(এক)
গ্রীষ্মের ভরদুপুরে যখন গরম থেকে কিছুটা শান্তি পেতে সবাই ভাতঘুমের কোলে আশ্রয় নিয়েছে,মর্জিনা তখন ঘরের দরজায় মেঝেতে বসে ভাবনার অতলে ডুবে আছে। আর মন্টু তখন ঘরে ফ্যান ছেড়ে শান্তিতে ঘুমের ঘোরে এপাশ ওপাশ করছে...! ডানপিটে ছেলেটা সেই জন্ম নেবার দিন থেকেই জ্বালিয়ে যাচ্ছে ! গর্ভে থাকতে এতো নড়াচড়া করত যে স্থীর হয়ে বসতে শুতে অনেক অসুবিধা হত মর্জিনার। এই নড়াচড়া'র কথা শুনে সবাই বলতো ছেলে হবে! আর এই ছেলে ফুটবল খেলোয়াড় হবেই! জন্ম নিয়ে ছেলে কোথায় ফুটবল খেলোয়াড় হল! হয়েছে এক নম্বরের ডানপিটে চঞ্চল এক উড়ন-চণ্ডী! সারা গ্রামের মানুষের ঘুম হারাম করে নালিশ নিয়ে বাড়ীর সামনে লম্বা লাইন তৈরী করে ছেড়েছে সে।
সেইসব দিনগুলোর কথা মনে হলে আজও মর্জিনা শিউরে উঠে ! সেসময়ে গ্রামের মানুষ সবাই অপেক্ষায় থাকতো কবে হক ছুটিতে গ্রামে আসবে,আর সবাই মিলে কে কার আগে মন্টু'র নামে নালিশ করে তাকে সাঁজার ব্যবস্থা করবে সেই আশায়! মর্জিনা এই নিয়ে ভীষন কষ্টে থাকত। কারন মাসে তিনদিনের জন্য মানুষটা গ্রামে আসে আর এসেই ছেলের কারনে অনিচ্ছাই নানা রকম মানুষের নানা রকম কথা শুনতে হয়! মর্জিনা ভাবে সে সহজ সরল মুর্খ গ্রাম্য বঁধু বলেই হয়ত ধৈর্য শক্তিটা একটু বেশিই পেয়েছে ! স্বামী হক তাকে সংসারের প্রতিটা বিষয়ে দোষারোপ করে যায়। তার ধৈর্য না থাকলে তার স্বামি'র ব্যবহারে মহল্লার মানুষ প্রায় প্রতিদিনই শালিশ বসিয়ে একবার করে সাতপাঁচ কথা শুনিয়ে দুজনকে দুদিকে করে দিত! যদিও সে কাজটি ছেলে মন্টু বেশ ভালই করেছিল! আলাদা করে দিয়েছে প্রাণের মাটি থেকে...!
গ্রাম ছেড়ে এই মফঃস্বল শহরে এসেছে সেও দীর্ঘ সময়...। গ্রামে থাকার সময়ে মর্জিনা সচরাচর স্বামীকে কিছুই বলতে সাহস পেতনা। কেননা অভাব অনটনের সংসার তার উপর স্বামী থাকে শহরে। যে কয় দিনের জন্য আসে তাতে সে নিজেই খুঁটে খুঁটে মর্জিনার ভুল ধরে চিৎকার চেঁচামেচি করে! মুরগীতে বারান্দায় পায়খানা করলেও সেইটা মর্জিনা'র দোষ ভেবে কয়েক কথা শুনিয়ে দেয় যে মানুষ,তাকে আগ বাড়িয়ে ছেলেকে নিয়ে কিছু বলার সাহস তার কখনো হয়ে উঠেনি! কিন্তু দিনে দিনে ছেলেকে নিয়ে গ্রামের কয়েকজন মানুষ প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন নালিশ নিয়ে ঘরের দরজায় এসে হাজির হয় ...! কী করা উচিৎ, কী করলে ছেলের ভাল হবে, মানুষের মত মানুষ হবে এইসব ভেবে দুঃশ্চিন্তা আর ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতেন মর্জিনা।
(দুই)
মর্জিনা জানে কেন মন্টু গ্রামের কয়েকজন মানুষকে শান্তিতে রাখ্তে চায়না। মন্টু গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে একবার গ্রামের একটা বাড়িতে যায়। সেখানে মন্টু ছাড়া অন্য বাচ্চারা কুল বরই চুরি করে। সে জানে চুরি করা অনেক পাপ তাই সে ওদের সাথে ঐ বাসায় গেলেও চুরি করে না বা ঐ কুল বরই খায় না। যখন মালিক আসে সবাই দৌড়ে পালিয়ে যায় কিন্তু মন্টু ভাবে সে তো চুরি করেনি তাই সে কোথাও যায় না । আর মালিক এসে ওকেই ধরে এবং রোদের মাঝে ভর দুপুরে দঁড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। শুধু তাই না খুঁজতে খুঁজ্তে যখন মর্জিনা ওখানে আসে তখন ঐ মালিক মর্জিনাকেও অনেক কথা শুনিয়ে দেয়। মন্টু যত বলে সে চুরি করেনি তত ঐ লোকটা চড়াও হয় তার উপর এবং মর্জিনাকে অনেক কথা শুনিয়ে দেয়। গ্রামের অন্য ছেলেমেয়েকে কিছুই বলে না কারন তাদের অবস্থা ভাল এবং বেশ আধিপত্য আছে তাদের বাবা চাচাদের। যা মন্টুদের নেই...! ঐ বাসা থেকে মন্টুকে নিয়ে গিয়ে মর্জিনা ছেলেকে ভীষণ মার দেয় যা মন্টুর প্রাপ্য ছিল না।
মন্টুর বয়স যখন আট বছর তখন থেকে শুরু এই নালিশের। প্রথম প্রথম কেউ বলতো তাদের গাছের ফল চুরি করেছে, ক্ষেতের শশা চুরি করেছে ! আর মন্টু বলতো সে চুরি করেনি। এভাবে বেশ কয়েকবার গ্রামের কয়েকজন গৃহস্থ্য মানুষের সাথে বাক-বিতন্ডা হয়ে যায়..! আর সেই থেকে সত্যিই মন্টু চুরি করতে লাগল। সে চুরি করার আগে মালিকের কাছে চাইতো না দিলে বলত" ঠিক আছে চাইছি দিলে না যেদিন গাছ ন্যাড়া করে সব খাইয়ে ফেলবোনে সেদিন ভেউ ভেউ কইরে কাইন্দে কাইন্দে বুক ভাসাইয়েনে"! এরপরই সে চুরির কাজগুলো করতো। তার ভাষায় সে চুরি না করেও যখন চোর হয়েছে তখন চুরি করেই চোর হোক! মা দাদী কারো কথায় সে শুনল না...!
বার তের বছর বয়সে সে ঘ্টিয়ে ফেলল একই দিনে দুটি ভয়াবহ ঘটনা ! যা থেকে প্রিয় জন্মভুমি'র মাটি ছাড়তে বাধ্য হল তারা! একদিন একজনের গাছে ঢিল মারলে তা গাছে না লেগে ঐ বাড়ি'র বৌ'য়ের কপালে লাগে! ব্যস এই নিয়ে নানা গল্পের জন্ম দিয়ে পুলিশের ভয় আর ধামকি দিতে থাকে। সেই সময়ে হক বাড়িতে ছিলেন। সব শুনে খুব রেগে গেলেন। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে আজ। মর্জিনাকে আগে শাষালেন কেন সে একটা ছেলেকে মানুষ করতে পারছে না...।
-"কেন আমি কি টাকা কম দেই যে ছেলেরে পাগলা গরু বানাই গ্রামে ছাইরা দিছো?"
-"কি কচ্ছেন আফনি! ছেলে কথা শুনলি না কিছু..."
-"কথা কলাম একদম কবিনা বৌ ... তালি ফরে তোরেও আইজকে যমের ঘরে পাঠাই দিবানি। কৈ সেই জানোয়ারের বাচ্চা? আইজকে ওর একদিন কী ওর বাপের একদিন।"
মর্জিনার শাশুড়ি পাশেই ছিল ছেলের কথা শুনে হাঁক দেয়
-"ওরে ও জানোয়ার মাসের মধ্যি একবার আইসে বাচ্ছার খুঁজ নিলি কী বাচ্ছা মানুষ হইয়ে যায়?"
হক এবার আরো রেগে যায় ঘরে ঢুকে দেখে মন্টু ঘুম। মন্টু আসলে এতোক্ষণ সব শুনছিল। পরিস্থিতি বুঝে বের হতেও চেয়েছিল ঠিক সেই মুহুর্তেই দেখে বাবা ঘরে ঢুকছে তাই সে ঘুমের ভান করে পড়ে আছে।
-"ঐ জানোয়ারের বাচ.."থেমে যায় হক মায়ের কথা মনে করে। এবার আরো চড়া গলায় বলল
-"ঐ জানোয়ার মানুষ বাসায় নালিশ নিয়ে কেন আসলো? আইজকে তোরে মাইরেই ফেলবো।" লাঠির বাড়ি গায়ে দিতেই মন্টুও চিৎকার দিয়ে উঠে
-"ওরে বাবারে...জানোয়ারের বাপ আমারে মাইরে ফেলল রে..."হকের রাগ একেবারে মস্তিস্কের মধ্যে হাঁতুড়ি পেটাতে শুরু করেছে। মন্টু খিচে জোরে দৌড় দিতেই পিছনে ধাওয়া করে হক। আজকে ছেলেকে হাতে পেলে একেবারে আটার দলা বানিয়ে ছাড়বে ! ওদিকে মন্টু দৌড়ে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। হক দৌড়ে বের হতে গিয়ে গবরে পা দিয়ে পিছলে পড়ে যায়
-"ওরে আল্লারে আমার মাজা গেল রে ..। পুতের পুত আজকে ছাড়াবো তোর ভুত!"হকের পিছনে ততক্ষনে মর্জিনা এসে দাঁড়িয়েছে । গবর কীভাবে এইখানে এলো সে বুঝেই পেল না কারন গরু সেই সকালে মাঠে নেয়া হয়েছে এখনো ঘরে আনা হয়নি। সে নিজে হাতে সব পরিষ্কার করেছে। তাহলে...! ছেলেটা যে একেবারে বদ হয়েছে তাতে আর সন্দেহ নাই। মর্জিনা স্বামীকে হাত ধরে উঠাতে চেষ্টা করে বলে-
-"উইঠে আসেন- পুকুরে চলেন"
-"হ্যাঁ আমি পুকুরে যাই আর তুমি এই ফাঁকে ঐ বান্দরডারে বাপের বাড়ি পাচার কইরে দাও, না? আইজকে ওর পাছার ছাল উঠাই যদি না দিছি তো আমার নাম...ওরে বাবা রে!" ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে। স্বামীর কথা শুনে মর্জিনার বেশ হাসি পায়। "ছেলের ছাল উঠাবে কী নিজেরটা উইঠে...."-মনে মনে ভাবে। কিন্তু সে হাসে না বরং ছেলের উপর ভীষণ রাগ হয়। স্বামীকে ধরে পুকুর ঘাটে নিয়ে যায়। হক রাগে থরথর করে কাঁপছে। মন্টু বাবাকে নিয়ে বেশ মজা পাচ্ছে। গাছের আড়াল থেকে বাবাকে অনুসরণ করে পুকুরের ওপাড়ে যায়।
পুকুরের দুই পাড়েই খেঁজুরের গাছ কেটে লম্বা ভাবে পাড় থেকে পানির মাঝে দিয়ে পুকুরে নামার সুবিধা করে দিয়েছে। এপাড়ে হক পানিতে নেমে গবর ধুয়ে নিচ্ছেন আর অন্যপাড়ে যে লোক নালিশ করেছিল সে গোসল সেরে খেঁজুর গাছের সিড়ি বেয়ে উঠে আসছে । এমন সময়ে খেঁজুর গাছের সিড়ি বেশ জোরে নড়তে থাকে। কিন্তু পুকুরে পানি কম থাকায় এবং পাড় দুরে থাকায় কাউকেই সে দেখ্তে পাচ্ছে না। ঝাকিতে কোনভাবেই সে উপরে উঠে আসতে পারছে না। লোকটা ভাবলো ভুমিকম্প হচ্ছে। পানির দিকে তাকিয়ে দেখে তার মনে হল পানি ফুসে উঠছে! লোকটার ছিল ভুমিকম্পের প্রচন্ড আতঙ্ক! তিনি যখন ছোট ছিলেন সে সময়ে তার বাবা ভুমিকম্পের সময়ে গাছ চাপা পড়ে মারা গেছেন। সেই কথা মনে হতেই তিনি ঘাবড়ে গেলেন! চিৎকার দিয়ে পড়িমরি করে পানি থেকে উঠে আসতে গিয়ে গামছা লুঙ্গি সব পুকুরে রেখেই উঠে এলেন উপরে..! লোকটার চিৎকার শুনে অনেক মানুষ পুকুর পাড়ে এসে ভীড় করেছে। হক আর মর্জিনাও এসে দাঁড়ালো সেই ভীড়ে! লোকটাকে ঐ অবস্থায় দেখে সবাই লজ্জায় নিজেদের চোখ ঢেকে ফেলল। আর তা দেখে লোকটার খেয়াল হল সে কী ভুল করেছে...। নিজের দিকে তাকিয়ে উল্টোপথে দৌড়াতে দৌড়াতে লোকটা বাড়ির দিকে যায়। আর তার পিছু পিছু ছোটে মন্টুসহ ছোট্ট কিশোরদের একটা দল। সবাই একী সুরে বলে " পাগল,পাগল"মর্জিনার বুঝতে বাকি থাকে না এর পিছনে কে আছে।
(তিন)
পুকুর ঘাট থেকে বাসায় এসে হক যা কোনদিন করেনি এই প্রথম তাই করল...! মন্টুকে না পেয়ে মর্জিনাকে মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দিল...! পরের দিন মর্জিনা স্বামী একটু শান্ত হলে অনেক বুঝিয়ে বলে যেন মন্টুকে শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। যে কথা স্বামীকে এতোদিনে বলেনি সেইসব কথা আজ বলে -
-"আপনি কন আপনারে যদি কেউ বিনা কারনে ইয়ার্কি করে বা আপনি চুরি না কইরেও চোর হন;আপনারে চোর চোর কইরে ডাকে, শাস্তি দেয়, বাসায় মুরুব্বিগের কাছে নালিশ করে তালি পরে তহন আপনি কী করবেননে?" হক ভাবনায় পড়ে যায়- মনে পড়ে অফিসের একটা ঘটনা যা তার মনে দগদগে ঘা'র মত বসে আছে!
একদিন অফিসের সবাই বসে বাতেন সাহেবের প্রমোশন হয়েছে সেই উপলক্ষ্যে মিষ্টি খাচ্ছে। তাকে দিয়েই আনিয়েছে অথচ তাকে একটা মিষ্টি কেউ দেয়নি যা তার কাছে খারাপ লেগেছে। সে নিজে থেকেই সবাইকে পানি দিতে দিতে বাতেন সাহেবকে বলে -স্যার মিষ্টি খালি নিজিরা নিজিরা খালেন বাসার জন্যি নেবেন না? কথাটা শুনে বাতেন সাহেব বলে- আরে হক তোমারেও তো মিষ্টি দেয়া হল না ।
জামান সাহেব সাথে সাথে টিপ্পনি কাটে-
-"কী যে বলেন বাতেন সাহেব ও আবার মিষ্টি খায় নাকি ! হজম করতে পারবে না, ডায়াবেটিক হবে না ?"হক জানে এই জামান তাকে পছন্দ করে না। কিন্তু তাই বলে সবার সামনে যা মুখে আসে তাই বলবে? আজ কেন জানি বলতে ইচ্ছে হল -
-"কেন স্যার গরিব পিয়ন বলে কী মিষ্টি খেতে নেই" কিন্তু বলতে পারল না। কথাটা বলে দিল শিরিন ম্যাডাম " কেন জামান সাহেব গরীব মানুষের কী মিষ্টি খাওয়া নিষেধ? ওদেরই কেবল ডায়াবেটিকের চিন্তা করতে হবে? বড় লোকদের কী এই রোগ হয় না?"
-"আরে আপা আপনি কেন ওর হয়ে উকালতি করছেন?"এই কথা শুনে এবার টিপ্পনি কাটে মুসা সাহেব। যে কিনা জামান সাহেবের কাছের মানুষ।
-"কী ব্যাপার আপা ..ঘটনা আছে নাকী?"চোখে টিপ্পনি দেয় যা শিরিনের ভাল লাগে না
-"আপনারা আসলে ইয়ার্কি করতে করতে মাত্রা ছাড়িয়ে ফেলেন এইটা ঠিক না"!- উষ্মা ঝরে পড়ে শিরিনের কন্ঠে । ঠিক ঐ সময় হক পানি নিয়ে বের হতে যাবে পিছন থেকে ডাক দেয় জামান-
- "ঐ ব্যাটা পিয়ন পানি দে ..।"হকের সহ্য হলনা কথাটা সে বেশ নরম সুরেই বলে
-"স্যার বাবা মা'র দেয়া একটা নাম আমার আছে -আব্দুল হক।" অমনি খুঁট মেরে জামান বলে
- " ইস নাই ঢক নাই পদ নাম রাখছে আব্দুল হক" শিরিন আপা ছাড়া সবাই হেসে দেয়। হক রুম থেকে বের হয়ে যায়। সেদিন মনে হয়েছিল জামানকে ঘুষি মেরে রক্ত বের করে দিতে। এবার সে ছেলে মন্টুর মনের কষ্টটা কিছুটা বুঝতে পারল! পরের দিনই পরিবার নিয়ে গ্রাম ছেড়ে এই শহরে এসে ঘর বেঁধেছে।
মর্জিনা অনেকটা স্বস্তি পেল শহরে এসে। মন্টু নতুন পরিবেশে এসে মোটামুটি লেখাপড়া আর হিন্দি সিরিয়াল নিয়ে অনেক ব্যস্ত হয়ে উঠলো। সেই যে গ্রাম ছেড়েছে আর গ্রামে যাওয়া হয়নি! বাবা মা গেলেও মন্টু'র কখনও মনে হয়নি গ্রামে যেতে। এই শহরেই বেশ ভাল আছে সে।
(চার)
সময়ের স্রোতে দিন চলে যায় দিনের নিয়মে...! এক সময়ের দুরন্ত মন্টু বিয়ে করে সংসারি হয়েছে তাও সাত বছর হয়ে গেল...। মেয়ে রুবিনা'র বয়স এখন ছয় বছর। এই শহরেই গ্রামের বাল্যবন্ধু বিয়ে করেছে,এখন গ্রামেই বৌভাত করবে। মন্টুকে পুরো পরিবার নিয়ে যেতে হবে...। মন্টু'রও বহুদিন পর গ্রামে যেতে খুব মন চায়ছে..। সেই সবুজ মাঠ যেখানে বন্ধুরা মিলে হৈচৈ-হুল্লোড়ে কেটেছে শৈশব...সেই ছায়া ঘেরা পুকুর যেখানে সবাই মিলে উড়ন্ত পাখির মত ডানা মেলে ঝাপিয়ে গেছে এপার থেকে ওপার! সেই শাপলা দীঘি জল, বৈচী'র বন,নীলাকাশ ছুয়ে দিগন্তের চুড়া পেরিয়ে ছুটেছে জীবন! সেই সময়ে সবাই গ্রাম ছাড়লেও দাদী ছাড়েনি। আর তাই তিনি মারা গেলে মা আর বাবা গেছে গ্রামে শুধু মন্টু যায়নি! প্রিয় দাদীর আকুতিও মন্টুর অভিমানের বরফ গলাতে পারেনি আর তাই মনের মাঝে কষ্টটা আজকাল অনেক বেশি জ্বালায়। গ্রাম আজ খুব টানছে তাকে....!
এদিকে কোনভাবেই মর্জিনা মন্টুকে সাথে নিয়ে গ্রামে যেতে রাজি নয়। বলে -
-"নারে বাবা অনেক কষ্টে তোর ছোট বেলার সেই সব অপমানের দিনগুলোনের কথা ভুইলে গ্রামের মানুষ আমাগের আপন করে নিছে...। আমরা গ্রামে গেলি সারা গ্রাম জুড়ে একটা উৎসবের জোয়ার বইয়ে যায়। আজ তুই গ্রামে গেলি যদি আবার কিছু ঘটে তালি পরে সে ধাক্কা সহ্য করতি পারব নানে" মন্টু মায়ের কথায় হেসে খুন-
-"ক্যা বলতা হো মা ! এক মেয়ের বাবা হু ম্যা তাও আমি গ্রামে জায়েজ্ঞে তো তোমহারে ধাক্কা খাওয়াব? ক্যাইছে ভাবলা তুম? কুচ নেহি হোগা অর তুমহা...।" মর্জিনা রেগে যায়-
-"চুপ কর...! তরে না কইছি এইসব খিছুড়ি মার্কা কথা কবি না আমার সামনে...!"মায়ের কথায় দাঁত বের করে হাসে মন্টু । বলে
-"অভ্যেস হইয়ে গেছে। আইচ্ছা আর কব না... কচ্ছিলাম তোমার বৌমাও গ্রাম দেহেনি কোনদিন। তাই চল দেইখো এবার গ্রামে গেলি আর শহরে আসতি চাবা নানে"
মর্জিনাও চায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রামে যেতে। বিশেষ করে পুত্নীকে দেখাতে চায় গ্রামের সবাইকে....। কিন্তু হককে কোনভাবেই রাজি করানো যাচ্ছে না! তার কথা"এবার যদি কোন অঘটন ঘটে তাহলে এই বয়সে এসে ধৈর্য ধরে মুখ লুকানোর মত শক্তি সে পাবে না...হয়ত স্ট্রোক করে ওখানেই মরে যাবে সে। তবে মরার আগে মর্জিনাকে মেরে তক্তা বানাবার মত শক্তি সে পাবে!" কথাগুলো শুনে মনের মাঝে ধুকপুক শুরু হয়ে যায় "এই বয়সে এসেও ছেলে বৌ পুত্নীর সামনে...!" দোদুল্যমান ভাবনায় দোলে সে তবুও সাহস নিয়ে বলে "দেখবেন কিছুই হবে না...! বিশ্বাস রাখেন সব কিছুই ভাল হবে"।
(শেষ)
কী সুন্দর মায়াময় ছায়া ঘেরা গ্রাম...যেদিকে চোখ যায় জুড়িয়ে যায় মন। এখানে নেই অহেতুক শব্দ, নেই চিৎকার চেচামেচি! নেই মানুষের কোলাহল! আর তাই ছোট্ট পাখি'র কিচিরমিচিরও হৃদয়ে সুরের মুর্ছনা তোলে। আগের সেই মেঠোপথ দখল করে নিয়েছে পিচঢালা পথ আর লঞ্চের জায়গায় বাস! মন্টু'র চোখ ভীজে আসে জলে..! আনন্দের সীমা পেরিয়ে গতকাল সবাই মিলে গ্রামে এসেছে।
আজ ছেলের বাড়িতে বৌভাতের অনুষ্ঠান। বৌয়ের বাড়ি থেকে অনেক আত্মীয়-স্বজন এসেছে। সরবত,নাস্তা খেয়ে বৌয়ের বাবা সরদার সাহেব ঘরের বারান্দার চৌকিতে আধশোয়া হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। ঘরের মাঝে ফিসফিস করে সবাই বলাবলি করছে -
-"আরে মেয়ের বাপ কোন দিকে তাকায় আর কার দিকে তাকায়ে কথা বলে তার কিছুই বোঝা যায় না!" মর্জিনা রুবিনাকে কোলে নিয়ে বসে বসে সবার কথা শুনছে । একজন বলল
-"আরে আমরা দুজন গেছি সরবত দিতে। মেয়ের বাবা জিজ্ঞাসা করে তোমার নাম কি? আমি তাকাই ওর দিকে ও তাকায় আমার দিকে! কারে জিজ্ঞাসা করে বুইঝে পাইনা। আমি কলাম-আফনি কারে জিজ্ঞাসা করেন? সে তাকায় আছে আমার দিকে হাত দিয়ে দেখায় ওরে! কয় - উনারে জিজ্ঞাসা করি,নাম কি?"
ঘরের সবাই হো হো করে হেসে খুন...। সমালোচনা,হাসি,তামাশা যখন তুঙ্গে,ওদিকে তখন সরদার সাহেব তাকিয়ে দেখে ছোট্ট ছয়-সাত বছরের ফুটফুটে একটা মেয়ে এক দৃষ্টি নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চোখ দুটো দেখে মায়ায় তার নিজের চোখেই জল এসে যায়-"আহারে বাচ্চা মেয়েটা দেখতে কত সুন্দর অথচ তার চোখ দু'টো হয়েছে সরদার সাহেবের চোখের মত।" ইশারায় মেয়েটাকে কাছে ডাকে...আদর করে জিজ্ঞাসা করে
-মামনি তোমার নাম কি?
-রুবিনা -মিষ্টি সুরে মেয়েটা বলে
-খুব মিষ্টি নাম...তুমি দেখতেও বেশ মিষ্টি। তা মামনি লেখা পড়া কর?
রুবিনা মাথা কাত করে বলে
-হ্যাঁ স্কুলে যাই আসি, বুয়া ব্যাগ নিয়ে যায় আর আমি সাথে থাকি। বাসায় আম্মু পড়ে আমি শুনি..! একটু থেমে বলে
-"আংকেল আপনি ওমন করে চোখ একরা বেকরা (এবড়ো-থেবড়ো)করে কেন তাকান ? কথাটা শুনে হো হো করে হেসে দেয় সরদার সাহেব। সরদার ভাবে মেয়েটা নিজেই একরা বেকরা করে তাকায় অথচ সে জানে না ! আসলে জানবে কী করে! সে নিজেই কী জানে সে একরা বেকরা করে তাকায়। মেয়েটার চোখের দিকে আরেকবার তাকাতেও বেশ কষ্ট অনুভব করে তাই আর সেদিকে তাকায় না। আদরমাখা কন্ঠে বলে
-"তা মামনি এই নাও মিষ্টি কিনে খেও।" এই কথা বলে একশো টাকার একটা নোট রুবিনা'র হাতে জোর করে গঁুজে দেয়। রুবিনা প্রথমে না না করলেও পরে টাকাটা মুঠোয় পুরে নেয়। মেয়েটার জন্য অনেক বেশি মায়া হয়...হেসে সুন্দর কচি মুখ খানা দু'হাতে তুলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে এবার মেয়েটার চোখের দিকে তাকাতেই সব হাসি মিলিয়ে যায়..। গায়ের রক্ত সব যেয়ে টগবগ করে ফুটে উঠে মাথার মধ্যে! রেগে গেলে আঞ্চলিক ভাষায় সে কি বলে নিজেই জানেনা...! সরদার সাহেবের গর্জনে কেঁপে উঠে সারা বাড়ি।
মর্জিনা এতোক্ষণে খেয়াল করে রুবিনা তার কাছে নেই ...আজ কত বছর পরে গ্রামে এসেছে পুরো পরিবার নিয়ে আল্লাহ জানে কীসের গজব পড়ল! ছুটে সবাই বারান্দায় আসে । মর্জিনা দেখে রুবিনা কেঁদেই যাচ্ছে আর তাকে ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে গর্জে যাচ্ছে বৌয়ের বাবা-
-"ওয় বদমাইশ্যা মাইয়া গু খার? আই আর ইয়ান থাউম না ! আইর মাইয়া ওয় গরে হাঙ্গা দি আই ভুল হচ্চি। হেতি ওয় বাইর বৌ ওইত না .. আইর এজ্ঞা মাইয়া হেতি আইর লগে আইতে না ছাইলে হেতিরে ঘেঁডি দরি লই যামু, হুহুরের হানির মইদ্যে মাডি দি হালামু ...আই উজ্ঞারে কাডি নদীত ভাসাই দিমু, কাউয়া দি খাওয়াই দিমু তবু ওয় গরে দিতাম না !" কথাগুলো বলতে বলতে একফাকে রুবিনাকে দেয়া টাকাটা ছোঁ মেরে তার হাত থেকে নিয়ে পকেটে পুরে ফেলে। তারপর একটু থেমে আবার শুরু করে "যে হোর বাসাত হগলে মাইয়ার বাফরে হম্মান কৈত্তাম হারে না,হেই বাসাত আইর মাইয়া হুইত্তেন্ন,খাইত্তেন্ন ..!"
রাগে গপ্জগজ করতে করতে রুবানাকে আরো শক্ত করে ধরে বলে- "ওয় সতানি হুচকান মাইয়া, হেত্তে কিল্লাই আইর লগে হ্যারা সাঁজি মশখারা হরিল... বেয়াদ্দপের বেয়াদ্দপ...হান্দরের লেনজা হান্দর ! ওয় হেয়ানা মাইয়া হাগলের হাইচ্চা হাগল?" সরদার সাহেব একটু থেমে দম নেয়। হাঁপিয়ে গেছে সে।
মর্জিনা অনুভব করছে সমস্ত পৃথিবী কাঁপছে ! ভুমিকম্প....যেদিকে তাকায় দেখে সব ঘুরছে ! অনেক বড় ভুমিকম্প শুরু হয়েছে...
-"আরে বিয়ে বাড়িতে কী একটু মসকারা হতে পারে না! " কেউ একজন বলে
-"ছোটেছি বাত ক্যা লিয়ে ইত্নাছা হাঙ্গামা...! ও বাচ্চা মানুষ কুছ সমাসতা নেহি হে...ওর ইছ উমর ম্যা শারারাত নেহি করেগা তো কবে করে গা...? একদৃষ্টিতে দেখা ইসলিয়ে চোখ ওয়ছা হো গেছে । এই নিয়ে ইতনা তুলকালাম কাণ্ড করতা হে ক্যা!?" মন্টু এসে রুবিনাকে কোলে তুলে নিতে নিতে কথাগুলো বলে। অনেকেই ওর কথা শুনে আরো হেসে গড়াগড়ি খায়...! যা দেখে সরদার সাহেব সবার দিকে চোখ বুলিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলে -
-"আইর লগে খোন চুদুর বুদুর চইলতোনো...বেগ্যিন হুদামিছা বিতলামী দেহন লাগি খারাইয়া হইচ্চন..! আই বেজ্ঞুন রে ছিনি হালাইছি..!"
রুবিনা মেয়েটা কিছুই বুঝতে পারছে না "সে কাঁদছে আর কেন তার বাবাসহ সবাই হাসছে...! আর ঐ লোকটাই বা কেন চিৎকার করছে?" "ব্যাটা আমার পুত্নীরে ধমক দিয়ে কথা কয়...মগের মুল্লুক পাইছে না কী...আইজকে কাউরে ছাইরে কথা কব নানে" রাগে গজগজ করে হক। দূর থেকে মর্জিনা ঘোলা চোখে দেখতে পায় স্বামী বিড়বিড় করে কীসব বলতে বলতে হেলে দুলে কাঁপতে কাঁপতে লাঠিতে ভর দিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে...! তাই দেখে দু'হাতে মাথা চেপে ধরে উচ্চস্বরে বলে-
-" ও রে আল্লা গো কী বড় ভূমিকম্প রে বাবা... আকাশ মাথায় ভাইঙ্গা পরল রে এ এ এ ...এতো ভার কি জন্যি লাগতিছে! ও মাথা খাড়া থাকিস না কেন..ও মাথা তোর কসম লাগে খাড়াইয়া থা...ক"! "ধপাস" করে একটা শব্দ হতেই সবাই তাকায় সেদিকে..।
২৭ মে - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১২০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪