বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে গণসঙ্গীত জড়িয়ে আছে সেই গোড়া থেকেই ৷ আঁধার রাতে গাঢ়তম তন্দ্রার ভেতর জেগে ওঠে মুক্তিপাগল মানুষের হাতকে যোদ্ধার শাণিত হাতে মিলিয়ে দিতে শেখ লুৎফর রহমান, আব্দুল লতিফ, শামসুদ্দিন আহমেদ, নিজামুল হক, আলতাফ মাহমুদ, মোমিনুল হকসহ অনেকেই প্রতিবাদের গান গেয়েছিলেন, আন্দোলনকে করেছিলেন বেগবান ৷ দেশ ভাগের পর শুধু বড় শহরগুলোতেই নয়, বরং নেত্রকোনা পাবনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, কুমিলল্লায় কৃষক সংগ্রামের পটভূমিতে বহু গণসঙ্গীত রচিত এবং গীত হয় ৷
১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের জনসভায় পল্টন এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় গণসঙ্গীতের উত্তাল ধ্বনিতে লোক জমায়েত করতেন বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই আব্দুল হাকিম, যিনি 'হাকিম ভাই' নামে পরিচিত ৷১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠে ৷ সাংস্কৃতিক কর্মীরা নেমে আসেন রাজপথে ৷ রবীন্দ্রসঙ্গীত, নাটকের ওপর নেমে আসে খড়গসম নিষেধাজ্ঞা ৷ সারা দেশে শুরু হয় রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর আয়োজন ৷ দুঃস্বপ্নের ঘোরে ধোঁয়াচ্ছন্ন আঁধারে বারবার যে আশ্রয়ে আমরা ফিরে যাই তার নামই তো রবীন্দ্রনাথ, নজরম্নল, সুকান্ত ৷ প্রতিরোধকে সামনে রেখেই ১৯৬১ সালে জন্ম নেয় ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যানিকেতন, ১৯৬৭ সালে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী, ১৯৬৮ সালে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ৷ ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী ভারতীয় গণনাট্য সংঘের পুরনো গানগুলোকে আবার নতুন করে গাইতে শুরু করে ৷
অসহায় ক্রোধের ভেতর একসময় প্রচুর গণসঙ্গীত রচিত হয়েছে ৷ খুলনা থেকে আবু বকর সিদ্দিকী লিখতেন গণসঙ্গীত ৷ চট্টগ্রামের প্রান্তিক শিল্পীগোষ্ঠীর হরি প্রসন্ন পালকে বলা হতো বাংলার পল রবসন ৷কাগমারী কনফারেন্সে তার গণসঙ্গীত মানুষকে সোচ্চার হতে অনুপ্রেরণা জোগায় ৷
এরকম গানের জন্মের সঙ্গে কতই না ইতিহাস, কতই না আবেগ জড়িত ৷ কখনো আবেগ ছাপিয়ে গেছে শিল্পমাত্রাকে, কখনো সঙ্গে নিয়েই এগিয়েছে ৷ সময়ের চাতালে সব আক্রোশ, সব না পাওয়া, সব অক্ষমতা জড়ো হয় আর গণশিল্পীরা তা দিয়ে গেঁথে চলেন অপুর্ব সব প্রেমগাথা ৷ তবুও বুনে চলেন স্বপ্নবীজ নতুন দিনের আশ্বাসে ৷
কবিয়াল রমেশ শীল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ফণী বড়ুয়া, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রী, সাধন দাশ গুপ্ত, হরিপদ কুশারী, সলিল চৌধুরী, কানু ঘোষ, প্রেম ধর, প্রেম ধাওয়ান, মখদুম মহিউদ্দীন, নিবারণ পন্ডিত, পারভেজ শাহেদি, সজল চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা, নির্মলেন্দু চৌধুরী, অমর শেখ, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, হলরাজী, মোহিনী চৌধুরী, দিলীপ সেনগুপ্ত, অজিত পান্ডে, শুভ্যেন্দু মাইতি, আলতাফ মাহামুদ, হাফিজ উদ্দিন প্রমুখের গণসঙ্গীত সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখে ৷ পল রবসন, নাজিম হিকমাত, ইউজিন পাতিয়ের, পিয়ের দেক্তার, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের গান ভিন্ন ভাষায় রচিত হলেও বাংলায় অনূদিত হয়ে গীত হতো ৷ এমনি কতগুলো ক্রান্তিকালের গান এখনো গীত হয় ৷ '...তোমার আছে বন্দুক আর আমার আছে ক্ষুধা...', অতো রেনে কস্তিয়ের এই গানটি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় অনুবাদ করেন, সুর করেন প্রতুল মুখোপাধ্যায় ৷ গোবিন্দ হালদারের কথা আর আপেল মাহমুদের সুরে গান আজও সবার মুখে মুখে- 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি / মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি ৷' ইউজিন পাতিয়ের সেই বিখ্যাত গান, সুর করেন পিয়ের দেগতার, যার সফল অনুবাদ করেন মোহিত বন্দ্যোপাধ্যায়- 'জাগো জাগো জাগো সর্বহারা অনশন বন্দি ক্রীতদাস / শ্রমিক দিয়েছে আজ সাড়া উঠিয়াছে মুক্তির আশ্বাস ৷' নাজিম হিকমতের কথায়, অনুবাদ আর সুর বসালেন কমল সরকার ৷ জন্ম নিল বাংলার গণসঙ্গীতের বলিষ্ঠ সংযোজন- ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না/নিগ্রো ভাই আমার পল রবসেন/আমরা আমাদের গান গাই ওরা চায় না ওরা চায় না ৷
বজ্রপাতের ঝলকানিতে চমকে ওঠা সমবেত স্পর্ধার চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের প্রতিটা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে, ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল যুগান্তকারী সব গান ৷ চট্টগ্রামের এই কেন্দ্র চিহ্নিত হয়ে পড়লে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে সরে যাওয়া হয় ৷ এটিও যখন পাকিস্থানিদের নজরে চলে আসে তখন ১০ কিলোওয়াটের ট্রান্সমিটারটি অকেজো করে শিল্পী, কলাকুশলীরা চলে যান ত্রিপুরার আগরতলায় ৷ আরেকটি দল চলে যায় বগাফায় ৷ ২৫ মে ১৯৭১ কলকাতার বালিগঞ্জে সার্কুলার রোডের দোতলা বাসায় স্থাপিত হয় বেতারকেন্দ্র, উদ্বোধনের দিন হিসেবে বেছে নেওয়া হয় নজরুলের জন্মদিন ১১ জ্যৈষ্ঠ ৷ রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর সুকান্তের গানেই তো রয়েছে জনমানুষের আকুতি, তাই এই গানগুলোও গীত হয় এবং হয়েছে গণসঙ্গীত হিসেবে, প্রতিরোধের ভাষা হিসেবে ৷
স্বজন হারানো ব্যথা, শস্যের জন্য ভালোবাসা, বুনো ঘাসের কচি ডগা, প্রার্থিত উজ্জ্বলতা কী ছিল না সেদিনের গানে? শুরু হলো কেন্দ্রটির যাত্রা, ভারতের দেওয়া রেকর্ডিং মেশিন ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করেনি নাকি সেদিনের সেই স্টেশনটি ৷ অপূর্ব সব গণসঙ্গীতের জন্মস্থান এই কেন্দ্র ৷ 'মুক্তির গান' গেয়ে যুদ্ধের সময় জনমত তৈরির প্রামাণ্যচিত্রে বেশ কিছু গণসঙ্গীত আমরা শুনতে পাই৷