ধূপছায়ার কলেবর

ঈর্ষা (জানুয়ারী ২০১৩)

সেলিনা ইসলাম
  • ২৬
  • ৪৯
এক.

ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ আর বিষাক্ত বাতাসে মশা, মাছি আর ইঁদুরের যেন চিরবন্ধন । যেন তারা জায়গাটাকে সমান ভাগ করে নিয়েছে নিজেদের অধিকারে। বড় বড় ইঁদুরগুলো কত উল্লাসে ছুটোছুটি করছে। টুপটুপ পানির শব্দ নিস্তব্ধতাকে তুচ্ছ পরিহাস করছে। এরই মাঝে আজ শরিফুল পানিতে দিব্যি ভেসে আছে । যে ছেলে এই সবকিছুকে সব সময় ভয় পেয়েছে আজ সে এদের মাঝে হয়ে উঠেছে খুবই সাহসী।

মনে মড়ে একদিন সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে বসে আছে সে আর বড়বোন শরিফা। এমন সময় কারেন্ট গেছে চলে। তার মনে হল ঘরের মাঝে ছুটোছুটি করছে কিছু ভূতের বাচ্চা। শরিফা বলে অন্ধকারে নাকি ভূত থাকে। মাও জানে শরিফুল অন্ধকারকে ভীষণ ভয় পায়। আর তাই সে সন্ধ্যা হবার আগেই হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ডিম করে রাখে। আজ মনে হয় ভুলে গেছে কারন মায়ের শরীরটাও ভাল নেই। শরিফুলের চিৎকার শুনে মা এসে আলো জ্বালে।
শরিফুল তার বাবার কোলে কোনদিন উঠেনি। তবে দেখেছে কম্পুউটারে। মা বলে সে নাকি দেখতে একদম বাবার মত হয়েছে। বাবার সাথে তার কোন ছবিও নেই যে পাশাপাশি রেখে তুলনা করবে! তবে বাবার সাথে শরিফার ছোট্ট বেলার অনেক ছবি আছে। শরিফাও বাবার কোলে উঠেছে কবে মনে করতে পারেনা। ওদের বাবা কুয়েতে থাকে। প্রতি বছর রোজার মাসে বলে ‘এইতো এবার ঈদে আসব। একসাথে শরিফা আর শরিফুলকে সাথে নিয়ে ঈদগাহ মসজিদে নামাজ পরড়তে যাব’ ঈদের আনন্দ প্রসারতা পায় দূর আকাশ পর্যন্ত! কিন্তু ঈদ আসে চলেও যায় বাবা আর আসেনা। মা বলে বাবা ছুটি পায়নি অফিস থেকে ছুটি পেলেই আসবে। মা যখন বাবার সাথে কথা বলে দুজনে বাচ্চাদের মত করে শুধু কাঁদে। শরিফা বলে ‘বাবা দেশে আসলে নাকি আর যেতে পারবে না তাই সে আসেনা’ মাকে কথাটা জিজ্ঞাসা করতেই উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে। যে চোখের ভাষা এই কচি দুজন শিশু বোঝেনা।

দুই .
রহমানের বড় চাচা তার বাবা ফারুককে জমিজমা একেবারেই দেয়নি ওর দাদা প্রথম সন্তানের নামেই সব জমি কিনেছিল। যা ভাগাভাগি করার সময় পায়নি তার আগেই চলে গেছে পরপারে। অনেক শালিসি করে থাকার একটু জায়গা এবং নদীর পাশের একটা ছোট্ট জমি পায়। ফারুক মারা গেলে রহমানের মা সেই জমিতে শব্জি চাষ করে অনেক অভাবের মাঝে থেকে ছেলেকে বড় করে। আর এদিকে রহমানের অসুস্থ বড়চাচার জুয়াড়ী বড় ছেলে বাবার সব জমি বন্ধক রেখে আরাম আয়েস করতে করতে পথে নামে। চাচার ছোট ছেলে জাফর পড়াশুনায় ভাল। গ্রামের সবাই তাকে গ্রামের রত্ন মনে করে। বড়চাচার বড় ছেলের অত্যাচারে একসময় ভিটে টুকুতে পড়ে থাকতে বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় আর তাই মা মারা যাবার পরে রহমান ভিটা বিক্রি করে এবং শ্বশুরের দেয়া কিছু টাকা নিয়ে চলে যায় কুয়েতে। তাকে অনেক টাকা রোজগার করতে হবে। ছেলেমেয়েকে শহরে রেখে লেখাপড়া করাতে হবে। পাকা ঘাঁটের পুকুর আর একটা পাকা বাড়ি করতে হবে। স্বপ্নের ডানা তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় সুদূর মরুদেশে।

ছেলেমেয়ে দুজনকে নিয়ে প্রবাসী বাবার অনেক স্বপ্ন। বাবা বলে ‘সোনা আমি অনেক কষ্ট করি এখানে কেন জানো?’ দুজনেই স্ক্রিনের দিকে জিজ্ঞাসু চোখ মেলে তাকিয়ে অপেক্ষায় থাকে কেন? ‘আমার মত যেন তোমাদের কোনদিন অভাবে না পড়তে হয়, পরিবার ছেড়ে দূরে থাকতে না হয়’ শরিফুল মায়ের কোলে বসে দুলতে থাকে। কথা বলে শরিফা-‘বাবা তাইলে আপনে চইলা আসেন, থাকনের দরকার নাই’মৃদ্যু ধমক দেয় বাবা।‘আমি বলেছি না মা শুদ্ধ বাংলায় সুন্দর করে কথা বলবে’ লজ্জা পায় শরিফা। ‘হ্যাঁ রে মা আসব। তোমরা পড়ালেখা শেষ করে যত তাড়াতাড়ি বড় হবা তত তাড়াতাড়ি আসব’ ‘বাবা আমার লেখাপড়া ভাল লাগেনা। অনেক পড়া দেয় টিচার আর ইংলিশ পড়ায় বেশী’ মাথা নেড়ে নেড়ে কথাগুলো বলে শরিফুল। হেসে দেয় বাবা। ‘বাবা লেখাপড়া না করলে তো আমিও দেশে আসতে পারবনা আর তুমিও আমার কোলে উঠতে পারবে না’ অবাক হয় শরিফুল। এইটা কোন কথা হল! ‘বাবা আমাদের ক্লাসে রুদ্র অনেক ভাল লেখা পড়ায় তার বাবা তো দেশেই থাকে। ওর বাবা সকালে গাড়ীতে করে নামিয়ে দিয়ে যায় স্কুলে’ এবার কি বলবে বুঝে পায়না রহমান। একটু থেমে বলে ‘বাবা আমিও এসে গাড়ী কিনে দিব,তোমাদেরকে নিয়ে ঘুরবো। কিন্তু দুজনেকেই ক্লাসে ফাস্ট হতে হবে’ এভাবেই বাবার সাথে প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়। রহমান যখন কুয়েতে যায় শরিফার বয়স তখন দুই বছর আর শরিফুল গর্ভে। তখন সবাই গ্রামে ছিল। কিন্তু ছেলে মেয়ে একটু বড় হতেই তাদের লেখাপড়া ও পরিবেশের কথা ভেবে এই শহরে আসা। শহর থেকে গ্রামে যেতে ৫/৬ ঘন্টা লাগে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে কেউ না কেউ গ্রাম থেকে আসে।


তিন.
শরিফুল আর শরিফা একই স্কুলে পড়ে। মা রোজী দুই রুমের একটা বাসা ভাড়া করে ছোটভাই জামিলকে নিয়ে থাকে। ছেলেমেয়েকে একটা ভাল স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। শহরে এসেছে দুইবছর এর আগে ছেলেমেয়ে গ্রামেই লেখাপড়া করত। শরিফা ক্লাস ফোরে আর শরিফুল ক্লাস টুতে। কিন্তু এখানে এসে শরিফাকে ওয়ানে আর শরিফুলকে কিন্ডারগার্টেন ক্লাসে ভর্তি করতে হয়েছে। রহমান যে টাকা পাঠায় তাতে ঘরভাড়া আর ছেলেমেয়ের বেতন দিয়ে খুব কম টাকা থাকে হাতে। রোজিও তেমন পড়াশুনা করেনি যে ছেলেমেয়েকে পড়াশুনায় সাহায্য করবে। অনেক ভেবে চিন্তে সদ্য শহরে পড়তে আসা জাফরকে বাচ্চাদের মাষ্টার করে রেখে দেয় রোজী স্বামীর কথায়। রোজী এই নিয়ে স্বামীর সাথে বেশ তর্কও করে।
-দেখ তোমার চাচা চাচাত ভাই কেউ তোমাগোর বালা চায় না হেই বারীর পোলারে মাষ্টর করবা?
-আরে কিচ্ছু হইব না । জাফর লেখাপড়ায় অনেক বালা হে আমাগো পোলামাইয়ারে বালা পাইব আর তোমার কোন আইডিয়া আছে যে শহরে একজন মাষ্টর রাখতে কত টেহা লাগে?
-হের পরেও আমার মুন সাঁয় দেয়না। হেই যদি আমাগো কুনো ক্ষতি হরে?
-আরে লেখাপরা জানা পোলাই এমন কিছুই হরব না যাতে অন্যের ক্ষতি হয় আর হেইতো পরনা আমার রক্তের মানু ।
-হেরা আগেও তোমাগো বালা চায়নায় এখনও চায়না
- আরে ধুর বাদ দাউ কিচ্ছু হইব না । হুনো ডাক্তার কি কইছে তোমার কি হইছে?
- গ্যাস্টিকের ব্যথা
-গ্যাষ্টিকের ব্যথা বুকে হইব ক্যা ?
-হ গ্যাস হইলে নাকি বুকেও ব্যথা হরে মানুও নাকি মইরা যায়
-কি কউ তুমি !
-হ গ্যাষ্টিক হইলে নাকি মানসে হার্ট ফেল কইরা মইরা যায়
-ওষুধ দেছে
-হ দেছে
-ঠিক মত খাইবা আর না খাইয়া থাকবা না ...আমি এত কষ্ট করি কাগো লাইগা হ্যাঁ ?
স্বামীর কথায় হু হু করে কেঁদে দেয় রোজী। রহমান স্ত্রীকে ঠিকমত খাবার কথা বললেও নিজেই বড়বেশী অনিয়ম করে। এমনও দিন গেছে সারাদিনে একটা বনরুটি আর এককাপ চা খেয়ে আছে। সেই রাতে যেয়ে আলুভর্তা দিয়ে ভাত। একটু পাতলা ডালও নেই আর তাই শুঁকনো ভাত খেতে কষ্ট হওয়াতে আলুভর্তা দিয়ে মাখা ভাতের মাঝে পানি ঢেলে দিয়ে খেয়েছে। মনে হয়েছে এতো মজার খাবার সে জীবনেও খায়নি। ছেলেমেয়েকে পড়ানোর জন্য জাফরকে দুইবেলা খাওয়া আর অল্পকিছু টাকা দিলেই হবে। কিন্তু এই বাড়তি খরচের জন্য রহমান আরো ৪ঘন্টা বেশী কাজ করা শুরু করে।

ক্লাসে ফাস্ট হলে বাবা আসবে এই কথা শরিফুলের মনে গেঁথে যায়। আর তাই সে ফাস্ট হতে পড়াশুনায় মন দেয়। যেভাবেই হোক এবার রুদ্রকে ফাস্ট হতে দেয়া যাবেনা। রুদ্রের সাথে শরিফুলের কখনোই বনিবনা হয়না। সে যাদের সাথে মিশে তারা সবাই গাড়ীতে করে স্কুলে আসে। তারা সবাই শরিফুলকে সুযোগ পেলেই তার নাম নিয়ে এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে তিরস্কার করে। একদিন টিফিনের সময়ে দুই ভাইবোন বসে মায়ের দেয়া রুটি আর আলুভাজি খাচ্ছে। এমন সময় রুদ্র কিছুটা ফিল্মি স্টাইলে দল নিয়ে এসে হাজির। কেউ বলে ‘বস্তির খাবার খাচ্ছে’ কেউ বলে ‘ডাস্টবিনের খাবার’। শরিফুল কিছু বলতে যায় কিন্তু বোন বাঁধা দেয়। আর তাই চুপচাপ খেয়ে যায়। রুদ্র শরিফুলের নাম নিয়ে কটাক্ষ করে বলে ‘ ওদের বাসার দারোয়ানের নাম নাকি শরিফুল। এই সব নাম এখন গাইয়ারাও রাখে না! শ শ শ ফুলল’ হা হা হা সবাই হেসে গড়াগড়ি খায়। শরিফুল কিছু বলতে না পেরে খাবার রেখেই জায়গা ছেড়ে চলে যায়। দুই ভাইবোন সব সময় কিছুটা ভয়ে ভয়ে থাকে।

জাফরের সাথে এই নিয়ে কথা বলতেই সে বলে ‘শোন আমিও গ্রাম থেকে পড়াশুনা করে এখন ভার্সিটিতে পড়ছি। যদি তোমরা ওদের অপমানের বদলা নিতে চাও তাহলে ওদের থেকে ভাল লেখাপড়া করে দেখাও তাহলেই সমুচিত জবাব হবে’ এই কথা ভেবেই শরিফুল বাবার ছবির সামনে বসে প্রায়ই কথা বলে। একজন সাহসী ছেলে সে এবং সে বাবাকে খুব তাড়াতাড়ি দেখতে চায়। বাবার সাথে ছবি তুলতে চায়। ‘বাবা তুমি আর আমি রুদ্রকে আচ্ছা করে বকা দিয়ে দেব ঠিক আছে?’

বাবার মন হয়তবা শুনতে পায় ছেলের এই আবদার। কাজ করতে করতে সবার কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে যায় তার। চোখের সামনে ভাসে প্রিয় সন্তানের মুখ। ইট বালির মাঝে বড় বেশী ক্লান্ত লাগে তার। মন ছুটে যায় দূর বহুদূর সবুজের কোলে। মনে পড়ে যায় নদীর ক্ষুধা মেটাতে তলিয়ে যাওয়া জমির আর্ত চিৎকার! সন্তানের মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাত তুলে দেবার অনন্ত হাহাকার। তপ্ত রোঁদের মাঝে দীর্ঘশ্বাসের ঝিরঝির বাতাস বাড়িয়ে দেয় কাজের উদ্যমতা।

চার.
ইদানিং জাফর রোজীর সাথে বেশ ঘনিষ্ট হয়ে কথা বলতে চায় যা রোজীর ভাল না লাগলেও কিছুই বলতে পারেনা।
-কিগো ভাবী ভাইরে মিস করতাছেন?
-সেইটা তোমারে কমু কেন
-মিস কইরেন না আমি তো আছি
-তুমি আর তোমার ভাই কি এক হইল?
-একই তো এক রক্ত না
-দেহো এইসব কইয়া টাইম নষ্ট কইর না যে কামে আইছ হেই কাম কর
-হ হেই কামতো সময় হইলেই করুম সময় আইব কবে ভাবী?
রোজী কথার উত্তর দেয়না। আর তা দেখে জাফর বেশ রাগ হয়। পড়াশুনার জন্য সে শহরে আসলেও এখন সে পড়াশুনা খুব একটা করেনা। বেশীর ভাগ সময়ই সে ভার্সিটির ক্লাসের চেয়ে গেইটের কাছে দলবল নিয়ে থাকতে পছন্দ করে। রোজী ভেবে রেখেছে ছেলেমেয়ের পরিক্ষা শেষ হলেই জাফরকে এই বাসায় আসতে নিষেধ করবে।
আজ শরিফুলের রেজাল্ট দিয়েছে। সে ফাস্ট হয়েছে। কখন বাসায় যাবে আর বাবাকে মেইল করে খবরটা দেবে সেই আনন্দে অস্থির হয়ে আছে সে। রুদ্র আজ অনেক ক্ষেপেছে। আজ সে শরিফুলকে পেলে কি করবে তা সে নিজেও জানেনা। ওর মা বলেছে এবার যদি সে ফাইনালে ফাস্ট হয় তাহলে
Wii Nintendo গেইম কিনে দেবে। কতদিন ধরে সে এই গেইমের জন্য অপেক্ষা করেছে। কিন্তু সে মাত্র তিন মার্কের জন্য ফাস্ট হতে পারেনি। এদিকে রোজীর আজ শরীর অনেক খারাপ তাই সে ঘুমিয়ে গেছে। ছেলেমেয়ের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে কিন্তু তার ঘুম ভাঙ্গেনি। দুই ভাইবোন প্রতিদিনের মতই মায়ের অপেক্ষায় স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে। রুদ্র এবং তার দলের সবাইকে তাদের দিকে হেঁটে আসতে দেখে ভয় পেয়ে যায় দুজনেই। শরিফা ভায়ের হাত শক্ত করে ধরে দারোয়ানকে খুঁজে। কিন্তু তাকে দেখতে পায়না কোঁথাও। কি করবে তা ভেবে না পেয়ে মায়ের জন্য সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। স্কুলের গেইটের থেকে কিছুদূর আসার পরে আর এগুতে সাহস পায়না দুজন। রুদ্র সদলবলে কোনকিছু না বলেই এলোপাতাড়ি মারতে থাকে শরিফুলকে। ভায়ের এমন মার খাবার দৃশ্য দেখে শান্ত স্বভাবের বোনও হুঙ্কার ছাড়ে। ওদিক থেকে একটা সাদা মাইক্রোভ্যান আসে...একসময় রুদ্র চলে যায় কিন্তু শরিফুলকে কোথাও দেখতে পায়না শরিফা।

পাঁচ.
রোজীর মোবাইলে আননোন নাম্বার থেকে একটা ম্যাসেজ আসে “চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পাঁচলাখ টাকা রেডী রাখবা। কাল ঠিক এই সময়ে যে ঠিকানা দেয়া হবে সেই ঠিকানায় টাকা পৌছাইয়া দিয়ে ছেলেকে নিয়ে যাবে আর যদি পুলিশে যানাও তাহলে ছেলের মুখ জীবনেও দেখবে না এবং মেয়েটাকেও হারাবে”

রহমান খবরটা শুনে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে নামে। সে যত টাকা রোজগার করেছে তার সবই দেশে দিয়েছে। কাউকে না জানিয়ে কেনার মধ্যে শ্বশুরের মাধ্যমে ৫বিঘা জমি কিনেছে। সে জমি সে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বিক্রি করতে পারবে না। পাগলের মত হয়ে যায় সে, এতো টাকা কোথায় পাবে? যাদের সাথে থাকে তাঁরা সবাই তারই মত কষ্ট করে নিজেরা না খেয়ে পরিবারের জন্য টাকা পাঠিয়ে দেয়। কি করবে সে এখন? তবুও পরিচিত যতজন বাঙালি ছিল সবাই সাহায্যের হাত বাঁড়ায়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সবাই রহমানের পাশে এসে সান্ত্বনা দেয়। সে নিজেও কাজ করতে করতে চোখের জলে বুক ভাসায়। প্রবাসে এই একটা সুখ সবাই দুঃখের সময়ে হাতে হাত রাখার সর্বত চেষ্টা করে। সব মিলিয়ে একলাখ টাকা রোজীর একাউন্টে পাঠিয়ে দেয়। রোজী তার কাছে যেটুকু ছিল আর স্বামীর পাঠানো টাকা মিলিয়ে দেখে দেড়লাখেরও কম টাকা। কলিজার টুকরোকে আর মনে হয় ফিরে পাবেনা তারা। দুজনে সিদ্ধান্ত নেয় জমিটা বিক্রি করে দেবে কিন্তু তার জন্য সময় দরকার। যারা ছেলেটাকে নিয়ে গেছে তাদের সাথে কথা বলা দরকার কিন্তু তাওতো সম্ভব হচ্ছেনা! রহমান ভাবে যে সন্তানের জন্য আজ সে নিজের জীবনটাকে বিলাতে সবকিছু ছেড়ে সব আনন্দ ফুর্তি ছেড়ে একটু আলো সন্তানদেরকে দিতে উৎসর্গিত হয়েছে। যে চাঁদের মুখটা দুহাতের মাঝে নিয়ে সব কষ্টব্যাথা ভুলে যেতে চেয়েছে সেই চাঁদটা পূর্ণতা পাবার আগেই গ্রহণের শিকার হয়েছে! কীভাবে সে এই চাঁদকে রাহুমুক্ত করবে? কীভাবে?

সকালে মোবাইলটা বেজে উঠতেই রোজী ধরে। দেখে একটা অপরিচিত কন্ঠ
-টাকা রেডী?
-হুনেন ভাই আমগোর কাছে এতো টেহা নাই, দেড়লাখের একটু কম আছে আমার পোলারে চাইরা দেন
-ঐ বেডী নাটক কর? তোর স্বামী বিদেশে থাকে টাকা নাই না পোলার জানের দাম নাই?
-না ভাই হুনেন... হ্যালো হ্যালো
লাইন কেটে যায় রোজী উম্মাদ হয়ে যায়। মেয়েকে বুকে নিয়ে কেঁদেই যায় সে। একটু পরে ম্যাসেজ আসে দেড়লাখ টাকা নিয়ে একঘণ্টার মধ্যে আসতে হবে না হলে ছেলের লাশ দেখতে হবে।
রোজী ভয়ে কাউকে কিছু জানায়না । পাঁশেই একটা পরিবারের সাথে তাঁর বেশ সখ্যতা বাকী টাকা সেই বাসার মহিলার কাছ থেকে নিয়ে শরিফাকে রেখে রোজী জামিলকে নিয়ে একটা টেম্ফুতে করে পৌছে যায় এসএমএস-এ দেয়া ঠিকানায়। পুরোন বাড়ীর প্রতিটা ইটের দিকে তাকিয়ে খুঁজে চলে আদরের ধনকে। ম্যাসেজ আসে “টাকার ব্যাগ সামনের গাছের নীচে রাখ” রোজী তাই করে । এদিক ওদিক তাকায় । এই বুঝি ছুটে এসে ঝাঁপ দিল বুকে! এই বুঝি...
আবার ম্যাসেজ আসে সোজা চলে যাও ছেলে তোমাদের বাসায় পৌঁছে গেছে । রোজী দৌড়ে এসে অপেক্ষারত টেম্পুতে উঠে তাকে বাসায় যেতে হবে এখুনি । পারলে সে উড়ে যেতে চায়। কিন্তু বাসায় এসে কাউকেই পায়না সে। দুদিন হয়ে যায় ছোট্টসোনা পাখী ফিরে আসে না...রোজীর চোখে এখন আর পানি নেই। নেই সামান্য আশার দীপ। সবটুকু আলো নিভে গেছে এখন, বড় নিষ্ঠুর,বড় অশুভ...চারিদিকে ঘন কালো পৃথিবী।

মাগো অনেক পানি পিপাসা লেগেছে পানি দাও। মা পানি দেয়না বলে ঢকঢক করে অনেক পানি খেয়ে নেয় শরিফুল। সে সাঁতার জানেনা অথচ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পানিতে ভাসছে! ইস কি অন্ধকার আর দুর্গন্ধ! মা তুমি কোথায়? বাবাকে দেখে সামনে । হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নেই ছোট্ট সোনাকে। বাবা তার জন্য একটা বড় প্লেনও কিনে এনেছে। যা রিমোট কন্ট্রোলে চলে। খোলা সবুজ মাঠে বাবার সাথে আনন্দ করে করে প্লেনের উড়ে যাওয়া দেখে। মা তার হেসে হেসে হাতে তালি দিয়ে বলে –‘শরিফুল... আরো উপরে উঠাও আরো উপরে...আকাশ ছুয়ে দাও, ঐ আকাশ ছুয়ে দাও বাবা!’
দুমাস পরে শহর থেকে একটু দূরে মিউনিসিপ্যাল্টির লোকেরা ম্যানহোলের ভীতরে প্ল্যাস্টিকের ব্যাগেভরা একজন অজ্ঞাত শিশুর গলিত লাশ পায় ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সেলিনা ইসলাম সব গুণী লেখকদেরকে আমার লেখায় দেখে এবং তাঁদের মন্তব্য পড়ে আমি সত্যিই অনেক ধন্য হয়েছি! সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ সবার জন্য রইল অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে একরাশ ফুলেল শুভেচ্ছা ।
ভালো লাগেনি ২৯ জানুয়ারী, ২০১৩
সূর্য সনাতন আটপৌড়ি জীবনের কাহিনী সাবলীল ভাবে উঠে এসেছে গল্পে। এমন হিংসা (ইর্ষা)র বশবতী হয়ে দুটো পরিবারই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যেতে দেখেছি। দারুন গল্প।
ভালো লাগেনি ২৮ জানুয়ারী, ২০১৩
তাপসকিরণ রায় আপনি বড় নিষ্ঠুর--তাই মনে হোল গল্প পড়ে।কাহিনী সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে এ কেমন পরিণতিতে নিয়ে আসলেন!খুব ভাল লিখেছেন বলেই তো এমনি কথা মনে হোল,ভাই! ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ২৫ জানুয়ারী, ২০১৩
পন্ডিত মাহী গল্পটা হৃদয়স্পর্শী। ভেতরের আঘাত করে গেলো। কষ্ট পেয়েছি শেষটায়। আপনার লেখার গাঁথুনি অসাধারণ।
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১৩
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ আপনার লেখায় সবসময় কথাসাহিত্যের প্রকৃত স্বাদ পাই। চরিত্র চিত্রণে জীবনের আস্বাদ ফুটে উঠে বেশ । লেখকের জন্য সাধুবাদ ।
ভালো লাগেনি ২০ জানুয়ারী, ২০১৩
মোঃ গালিব মেহেদী খাঁন সেলিনা ইসলাম , ওরা কারা? মায়ের জঠরে বেড়ে ওঠা সেই সব শিশুদের একজন তো না? ভাই বোনের খুনসুটিতে বেড়ে ওঠা বাবার হাত ধরে ঘরের বাইরে যেতে শেখা অসুস্থ সন্তান কোলে মা-বাবার নির্ঘুম রাত কাটানো অভুক্ত মায়ের সন্তানের পাতে তুলে দেয়া সাদা ভাত। বা্বার জির্ন শার্টের পকেট থেকে বের করে দেয়া চকচকে নোটে কেনা বাহারি রংযের নতুন জামা। সেই সব শিশুদের একজন তো না? নষ্ট সময়ের পচা গলা সমাজের জারজ কীট এখন। অনিরাপদ আমার সন্তান, আমি, আমরা........................।।
ভালো লাগেনি ২০ জানুয়ারী, ২০১৩
সালেহ মাহমুদ সাংঘাতিক ভয় ধরানো একটি গল্প। জীবনের এই সত্য কাহিনী এত নিখুঁতভাবে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ। কবে এই সবের অবসান হেব?
ভালো লাগেনি ১৯ জানুয়ারী, ২০১৩
স্বাধীন শেষটায় ভেবেছিলাম বাবার আশা পূর্ণ করে ছেলেমেয়ে দুটো মানুষ হয়ে মা-বাবা আর অভাবকে গৌরব দিবে। এমন পরিনতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। নষ্ট সময় কষ্টকর বাস্তবের আখ্যান ভালভাবেই তুলে ধরতে পেরেছেন।
ভালো লাগেনি ১৯ জানুয়ারী, ২০১৩
মোঃ সাইফুল্লাহ সমাজের বাস্তব চিত্র চিত্রায়ন করেছেন। ঘটনার বর্ণনা খুবই সাবলীল । শুভ কামনা রইলো।
ভালো লাগেনি ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩
নিলাঞ্জনা নীল খুব ভালো লিখেছেন !
ভালো লাগেনি ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩

২৭ মে - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪