আমার শরীরটা ভীষণ খারাপ। কাশিটা ভীষণ জ্বালাচ্ছে! সেই সাথে হাঁচি! কিছুটা জ্বর জ্বরও লাগছে। চুপচাপ বসে ছিলাম। আমার থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে নয়ন পেপার মুখস্ত করছে! হ্যাঁ মুখস্তই তো করছে! একেবারে পেপারের ভীতর যেন ঢুকে গেছে! মনে হচ্ছে ভ্যানিস হতে বাকি! আমার থেকে একটু দূরে টেবিলের উপর আমার মোবাইলটা বেজেই যাচ্ছে! কে যেন ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে কল দিয়েছে! নয়নের হাতের কাছেই ফোনটা অথচ সেদিকে ওর একটুও খেয়াল নেই। অনিচ্ছা স্বত্বেও উঠে যেয়ে ফোনটা ধরলাম। ওপাশ থেকে ভেসে এলো ফেসবুক বন্ধু দীপালির দরাজ কণ্ঠ-
-কী রে দোস্ত কখন থেকে রিং দিচ্ছি ধরিস না কেন?
"খক খক খক খটাস খটাস" শব্দ করে দশ পনেরটা কাশি দিলাম। তারপর একটু দম নিয়ে বললাম-
-আর বলিস না গোস্ত! (কাশির দাপটে দোস্তকে গোস্ত শুনালো!) আবার "খকখক খটাস! খকখক খটাস"শব্দে আরও কিছু কাশি দিলাম! ব্যাস দীপালির দরাজ কণ্ঠ মুহূর্তেই বাজখাই হয়ে গেলো!
-ইইইউউউ! তোর তো দেখি করোনা হয়ছে! ওর কথা শুনে রাগে আমার শরীরের উত্তাপ বেড়ে ব্রেনে যেয়ে আঘাত হানল। শুরু হল আমাদের দুই বান্ধবীর কথোপ-কথন। বললাম-
-ধ্যাত এসব অলুক্ষুনে কথা বলে ভয় দিস কেন?
-তুই পরীক্ষা করিয়েছিস?
-এমন কাশি এর আগেও হয়ছে। প্রতিবছর যখন সিজন চেঞ্জ হয় আমার ঠাণ্ডা গরমে এলার্জি হয়।
-তুই প্লিজ একটু সিরিয়াস হ। করোনাভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস-যা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। আজকে মার্চের পঁচিশ তারিখ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে আজ পর্যন্ত সারাবিশ্বে এরই মধ্যে প্রায় ১৯৭টিরও বেশি দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রাণহানি হয়েছে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষের।
-তুই আমারে ভয় দিস ক্যান?
-আরে ভয় ক্যান দেবো?
-তাইলে তুই খুইলা ক...।
-কী খুলে বলবো?
-এই যে করোনা না করোলা কী সব কইলি! আর কোন নাম খুইজা পাইলো না?
আমি অবশ্য কিছুটা জানি। নয়ন সারাক্ষণ এইসব নিয়েই আত্মীয় বন্ধু বান্ধব সবার সাথে ফোনে কথা বলে। দেখুক আর না দেখুক টেলিভিশন চালায় রাখে। কথা বলতে একদম ইচ্ছে হচ্ছে না বলেই দীপালিকে একটু খুঁচা দিলাম। দেখি কভিক করোনা ভাইরাস নিয়ে সে কতটা জানে! আমার কথা শুনে দীপালি "হিঃ হিঃ" করে হেসে দিলো। আমার বুঝতে কষ্ট হল না ও আমার অজ্ঞতা ভেবে বেশ মজা করছে। আর তাই আবারও "খক খক খক খটাস খটাস" শব্দ করে গোটা চারেক কাশি দিয়ে একটু দম নিয়ে বললাম-
-শোন সত্যিই শরীরটা ভালো লাগছে না। তুই একটু খুলে বল আমি শুনছি!
এবার বিজ্ঞের মত বলতে লাগলো-
-করোনাভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন করোনা থেকে নেওয়া হয়েছে,যার অর্থ মুকুট। কারণ দ্বিমাত্রিক সঞ্চালন ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে এই ভাইরাসটির ক্লাব-আকৃতির প্রোটিন স্পাইকের কারণে একে দেখতে অনেকটা মুকুটের মত লাগে। ধারণা করা হয় করোনাভাইরাসের এই নতুন প্রজাতি ছড়িয়েছে বন্যপ্রাণী থেকে। প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ছড়ানো ভাইরাস কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে - তা এই সংকটের মধ্যে দিয়ে বোঝা যাচ্ছে।এর আগেও বহু ভাইরাসে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যেমন- সোয়াইন ফ্লু, ইবোলা,মার্স,সার্স ইত্যাদি। করোনাভাইরাস এদেরই মতো; সার্সের উত্তরসূরি। তবে করোনাভাইরাস একেবারেই নতুন একটা ভাইরাস। এর কোন চিকিৎসা এখনও কোন দেশ বের করতে পারে নায়। চিন্তা করতে পারিস আমেরিকা ইউরোপের মত দেশ নিউক্লিয়ার বোমা বানায় বইসা আছে! অথচ এই ভাইরাসের ওষুধ বাইর করতে তাদের ঘাম বের হয়ে যাচ্ছে!
-হুম চিন্তা কর এই ভাইরাস যদি আমাদের দেশে আগে বের হত,তাহলে কী হতো?
দীপালির কথা থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম কথাটা। সাথে সাথে ও জিজ্ঞাসা করে-
-কী হত?
-আরে গাঁধি,দেশের টাকা পয়সা নিয়ে সব চিকিৎসা নিতে ইউরোপ আমেরিকা দৌড়াইত! মরতো সব আমাদের মত মধ্যবিত্ত আর গরিব মানুষরা।
-হ্যাঁ তুই ঠিকই বলছিস। এ থেকেও ধারণা নেয়া যায় যে,করোনাভাইরাস কতটা মারাত্মক! বড় বড় দেশগুলোই কিছু করতে পারছে না! আর আমাদের মত দেশে সেখানে কী হবে আল্লাহই জানে! কারণ এই রোগ ভীষণ ছোঁয়াসে! এতটাই ছোঁয়াসে যে,একজনের কাছ থেকে হাজার হাজার মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। তাইতো সবাইকে ১৪দিন ঘরে থাকতে বলা হয়েছে।
আমি সত্যিই যেন কিছু জানি না এমন করে আবার একটু ভাব নিলাম । অবাক হয়ে বললাম-
-কী বলিস তুই? আমার তো ভয় লাগতেছে!
-শোন ভয় করিস না। এর পুরো নাম হল "নোভেল করোনা ভাইরাস"নোভেল অর্থ হল নতুন! এই রোগের নতুন আরেকটা নামকরণ হয়ছে- 'কোভিড-১৯'। তুই যদি...
আমি ওর কথা থামিয়ে দিয়ে বললাম-
-আচ্ছা আমি ক্যামনে বুঝবো যে এই অসুখ আমার হয়ছে?
-জ্বর,কাশি,শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাই মূলত প্রধান লক্ষণ। অনেক সময় এই লক্ষণগুলোও সব একসাথে থাকে না। শুধু একটা দুইটা লক্ষণও থাকে। মূলত এটি ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণতঃ উপসর্গ শুরু শুষ্ক কাশি ও জ্বরের মাধ্যমেই হয়। পরে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। এই শ্বাস কষ্টটাই আসলে মানুষকে কাহিল করে দেয়। সাধারণত রোগের উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে গড়ে পাঁচদিন সময় নেয়।
-ও আচ্ছা।
- হুম...৫৬ হাজার আক্রান্ত রোগীর উপর চালানো এক জরিপ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে:-এই রোগে ৬% কঠিনভাবে অসুস্থ হয় - তাদের ফুসফুস বিকল হওয়া, সেপটিক শক, অঙ্গ বৈকল্য এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা তৈরি হয়। ১৪% এর মধ্যে তীব্রভাবে উপসর্গ দেখা যায়। তাদের মূলত শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা তৈরি হয়। ৮০% এর মধ্যে হালকা উপসর্গ দেখা যায় - জ্বর এবং কাশি ছাড়াও কারো কারো নিউমোনিয়ার উপসর্গ দেখা যেতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের কোনো ধরণের অসুস্থতা রয়েছে,যেমন-অ্যাজমা, ডায়বেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ,তাদের করোনা ভাইরাসে মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।বিজ্ঞানীরা বলছেন-"মানুষের শরীরেই বাহক খুঁজে নিচ্ছে করোনা ভাইরাস, সংসার পাতছে কোষের ভেতরে। এই ভাইরাস ৩৮০ বার মিউটেশন অর্থাৎ জিনের গঠন বদলে গেছে।" এই কারণেই মেডিসিন বের করতে হিমসিম খাচ্ছে।
-আচ্ছা এ থেকে কী মুক্তির কোন উপায় নেই?
-এখন নেই। তবে এই রোগ থেকে এখন পর্যন্ত রক্ষার একমাত্র উপায় হলো অন্যদের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হতে না দেয়া। যার মানে হলো:১/মানুষ জনের চলাচল সীমিত করে দেয়া। ২/ বারবার হাত ধুতে সবাইকে উৎসাহিত করা। ৩/স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরে রোগীদের আলাদা আলাদা করে চিকিৎসা সেবা দেয়া। তাছাড়া রোগীদের ভাইরাস রয়েছে কিনা তা জানতে এবং রোগীদের সংস্পর্শে আসা লোকদের শনাক্ত করার জন্যও গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড বা নজরদারির ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে। আমাদের দেশের সরকার যে সবাইকে ঘরে থাকার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন! এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। আমাদের সবার উচিৎ তা মেনে চলা।
-কিন্তু কেউ তো শুনে না কথা।
-আসলে আমাদের দেশের মানুষ এই মহামারির ভয়াবহতা বুঝতে পারছে না!
-যে না বুঝে সে মরুক! এক একটার কান ধইরা নাকে খদ দিয়া ঘরে থাকার বাধ্য করতে হবে।
-এইটা ঠিক বলছিস। আসলে এই ভাইরাস একজনের হাঁচি কাশির সাথে জীবাণু বের হয়ে ছড়িয়ে যায়। তুই চিন্তা করতে পারিস সবচেয়ে ছোট্ট যে ভাইরাসটা সেও তিন ঘণ্টা বেঁচে থাকে! আর কত ছোট জানিস?
-কত...?
-আমাদের মাথার চুলের প্রস্থের দশ ভাগের একভাগ।
-উফঃ...! কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার তাই না...?
-ভয়ঙ্কর তো অবশ্যই। আসলে কী জানিস...জঙ্গলের গাছপালা পুড়ানো,গাছ কেটে জঙ্গল উজাড় করে ফেলা! নদী নালা খালবিল সবকিছুকে মানুষ যে যেভাবে পারে অপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করেছে! আমার মনে হয় মানুষ প্রকৃতির সাথে এতো জঘন্য আচরণ করেছে-যা কোন ভাবেই কোন সভ্য জগতের কেউ মেনে নিতে পারে না! কিন্তু কেউ এই অসভ্যতাকে দমাতেও পারছে না! অত্যাচার বাড়তে বাড়তে এখন প্রকৃতির ধৈর্যচ্যুতি তার ক্ষমতা দেখাতে বাধ্য হয়েছে! আর তাই প্রকৃতি এখন নৃশংস হয়ে,মানুষের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে! মানুষের অশিষ্ট আচরণ সহ্য করতে না পেরে সবাইকে ঘরবন্দী করে,কল-কারখানার দূষণ বন্ধ করে নিজের বন্ধ থাকা নিঃশ্বাস নিচ্ছে। প্রকৃতি মানুষকে পিছিয়ে দিয়ে,পৃথিবীর আয়ু বাড়িয়ে নিচ্ছে!
-হবে হয়ত! তুই লেখক মানুষ। তোর এইসব সাহিত্যের কথা আমার মাথার উপর দিয়ে গেছে। তবে কেন যেন খুব ভালোও লাগছে!
দীপালি নিজের প্রশংসা শুনে আবার সেই "খট খট" শব্দে হাসি হাসে। করোনা ভাইরাস নিয়ে এতো সব শুনে আমার এবার সত্যিই ভয় লাগতে লাগলো। তবুও মাথার ভীতর কুটুর কুটুর কামড় বসায় হাজারো ভাবনা! ভাবতে লাগলাম দীপালি তো ডাক্তার না! ও এতো কথা কীভাবে বলে! ও জানলো কীভাবে? আমাকে ভয় দিতে দুনিয়ার ভুলভাল বুঝায় দিলো নাতো? তাই আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারলাম না। জানি দেমাগে ওর দুই চারটা কথাও আমার হজম করতে হবে। তবুও জিজ্ঞাসা করলাম-
-তুই এত কিছু জানিস ক্যামনে?
সেই শয়তানি হিঃ হিঃ হাসি! মনে হয় ফোনের ভীতর দিয়ে ঢুকে ওর গলা টিপে ধরি। বহু কষ্টে নিজেরে নিজের মধ্যে দমাইয়া রাখলাম। সে দেখি বলে-
-আরে এখন এই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সবাই কম বেশি জানে। সবাই কম বেশি ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার,দার্শনিক! এক একটা জ্ঞানের ভাণ্ডার। তোর মত অজ্ঞ নাকি সবাই? গুগুলে সার্চ দিলেও বহু কিছু জানা যায়। তুই শুধু মজার মজার রান্না কর,তোর জামাইরে খাওয়া। নিজে খেয়ে খেয়ে ভুঁড়ি বাড়া। আর অন্যদের দেখে হিংসায় জ্বলে জ্বলে ছাই হয়ে যা! হিঃ হিঃ...
উফঃ এত বড় কথা! দাঁড়া কাশির গুষ্টি কিলায়। করোনার মুখে ছাই...! রাগে আমার শ্বাস কষ্ট বেড়ে চার গুণ হল। ওদিকে শুনি নয়ন কার সাথে যেন ফোনে পটর পটর কথা বলে। কথার ধরণে বুঝলাম ওর মার সাথেই কথা বলে। দীপালিকে আর কিছুই বলতে পারলাম না। সেই-ই বলে উঠে আবার-
-শোন আগে যে ওষুধ খাইতি ঐটাই খা। বেশি শ্বাসকষ্ট হলে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা বলে নিবি! আর বেশি বেশি ভিটামিন সি,পানি খাবি। আর…
-হয়ছে তোর আর কইতে হবে না।
আমার মৃদ্যু রাগ দেখে প্রসঙ্গ বদলে বলে-
-এই কে কথা বলে রে?
-তোর কী মনে হয় তোর মত আমি পাঁশের ফ্ল্যাটের ভাইদের আমার ঘরে বসায় চা খাওয়াই আর চাপা মারি?
"আহঃ কি যে শান্তি লাগলো কথাটা বলে!" কিন্তু ওর কিছুই হল না। খ্যাঁক খ্যাঁক হাসি দিয়ে বলে-
-কী করব বল? সবাই আমাকে বন্ধু বানিয়ে আড্ডা দিতে চায়। নয়ন ভাইও কিন্তু অনেক আড্ডা বাজ। তুই জানিস না...
-দীপালি আমার কিন্তু মাথা গরম হচ্ছে!
-হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ
-ইশশশ ছেলেদের মত হাসিস তুই...!
-তাই না...? আচ্ছা বৈশাখী তোর শাশুড়ির সাথে তোর সম্পর্ক ঠিক হয়ে গেছে?
-আর কস না! ঐ বুড়ির কথা আর কী বলব! এখন তো তোর কাছে করোনাভাইরাস নিয়ে শুনে মনে হচ্ছে ঐ বুড়িরে একজন করোনা ভাইরাস রুগীর সাথে কোলাকুলি করাই দি!
কথা শেষ করে আবারও আমার কাশি এলো। কথা বলার জন্য যেন কাশিটা আরও বেশি বাড়ছে! আমার শাশুড়ি আমাকে ভীষণ অপছন্দ করে। মহিলার ধারণা তার ছেলে সব টাকা পয়সা এনে আমাকে দেয়। আর আমি তা উনাদেরকে না দিয়ে নিজের সৎ মা আর ভাইকে দেই। একটু ভুল করলেই উনি বলবেন-"তোমার মা কী কিছু শেখায়নি!" কথায় কথায় বকা দিয়ে কথা বলে। দীপালির সাথে আমি সবকিছু শেয়ার করি। ওর সাথে আমার অনেক দিনের পরিচয়। দীপালিও আমার সাথে অনেক কথা শেয়ার করে। ও অনেক মজা করে। অনেক ভালো মনের একজন মানুষ।
-কী রে চুপ করে কী ভাবিস?
-ভাবতেছি করোনায় কত হাজার হাজার মানুষ মরে। এই বুড়িও যেন মরে।
-এভাবে বলিস না। বয়স্ক যারা তাদেরই কিন্তু করোনাভাইরাসে বেশি আক্রান্ত করছে। তোর শাশুড়ি তোর সাথে যেমনই হোক। তুই যাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসিস সেই নয়ন ভাইয়ের সে কিন্তু মা হয়। তুই এভাবে বলবি না...!
দীপালির কথা শেষ হতেই শুনি নয়ন ডাকছে।
-বৈশাখী...আর কত কথা বলবা। এই নাও মা কথা বলবে।
নয়ন আমার দিকে ওর ফোনটা বাড়িয়ে ধরেছে। আমি দীপালির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অনেক বিরক্ত হয়ে ফোন ধরলাম। এই মহিলার সাথে আমার একটুও কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। তবুও বিরক্ত নিয়ে ফোন কানে লাগিয়ে আবারও প্রচণ্ড কাশতে লাগলাম। দশটা কাশির ভীতরে ছয়টা দিলাম ইচ্ছাকৃত নকল কাশি। ওপাশ থেকে খড়খড়ে কণ্ঠে শাশুড়ি বলে উঠলো-
- কী রে বৈশাখী তোমার তো মরণের কাশি হয়ছে! ডাক্তার দেখাইছো?
-আর ডাক্তার...আপনার ছেলে ডাক্তারের কাছে নিলে না ডাক্তারের কাছে যাব?
-শুনো আদা লবণ হলুদের গুড়া আর মধু দিয়া র'চা খাও।
-সেইটা ওতো আমারই বানাই খাইতে হবে!
কথাটা বলতে বলতে রাগে রাগে নয়নের দিকে তাকাই। সে দেখি থার্মোমিটারের পারোদের মত মেজাজ গরম করে উপরে উঠাইতেছে। রাগে চক্ষু লাল। শাশুড়ি বলে-
-এইটা কেমন কথা বলো। তুমি বিশ্রাম নেবা। কাউরে ছুবা না। টুম্পারেও না।
-কী বলেন বোকার মত। আমি মা আমার পাঁচ বছরের মেয়েকে স্পর্শ করব না?!
-না করবা না। তুমি দেখো না কীভাবে করোনায় মানুষ মারা যায়তেছে?
"ও আল্লাহ্ সে তো দেখি শহরের বাইরে থেকেও সব খবর রাখে!"কথাটা মনে মনে ভেবে বেশ অবাকই হলাম। বললাম-
-মিডিয়া একটু বাড়ায় চাড়ায় বলে। ওরা মানুষকে ভয় দিয়াই মারবে।
- বেয়াদপ তুমি একটা। তর্ক করা তোমার স্বভাব। মুরুব্বীদের কথায়ও তোমার বিশ্বাস নাই…
আমি ফোনটা নয়নকে দিয়ে দিলাম। মনে হচ্ছিল ফোনে আচ্ছা করে দুই কথা শুনীয়ে মনের সাধ মেটাই। কিন্তু পারলাম না। শুনী নয়ন বলছে-
-মা তোমরা ঘর থেকে একটুও বের হবা না। আব্বাকে তুমি গেইটে তালা দিয়ে রাখবা। ছোটনকেও বের হতে দিও না। কাউকে বাসায় আসতেও দিবা না। আর কারো বাসায় যাবা ওনা। মনে রাখবা এইটা কিন্তু ভীষণ ছোঁয়াসে অসুখ।
আমি আর কোন কথা শুনতে পারলাম না। আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে সত্যিই মরে যাবো। টুম্পা কাঁদছে। ওকে খাওয়াতে হবে। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। মাথা,চোখ এতো ভার এবং ব্যথা করছে যে বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়লাম। মনে হল আমি জ্ঞান হারাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর নয়ন বেশ দূরে দাঁড়িয়ে ডাকছে-
-বৈশাখী তোমার মাথার কাছে টেবিলে জ্বর আর তোমার ব্রঙ্কাইটিসের ওষুধ রাখা আছে। প্লিজ একটু খেয়ে নেও। আমি টুম্পাকে নিয়ে পাঁশের ঘরে আছি। কিছু দরকার হলে মোবাইলে ম্যাসেজ দিও। শুনতে পাচ্ছ?
বহু কষ্টে বললাম-আচ্ছা!
-শুনো তুমি ঘরের বাইরে বের হইয়ো না। মুখে মাস্ক পরে নিও। আর কাশি বা হাঁচি এলে মুখে রুমাল বা টিস্যু দিয়ে চেপে ধর।
ভীষণ রাগ হল। আস্তে করে বললাম-তুমি কী ভাবো আমার করোনা হয়ছে? আমি মরে যাবো?
-না না তা না। কিন্তু শিওর ওতো না,তাই না? সাবধানে থাকো। যদি তোমার এই ওষুধে কাজ না হয় এবং কষ্ট বাড়ে আমি হট লাইনে ফোন দিয়ে তোমাকে নিয়ে যাবো। আর যদি সত্যই করোনা হয়? সেই ভয়েই আমি টুম্পাকে নিয়ে দূরে আছি।
আমি কাঁপা কাঁপা হাতে নয়নের রেখে যাওয়া স্যুপ খেলাম। তারপর ওষুধ খেলাম। অনেক কষ্ট হচ্ছে। টুম্পার কান্নার আওয়াজ পেলাম। কিন্তু উঠতে ইচ্ছে হল না।
ঘুম ভাঙলো কলিং বেলের শব্দে। দেখি শরীরটা এখন বেশ ভালো লাগছে। মাথা চোখ ব্যথা নেই। কাশিটা আছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম,দেখি নয়ন উঠে দরজা খোলে কিনা। এতো সকালে কে এলো? নয়ন মনে হয় টুম্পাকে নিয়ে সারারাত জেগেছে। হয়ত ঘুম। আর তাই বাধ্য হয়েই ঘর থেকে বের হলাম। দরজা খুলতেই দেখি মুখে মাস্ক পরা, হাতে গ্লোভস পরা একজন মহিলা। হাতে একটা ব্যাগ। মহিলাকে দেখে নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আমাকে পাঁশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সেই খটখট কণ্ঠে বলে উঠে-
-বৈশাখী তোমারে না কইছি ঘরে বন্দী থাকবা। বের হইছো ক্যান? তোমার মা কী মুরুব্বীদের কথার মান্য করতে শেখায় নায়?
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে নয়ন বের হয়েছে। অবাক হয়ে বলছে-
-মা তোমাকে বলছি আসতে হবে না। আমি বৈশাখীর দেখা শুনা করব!
-হ্যাঁ দেখাশুনা করবা। আমার কোন দায়িত্ব নাই তাই না? ভয় পাওয়া চলবে না। শক্ত থাকতে হবে। সাবধানে থাকতে হবে।আমি সাবধানেই আছি। কিন্তু আমার ছেলে,বউ,পুত্নি সবাই কষ্টে থাকলে কীভাবে বইসা থাকি? তোর কথা আমি শুনব ভাবলি ক্যামনে? তোর বাপের কথাই শুনী নাই। এই দেখ একাই চইলা আইছি! তারে তালা দিয়া রাইখা প্রাইভেট কার নিয়া চইলা আইছি।
আমি যেন আজ সব কথা হারিয়ে ফেলেছি। কোন কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেলাম। মনে মনে বললাম-"কী আশ্চর্য এই মহিলা জানে করোনা কত ছোঁয়াচে রোগ। তার যে বয়স তার তো ভয় পাওয়া উচিৎ। তা না সে আসছে আমার মেয়ে আর আমাকে দেখাশুনা করতে!" আমার কুৎসিত মনটা যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! এই মানুষটাকে নিয়ে আমি কত কী মানুষকে বলি। ঘাতক ভাইরাস আমি তো আসলে আমার মনেই পুষে রেখেছি। আমার শাশুড়ির ভালোবাসা আমি কোন দিন দেখিনি! শুধু তার বকা দিয়ে কথা বলার ধরণটাই দেখেছি! কেন জানি না চারদিকের সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে। আমার ভীষণ ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
জঘন্য হন্তারক"গল্পে ভাইরাস "করোনা" এবং হিংসা "করো না"বিষয় দুটোই অদৃশ্য শত্রু! যার মাঝে কদর্য খুনির পরিচয় মেলে! সমাজে দুটো বিষয়ই কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। গল্পের বিষয় "অশ্লীল"-এর সাথে উল্লিখিত বিষয় দুটির সামঞ্জস্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।