হৃদয়-অন্তরালে কষ্টরা নীরবে কাঁদে

অসহায়ত্ব (আগষ্ট ২০১৪)

সেলিনা ইসলাম
  • ১০
মোশারফ আর রুমালী'র তিন ছেলে আর দুই মেয়ে। মেয়ে দুটোর দেখে শুনে ভাল ঘরেই বিয়ে দেয়া হয়েছে,সুখেই আছে তারা। বড় ছেলে সেও বিয়ে করেছে এবং বেশ ভাল চাকুরী করে। মেঝো ছেলে ইঞ্জিয়ার তবে এখনো বিয়ে করেনি। সে  সাফসাফ বলে দিয়েছে সময় হলে নিজেই নিজের জীবন সঙ্গী বেছে নেবে। আর ছোট ছেলে  বিবিএ পড়ছে স্থানীয় একটা কলেজে।
মোশারফ একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকুরী করেন। এই ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে দোতালা বাড়ীটি করেছেন। বাড়ীর উপরের ফ্লাটে বড় ছেলে এক মেয়ে ও পরিবার নিয়ে থাকে। অবশ্য মাস শেষে ভাড়া দেয়। আর সেই টাকার সাথে বাকী টাকা মিলিয়ে প্রতিমাসের লোনের কিস্তি মোশারফকে শোধ দিতে হয়। মেঝো ছেলে আর ছোট ছেলেকে নিয়ে রুমালী আর মোশারফের সংসার।

মোশারফ রুমালী'র শেষ স্মৃতিচিহ্ন গহনাটুকু বিক্রি করে তাদের বাসার দক্ষিণের খালি জায়গাটা কিনেছে। ওখানে ছয় কাঠা জমি আছে। বেশ সস্তায় পেয়েছে সে। কিন্তু রুমালী খুশী হতে পারে না কারন সে জানে এই জমি কিনতে গিয়ে স্বামী তার আরো কিছু ধারদেনা করেছেন,এতে কোন সন্দেহ নেই। কোমল কন্ঠে স্বামীকে বলে-
-“জমির কি দরকার ? এই বাড়ী তো আছে , না ?”
-“শুনো দুইজনে মিলে ঐখানে একটা বাগান করব। আর তোমার এই ঘরে দক্ষিণের একটা বড় জানালা করে দেব !”এবার বেশ খুশি হয় রুমালী। সেই কবে থেকে সে বলছে দক্ষিণের দিকে একটা জানালা করতে তা কেউ শোনে না। জানালার পাশে সারী সারী কত রকম গাছ থাকবে। পাখীরা ভীড় জমাবে গাছের ডালে ডালে আর ঘরটাতেও আরো একটু আলো বাতাস ঢুকবে। কথাটা ভাবতেই মনটা খুশিতে নেচে উঠলেও ভাবনা থেকেই যায়। একেতে এই বাড়ীর লোন আছে তার উপর এই সংসার শুধুমাত্র স্বামীর টাকাতেই চলে। ছেলেরা কেউ কোন টাকা দেয় না। আবার কতটা ধার করল কে জানে? অজানা আশঙ্কা রুমালীর মনটাকে পাথরের মত ভারী করে তোলে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে গলা ছেড়ে ডাকেন ছেলেদেরকে। মেঝো ছেলে খেতে আসলেও ছোট ছেলে আসেনা। কারন সে এখনো বাসায় আসেনি। আজ বেশ কয়েকদিন ধরে সে গভীর রাতে বাসায় আসে। কোন কোন রাত আসেও না । জিজ্ঞাসা করলে বলে বন্ধুদের বাসায় ছিল। ইদানিং এই ছেলেকে নিয়ে বেশ অশান্তিতে আছে রুমালী। ছেলের মেজাজ  সবসময় বেশ চড়া থাকে। খিটমিটে স্বভাব হয়ে গেছে। কিছু জিজ্ঞাসা করলে  ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পাশ কাঁটিয়ে চলে যায় । স্বামী এমনিতে কতরকম ঝামেলায় থাকে তার উপর এই ছেলের বাড়তি চিন্তা তাকে আরো কাহিল করে দেবে ভেবে রুমালী ভয়ে এখনো কিছুই বলেনি।

পরের দিন অফিস থেকে ফিরে মোশারফ রুমালীকে সাথে নিয়ে যায় দক্ষিনের জায়গাটাতে। বেশ কতগুলো গাছ কিনে এনেছে সেইগুলো দুজনে মিলে সমস্ত জায়গা জুড়ে লাগায়। যা দেখে কিছুটা শঙ্কিত হয় রুমালী। তার ভাবনা ছিল চারিপাশে গাছ লাগালেও মাঝে থাকবে ইনকামের একটা পথ। যা থেকে কিছুটা হলেও সাশ্রয় হবে সংসারের চাহিদা পূরণে ।
-“আচ্ছা এই বয়সে এইসব গাছ গাছালি লাগানোর জন্য কি এই জায়গা কিনেছেন আপনি?” কৈফতের সুরে কথা বলে রুমালী। যা শুনে মোশারফ বেশ জোরেই হাসে । তারপর হাসি থামিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায় তার মন ।
-“একটা নতুন জীবনের আনন্দ দুজনে মিলে পাবো। জীবনে তো অনেক রকম আনন্দ,দুঃখ,কষ্ট,সুখ সবই পেলাম। এবার এক অন্যরকম আনন্দ,আসল আনন্দ। এর সুখ অনেক,তৃপ্তি অপরিসীম ।” মোশারফ আনমনে কথাগুলো বলে যায়। আর রুমালী কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রিয় মানুষটার দিকে ! ভাবে “নতুন কি এমন জীবন? যার আনন্দ এই শেষ বয়সে নিতে জমি কিনতে হবে ?” একটু থেমে মোশারফ আবার হেসে উঠে। সে যেন প্রিয়তমার মনের কথা বুঝতে পেরেছে –
- শুনো বেশী না দুটো বছর পরে যখন দেখবে এই গাছে ফল ধরেছে তখন যে কত আনন্দ লাগবে,সেইটা এখন হিসাব করে বলা যাবে না । শহরে এমন গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া অনেক বড় আনন্দের ব্যাপার !”
-“ওওও এই কথা তাই বলেন ! আমি ভাবলাম না জানি কি। এতে নতুন কি আছে ? গ্রামে গেলেইতো টাটকা ফল পেড়ে খাওয়া যায় আর এই মফঃস্বলে যা আসে তা কি গাছ থেকে পেড়ে আনে না? নাকি আকাশ থেকে পেড়ে আনে ,হু...?” -“ফরমালিন দিয়ে এসব ফল বিষাক্ত করে ফেলে ব্যবসায়ীরা। এসব তুমি বুঝবা না ...শুধু আনন্দ নিয়ে আমার সাথে কাজ করে যাও বুঝলে গো সখি ।” রুমালী আর কিছু না বলে একমনে কাজ করে যায়।
ভালবাসা আর মমতার স্পর্শে গাছগুলি বেড়ে উঠে তরতর করে। কেমন করে যেন সময়ও ছুটে চলে ঠিক রেলগাড়ীর মত।  দেখতে দেখতে পার হয়ে যায় তিনটা বছর। বাগানের গাছগুলো বেশ বড় হয়ে যায়। কিছু কিছু গাছে ফলও ধরেছে বেশ । নিম গাছ থেকে শুরু করে বাঁশঝাড় সব কিছুই আছে।

আজ শরীরটা ভাল লাগছে না রুমালীর । স্বামীর আসার অপেক্ষা করতে করতে কখন যেন চোখ লেগে এসেছে । সময়টা যে অনেকখানি সামনে গেছে সেদিকে খেয়াল হতেই ঘড়ির দিকে তাকায়। অবাক হয় এখনো কি এলো না মানুষটা! সেতো কখনো এত দেরী করে না। সেই জমি কেনার দিনই দেরী করেছিল কিন্তু আজ কি হল ? জানালা দিয়ে বাগানে তাকাতেই রাজ্যের বিস্ময় ! কিন্তু এটাই বা কি করে সম্ভব ? সেতো কোন দিন রুমালীকে ছাড়া বাগানে যায়নি তাহলে আজ কেন গেলো ? রুমালী দেখে মোশারফ কোদাল দিয়ে একটা বড় গর্ত খুড়ছে। রুমালী উঠে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় বাগানের দিকে। প্রিয়তম স্বামীর কাছে যত সে এগিয়ে যায় সে নিজেও জানে না অন্যরকম এক অনুভূতি তার সমস্ত শরীরে ভয়ের শীতল পরশ মাখিয়ে দিচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে ? কেন কষ্টরা বুকের মাঝে চেপে বসেছে ?
-“কি ব্যাপার আপনি যে আজ একা একা এসেছেন? আমাকে ডাক দিলেন না কেন?”
গর্তটা খোঁড়া শেষ তারই মাঝে দাঁড়িয়ে যেন চমকে উঠে মোশারফ ! তারপর স্বাভাবিক সুরে বলে
-“তুমি ওতো এই প্রথম আমার অপেক্ষা না করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলে তাই আর ডাকিনি। তবে একটু পর পর জানালার দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম যে তুমি আমাকে দেখছিলে কিনা !” রুমালী বলে –
-“তা এই গর্ত করছেন কেন? কি গাছ লাগাবেন এখানে ?এত্তো বড় কি গাছ আছে ?”
কথাটা শুনে ম্লান হাসি হেসে মোশারফ বলে-
- “গর্ত দেখলে কোথায় তুমি ? আমি বানিয়েছি নতুন ঘর আর তুমি বল গর্ত ? আসো দুজনে মিলে কিছুক্ষন বসি একসাথে ।”
অবাক হয় রুমালী ভাবে লোকটার মাথা ঠিক আছে তো ?  কিন্তু মুখ থেকে কিছুই বলতে পারে না । বুকের বাম পাশটায় চিনচিন করে ব্যথা অনুভব করে। সেই সাথে সমস্ত বুক জুড়ে শুন্য ধুধু মরুভূমি মনে হয়। কিন্তু কেন ? পলকহীন তাকিয়ে থাকে স্বামীর দিকে। মোশারফ দুহাত বাড়িয়ে দেয় রুমালীর দিকে ! রুমালীও দুহাত বাড়িয়ে দেয় আর মোশারফ বগলের মাঝে হাত দিয়ে একরকম বুকে জড়িয়ে নিচে নামিয়ে আনে প্রিয়তমাকে !
-"বাপরে ! মাসাল্লা স্বাস্থ্যখানা বেশ বানিয়েছো গো খুকী ।”
কথাটা বলে হাসতে চেষ্টা করে মোশারফ। হয়ত অন্যকোন দিন হলে সে আকাশকে কাঁপিয়ে হেসেও দিত । কিন্তু আজ দুচোখে মেঘের ঘনঘটা! চেষ্টা করছে যেন বৃষ্টি না হয়। রুমালী কিছু না বলেই ফুঁপিয়ে  কেঁদে ওঠে। তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি বসে । “আল্লাহু আকবার, আল্লা...হু আকবার...”পাশের মসজিদ থেকে  আযান ভেসে আসে । মোশারফ রুমালীর হাত দুটি নিজের হাতের মাঝে নিয়ে উপরে গাছের দিকে তাকায় ।  বলে –
-“দেখো রুমালী,সব পাখীরা মাগরিবের আযান হতেই বাসায় ফিরে এসেছে। ঘরে প্রিয়জনদের মাঝে ফেরার আনন্দে উল্লাস করছে। একটু অন্ধকার হতেই ওরা বুঝে যাবে এখন ঘুমের সময় । আবার ফজরের আযান হতেই সবাই একটা নতুন দিন পাবার আনন্দে খুশীতে আনন্দ করবে। একটু আলো ফুটতেই সবাই বের হয়ে যাবে খাবারের সন্ধানে। আল্লাহ কি সুন্দর জীবন দিয়েছেন ওদের। আর এই গাছগুলো ওদের সুখের নীড়,ওদের ঠিকানা। আর এই সুন্দর প্রকৃতির মাঝে এই দেখো,আমি আমার চিরস্থায়ী নতুন ঘর বানিয়েছি। আমার আসল ঠিকানা !” কথাটা শেষ করে তাকায় সরাসরি রুমালীর চোখের দিকে ।
রুমালী কেঁদে যায়। এবার আর ফুঁপিয়ে নয় ডুকরে কেঁদে ওঠে।
-"এই ভর সন্ধ্যায় আপনি এগুলো কী বলছেন!?"
মোশারফ আবার বলে চলে-
–“এই জমিটা আমি কিনেছি গোরস্থানের জন্য। এক এক করে আমি তুমি আমাদের ছেলে মেয়ে, আমাদের বংশধর সবার আসল ঠিকানা হবে এখানে। সন্তানদের মাথা গুঁজার ঠায় দিতে পেরে একটা বাড়ী করে আমি যতটা আনন্দ পেয়েছি, তার থেকে লক্ষগুণ শান্তি পেয়েছি এই জায়গাটা কিনে ! ছেলেরা কোনদিন তার বাবা মায়ের খোঁজ নেয়নি! ওদের কাছে আমি কোনদিন কিছু চাইনি। চাইনা আমি মরে গেলে আমার কবরের জমি কেনা নিয়ে ওদের ভাই-বোনদের মাঝে মন কষাকষি হোক তাই আমি...”
কথাটা বলে খুব বড় করে একটা নিঃশ্বাস নেয়। পরিবেশটা হালকা করতে বলে –
-“তোমার গায়ের গন্ধ এই ঘরে শুয়ে শুয়ে নেব আর তুমি ঐ জানালায় বসে বসে এই ঘরের দিকে তাকিয়ে আমার সাথে হাজারও কথার মালা গাঁথবে! কী গাঁথবে না?” একটু থেমে বলে
–“চল নামাজের সময় হয়েছে” কথাটা বলে রুমালীকে উপরে উঠিয়ে দিয়ে সুন্দর করে লেপন করতে থাকে নিজের হাতে বানানো ঘরটাকে। আর গুন গুন করে গান গায়–
আমারে শুয়াইয়া দিও মাটির বিছানায়.....
ও বন্ধু ঘুম পড়াইয়া দিও আমায় মাটিরও ছায়ায়...
রুমালি'র যে কি হল একটাও কথা বলতে পারল না আর। তাঁর মনে হল কেউ তার গলা চেপে ধরেছে। সে চাইছে কিছু বলতে কিন্তু পারছে না।
কাঁদা মেখে একাকার দুজনে হাত ধরাধরি করে বাড়ীতে ঢোকে। একসাথে কল তলাতে যায় । মোশারফ নিজে গোসল করে আর গান গেয়ে যায়। রুমালী ঘর থেকে লুঙ্গি গামছা এনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আর মোশারফ এক বালতি পানি ঢেলে দেয় রুমালীর মাথায়। কষ্ট নিয়েই দুজনেই হেসে দেয় আর তাই দেখে বড় বৌয়ের মুখ থেকে বের হয়ে যায়
-“আর বুড়ো বয়সে ভীমরতি ! কবে যে মানুষটার বদলী হবে আর এইসব নাটক দেখা থেকে রেহায় পাবো আল্লাহই জানে !”
কথাটা দুজনেই শোনে কিন্তু কেউ কিছু বলে না ! বড়বৌ সরে যেতেই রুমালী বকা দেয় ।
- “কি দরকার ছিল এমন করে আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে আনন্দ নেবার ?”
-  “আরে আমি তো দেখেই দিলাম পানি। যখন দেখলাম দেখি কেউ নেই আশে পাশে। তোমার পুত্র বধূ যে আড়ালে থেকে আমাদের দেখছে আর সময় বুঝে এন্ট্রি মারবে এটা কে বুঝেছে ? ” কথাটা বলে হো হো করে হাসে যা দেখে রুমালীর আরো রাগ হয় তবে তা ক্ষনিকের জন্য ।
- "তাড়াতাড়ি করেন নামাজের সময় যায়"
-" হ্যঁা যাই..। আর শুনো এরা দাম্পত্য জীবনে এইসব ছোট ছোট আনন্দগুলোকে আদিখ্যেতা ভাবে। এখনকার ছেলে মেয়েরা শুধু কতটুকু পেল তার হিসেব কষে ,কতটুকু দিল তার হিসাব করে না। সুখ খোঁজে অর্থবিত্ত আর জৌলুষে ।
এদের জন্য কষ্ট হয়, বড় চিন্তা হয় রুমালী ...।” কথাগুলো বলতে বলতে দুজনেই চুপ হয়ে যায় ।

রাতে ভাত খাবার পরে আজ একটু সকাল সকাল শুয়ে পড়ে রুমালী। শরীরটা ভাল লাগে না তার। সে বুঝতে পারে প্রেসারটা বেড়েছে কিন্তু ডাক্তার দেখাতে গিয়ে আরো কিছু টাকা বের হয়ে যাবে এই অভাবের সংসার থেকে। এমনিতেই কেন যেন তার নিজের কাছে মনে হচ্ছে স্বামী তার অনেক চিন্তার মাঝে আছে ।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে  চোখ দুটো কেবল মিলিত হয়েছিল। ঘুম ছুটে যায় একটা গোঙানির শব্দে। অন্ধকারেই বোঝার চেষ্টা করে শব্দটার উৎস কোথায়? এক মুহূর্ত সময় নিয়ে ছটফট করতে করতেই ঝড় বেগে বেড সুইচ অন করে আলো জ্বালে। দেখে মোশারফ ঘেমে একাকার মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। পাগলের মত হয়ে যায় রুমালী। সে কি করবে ভেবে পায় না। গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে ছেলেদের নাম ধরে ডাকে কিন্তু কেউ আসেনা। মোশারফ যেন এবার কিছু বলতে চায়

-“রুমালী শোনো ...তোমার আলমারিতে দশ হাজার টাকা আছে আর আছে আমার কাফনের কাপড় !”
-“এইটা আপনি কী বলেন ? আপনি আমারে একা করে যেতে পারেন না !”
- “আমাকে ক্ষমা করে দিও” মোশারফের নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ।
- “আপনার কিছুই হবে না। আমি আপানকে এভাবে চলে যেতে দেব না ।”রুমালী ছুটে বের হতে চায় মশারীর ভেতর থেকে । হাত চেপে ধরে মোশারফ
- “শোনো! গত মাসে আমার চাকরীটা চলে গেছে...আমার ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। আর,আর তোমার মেঝো ছেলে বিয়ে করছে। কাকে জানো ...? আমার ব্যাংকের এমডির মেয়েকে! যে লোক ঘুষ খেয়ে যারা ঋণ পাবার যোগ্য না সেইসব মানুষকে ঋণ দিয়ে হাজারো মানুষের পেটে লাথি মেরেছে...! আর ,আর তোমার ছোট ছেলে...নেশাখোর...সে নেশা......”শেষের দিকে কথা জড়িয়ে যায় রুমালী কিছুই বুঝতে পারে না ! আবারো চিৎকার দিয়ে ছেলেদের ডাকে। এবার দৌড়ে আসে সবাই । মোশাফর বলে
 –“রুমালী আমার বানানো ঘরে আমাকে রাখবে...লা..ই..লা...হা...!”রুমালীর দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক ভালবাসার দুটি চোখ। তখনো রুমালীর হাতের মাঝে নিথর দুটো হাত।

আধা ঘন্টার মধ্যে বাসা ভরে যায় মানুষে। সবাই ঘরের খাট থেকে নামিয়ে নিয়ে উঠানে একটা তক্তার উপরে রেখে দিলো প্রিয়তমের নিথর দেহ। রুমালীর চোখে এক ফোঁটা পানি নেই ।  সে বুঝে পাচ্ছে না কেন এমনটা হচ্ছে তার! মেয়ে জামাই সবাই এসেছে। সবাই ব্যস্ত মোশারফকে শেষ বিদায় দিতে। চুপ করে বসে আছে রুমালী । সবাই কাঁদছে হাউমাউ করে ,চিৎকার দিয়ে। রুমালীর কান্না আসেনা! সে কেন কাঁদবে? এখনো তার গায়ে প্রিয়তমের নিজের হাতে মাখানো মাটির ঘ্রাণ। সে ঘুমিয়ে আছে,ঐ যে সে ঘুমিয়ে আছে। তার হঠাৎ করে মনে পড়ে “আরে আজতো জুম্মার দিন লোকটা নামাজ পড়তে যাবে না?” – রুমালী আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। আলমারি খুলে সাদা ধবধবে কাফনের দুইটা কাপড় পায়। লোকটা রুমালীর জন্য কিনে আনতেও ভুল করেনি। ছোট ছেলে জামিল এসে পাশে দাঁড়ায়
– “মা বাবার কাফনের কাপড় কেনা হয়ে গেছে আর সরকারী গোরস্থানে কবর খোঁড়াও হয়ে গেছে !”
আস্তে অথচ স্বাভাবিকভাবে রুমালী বলে
-“এই নে তোর বাবার কাফনের কাপড়। আর তোদের বাবা তার নিজের স্থায়ী ঘর নিজেই বানাই রেখে গেছে । সেখানেই তাকে শোয়াতে হবে !”
-“কিন্তু মা ...!” রুমালী হাত উঁচু করে থামিয়ে দেয়। জামিল মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকায় তারপর কি যেন একটা তুলে নেয় প্যান্টের পকেটে ।
বড় ছেলে, মেঝো ছেলে এমন কি মেয়েরা কেউ রাজী হয় না বাবাকে বাসার পাশে কবর দিতে। বড় ছেলে চিৎকার করে বলে

- " এইটা কোন কথা হল বাসার পাশে কবর ? কোন দরকার নেই। বাবাকে নিয়ে যাওয়া হবে সরকারী গোরস্থানে।"  

রুমালী ভেবে পায়না “সরকারী গোরস্থানের পাশে কী কোন বাসা নেই? এরা কী তার নিজের গর্ভে ধরা সন্তান? বাবার অন্তিম  ইচ্ছাটাও কেউ পুরন করবে না ? তোরা কী কেউ বুঝতে পারছিস না সন্তানদের প্রতি কতটা অভিমান থাকলে একজন বাবা এমনটা করে! তোদের টাকায় সে দাফন কাফন কোন কিছুই নিতে চায় না! বেঁচে থাকতে তোরা যেমন খুশি , যা খুশি করেছিস কিছুই বলেনি কখনো। তোদের বাবা কিছুই চায়নি তোদের কাছে কিন্তু এখন তো একটু শান্তিতে থাকতে দে...! ”

সবাই খাটিয়া নিয়ে বের হতে যাবে সামনে দাঁড়িয়ে রুমালী। শান্ত স্বাভাবিকভাবে ছেলেদেরকে বলে তাদের বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ করার কথা ! কিন্তু কোন লাভ হয় না বরং বড় ছেলে বেশ জোরে ধমক দেয় -
- “এইটা আবাসিক এলাকা এখানে কবর দেয়া ঠিক না। আর বাবা এমন আব্দার করতেই পারে না …”কথাটা শেষ ্না করে মায়ের চোখের দিকে তাকায় । আজ কি যেন দেখতে পায় মায়ের চোখে তাই আর কথা শেষ করতে পারে না । রুমালীর ঘৃণা হয় ছেলের কথা শুনে-তাকে সে মিথ্যেবাদী ভাবছে! যদিও এখন এসব তার কাছে মূল্যহীন। সে বুঝে যায় তার কথা সবাই অগ্রাহ্য করছে। বাহানা করে,কথার মারপ্যাচ দিয়ে স্বামীকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে চাইছে! আর তাই যেভাবেই হোক মোশারফের শেষ ইচ্ছা সে পূরণ করবেই...। রুমালী শাড়ীর ভীতর থেকে এবারে স্বামীর রেখে যাওয়া রামদাটা বের করে ছেলেদের দিকে ধরে। তাই দেখে সবাই অবাক হয়ে যায় এবং ভয় পায়। সবাই ভাবে মা পাগল হয়ে গেছে বাবার শোকে । রুমালী জামিলকে বলে
-“তোর ভাইদেরকে বল খাঁটিয়া নীচে রেখে দিতে। আর তুই যদি ভাল চাস তাহলে আমার সাথে সাথে আয়।" মায়ের এমন মূর্তি এর আগে কেউ কখনো দেখেনি। মানসম্মানের কথা ভেবে সবাই এবার মায়ের পিছু নেয়।

পাখীরা বাসায় ফিরতে শুরু করেছে। মনে হল আজ যেন একটু আগে ভাগেই ফিরেছে সবাই । কিন্তু  অন্যদিনের মত করে আজ কোন উল্লাস নেই। মোশারফকে দাফন করে সবাই চলে যায় । শুধু রুমালী থেকে যায় প্রিয়তমের পাশে । রাত গভীরে সবাই একরকম জোরাজুরী করে ঘরে আনে তাঁকে । স্বামীর কাছে শোনা শেষ কথাগুলো এবং কতটা কষ্ট সে এতোদিন চেপে রেখেছিল মনে ,সেই ভাবনা রুমালীকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।


এদিকে চল্লিশ দিন না যেতেই বদলে যায় সবকিছু! রুমালী ভাবে ঐ দশ হাজার টাকা দিয়ে স্বামীর চল্লিশা করবে।  গরীব আর এতীমদের খাওয়াবে। কিন্তু সেই টাকা কোথাও পায়না সে। সারা আলমিরা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায়না সেই টাকা । কিন্তু রুমালীর মনে আছে সে ঐদিনই একটা টাকার বান্ডিল দেখেছিল কাফনের কাপড়ের মাঝে। বান্ডিলটা নীচে পড়ে গিয়েছিল কিন্তু সে উঠাতে ভুলে গিয়েছিল।  নাহ এতো মানুষের  ভীড়ে হয়ত সেদিন কেউ নিয়ে গেছে টাকাটা। কিন্তু কে করল এই কাজ ? এখন কী হবে ?

বড় ছেলে বদলী হয়ে গেছে অন্য শহরে। নতুন জায়গা,ঘর,টাকাও অনেক খরচ হয়ে গেছে। সে আসতে পারবে না চল্লিশাতে । তবে মাকে আশ্বাস দিয়েছে পরবর্তী বছর মায়ের ইচ্ছেমতই পালন করা হবে বাবার কূলখানি এবং তার যাবতীয় ভার বহন করবে সে একা। মেঝো ছেলে নতুন সংসার শুরু করেছে উপরের তলাতে। সে একহাজার টাকা দেয় বাবার চল্লিশার জন্য। ছোট ছেলে জামিল সেই টাকা দিয়ে মসজিদে মিলাদ দেয়। এতিম মিসকিনদের আর খাওয়ানো হয়না। মেয়েরা এসে সারাদিন থেকে যায়। নিজেরাই বাজার করে রান্না করে খেয়েদেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে। বাবা তাঁদেরকে কোথায় রেখে গেল ? বাবা থাকলে এইটা হত ঐটা হত। বাবা কাউকে কিছুই দিয়ে গেল না ? সারাটা জীবন তাদের জন্য বাবা কিছুই করেনি ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা তারপর যে যার মত করে চলে যায় নিজেদের ঠিকানায়। কারো সাথে রুমালীর কথা বলতে মন চাইনি। এখনো সারাদিন সে চুপচাপ শুধুই ভেবেছে - "মানুষটা তাকে সবকিছু বলত। এমন কোন কথা নেই যা তাকে সে বলেনি কিন্তু সেই মানুষটা কি করে চাকুরী চলে যাওয়া, মেঝো ছেলে নিজে নিজে বিয়ে করা, ছোট ছেলে নেশা করে এই সব কথা বুকে চেপে রেখে রুমালীকে হাসিমুখ দেখাতো! সে জানতো এসব জানলে রুমালী অনেক অসুস্থ হয়ে যাবে।  আর তাই তাকে সুস্থ রাখতে মানুষটা এতোগুলো কষ্ট বুকে বয়ে নিয়ে বেড়ালো! মানুষটা কত ভালবেসেছে তাকে !”বহুদিন পর হুহু করে কেঁদে যায় সে ।  

রুমালী প্রতিটা ফজরের এবং মাগরিবের নামাজের শেষে প্রতিদিন হারিকেনের আলোতে মোশাররফের শিয়রে বসে কোরান তেলাওয়াত করে যায়। বাঁকিটা সময় জানালায় বসে কত কথা বলে প্রিয়তমের সাথে । ছেলেরা কে কি বলেছে , কে কি করেছে সব কিছুই বলে। একটা কথাও মনে চেপে রাখে না সে । মাঝে মাঝে কান্নাকাটিও করে কারো কারো দেওয়া কষ্ট থেকে। বাঁশঝাড়ে বাসা বেঁধেছে জোনাকির ঝাঁক। যত রাত বাড়ে তত বাড়ে জোনাকীর নাচ সাথে থাকে বেসুরো ঝিঁঝিঁর গান !

সময়টা যে কী? একেবারে যেন লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যায় !  পনেরোটা বছর চলে গেলো ...! রুমালী এখন চোখে একেবারেই দেখে না। বাগানেও আর যেতে পারে না। কিন্তু জানালার গ্রিলে হাত দিয়ে বসে থাকে। এক পশলা মৃদুমন্দ বাতাসের ঝাঁপটা রুমালীর দেহে পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায় প্রিয়তমের অনুভূতি! শিহরিত হয় সে। বেঁচে থাকার পরম নির্যাস মনটাকে সুধা ভরে শক্তি দিয়ে যায় !
কিন্তু আজ এত শব্দ কেন? জানালা কেউ খুলে দেয় না কেন ? দুর্বল কন্ঠে হাঁক দেয় রুমালী
–“ নিতু ! ও নিতু !” ছুটে আসে সাত বছরের বুড়ীটা । এসেই শুরু করে পাকামো। কোমরে দুহাত রেখে বলে-
“ও-ঐ বুড়ী ! বলেছি না নিতু নিতু করে চিল্লাবা না । দিদা বলবা দিদা,  মনে থাকে না ?”
হাসে রুমালী “ হি হি ...আচ্ছা দিদা এতো শব্দ কিসের ? আর জানালাটা খুলে দেও না কেন?”
-“ হায় আল্লাহ...তুমি দেখি অনেক বোকা ! আরে জানালা বন্ধ করে দিয়েছে যেন কাঠের ধুলো ঘরে না আসে। আর শব্দ ? ইলেক্ট্রিক করাতে গাছ কাটলে শব্দ হবে না তো কি ড্রাম বাজবে ? বোকা বুড়ী ...ঘুমাউ তো !” বেশ জোরে একটা মিষ্টি শাসনের ধমক দেয় সে ।
-“হ্যাঁ রে দিদা, সবাই শুধু আমাকে ঘুম পড়তে বলে। আমার আর জেগে থেকে কি হবে ? আমি তো এখন মরা গাং যেখানে জোয়ার ভাঁটা নেই! এ  গাং কারো কাজে আসে না । আমি তো এখন একটা জগদ্দল---” রুমালী বুঝতে পারে ঘরে এখন কেউ নেই। নিজে নিজে কিছুক্ষণ কথা বলে চুপ হয়ে যায় ।

দুদিন যায় , তিনদিন যায় শব্দ যেন বাড়তেই থাকে। এদিকে জানালাও কেউ খোলে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে । এভাবে যে কতদিন পার হয়ে যায় তার হিসাব রাখতে পারে না রুমালী ! কারেন্টের বিল বেশী আসবে ভেবে ঘরের ফ্যানটাও কেউ ছাড়ে না! ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আজ...চিৎকার দিয়ে ডাকে –“নিতু ও নিতু !”
-“মা নিতু তো স্কুলে গেছে”
“ছোট বৌ জানালাটা একটু খুলে দেও না মা । কত দিন তোমার বাবার কবরটা দেখিনা...দেখিনা ! হা হা কী সব যে বলি! ওমা একটু খুলে দেও না –’

ছোট বৌ মিলা রুমালীকে নিজের মায়ের মতই ভালবাসে আর তাই তার কাছে চরম সত্যটি লুকিয়ে নিজেকে বড় বেশী অপরাধী মনে হয়। রুমালীর মাথায় হাত দিয়ে মিলা বলে –
“মা কয়েকটা দিন এমন শব্দ হবে তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে !”
“কিন্তু বৌমা কীসের শব্দ? আর জানালা কেন খুলছো না ?”
“মা আসলে, আসলে ...”ইতস্ততঃ করতে থাকে মিলা  কিভাবে বলবে কথাটা !
মিলার গলার স্বরেই বেশ অস্থির হয়ে যায় রুমালী
- “কি হয়েছে মা ? আমার ছেলে- মেয়ে , নাতী- নাত্নী সবাই ভাল আছে তো? আমি তো সব সময় ওদের জন্য করুণাময়ের কাছে দোয়া করি তাহলে কি,কি ...!”
মিলা আর সইতে পারে না । তার নিজেরও ভাবতে কষ্ট হয় এমন মায়ের সন্তান হয়ে ছেলেরা কি করে এতো বড় একটা কাজ করতে পারলো ?
-“না আসলে মা পাশের ঐ জায়গাটা ...”
-“হ্যাঁ মা বল !  তোমার শ্বশুর ঠিক আছে তো ? আচ্ছা মা আমি তো তোমাকে প্রথম দিনই বলেছি-আমাকে দেখতে হবে না কিন্তু তোমার শ্বশুরের  দিকে একটু খেয়াল দিও।  সব ঠিক আছে তো মা ?” অস্থিরতা বেড়ে যায় রুমালীর
-“মা ঐ জায়গাটা আপনার ছেলেরা মিলে ডেভলপারদেরকে দিয়ে দিয়েছে !”
-“ও আচ্ছা । খুশি হলাম মা আমার ছেলেরা তার বাবার অনেক খেয়াল করছে শুনে" বুক চীরে একটা ঝড় হাওয়া রুমালীর শরীরটাকে কাঁপিয়ে দেয় !
মিলা বুঝতে পারে তার  শাশুড়ি আসলে কিছুই বোঝেনি। কিন্তু যখন ভেঙ্গে বোঝাতে যাবে তখন কী হবে? কেমন করে সইবে-এই অন্ধ,অসুস্থ মায়ের অগোচরে তারই পেটের সন্তানরা মিলে কতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে! কথাটা মনে হতেই চোখ ভিজে আসে তার। রুমালীর অস্থিরতা আর টেনশনে প্রেশার হাই হয়ে যায়। তাই  দেখে মিলা প্রেসারের ওষুধ খাইয়ে , ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
মিলা এই মানুষটাকে সবকিছু গোপন করে নিজের বিবেককেই কলঙ্কিত করছে। রুমালী যখন সব কথা শুনবে তখন তো তার কিছু করারও কোন শক্তি থাকবে না। তাহলে সবকিছু বলে দিলে কী এমন ক্ষতি হবে? নাহঃ মিলা অন্যদের মত হতে পারবে না। সে নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে চায়, দায়মুক্ত থাকতে চায়। নানা রকম ভাবনা ভাবতে ভাবতে ঘুমন্ত শাশুড়ির মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দেয় সে তারপর গৃহস্থলির কাজে যায়।


পরেরদিন আবারো রুমালী সেই একই প্রশ্ন করে কেন জানালা খুলছে না ? কেন এতো শব্দ ? আজ মিলা বুঝিয়ে বলে !
-“মা আসলে ঐ জায়গাটা আপনার ছেলেরা রিয়েলস্টেটের কাছে দিয়ে দিয়েছে। ওখানে বড় আধুনিক ফ্লাট করা হচ্ছে !”
রুমালী কিছুই বুঝে উঠতে পারে না কিন্তু সেই চিনচিন করে বুকের ব্যথাটা অনেক বেশী বেড়ে যায় । বলে
-প্লাট কী বৌমা !
-ওখানে দালান মানে বিল্ডিং বানানো হচ্ছে মা। সব গাছ কেটে ফেলেছে আর বাবার কবরও..!
-দালান... ! বিল্ডিং বানানো হচ্ছে ? তাহলে গাছ! তোমার শ্বশুর!?
মিলার কথা শুনবার মত ধৈর্য যেন আজ নেই রুমালীর। বেশ ভাবনায় পড়ে যায় সে। কোনভাবেই হিসাব মিলাতে পারেনা । আজ আলোহীন দু'চোখ অঝরে ঝরে যায়! পাথর বুকে সামান্যতম শক্তি সে পায়না। স্বামীর রেখে যাওয়া সব আছে বাড়ী,সন্তান সব, তবুও আজ সে ভীষণ্ভাবে অসহায় বোধ করে।
জীবন বড় বৈচিত্র্যময় ! শুধু সময়ের খেলায় আবদ্ধ হয় আর যেন কিছু নয়। রাজ্যের ক্লান্তি এসে রোধ করে সব ভাষা...! একটু থেমে বহুকষ্টে আবার বলে
–“আচ্ছা তোমার শ্বশুর তো অতো ভার সইতে পারবে না মা ! নতুন নতুন ঘর বাড়ী ...রঙিন রঙিন সব ইট পাথরের ভার...।  আর পাখীরা …পাখীরা সব কোথায় যাবে? আর,আর আমার ঘর? আচ্ছা আমি,আমি কোথায় থাকব? তোমার শ্বশুরের পাশে থাকতে পারব না ......? ” রুমালী অস্থিরতায় কী করবে ভেবে পায়না। কথাগুলো বলতে বলতে খাট থেকে নেমে হাঁটতে চায় কিন্তু পারে না। ভুলে যায় সে যে প্যারালাইজ্ড। শরীরটা অনেক বেশী ভারী মনে হয়। ছেলে মেয়ে সবার কথা শুনতে পায় সে । সবাই যেন কি বলছে ঠিক বুঝতে পারেনা । নীতু কাঁদছে “দিদা” “দিদা” বলে। কেউ একজন ভীষণ জোরে মিলাকে চড় মেরে বসেছে; জামিলই হবে । মিলা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। মেয়েটা মাফ চাচ্ছে বারবার রুমালীর কাছে “মা আমাকে মাফ করে দিবেন প্লিজ, মা আপনার শরীর এতোটা খারাপ হবে ভাবলে আমি অন্য সবার মত চুপ থাকতাম মা। আপনার জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি মা..আমাকে মাফ করে দিবেন মা ” ধুর বোকা মেয়েটা...এতো ন্যাকামো দেখানোর কী আছে ? তুই কী পারতি না স্বামীকে সাথে নিয়ে প্রতিবাদ করতে!? তুইও প্লাটের লোভ করেছিস জানি আমি...! হঠাৎ সব কোলাহল থেমে যায়। আরে মোশারফ এলো কোথা থেকে! হাতে কাঁদা মাটি মাখা! লোকটার একটুও পরিবর্তন হয়নি ! মুখ টিপেটিপে হাসছে আর হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকছে। ছুতে চায় রুমালী প্রিয় মানুষটাকে কিন্তু দূরে সরে যায় সে! কেন তাকে নিঃসঙ্গ করে চ্লে গেল সে? কেন সে একাকী এই কষ্টের জীবনকে বয়ে চলেছে? কেন তার জীবন আজ এভাবে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে? অভিমানভরা হাজারো প্রশ্নের জলধারা আজ দু'চোখে আনে জোয়ার...। বহুদূর থেকে গুনগুন সুর ভাসে ….. “আমারে শুয়াইয়া দিও মাটির বিছানায়.....ও বন্ধু ঘুম পড়াইয়া দিও আমায় মাটিরও ছায়ায়...” গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে! "পানি... একটু পা...ন...ই... "
আজ আর তেষ্টা মেটাতেও কেউ আসেনা! রুমালীর অনেক ঘুম আসে,অ-নে-ক ...। নতুন ঠিকানার আশায় সে তলিয়ে যেতে চায় প্রিয়তমের ভালবাসায় সিক্ত হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। দুজন ছুটে চলতে চায় রঙবেরঙের পাখা মেলে!
সহায় সম্বলহীন হয়েও একটুখানি সুখ খুঁজে ফেরে আলো আঁধারিতে অনেক দুরের কোন জোনাকি আর ঝিঁঝিঁদের ঘেরা বাঁশ বাগানের কোমল আলিঙ্গনে ! কিন্তু তা আর হয়না! ধীরে ধীরে রুমালী তলিয়ে যায় একাকীত্বের নিঝুম অন্ধকারে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এশরার লতিফ আপনার লেখায় তো ভোটিং বন্ধ ছিল.
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪
আরশ আলো ভাল লাগল। দীর্ঘ লেখা।
আখতারুজ্জামান সোহাগ বড় পরিসরে লেখা গল্প, কিন্তু পড়ার সময় মনযোগ হারাইনি। মোশারফ সাহেবের মৃত্যু, এবং তারপর তার সন্তানদের আচরণ, বিশেষ করে পনের বছর পর কবর সমেত পুরো জায়গাটা ডেভেলপারদের হাতে তুলে দেওয়া- এই ব্যাপারগুলো মনটাকে ভারি করে দিল। আপনি সব সময় ভালে লেখেন। এটাও বরাবরের মতো। শুভকামনা আপু।
গল্পটা অনেক বড় হয়ে যাওয়ায় আন্তরিকভাবে দুঃখিত তবে ভাল লাগল জেনে পড়ার সময় মনযোগ হারাইনি ! অনেক অনেক ধন্যবাদ পড়ে সুন্দর মন্তব্য করায় সতত শুভকামনা
Azaha Sultan কতদূর পড়েছি......সময় না থাকাতে ফিরছি, পরে এসে দেখব আশা রইল.......
অনেক ধন্যবাদ সময় বের করে পড়ার জন্য
এশরার লতিফ এমন সন্তানদের কথা আগে ভাবতে পারতাম না, এখন পারি. মানুষের লোভ মানুষকে ভেতরে ভেতরে ধংস করে দ্যায়. সুন্দর গল্প, ভালো লাগলো.
অনেক অনেক ধন্যবাদ সময় দিয়ে গল্প পড়ে মুল্যবান মন্তব্য করায় সতত শুভকামনা
অপদেবতা গল্পটা ভোট পাওয়ার জন্য ফিট
ধন্যবাদ শুভেচ্ছা রইল
শামীম খান গল্পটা পড়ে মন একেবারে হাহাকার করে উঠলো । বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের চেয়ে অসহায় আর কে হতে পারে যাদের সন্তানেরা মানুষ না হয়ে অমানুষ জানোয়ার হয়ে যায় । সুন্দর হয়েছে । লেখককে অফুরন্ত শুভেচ্ছা ।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ সতত শুভকামনা
সাদিয়া সুলতানা আচ্ছা তোমার শ্বশুর তো অতো ভার সইতে পারবে না মা ! নতুন নতুন ঘর বাড়ী ...রঙিন রঙিন সব ইট পাথরের ভার...। আর পাখীরা …পাখীরা সব কোথায় যাবে? আর,আর আমার ঘর? আচ্ছা আমি,আমি কোথায় থাকব? তোমার শ্বশুরের পাশে থাকতে পারব না ......?........আমার মা-শ্বশুর-শাশড়ি তাদের যেন এই হাহাকারে পড়তে না হয় তাই মাঝে মাঝে ভাবি। ছোট ছিলাম বেশ ছিলাম। সবার সংসারের ডালপালা বাড়বার সাথে সাথে যেন হিসেবও বাড়তে থাকে। ভাই-বোন অচেনা হয়ে যায়। আমার খুব কাছের মানুষদের সম্পত্তি নিয়ে এমন বাস্তবতা দেখেছি আমি। জীবনের গল্প। শুভকামনা ও সালাম জানবেন।
ধন্যবাদ গল্প পড়ে মন্তব্য দেবার জন্য শুভকামনা সতত
মালেক জোমাদ্দার খুব সুন্দর গল্প , আমার কবিতা ও গল্প পড়ার অনুরোধ থাকলো। শুভ কামনা।
ধন্যবাদ গল্প পড়ার জন্য শুভকামনা রইল
আফরান মোল্লা হৃদয়ে আঁচড় কেটেছে গল্পটি।শুভকামনা রইল।
অনেক অনেক ধন্যবাদ সময় দিয়ে গল্প পড়ার জন্য শুভেচ্ছা রইল
আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছুটা আমার গল্প এবং কবিতার পাতায় বিলিয়ে গেলে অনেক খুশি হতাম।নিরন্তর শুভকামনা।

২৭ মে - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪