ফিকে রক্তের রঙ !

২১শে ফেব্রুয়ারী (ফেব্রুয়ারী ২০১২)

সেলিনা ইসলাম
  • ৩২
  • ১১
ফারুক সাহেব হেড বোর্ডে মাথা রেখে মিছেমিছি একটা বইয়ের পাতা মেলে ধরেছেন চোখের সামনে । ভাবখানা সে বইটা বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন । নাকের উপরে রাখা ভারী চশমাটা একেবারে নাকের ডগায় ঝুলে এসেছে সেদিকেও খেয়াল নেই তার । বইয়ের প্রতিটা অক্ষর ঝাপ্সা লাগলেও স্মৃতির পাতা একের পর এক উল্টিয়ে যাচ্ছেন মনের জলন্ত অগ্নিগ্রন্থে ! সেই ছোটবেলায় বন্ধুরা মিলে প্রতিটা বাসায় গিয়ে চাঁদা তোলা । সারা রাত মাইকে গান বাজানো “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি” অথবা “আঁটোই ফাল্গুনের কথা আমরা ভুলি নাই” ! সুরে সুরে ঠোঁট মেলানো আর ব্যানার লেখা, কাল ব্যাজ বানানো, এবং ফুলের মালা গাঁথা । কে কে মিছিলের সামনের সারীতে থাকবে তা ঠিক করা । বেদনার বেদীতে বসে এ এক আনন্দোঘন প্রাপ্তির পরম বিজয়ের স্বাদ নেয়া !
সুর যেমনই হোক এই সময়ে যেন সবাই একই তাল ও সুরে গান গায় । প্রভাতফেরীতে কোরাস গাইতে গাইতে , শিশিরে ভেজা গালিচায় খালি পায়ে অলিগলি ঘুরে ঘুরে সঙ্গীদেরকে নিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দেয়া । এ যেন এক সাগর মানুষের ঢলে সজ্জিত হয়ে দেশের সকল মুক্তিসেনা ও শহীদদের প্রতি দৃঢ় দুর্বার চিত্তে প্রত্যয়িত হওয়া এবং উচ্চকিত শীরে বুক ফুলিয়ে কমরেড লাল সালাম জানানো ! কিন্তু এখন যা হচ্ছে ! - শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মিলাদ মাহফিলের নামে চাঁদা নিয়ে নেশা করা আর আত্মোল্লাসে অশুভ কুহরে ডুবে থাকা ! এসব মেনে নিতে কষ্ট হয় । ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও এই বিশেষ দিনগুলোতে বাইরে যেতে মন চায় না । এই দিনগুলি নিয়ে অতিরঞ্জিত সবকিছু দেখেও প্রতিবাদের যেন কোন ভাষা নেই , নেই একাত্বতা গড়ে তুলে এই অন্যায়কে সমুলে উপড়ে ফেলার আন্দোলিত মানসিকতা ! ফারুকের জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এসে না পারার যন্ত্রণায় আত্মগ্লানিতে মনের ভিতটা ভীতরে ভীতরে উইপোকায় খেয়ে ফেলছে নিভৃতে , সবারই অজান্তে !

কিশোরী মেয়ে তনু এসে ভাবনার তারে বিঘ্ন ঘটায় ।
-“বাবা আজ তোমার সাথে ঘুমাব । খুব ভোরে উঠতে হবে আমাকে । তুমি কিন্তু সাথে নিয়ে যাবে বাবা !” ছোট্ট বাচ্চাদের মত নাকি সুরে তনু কথাগুলো বলে ।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বিনু একরকম ধমক দিয়েই উঠে
-“না কোথাও যেতে হবে না । যাও তোমার রুমে গিয়ে ঘুমাও ! এসব আবদার রাখো।”
-“আরে এমন করছো কেন! আমরা ওতো ছোট বেলায় গেছি , এমন কি বড় হয়েও গেছি । যেতে দাও না ওকে । একটা সময় মন যেতে চাইলেও হয়ত সাংসারিক ঝামেলার জন্য যেতে পারবে না ।” বেশ নরম সুরে কথা গুলো বলে ফারুক ।
-“তুমি আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে মেয়েটার মাথা খেয়েছো । আমাদের সময় আর এখনকার সময় কি এক হল ! আর টিভিতে সরাসরি দেখাবে ঐটা দেখলেই হবে !” অনুযোগের সুর ভাসে বিনুর কথায় !
তনুরও অভিমানটা বেড়ে যায় দ্বিগুণ -
-“মা , বাবা তোমরা মিনারে গিয়ে ফুল দিয়েছ , সারারাত জেগে জেগে রিহার্সেল করেছ। আমি তোমাদের সাথেই যেতে চাচ্ছি কেন বাঁধা দিচ্ছ !”
-“ঠিক আছে মা , আগে সকাল হোক । আমি নিয়ে যাব তোঁকে ,মন খারাপ করিস না।” সান্ত্বনার সুরে বলে ফারুক । “ দরকার হলে দুজনে চুপিচুপি যাব......হা হা হা !” ফিসফিস করে মেয়েকে কথাগুলো বলে হেসে দেয় সে । ফারুক নিজেও জানে বিনু কেন এমন করে যেতে নিষেধ করছে । একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে সমস্ত শরীরটা কাঁপিয়ে ! তনুর বিশ্বাস শেষাবধী বাবা তাকে ঠিকই নিয়ে যাবে । আশ্বস্ত হয় সে , কিছুটা ভাল লাগে তার !
বাবার বুকে মাথা রেখে প্রশ্ন করে
-“আচ্ছা বাবা , তুমিতো ৭১ এ যুদ্ধ করেছিলে । তাহলে কি ভাষা আন্দোলনের সময়ও তুমি আন্দোলন করেছিলে ?”
-“না রে মা , তখন আমি বেশ ছোট ।” একটু নড়ে বসেন ফারুক ।
-“আচ্ছা বাবা স্কুলে কি তুমি উর্দুতে পড়তে ?” বেশ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে তনু -
-“হ্যারে মা পড়তাম - " কুত্তে জামিন পে ল্যাটা হে -উস্কো লাত মার্কে ভাগাতে হে " হা হা হা হা বাবা আর মেয়ে হেসেই গড়াগড়ি খায় । একটু পরে তনু বাবার বুকের মাঝে আরো নিবিড় করে আঁকড়ে ধরে নিজেকে । বলে
-“কি হয়েছিল বাবা ২১শে ফেব্রুয়ারির সেদিন ?”
-“অনেকবার শুনেছিস তো মা !”
-“বলনা বাবা , তুমি যতবার বল ততবারই মনে হয় যেন এখুনি প্রথমবার শুনছি !”
কথাটা শুনে একরকম আনন্দের দোলা লাগে ফারুকের মনে । তার নিজেরও বারবার বলতে ভাল লাগে । মনে হয় যেন এইতো কিছুদিন আগের ঘটনা ,সবকিছু একেবারে টাটকা জীবন্ত । ছোট হওয়ার কারনে সে নিজে ভাষা আন্দোলনে দুর্ভাগ্যবশত অংশীদার হতে পারেনি । সব কিছু শোনা আর খবরে জানা কিন্তু মনে হয় যেন সব কিছুই সে নিজে সামনে থেকে দেখেছে । কতটা তাণ্ডব যজ্ঞ চালিয়েছিল পাষণ্ডের দল !
বাবাকে কিছু বলতে না দেখে আবার তাড়া দেয় তনু-
-“ও বাবা বলনা।”
হুস করে একটা দমকা হাওয়া ছেড়ে কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে ফারুক শুরু করে -
- “৪৮’এর পর থেকেই বাংলা ভাষার দাবীতে সবার মনে আগুন জ্বলছিল। শ্রদ্ধেয় গাজীউল হক, তোহা সাহেব, সুলতান সাহেব, কে জি মোস্তফা, আব্দুস সামাদ আজাদ ,হালিমা খাতুন এবং আরো অনেকেই মিলে ভাষার দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন । এর মধ্যে নাজিমুদ্দীন সাহেবের ঘোষণার পর সবাই বিক্ষোভে ফেটে পড়েন । শিক্ষিত ছাত্র ছাত্রী , বুদ্ধিজীবি , সাধারন জনগন সবাই বুঝতে পারল উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে এদেশের মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না , পদানত থাকবে সারাটা জীবন। আর যাই হোক মায়ের ভাষাকে জলাঞ্জলি দেয়া যাবে না !”
-“আচ্ছা তারপর ?” কৌতুহল ঘিরে ধরে তনুকে !
- “এখন যেখানে জগন্নাথ হল ,সেখানে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সংসদ ভবন । ওখানেই বাজেট সেশনে উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এই বিলটি পাস করা হবে। এই ঘোষনা শুনে ২১শে ফেব্রুয়ারি সারা ঢাকায় ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সংসদ ঘেরাও করবে, এই বিল পাস না করার দাবিতে , দেয়া হবে স্মারকলিপি । আর ওদিকে ধর্মঘট যেন পালন করতে না পারে সেই জন্য পাকিস্থানী শাসক ঐ দিন ১৪৪ ধারা জারী করে ।”
-“বাবা তুমি এত কিছু জানো !” বিস্মিত হয় তনু
-“আগে শোন না মা -সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম কমিটি ১৪৪ ধারার বিরোধিতা করে ২০ তারিখ রাতে বার লাইব্রেরির সভায় তমুদ্দিন মজলিশসহ সব ছাত্র সংগঠনের নেতারা উপস্থিত থেকে সিদ্ধান্ত নেন যে - এখন যেখানে মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সি সেখানে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন- সেখানে সবাই জড়ো হবেন । সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেখানেই সবাই মিলিত হয়ে স্লোগান দেয় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’- ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’- ‘চলো চলো অ্যাসেম্বলি চলো’। এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছেলেদের ১০ জনের একটি করে দল আর মেয়েদের চারজনের একটি করে দল পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে বাইরে বের হবে। এবং সবাই তাই করল । এমন ঘটনা দেখে পুলিশ প্রথমে হকচকিয়ে যায় কি করবে তাই ভেবে । প্রথমে ছাত্রদেরকে ছত্র ভঙ্গ করতে লাঠি চার্জ করে , তারপর কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে । এতেও যখন দেখল দলে দলে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা শ্লোগান দিতে দিতে সামনে এগিয়ে আসছে , তখন তাদেরকে উদ্যেশ্য করে এলোপাতাড়ী গুলী চালানো হয় । বাঙালি জাতি বুঝতে পারেনি যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে এমন করে তাদের উপর পৈশাচিক শাসক এক সাগর রক্তের সূচনার আদেশ দেবে ! শুধু কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা না , স্কুলের কিশোর কিশোরীরাও দলে দলে সেদিন রাস্তায় নেমেছিল । এমন কি ছোট্ট পথশিশুটিও সেদিন প্রতিবাদী হয়ে মিছিলের সামনে দাড়িয়েছিল ! তাদের সবার তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রক্ত সমুদ্রে পরিনত হয়েছিল !”

কথাগুলো খুব খেয়াল করে শোনে তনু । সে নিজেও জানে না কখন চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে , কিন্তু বাবা ! তনু টের পেল বাবার বুকের উঠানামা বেড়ে গিয়েছে ,সমস্ত পেশীগুলো শক্ত হয়ে গিয়েছে ।

-“হ্যাঁ অনেক হয়েছে এখন ঘুমাও , আর গল্প করতে হবে না”- মৃদু ধমক দেয় বিনু ।
প্রতিবাদ করে ফারুক
- “বিনু তুমি কাকে গল্প বলছো ! তোমার বড় মামা মারা গেছে তার পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারী শহীদদের জানাজা শেষে মিছিলে যোগ দিতে গিয়ে আর তুমি বলছ গল্প !”
ফারুক বুঝতে পারল কথাটা এমন করে বলা ঠিক হয়নি । বিনুর আসলে মন খারাপ লাগছে । ফারুক নিজেই নিজের কথায় লজ্জা পেল । পরিবেশটা বেশ জটিল হয়ে গেল !
তনু ভাবে তখন অশিক্ষিতের হার কম থাকলেও স্বদেশীদের প্রতি কত ভালবাসা আর আত্মিক সম্পর্ক ছিল । আর তাই বুঝি সবাই একই পতাকা তলে দাঁড়াতে বদ্ধপরিকর হয় । অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় লক্ষ্যে পৌছাতে , কিন্তু এখন ! ভায়ে ভায়ে মারামারি , কোন্দল । সামনের পরে একজন মানুষকে কেউ পিটিয়ে মারলেও অন্য কেউ এগিয়ে আসে না ! কিন্তু কেন ? তনু জানেনা তবে সে আশাবাদী । ওর বন্ধুরা সবাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এই সোনার দেশটা একদিন সত্যিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সবুজ শ্যামল , ভালবাসায় সমৃদ্ধ স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা দেশ হবে । ছোট্ট তনু বাবা আর মায়ের মাঝে শুয়ে নতুন হিরন্ময়ী দিগন্তের খোঁজে ,এঁকে চলে আগামীর লাল-সবুজের পটভূমি!


“আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম......!"
ফারুক দেখে বিনু বিছানায় নেই ! তনু নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে । আস্তে করে উঠে যায় বিছানা ছেড়ে । দেখে বিনু ড্রয়িংরুমে বসে আছে টিভি খুলে । নামাজ শেষ করে ফারুক কফি বানায় তারপর নিয়ে হাজির হয় বিনুর সামনে । বিনুর মগ বিনুর হাতে দিয়ে নিজে বেশ আয়েস করে বসে । কেউ কোন কথা বলে না ।
তনুর ফোন বেজে উঠে । ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে
-“হ্যালো কে !”
ওপাশ থেকে স্কুলের গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারু গাছে বসবাসরত বাসিন্দাদের কিচিরমিচির শব্দ । তনুর একটুও বুঝতে বাকি থাকে না রিনি কল করেছে - উঠে বসে বিছানায় । একরকম চিৎকার করে রিনি বলে-
-“তনু তুই কই ? আমরা তো এখুনি রওনা দেব , সবাই এসে গেছে তুই আসবি না ?”
তনু কোন কথা না বলে একরকম দৌড়ে যায় বাবা মায়ের কাছে । আবার আবদার করে কিন্তু সেই একই উত্তর আসে বিনুর কাছ থেকে । ফারুক কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না । তনু বুঝতে পারে বাবা ,মায়ের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কখনোই যাবে না । হাজার হোক সন্তানের ভালোমন্দ নিয়ে কথা । আর তাই রিনিকে কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দেয় । চুপ করে বসে থাকে একটা চেয়ারে । আবার ফোন বাজে কিন্তু ধরে না তনু ।
বেশ ক্ষীণ স্বরে ফারুক বলে
-“ বিনু আমি নিজে নিয়ে যাব । আর তুমি যা ভয় পাচ্ছ তা তো নাও হতে পারে । ওখানে কত নেতানেত্রীরা থাকবেন , কত গুণীজন থাকবেন । নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক সুশৃংখল থাকবে । তুমিই দেখ , টিভিতে দেখাচ্ছে তো সরাসরি ।”
-“শুনো তোমার ঐ নেতানেত্রীরা আর গুণীজনেরা এখন সকালে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন । উনারা প্রভাত ফেরীতে কুয়াশার চাদর গায়ে জড়াবেন না আর তাই রাত ১২টা ১ মিনিটে দায়িত্ব পালন করেছেন দায় সারা গোছে। উনারা না থাকলেও মিনারের উঁচু জায়গাটা দখল করে আছে বড় বড় মালায় সজ্জিত হয়ে ।” বেশ বিরক্তি আর শ্লেষ ঝরে পড়ল কথায় ।
-“এমন করে কেন বলছ ! কি হয়েছে তোমার ?” মোলায়েম সুরে বলে ফারুক
-“আমি যাবার অনুমতি দিলাম না , এখন তুমি চাইলে বাবা মেয়ে যেতে পার ।" বুকের মাঝ থেকে বের হয়ে আসা ঝড় হাওয়া এলোমেলো করে দেয় ভাবনা । একটু থেমে ঠোঁট উল্টিয়ে ধরা গলায় বিনু আবার বলে "আমার মন জানিনা কেন সাঁয় দিচ্ছে না , আমি সত্যিই জানি না ।" সে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
আবার ফোন বাজতেই তনু ফোন ধরলো ।বেশ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল
-“হ্যালো রিনি ! আমার যাওয়া হবে না রে ...আমি গেলে মা যে কষ্ট পাবে ।”
-“বলিস কি ! চাচী তো দুদিন আগেও বলল যে সেও আসবে তোকে সাথে নিয়ে ।”
-“জানি না রে ! কাল নাকি কি খারাপ স্বপ্ন দেখেছে আমাকে নিয়ে । তুই জানিষ তো মা আমাকে নিয়ে কত দুঃশ্চিন্তা করে । তুই আনন্দো কর । আগামী বছর যাব ।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে তুই মন খারাপ করিস না । আমি তোকে না নিয়ে আসবই না আগামী বছর ! দেখ দেখ আমাদের টিভিতে দেখাবে ! অনেকগুলো টিভি ক্যামেরা ঘিরে আছে । তুই টিভিতে দেখ , আমি তোর নাম ধরে অনেক জোরে চিৎকার দেব ! ত-----নু উউউউউউউ বলে ! এখন রাখি ”

আজ অন্যরকম একটা সকাল , গর্বিত শিকড়ের সূচনার দিন । চারিদিক থেকে ভেসে আসছে হাজারো সুরেলা কন্ঠে দেশের বীর শহীদ দামাল ছেলেদের দৌরাত্বতা এবং সাহসিকতার দৃষ্টান্তমূলক স্মরণের কলরব ! বিনু , ফারুক , তনু সবাই বসে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে । শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি থেকেই ৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারী স্বাধীনতার বীজ ছাত্রদের রক্ত দিয়ে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে রোপণ করা হয়েছিল । এই ভাষা আন্দোলনই চেতনার জমিনে আন্দোলনের স্পর্শ ,স্বাধীকার আদায়ের উদ্যমতার শক্তিশালী শেকড়ের ভিত মজবুত করেছিল প্রতিটা বাঙালীর রক্ত কণিকায় । ফারুক নস্টালজিক হয়ে হাতড়ে খোঁজে স্মৃতিভরা দোদুল্যমান সেই যুদ্ধের দিনগুলিকে ।
ঐদিকে বিনু ভাবে -মায়ের খুব আদরের ভাই ছিল বড় মামা । মাকে ঘাড়ে নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতেন । বিনু ছবিতে দেখেছে একদম মায়ের মত দেখতে মামা । ভাইয়া গর্ভে থাকতে মায়ের যখন প্রসব বেদনা উঠে , এই মামাই মাকে একরকম পাঁজা কোলা করে নিয়ে হাস্পাতালে যাবার জন্য ভ্যানের খোঁজে দেড়মাইল পথ হেঁটেছিলেন । আজ বড় ভাইয়ার এই পৃথিবীর আলো দেখা এই মামার জন্য হলেও , মামা নিজের পৃথিবীকে স্মরণীয় করে রেখে গেছেন ভাষা দিবসের মধ্য দিয়ে । হঠাৎ তনুর ফোন বেজে উঠে । সবাই তাকায় তনুর দিকে ।
তনু লজ্জা পায় । ফোনটা ধরে –
-“হ্যালো”
-“তনু আমাকে টিভিতে দেখাবে এখুনি , দেখ আমি কি বলি !”রিনির উত্তেজিত কন্ঠ বাতাসে ভেসে আসে ।
- “কই কই ?” খুশিতে তনু কি করবে বুঝতে পারে না ।" মা, মা টিভির চ্যানেল ঘুরাও রিনিকে দেখাচ্ছে টিভিতে ।"

বিনু একটা চ্যানেল ঘুরাতেই দেখে রিনিকে । সকালের স্নিগ্ধতায় কি সুন্দর ছোট ছোট বাচ্চারা হাতে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাইন দিয়ে । সবার চোখে মুখে পবিত্রতার দীপ্তি ছড়িয়ে আছে । খুশীর জোয়ারে ভেসে আজ যেন শহীদদের উদ্যেশ্যে ফুল দিয়ে , তাঁদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার শপথ নিতে এসেছে । টিভির একটা ছেলে রিনিকে প্রশ্ন করে
-“আচ্ছা আজকে আপনার সব চেয়ে কোন জিনিষটা বেশী কষ্ট দিচ্ছে ।”
প্রশ্নটা শুনে এক নিমিষে উড়ে যায় রিনির মুখের হাসি , একটা কাল মেঘের ছায়া দেখতে পায় সেখানে তনু ।
- “আমার প্রিয় বন্ধু তনুকে নিয়ে মিনারে ফুল দেবার খুবই বাসনা ছিল । ওর মায়ের মামা মানে ওড় নানা একজন ভাষা শহীদ । ওর নানা ভাষা সৈনিক হলেও ওর কষ্ট ওর নানু অ আ ক খ পড়তে পারত না । কিন্তু তিনি তাঁর প্রতিটা সন্তানকে শিক্ষিত করেছেন । আর ওর বাবা দিয়েছেন আমাদের দেশের লাল সবুজ পতাকার গর্ব । আমার , আমার খু-উ-ব ইচ্ছে ছিল ওর হাত ধরে আজ মিনারে ফুল দেব । কিন্তু ও আজ আসতে পারেনি , এটাই আমার কষ্ট ! ”কথাটা শেষ হতেই কপোল মুছে রিনি ।
তনুর শ্রদ্ধা বেড়ে যায় দ্বিগুণ প্রিয় বন্ধুর ভালবাসার পরিধী মেপে । বিনুও অবাক হয়ে তনুর দিকে তাকিয়ে থাকে । মেয়ে তার কতটা গভীরভাবে চিন্তা করেছে , বন্ধুদের সাথে তা শেয়ারও করেছে ! বিনুর হৃদয় গহিনে নামে অশ্রুঢল ! একরকম অপরাধবোধ তার মনকে ছেয়ে ফেলে !






-“আচ্ছা , আমরা যতদুর জানি আপনার বাবা একজন স্বীকৃত রাজাকার । দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার পরে এখনকার জনগণ ,যুব সমাজ দেশদ্রোহীদের বিচারের দাবীতে সোচ্চার । এই সম্পর্কে আপনার মতামত..................
প্রশ্নটা শেষ হয়না । বিকট শব্দে মনে হল টেলিভিশনটাই ভেঙ্গে গেল ! ঘটনা কি ঘটল তা বোঝার আগেই টিভির পর্দায় ঝিরঝির শব্দ । চ্যানেল ঘুরিয়েও আর কোন বাংলা চ্যানেল আনতে সক্ষম হল না । তনু দেখতে পেয়েছিল প্রশ্নটা যখন করেছে রিনি তখন ক্যামেরার দিকে তাকাতে সংকোচ বোধ করছে তবে সে একটুও ভয় পায়নি বা লজ্জা বোধ করেনি, কারণটা তনু জানে । রিনি নিজেই ওর বাবাকে , দেশদ্রোহীদেরকে ভীষণভাবে ঘৃনা করে !

সবাই কেমন একটা ঘোরের মাঝে রইল ! প্রতিটা সেকেন্ড যেন থমকে গেছে , স্তব্ধ সময় , স্বপ্ন পেন্ডুলাম । কেউ কারো আসন ছেড়ে নড়তেই পারল না , এমন করে কতক্ষন ছিল ঠিক জানে না ----- পরে জানা গেল এটা ৫২ এর রক্তে গড়া একুশে ফেব্রুয়ারির রক্ত সাগরকে তরঙ্গে প্রবাহিত করতে , একবিংশ শতাব্দীর স্বাধীন পতাকা তলে ২১শে ফেব্রুয়ারী , আটই ফাল্গুনের আগুন ঝরা দিনে একাত্তরের গজিয়ে উঠা দানবের পৈশাচিক রক্ত উল্লাস ! যেখানে আপন ঔরসজাত রক্তের রঙও ধরা দেয় ফিকে হয়ে !
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ শামছুল আরেফিন প্রথম থেকে যতদূর পড়েছি আপু খুব ভাল লাগলো। সাবলীল ভাষায় লিখেছেন, গল্পে তাই একটা টান টান ভাব ছিল, তবে শেষের দিকে এসে গল্প বুঝতে একটু কষ্ট হয়ে গেল। যেমন- আচ্ছা , আমরা যতদুর জানি আপনার বাবা একজন স্বীকৃত রাজাকার ............ এখানে প্রশ্নটি কি রিনি কে করা হয়েছিল? নাকি অন্য কেউ
ভালো লাগেনি ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
গল্পের শেষে প্যারাটার যে স্পেস তা অনেক বেশী হয়ে গেছে এইটা আসলে কোনো প্যারা হবে না আর তাই আপনার এই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে - হ্যাঁ প্রশ্নটি রিনিকে করা হয়েছিল । অনেক ধন্যবাদ শুভেচ্ছা অসীম
ভালো লাগেনি ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
আবু ওয়াফা মোঃ মুফতি বেশ ভালো লাগলো|
ভালো লাগেনি ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
অনেক ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
মনির খলজি আপু, খুব সুন্দর সুন্দর শব্দের ব্যাঞ্জনায় ও ঝংকারে নান্দনিক গল্প যেখানে একুশের পটভূমি, একুশের মর্ম ও পরবতীতে অশুভচক্রের কালো দুরবিসন্ধি ও কিছু অনাকঙ্খিত শংকা একসাথে সবই প্রকাশ পেয়েছে ..ভীষণ ভালো লাগলো ! ....আর শুভকামনা রইল !
ভালো লাগেনি ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
বেশ কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী পাঠক পেয়েছি এখানে যাঁদের মাঝে আপনি একজন ! যাঁদের কথায় অনুপ্রাণিত হয় আবারো কিছু ম্যাসেজ সমৃদ্ধ ভাবনা ভাবতে । সবার ভালোবাসার কাছে ঋণী হয়ে রইলাম ...অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা , অনন্ত শুভকামনা
ভালো লাগেনি ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
বিন আরফান. অনেক পরিচ্ছন্ন একটি গল্প. পছন্দের তালিকায় রাখলাম.
ভালো লাগেনি ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
আনন্দিত হলাম পছন্দের করেছেন জেনে ! অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
ভালো লাগেনি ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ আপনার গল্পে কথোপকথন খুব শক্তিশালী ।ভাল লাগলো গল্প বলার ধরণও । শুভকামনা ।
ভালো লাগেনি ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হলাম ! শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
ভালো লাগেনি ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
নিলাঞ্জনা নীল খুব সুন্দর গল্প আপু....
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
খুশি হলাম ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
মাহ্ফুজা নাহার তুলি আপু খুব ভালো লাগলো ........পড়ার সময় সব ছবি যেন সামনে ভেসে উঠছিল....
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
ধন্যবাদ আপু সার্থক হোক পথচলা শুভেচ্ছা
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
amar ami শেষ টাতে রাজাকারদের প্রতি যেমন ঘৃনা উঠে এসেছে তা দরকার আমাদের এখনকার প্রজন্মের, নেত্রিবৃন্দুদের....
ভালো লাগেনি ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
মন্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করছি ...! ধন্যবাদ গল্প পড়ার জন্য শুভেচ্ছা
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
আহমাদ ইউসুফ অসাধারণ. আপনার লেখাটা পরে ভালো লাগলো
ভালো লাগেনি ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
আপনি আগেও একবার মন্তব্য করেছেন আমার এই লেখাতে তাই মনে প্রশ্ন জাগছে দুবার পড়লেন না কি না পড়েই মন্তব্য করলেন ঠিক বুঝতে পারছি না ! আবারও ধন্যবাদ
Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon) খুব ভালো লাগলো. অসাধারণ একটা গল্প!
ভালো লাগেনি ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
আপনাকে আমার পোষ্টে পেয়ে আনন্দিত হলাম । শুভেচ্ছা রইল

২৭ মে - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪