জাকারিয়ার হাত বেধে ফেলা হয়েছে। ফাসির মঞ্চও প্রস্তুত। ঠিক রাত সাড়ে চারটার সময় তার ফাসি কার্জকর হওয়ার কথা। জাকারিয়া বুঝতে পারছে তার হাতে সময় খুব অল্প। জল্লাদকে মনে হয় ঘুম থেকে জোর করে উঠিয়ে আনা হয়েছে। তার মুখে রাজ্যের বিরোক্তি। আর তার চোখ বলছে, ‘ভাই তারাতারি করেন, এরে ঝুলায়ে দিয়া একটু ঘুমানো লাগবো। পেট খারাপ ছিল তাই ঐ রাত্রে একটুও ঘুমাইতে পারি নাই। জল্লাদকে দেখে জাকারিয়ার খারাপ লাগলো, আহারে বেচারা। জাকারিয়ার ঠিক এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে তার নিজের কাচাপাকা দাড়িতে শেষ বারের মত হাত বুলাতে। হাত পিছন দিকে বাধা থাকার কারনেই হয়ত এই ইচ্ছাটা ধিরে ধিরে প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। একবার ভাবলো জল্লাদকে বলবে ভাই একটু হাতটা খুলে দেন, শেষ বারের মত একটু দাড়িতে হাত বুলাইতাম। এই চিন্তা দ্রুতই সে সরিয়ে ফেলল মাথা থেকে। শেষ ইচ্ছা হিসেবে দাড়িতে হাত বোলানোর ব্যাপারটা ঠিক নিজের কাছেই ভালো লাগলো না। অবশ্য জেইলার সাহেব তাকে এখানে আসার অনেক আগেই তার শেষ ইচ্ছা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। জেইলার মানুষটা ভালো। ছিপ ছিপে শরির বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের ভেতর কিন্তু দেখলে মনে হয় অনেক বেশি বুড়িয়ে গেছে, সেখানে জাকারিয়া এই ষাট বছর বয়সেও একদম যুবার মত শক্ত এবং সুঠাম দেহের অধিকারি। জাকারিয়া পেশায় দাড়োয়ান। তার ফাসির রায় হওয়ার প্রধান কারন হত্যা। তিনি যেই অফিসে চাকরি করতেন সেই অফিসের মালিক একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ি। জাকারিয়া তার এই মালিককে হত্যা করে এবং অফিসের ড্রয়ার থেকে টাকা আত্মসাত করার চেষ্টা করে। জল্লাদ জাকারিয়ার ডান হাতের কনুই চেপে ধরে তাকে ফাসির মঞ্চে উঠায়। জাকারিয়া বুঝতে পারছে সময় একদমই কম। আর সময়ও মনে হচ্ছে খুব বেশি দ্রুত এগোচ্ছে। এইতো সেই দিন, নিজের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছেন তিনি। আল্লাহর অশেষ রহমতে খুব ভালো জামাই পেয়েছেন মেয়ের জন্যে। মেয়ের জামাই বড় আলেম। মদিনা থেকে পাশ করা। মেয়েকে বিয়ে করে মদিনায়ই নিয়ে যাবে। সেখানের এক মসজিদের ইমামতি করেন তিনি। জাকারিয়ার জামাই বাবাজি একজন দ্বীন দার মেয়ে খুজছিলেন। আল্লাহর ক্রিপায় জাকারিয়াও তার একটি মাত্র মেয়েকে দ্বীনদার বানিয়েছে। সে হলফ করে বলতে পারবে যে তার মেয়ে সাবালিকা হওয়ার পর কোন পরপুরুষ তার মেয়ের চেহারা দেখতে পারে নাই। দ্বীনই শিক্ষাটাও তিনি তার এই মেয়েকে দিতে পেরেছিলেন। আর এই জন্যই হয়ত সে দাড়োয়ান হওয়া সত্যেও তার মেয়ের এত ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে। সবই আসলে আল্লাহর রহমত। মেয়ে বিয়ে দিয়ে জামাই বাবাজি সহ মেয়েকে সৌদি পাঠিয়ে দেয়ার কিছুদিন পরের ঘটনা, একটা অল্প বয়স্ক মেয়েকে জাকারিয়া যেই অফিসে কাজ করে সেই অফিসের চেয়ারম্যানের পারসোনাল সেক্রেটারি হিসেবে রাখা হয়। অফিস ছুটির পর প্রায় প্রতিদিনই চেয়ারম্যান তার সেক্রেটারির সাথে মিটিং করে। অন্য সব কর্মচারি আগেই চলে যায়। জাকারিয়ার মাগরিবের সালাত আদায় করার পর আরো ঘন্টা খানেক বসতে হয়। তারপর তাদের মিটিং শেষ হলে তারা বের হয়ে গেলে জাকারিয়ার কাজ হচ্ছে পুরো অফিস চেক করে তালাবদ্ধ করে আসা। অন্যসব দিনের মতই একদিন মেয়েটা চেয়ারম্যানের রুমে যায়। জাকারিয়া অপেক্ষা করে। মাগরিবের আজান হয়। মাগরিব আদায় করে, অপেক্ষা শেষ হয় না। সব দিন এতটা দেরি হয় না। আজকে কি হোল? একবার মনে করে দরজায় টোকা দেবে আবার কি মনে করে পিছিয়ে যায়। এশার আজান হয়। জাকারিয়ার অস্বস্তি বাড়তে থাকে এরকমতো হওয়ার কথা না। হঠাৎ ভেতর থেকে বিকট এক শব্দ হয়, মনে হয় বড় কোন কাচের পাত্র আঁচরে ফেলা হয়েছে মেঝেতে। জাকারিয়া দৌড়ে চেয়ারম্যানের রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে। চেয়ারম্যানের কক্ষে অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য বসার সোফাগুলোর সাথে যে কাচের টেবিলটা আছে, সেটা ভেঙ্গে তার উপর পরে আছে চেয়ারম্যান। মেয়েটির হাতে পিতলের ফুলদানি। ফুলদানির গায়ে তাজা রক্ত। তার চোখে পানি। জামার হাতার একটি অংশ ছিরে ঝুলে আছে। মেয়েটা জাকারিয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর ফোপাচ্ছে। জাকারিয়া আস্তে করে মেয়েটার হাত থেকে ফুলদানিটা নিয়ে চোখের ইশারায় চলে যেতে বলে। মেয়েটা যায় না বরং তাকিয়ে থাকে। জাকারিয়া আবার ইশারা করে চলে যেতে। মেয়েটা এইবার জড়িয়ে ধরে জাকারিয়াকে। শিশুরা বাবার কোলে উঠলে কোন কিছু দেখে ভয় পেলে বাবার কাপর যেমন দুই হাত দিয়ে খামচে ধরে ঠিক সেইভাবে। মেয়েটির চোখের পানি ভিজিয়ে দেয় জাকারিয়ার পাঞ্জাবি। জাকারিয়ারো চোখ ভিজে যায়। সে মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। জল্লাদ কালো কাপরটা দিয়ে জাকারিয়ার মুখ ঢেকে দেয়। সময় তাহলে সত্যিই শেষ। এখন ফজরের আজান হয় পৌনে পাঁচটায়। আজকের ফজরের আজান আর তার শোনা হবে না। যেই ভোরের প্রথম আলো দেখার জন্যে সে নামাজ পড়ে এসে ঘরের বাইরে বসে থাকত সেই ভোর হওয়া আর এই জীবনে দেখা হবে না। তারপরো জাকারিয়ার মণটা ভালো। বেস ভালো। কারন তার পরিবর্তে আজকে একটা মেয়ে ঠিকই ফজরের আজান শুনতে পারবে। ঠিকই সে ভোর হওয়া দেখতে পারবে। কারো জীবনে এই ভোর উপহার দেয়ার আনন্দটাই বা কম কি!!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Lutful Bari Panna
খুবই সুন্দর গল্প। ছোটখাট বিষয় নিয়ে এমন আত্মত্যাগের ঘটনা এই পৃথিবীতে অনেক আছে। হয়ত সেজন্য পৃথিবী আজো টিকে আছে। এটা একটু চরম উদাহরণ হল। তবু হতেই তো পারে। ছোট্ট গল্পটির মধ্যেও দক্ষতা লুকোনো থাকেনি।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি
কাহিনী চিত্রের মতো লেখা ............খুব সুন্দর বর্ণনা .........শেষের দিকটা অসাধ্রণ...........আলী ইবনে মুসাই আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ............
মামুন ম. আজিজ
করুণ ...মত্যু মানেই করুণ। ...মেয়েটা খুনের দায় স্বীকার করলে কি নিজেকে বাঁচানোর জন্য হত্যা ..এন প্রমাণ করা যেতো না?.....জানি না আজকাল আইন এর পাঠ বড্ড কঠিন লাগে.....আরেকটা জীবন পেলে আইন বিষয়টা নিয়ে পড়ে দেখতাম...
সূর্য
"কিলিং ফর সেল্ফ ডিফেন্স" এমন খুন প্রমান করতে পারলে খুনি সাজা পায় না বলে শুনেছি। মেয়েটার শরীরে আক্রমনের চিহ্নতো ছিলই। জাকারিয়া খুনের দায় মেনে নেয়ার সময় একবারও ভাবলেন না নিজের মেয়েটা খুনী বাবার পরিচয় বহন করে চলবে আজীবন!! একটা মেয়ের জীবন বাঁচাতে আরেকটা মেয়ের হাতে "খুনীর মেয়ে" অপবাদ তুলে দিলেন। আসলে কত কিছুইতো হয়, হতে পারে। জাকারিয়ার উপহার বেশ ভালো লেগেছে।
সূর্য দা আমি অন্যান্য গল্পেও আপনার মন্তব্য গুলো দেখেছি । দারুন সুচারু ভাবে আপনি লেখা গুলো পরেন তারপর উপলব্ধি করেন এবং এরপর মন্তব্য করেন। স্যালুট ভাই আপনাকে। এমন একজন পাঠক পাওয়া এই সময় আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার। আপনার লেখার হাতও কিন্তু বেশ। ধন্যবাদ আপনার মুল্যবান মন্তব্যের জন্যে। ও আরেকটা কথা বলি জাকারিয়া ব্যাটা সার্থ পর পিতা না হয়ে সার্থহীন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেছে আর কি।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।