি আর কোনোদিন চাকুরী করতে পারবেন না। পঙ্গু বাবা আর অসহায় মাকে নিয়ে কিভাবে সংসার চালাবে- অহনা বসে বসে চিন্তা করতে থাকে। যেভাবেই হোক একটা রাস্তা তাকে বের করতেই হবে। টেস্ট পরীক্ষা শেষ, এখন আর তার
ক্লাস নেই। শুধু পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিলেই হবে। এর পাশাপাশি যদি সে ২- ৩ টা টিউশনি যোগার করে নিতে পারে তাহলে আর তাদের না খেয়ে মরতে হবে না। লোকমান স্যার একদিন তাকে বাসায় দেখা করতে বলে। সে স্যারের বাসায় গিয়ে তার বাবার দুর্ঘটনার কথা সব খুলে বলে। কিন্তু, স্যার কিছুতেই শুনে না। “দেখো, টাকা না দিতে পারলে কিভাবে আদায় করে নিতে হয় তা আমার জানা আছে”। এ কথা বলে স্যার আস্তে করে উঠে দরজা আটকে দেয়। অহনা চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তার ভিতরে আজ আর কোনো ভয় নেই, আতঙ্কও নেই। সে যেনো একটা মুতি- নিশ্চুপ হয়ে তাকিয় থাকে সে। স্যার তাকে টান দিয়ে
চেয়ার থেকে তুলে নেয়। তার ওড়না খুলে মেঝেতে ফেলে দেয়, তারপর নিচের দিকে যখন নজর দেয় তখন অহনা স্পট দেখতে পায়- স্যারের মুখটি তার বুকের কাছে নেমে এসেছে। সে হঠাৎ এক টানে স্যারের গলা প্রচণ্ড শক্তিতে দাঁত দিয়ে কামরে ধরে। তাকে মেরে ফেললেও তার মুখের খাবার আজ আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। অনেকদিনের ক্ষুধা আজ তার মনে। মাত্র ১০- ১২ সেকেন্ডের ব্যবধানে সবকিছু আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। অহনার গায়ে এখন লাল রঙের জামা- তার পছন্দের প্রিয় রঙ। আজ যেনো তার ঈদ। সে আজ লাল জামা পড়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে।