এক
-শুনো আমার কথা ভেব না। আমি তো আর মাত্র কয়েকটা মাস আছি।
জলি খুব কষ্টে কথাটা বলে। ওকে অবাক করে দিয়ে মিঠু বলে-
-না তোমার কথা ভাবছি না। ভাবছি তুমি ছাড়া এই বিদেশ বিভূঁইয়ে বাচ্চা দুটো নিয়ে কীভাবে থাকব?
জলি যেন সব কথা হারিয়ে ফেলেছে ওর কথা শুনে। কষ্ট দলা পাকিয়ে জলির গলায় ব্যথা করছে! ঢোক গিলে বলে-
-জানো আমিও ঠিক এই কথাই ভাবছি।
দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর! ইঞ্জিনিয়ার স্বামী মিঠুর দুশ্চিন্তা হওয়াটা যেন খুবই স্বাভাবিক। ডাক্তার আজ জলির সামনে মিঠুকে বলেই দিয়েছে-"সময় আর মাত্র পাঁচ থেকে সাত মাস। উনার ইচ্ছেগুলো যত দ্রুত সম্ভব পূরণ করতে হবে।" জলির ইচ্ছে পূরণ কী করবে? কীভাবে করবে? কিছুই ভেবে পায় না। এখানে আত্মীয় স্বজনও কেউ নেই যাদের ভরসায় সন্তানদের রেখে জলি চলে যাবে। যাদের কাছে অভিমান করে হলেও একটা রাত কাটাবে! জলি বুঝতে পারে-মনের গহীনের নরম ভীতে একটা ভাজা মাংসের দলা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে! পোড়া গন্ধ ছড়ানোর চিন্তায় চিন্তায় ও সত্যিই অনেক অসুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু এই অসুস্থ্যতার কোন ছাপ ওর চেহারায় নেই। শুধু চোখের নিচে বাদামি রং ধরে আছে দুশ্চিন্তা আর কষ্টের ছাপ।
দুদিন পর একরাতে জলির হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখে মিঠু পাশে নেই! অজানা আশঙ্কায় জলির বুকের ভেতরটা ভীষণ ব্যথা করে উঠে! অথচ ওর এই ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। বাইরে ঝুল বারান্দায় এসে দেখে মিঠু কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। জলি যে ওর পিছনে তা টের পেয়ে বলল-
-আমি রাখি আজ। বুঝতেই পারছ মনটা একেবারেই ভালো না।
কথাটা বলেই ফোন রেখে দিয়ে ওর দিকে ঘুরল। আদর মাখা স্বরে বলল-
-কী হল তোমার? ঘুম ভেঙ্গে গেলো যে।
-হুম...!
জলি জানেনা কেন একটা কান্না এসে গলার ঠিক মাঝ বরাবর আটকে আছে। সবকিছু ঝাপসা দেখছে। ওর যে কী হল ধাম করে বলে ফেলল-
-মিঠু আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
- কী ব্যাপারে?
-আমি ভাবছি শেষ বিদায় নেবার আগে আমি তোমাকে ডিভোর্স দিব।
-পাগল হলে নাকী! কী আবোল তাবোল বকছো?
- হ্যাঁ তোমার কাছে এমনটাই মনে হবে। কিন্তু আমি সিরিয়াসলি বলছি। আমি চাই তুমি আবার বিয়ে করবে।
-আরে এই মাঝ রাতে কী শুরু করলে?
-ঠিক আছে তাহলে দিনের আলোতেই বলব।
কথাটা বলেই জলি বেড রুমে চলে যায়। জমে থাকা কান্না বৃষ্টি হয়ে ঝরতে থাকে। এই কান্না ও মরে যাবে সে জন্য নয়। এই কান্না ওর সন্তানদেরকে ছেড়ে চলে যাবে সে জন্যও নয়। এই কান্না ওর ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হতে দেখবে সেই কষ্টে। অথচ এমন এমন সময় এসেছে ওরা দুজনেই দুজনের প্রতি বিরক্ত হয়েছে। একজন আরেকজনের ছোট ছোট ভুলগুলো,দোষগুলো সহ্য করতে না পেরে ঝগড়া করেছে। দুজন দুদিকে চলে যাবার জন্য কয়েকবার দুজনে দুজনের কাছে আকুতি করেছে-'মুক্তি চাই...প্লিজ আমাকে এই বন্ধন থেকে মুক্তি দাও!" অথচ আজ যখন মুক্তি মিলছে তখন ওকে ছেড়ে যেতে জলির ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!
মিঠুর সাথে জলির প্রেম করেই বিয়ে হয়েছে। দুজনেই দুজনের সব পছন্দ অপছন্দ ভালো লাগায় পরিণত হয়েছে। দুজনের ভালোবাসায় জন্ম নিয়েছে ছেলে মেঘ আর মেয়ে বৃষ্টি। ওরা এখন স্কুলে যায়। ওরা এখনও জানে না ওদের বাবা মা খুব শীঘ্র দু'দিকে চলে যাবে। জলি কীভাবে বলবে ওদেরকে!
দুই
একদিন সকালে ছেলে মেয়েকে জলি নিজেই স্কুলে রেডি করে দিয়ে আসে। এসে দেখে মিঠু অফিসে যাবার জন্য রেডি। জলি বলে-
-আজ সিক কল দেউ প্লিজ।
-কেন কী হয়েছে?
-আজ আমি আর তুমি একটা জায়গায় যাব।
মিঠু সত্যিই আর কিছু না বলে অফিসে ফোন দিয়ে ছুটি নিয়ে নেয়। জলির কেন যেন এতে রাগ হল! তারপরও সে আজ অনেক করে নিজেকে সাঁজাল। বহুদিন পর নীল শাড়ি পড়ল। মাথায় পরলো ম্যাচিং করা কাপড়ের ফুল। কানে দুল আর হাতে দুগাছা চুড়ি! নীল একটা ছোট্ট টিপ দিতে গিয়েও দিল না। কেন যেন ইচ্ছে হল না। দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে কিছুক্ষণ নিজেকে আয়নায় দেখে নিলো। হাল্কা লিপিস্টিক ঠোঁটে লাগাতেই জমে রাখা নিঃশ্বাস চোখ থেকে টপটপ করে ঝরতে লাগল। চোখ মুছে কাজল পরে নিলো। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে বের হয়ে এলো। বাইরে বের হতেই মিঠুর চোখে চোখ রাখল। জলি যেন একটা শুকনো নদী দেখতে পেল! যেখানে এক বিন্দু জল নেই। নেই ভাল লাগার স্নিগ্ধ সোনালি ভোর! সেখানে শুধুই খাঁ খাঁ মাটি। জলির চোখ,মিঠুর ঠোঁটে এসে থমকে গেলো। থরথর করে কাঁপছে মোটা বাদামি ঠোঁট জোড়া। মনে মনে ভাবল "সত্যটা জানা না থাকলে ভেবেই নিতাম হয়ত,আমার বিদায়ে তোমার ভীতরে জমে থাকা কষ্ট রক্ত ঝরাচ্ছে! যার কাঁপন ঠোঁটে তুলেছে! কিন্তু মিঠু আমি যে সত্যটা জানি।" জলি মুখে কিছু না বলে গাড়ীতে উঠে বসল। মিঠু বলল-
-কোথায় যাবে?
-শিলার বাসায়। জলি খেয়াল করল মিঠু যেন ভীতরে ভীতরে খানিক চমকেই উঠলো! কিন্তু প্রকাশ করলো না। গাড়ী সোজা চলতে শুরু করলো। হালকা ঠাণ্ডা বাতাস কনকনে শীতের আভাস দিচ্ছে! রাস্তার দুপাশে রঙিন পাতায় সেজে গাছগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। জলি জানালায় ঝাপসা চোখ রেখে সে সব দৃশ্য দেখে। মনে মনে ভাবে আর কয়েকদিন পর একটা পাতাও থাকবে না গাছে। একেবারে নগ্ন শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সারি সারি গাছগুলো।
-তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে! মিঠু কথাটা বলে আবার সামনে তাকায়। ওর কথায় খুশি না হলেও জলি আস্তে করে বলে-
-ধন্যবাদ। গলাটা কেঁপে উঠে। এমন সাঁজে একটা সময়ে মিঠু উচ্ছ্বসিত হত। কোনভাবেই সে ঘর থেকে বের হত না। সারাটা সময় গভীরভাবে জলিকেই দেখত। ভালোবাসার ছোঁয়ায় ওকে গর্বিত করে নিয়ে যেত স্বর্গরাজ্যে। অথচ সেসব সময়গুলো এখন কেবলই স্মৃতি।
শিলার বাসার সামনে আসতেই ওর মায়ের সাথে দেখা। জলি আর মিঠুকে দেখে খুব খুশি হলেন। শিলা বাসায় আছে তাও জানালেন। শিলা ওদের পরিচিত আইনজীবি। জলির সাথে শিলার দুই বছর আগে পরিচয় হয়েছিল। সেই থেকে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। আইনজীবী হিসাবে উনার এখানে বেশ নাম যশ আছে। জলি আগেই ফোনে সবকিছু আলাপ করে রেখেছিল। মিঠু গাড়ী থেকে নামতে চাইলো না। ওর এসব কিছু দেখে জলির ভীষণ রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে দু'হাতে ওর গলাটা চেপে ধরে! অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে বলল-
-আমার শেষ ইচ্ছেটাও তুমি পূরণ করতে দেবে না?
-জলি প্লিজ এসব বন্ধ কর। তোমার কিছু হবে না দেখে নিও।
মিঠু কাঁদো কাঁদো ভাবে কথাটা বলল। জলি হাসল। হেসে দিয়ে বলল-
-যেখানে ডাক্তার সময় বেঁধে দিয়েছে। সেখানে তুমি কীভাবে বল যে কিছু হবে না? প্লিজ আমাকে শেষ কাজটা করতে দাও।
মিঠু আর কিছু বলল না। জলি মিঠুর হাত ধরে ওর একেবারে গা ঘেঁষেই শিলার চেম্বারে ঢুকল। রুমে ঢুকতেই শিলা প্রথমেই ওদের দুজনের গা ঘেঁষে থাকা দেখল। ওর সে দেখায় কী ছিল জলির জানা নেই! মিঠু হাত দিয়ে ওর হাত সরিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল! জলি অনুভব করলো-"ওর ভীতরে থাকা ভাজা মাংসের টুকরোটা,ইদানীং ঘরের সীমানা ছাড়িয়েও বেশ গন্ধ ছড়াচ্ছে! যে গন্ধে ওর সবকিছু অলট পালট করে দিচ্ছে।"
শিলা ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। খুব একটা সমস্যা হল না। পাঁচ বছরের প্রেম আর তের বছরের সংসার। সবকিছু শেষ করতে সময় লাগল মাত্র একটা ঘণ্টা। ওরা দুজনেই মিউচুয়াল ডিভোর্স পেপারে স্বাক্ষর করল। জলি অবাক হল ওর হাত একটুও কাঁপল না!
-"অনেক অনেক অভিনন্দন!" শিলা ওর হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে ঝেঁকে ঝেঁকে হ্যান্ডসেক করলো। ও হাতটা যতবার ঝাঁকি দিচ্ছিল। জলির বুকটা ততবার "ধাম ধাম" করে শব্দ করছিল। ভালোবাসার গর্বের পাহাড়টা শব্দ করেই ভেঙে যাচ্ছে! এত জোরে সে শব্দ,যেন কান পাতলেই শোনা যাবে।
-বাকি যা যা করার আমি করে ফেলব।
শিলা খুব খুশি খুশি মুখ করে কথাগুলো বলল। জলি কেন যেন শিলা বা মিঠুর চোখের দিকে আর তাকাতে পারল না। গা গুলিয়ে উঠলো! মাথার ভীতরে চক্কর দিচ্ছে! অস্ফুটে বলল-
-প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি কর।
জলি আর দাঁড়াতে পারেনি। ছুটে এসে গাড়িতে বসল। "এই মুক্তি আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে। অনেক...!" অস্থির লাগছে ওর। মিঠু গাড়ির কাছে ফিরল আরও দশ পণের মিনিট পর।সারা রাস্তা জলি একটা কথাও বলেনি! বাসায় এসে জলি বাচ্চাদের রুমে চলে গেল। মিঠু কফি বানিয়ে ওর জন্য নিয়ে এলো। স্বাভাবিকভাবে বলল-
-জলি এটা করার কী খুব দরকার ছিল?
-প্লিজ আমাকে একা থাকতে দাও...! জলির কেন যেন মিঠুর উপস্থিতি ভালো লাগছিল না। জলির জন্য আনা কফিটা রেখে,মিঠু কোন কথা না বলে সত্যিই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। দেশে থাকা স্বজনদের,অথবা এখানে থাকা পরিচিত কারো কাছে ওরা কেউ এই ডিভোর্সের কথা প্রকাশ করল না। জলিকে অবাক করে দিয়ে মাস খানেকের ভিতর শিলা সবকিছু করে ফেলল। সে অনেক কর্মঠ একজন আইনজীবি।
তিন
তিনমাস যেদিন শেষ হল জলি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তিনটা মাস যেন তিনশো বছর হয়ে ওকে জ্বালিয়েছে! এই তিনমাসে মিঠু ওর কাছ থেকে অনেকটাই এড়িয়ে চলেছে। ও-ও ওকে এড়িয়ে গেছে। কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারেনি! একটা জড়তা সব সময় সাপের মত ঠাণ্ডা আবেশ নিয়ে জড়িয়ে ধরেছে। মনে হয়েছে তাকালেই বিষের ছোবলে তছনছ করে দেবে চোখ। অবশ্য জলি মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে দেখেছে-ইদানীং মিঠুকে অনেক সুন্দর লাগছে। কালার করা চুলের স্টাইলও চেঞ্জ করেছে। নিয়মিত জিমে যাচ্ছে। জলির খুব করে ইচ্ছে হয় ওকে ছুঁয়ে দিতে। ইচ্ছে হয় ওকে খুব জোরে জড়িয়ে ধরে বলতে-'এত সহজে আমাকে ছাড়তে পারলে তুমি জান!' জান…! বিয়ের আগে থেকেই মিঠু জলিকে জান বলে ডাকত। জলি খেয়াল করেছে গত চার মাস ধরে মিঠু ওকে জান বলে আর ডাকে না। প্রচণ্ড রোদে তেষ্টা পেলে যে অনুভূতি হয়। মাঝে মাঝে মিঠুর মুখে "জান" ডাক শোনার জন্য জলিরও ঠিক তেমনি তৃষ্ণা জাগে! এই নব্বই দিনে জলি মোটামুটি সবকিছু ঘুছিয়ে নিয়েছে।মিঠু ওর শেষ আবদার রাখতে বিয়ের জন্য রেডি! আগামীকাল শিলার সাথে ওর বিয়ে।
মনে পড়ে দেশে থাকতে একবার জলি একা বাবার বাড়িতে গিয়েছিল। তখনও ওর কোল জুড়ে মেঘ আসেনি। সেইসব দিনগুলোর কথা ওর মনে পড়ে যায়! মনে পড়ে সেদিন মিঠু ফোন করে করে ওকে পাগল করে তুলেছিল।
-"জলি তোমার চুলের ঘ্রাণ না শুকলে আমার ঘুম আসে না।"
-'হিঃহিঃহিঃ আগে জানলে কয়েকটা চুল রেখে আসতাম। এক কাজ কর চিরুনিতে দেখো আমার চুলের ঘ্রাণ আছে।' জলি হেঁসে গড়াগড়ি যায়।মিঠুও নাছোড়বান্দা-
-"প্লিজ জান চলে আসো। তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে আমার ঘুম আসবে না!"
-'কেন কোল বালিশ আছে তো। এখন রাখো...আমাকে ঘুমাতে দাও। এক সপ্তাহের আগে আমি আসছি না।' জলি ফোন রেখে দিয়েছিল। সেদিন ওর সত্যিই নিজেকে মনে হয়েছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একজন নারী। যে স্বামীর মনের সবটুকু জায়গা দখল করে নিতে পেরেছে। সেদিন দুই ঘন্টা পরে আবার মিঠুর ফোন এসেছিল। ভোর তখন চারটা বাজে।
-'হ্যালো'
-"জান ঘুম আসে না। তুমি আমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে না দিলে,মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে একদম ঘুম আসবে না।"
-'কেন এমন করছো মিঠু! প্লিজ আমাকে ঘুমাতে দাও,তুমিও ঘুমাও।'
-"ঠিক আছে ঘুমাব। একটু ব্যালকনিতে আসো না প্লিজ। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে!"
জলির ঘুম ছুটে যায়।"এই পাগল তুমি বাসার সামনে!?" দৌড়ে ব্যালকনিতে এসে জলি দেখে মিঠু স্লিপিং গাউন পরে বাইকে বসে আছে! সেদিন ও নিজে স্লিপিং গাউন পরে বাসায় কাউকে কিছু না বলেই বের হয়ে এসেছিল।
এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে জলির রাতটা কেটে যায়। আজ কোর্টে যেতে হবে সকাল দশটায়। মিঠু আর শিলার বিয়ে। জলি ছেলে মেঘ আর মেয়ে বর্ষাকে স্কুলে যেতে দেয়নি। ওদেরকে সাথে নিয়েই কোর্টে গেল। ওরা কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। জলি খুব ছোট্ট করে ওদেরকে বলল-
-তোমাদের আব্বুর আজ বিয়ে হচ্ছে। তোমরা একজন নতুন মা পাবে। সাথে সাথে বর্ষা বলে উঠে-
-কিন্তু মা ওটা তো স্টেপ মাদার হবে। আমি তোমার সাথে থাকব।
ওর সাথে মেঘও সুর মেলায়। এই কয়দিন মিঠু ইচ্ছে মত ঘরে এসেছে। ইচ্ছে মত ফোনে কথা বলেছে। ডিভোর্সের প্রথম সপ্তাহে জলির প্রতি যেটুকুওবা টান ছিল,তা আটদিনের দিন থেকে আর দেখা গেল না।
যাক বেশ ভালো ভাবেই মিঠুর বিয়ে হয়ে গেলো। জলি আগেই ট্যাক্সিতে করে মেঘ আর বর্ষার এবং ওর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিষ নিয়ে এসেছে। জলি একটা হলুদ খামে মিঠুর নাম লিখে শিলার হাতে দিয়েছে। দূর থেকে নবদম্পতিকে বেশ অন্তরঙ্গভাবে দেখে জলি ছুটে যেন পালিয়ে বাঁচল। শাঁ শাঁ বাতাস কেটে ট্যাক্সিটা এই চেনা শহর ছেড়ে বিমান বন্দরের দিকে ছুটে চলেছে। বুকের উপর থেকে একটা পাথর সরে গেছে? না কী দ্বিগুণ ভারী হয়ে হৃদয়টাকে পাথর করে দিয়েছে? জলি সেই মুহু্র্তে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না! শুধু বুঝতে পারল ভীতর থেকে কে যেন তাড়া দিচ্ছে-“দূরে বহুদূরে চলে যা…!”
অন্য এস্টেটে একটা চাকুরীর দরখাস্ত করেছিল। চাকুরীটা হয়ে গেছে...! মুক্তির স্বাদই আসলে মানুষকে সবচেয়ে বেশি সুখে রাখে। জলি গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালায় চোখ রাখে। মনে মনে ভাবার চেষ্টা করে মিঠুকে লেখা চিঠির কথা। কিন্তু কী আশ্চর্য…! বুকের ভীতরে চাপচাপ ব্যথা এসে ঢেউ তুলছে চোখের ভীতরে। জলের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে সারা দেহ। চোখ জ্বালা করে সবকিছু ঝাপসা হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে তোলপাড় করে ডুবে যাবে মনের অটল নগরী!
চার
দশ বছর ধরে নানা শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে মিঠু। সেদিন বাসায় ফিরে প্রথম অনুভব করে চারদিক শূন্য। তখনও মিঠু জলির লেখা চিঠির কথা জানে না। শিলা এসে বার বার মিঠুকে বাসর ঘরে নিতে চায়ছে। কিন্তু ওর কিছুই ভালো লাগছে না। এই অনুভূতিটা বিয়ের পরেই হল! ওর মনে হচ্ছে "কেন জলির কথা শুনতে গেলাম? ওতো এমনিতেই কয়েকদিন পরে সবাইকে ছেড়ে যেত!" মিঠুর মনে হচ্ছে কেউ যেন যাদু মন্ত্রের মাধ্যমে ওকে বশ করে রেখছে! ও যেন গত কয়েক মাস ধরে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। আজ বাসায় এসে কাউকে না পেয়ে ঘোরটা কেটে গেছে! প্রতিদিন বাসায় এসে দরজা খুলতেই বাচ্চা দুটো "বাবা...!" বলে চিৎকার করে ছুটে এসে গলা জড়িয়ে ধরে। দুনিয়ার সব কষ্ট দুঃখ ক্লান্তি দূর হয়ে যায়! আজকে বাসায় এলো মিঠু ঠিকই,কিন্তু কেউ ছুটে এলো না। মিঠু ছুটে বাচ্চাদের ঘরে গিয়ে দেখে সেখানে কেউ নেই! ওদের কাপড়ও নেই। সারা ঘরে ওদের সবার বেশ কিছু ছবি দেয়ালে টানানো ছিল।সেগুলোও নেই। ভীষণ অস্থিরতায় সারা বাড়ি ছুটে ছুটে মেঘ আর বর্ষাকে খুঁজে যায়। "মেঘ...! বর্ষা...!" চিৎকার করে সন্তানদের নাম ধরে ডেকে যায়। সে ডাক শুনে আজ আর কেউ আসে না। শিলা বুঝতে পারে মিঠু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হয়ত শূন্যতা কতটুকু জ্বালা ধরায় মনে,তা সে বুঝে উঠতে পারেনি! হয়ত বুঝে উঠতে পারেনি একজন বাবার কাছে সন্তান সবচেয়ে বড় ধন! শিলা যতটুকু মিঠুকে চিনেছে বা বুঝেছে! তাতে সে জলিকে কতটা ভালোবাসে তাও বুঝেছে! জলিও যে মিঠুকে ভালোবাসে তা শিলা টের পেয়েছিল। কেন যেন ওদের ভালোবাসা শিলার সারা জীবনের কঠিন সিদ্ধান্তকে বদলে দিয়েছিল।
ওতো বিয়ে করবে না বলে বহু আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল-আজ থেকে দশ বছর আগে! আজ এই চল্লিশোর্ধ বয়সে এসে সেই প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে বিয়ে করতে নিজেকে সে বাধ্য করেছে। শুধুমাত্র মিঠু আর জলির একজনের প্রতি আরেকজনের গভীর ভালোবাসা দেখে। কেন যেন মনে হয়েছে ও-ও মিঠুর ভালোবাসা পাবার যোগ্য। বিয়ে করলেই মিঠু ওর হয়ে যাবে! কিন্তু না...! দেহের ক্ষুধা আর ভালোবাসা এক জিনিষ না! ভালোবাসা না থাকলেও মোহের ঘোরে মানুষ দেহের প্রতি আকৃষ্ট হয়! কিন্তু ইগো হোক বা মোহ , তা ভেঙে গেলে ভালোবাসা ছাড়া নিঃশ্বাস নিতেও যে কষ্ট হয়! ভালোবাসার কাছে পৃথিবীর সবকিছু তুচ্ছ! মিঠু জলিকে ভালোবাসে। শিলা হেরে গেল একজন প্রেমিকার কাছে। একজন মায়ের কাছে। অপমানে ওর বুকের ভেতরটায় আগুণ জ্বলে উঠলো! সে এভাবে কারো সাথেই সংসার তো দূরে থাক,পাশাপাশিও থাকতে পারবে না।
হঠাৎ জলির দেয়া খামের কথা মনে এলো। একবার ভাবল খামটা মিঠুকে দেবে না! পরে ভাবনায় আসে"না সে উদার মনের পরিচয় দেবে! সামান্য একটা চিঠি সে লুকাবে না!"দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের জল মুছে নেয়। তারপর ব্যাগ খুলে খামটা বের করে মিঠুকে দেয়। মিঠু খামটা নিয়ে ধীরে ধীরে মেলে ধরে চোখের সামনে। চিঠি পড়ে শুধু একটাই কথা বলল -"কাজটা ঠিক করলে না জলি!" একটু থেকে বলে" আ... মি ভীষণ দুঃখিত...।" শিলার মনে হল শেষের কথাটা ওর জন্য ছিল। সে কিছু না বলে মিঠুর সামনে দিয়ে কোন রকম বাঁধা ছাড়াই,মিঠুর বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।
শেষ
আজ ম্যানহাটনের একটা হাসপাতালে জলির এপয়েন্টমেন্ট আছে। রেগুলার চেক-আপ। এখানকার প্রায় সব ডাক্তার নার্সদের সাথে জলির বেশ সখ্যতা! যতবার আসে মিষ্টি হেসে সবাইকে "হাই হ্যালো" করে। এতেই সবাই ওকে চিনে রেখেছে! ওর বয়সটা বেড়ে গেলেও শরীরটাকে বেশ মজবুতই রেখেছে। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করে,পরিমিত স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে। রীতিমত নিউট্রিশনের তৈরি চার্ট ধরে বাসায় বাজার করা হয়। সবই ছেলে মেয়ের কারণে। "মা ভাত শরীরের জন্য খুবই খারাপ! ভাতে কার্বোহাইড্রেট অনেক বেশি থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর!" ইসঃ আসছে আমার মহাপণ্ডিতেরা! এই কিশোর বয়সেই ছেলে মেয়ে দুজনেই অনেক স্বাস্থ্য সচেতন! না হলে,যে জলি এক বেলা ভাত না খেলে কেঁদে কেটে বুক ভাসাত! সে কিনা এখন মাসের পরে মাস যায়,অথচ ভাত খায় না! মাঝে মাঝে ওর মনে হয় শুকনো মরিচ পোড়া আর কাঁচা পেঁয়াজ সরিষার তেল দিয়ে মেখে গরম গরম এক প্লেট ভাত খাবে। সাথে থাকবে কড়া করে ডিম ভাঁজি ! উমঃ একটু সরিষার কাসুন্দি হলে খুব ভালো-"আহা কী অমৃত!" জলি প্রায়ই মনে মনে কল্পনা করে ঢোক গিলে খায়। কিন্তু সত্যি সত্যি খাওয়া হয় না। আজও হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে ভাবছে "ইস যদি একপ্লেট পান্তাভাত আলুভর্তা দিয়ে খেতে পারতাম!" কথাটা মনে করে জেদ ধরে। আজকে বাসায় গিয়ে লুকিয়ে হলেও ভাত খাবে। ছেলে মেয়ে খাওয়া নিয়ে রীতিমত অত্যাচার করছে! আজকে ও শুনবে না। এমন সময় বেশ ছুটাছুটির শব্দ এবং ফিসফাস আওয়াজ! সেদিকে তাকিয়ে একজন নার্সকে জিজ্ঞাসা করতেই জানা যায়- ট্রেনষ্টেশন থেকে এ্যাম্বুলেন্স করে কোন এক হোমলেসকে আনা হয়েছে। তার শারীরিক অবস্থা ভীষণ খারাপ।
গৃহহীন,সহায়হীন মানুষগুলোর জন্য জলির খুব মায়া লাগে। নিশ্চয় এই মানুষগুলো এক সময়ে অনেক সুখে ছিল। ছিল মা বাবা ভাইবোন! হয়তবা বউ বাচ্চাও ছিল। হয়ত আরও কিছুটা শান্তি পেতে সবাই ওকে ছেড়ে গেছে! অথবা ও নিজেই সবাইকে ছেড়ে একা হয়ে গেছে! মানুষ যা পায়,তাতে সন্তুষ্ট হতে পারে না! তার আরও চাই ...আরও আরও। এই পাবার বাসনা তাঁকে ট্রেনের মত ছুটিয়ে বেড়ায়। এক সময় দুরন্ত ছুটে চলায় আসে ক্লান্তি! অবসন্নতায় যখন থেমে যায়-তখন দেখে যার জন্য, যাদের জন্য এই ছুটে চলা! তারা সবাই তাদের সুখের পথে ছুটে গেছে। আর ছুটে চলা মানুষটা নিজেই হয়ে পড়েছে একা...! নাম লিখেছে "হোমলেস"এর খাতায়।
কেউ কেউ অবশ্য ড্রাগসের নেশায় ডুবে সবকিছুকেই হাতের মুঠোয় চায়! নিজের মত করে পেতে গিয়ে সবকিছু হারায়। 'কেন মানুষ এত চায়?'জলি আপন মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যেন এসে দাঁড়ায় ঠিক স্ট্রেচারের কাছে! যেখানে হোমলেস লোকটা শুয়ে আছে। কেমন একটা অস্থিরতা জলির মনের মাঝে ঝড় তুলছে! কিন্তু কেন? সে জানে না। বারবার তেষ্টা লাগছে। "কোথাও কোন খারাপ কিছু হবে!" এমন সময় নার্স এসে স্ট্রেচার ঠেলে নিতে যাবে-জলির মনে হল লোকটা ওর হাত ধরে রেখেছে। কয়েকটা মুহূর্ত! ওর সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়! ওর চারপাশে কে যেন ফিসফিস গুঞ্জন তুলেছে "জা...ন!" জলির ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে। কথা বলতে চায়ছে কিন্তু একটা কষ্ট এসে ওর কণ্ঠ রোধ করে রেখেছে! কিছুক্ষণ পর জলি কী ভেবে যেন নার্সকে বলল-
'প্লিজ মিস লোকটাকে আমি দেখতে চাই...'
"কিন্তু ওর অবস্থা ভীষণ খারাপ।" কী ভেবে নার্স বলে উঠে "ও কী তোমার কিছু হয়?" জলি এ কথার উত্তর দেবার আগেই একজন ছেলে নার্স এসে লোকটার কাপড়গুলো একটা ব্যাগে ভরে নার্সের কাছে দেয়। একটা কাগজ দেখিয়ে বলে"এইটা কোন ভাষায় লেখা বুঝতে পারছি না!" নার্স নেড়ে চেড়ে কাগজটা দেখে। জলি দূর থেকেই বুঝতে পারে ওটা বাংলায় লেখা। খুশির একটা ঝিলিক খেলে যায় ওর মনে। বলে
-"মিস আমি জানি এটা আমার ভাষা!"
-"কী বল তুমি?"
-"হ্যাঁ মিস!"
"কিন্তু তোমাকে কী এটা দেয়া ঠিক হবে?" নার্স ভাবনায় পড়ে যায়। এর ভিতর ছেলে নার্সটি বলে উঠে-
- প্লিজ তাড়াতাড়ি আসো সে মরে যাচ্ছে!"
নার্স ছুটে যায়। জলি কী ভেবে নার্সের পিছু নেই।দেখে লোকটা ভীষণ ছটফট করছে। কেমন অস্থির...! আর বিড়বিড় করে কাকে যেন ডেকে যাচ্ছে। চুল দাড়িতে ঢাকা লোকটা জলির দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। কী ভেবে জলি লোকটার হাত ধরে। লোকটা জলিকে নিজের বুকের দিকে টেনে নিতে চায়! জলি সান্ত্বনার স্বরে বলে-"ভাববেন না... কিছু হবে না আপনার! আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন!" কেন যেন এই কথাটুকু বলতেই জলি হাঁপিয়ে উঠেছে! ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। লোকটার স্পর্শে কী ছিল সে জানে না! সমস্ত শরীরে একটা চেনা অনুভূতি খেলে যায়। রুগীর অবস্থা ভীষণ খারাপ। হার্টবিট কমে গেছে! লোকটা অক্সিজেন মাস্ক পরতে চায়ছে না। চিৎকার করে কী যেন বলতে চায়ছে। কিন্তু এত দুর্বল যে মুখে কথা ফুটছে না! এক সময় লোকটা জ্ঞান হারায়। নার্স জলিকে ক্যাবিন থেকে বাইরে নিয়ে আসে।
-"সরি মিস জলি লোকটা হয়ত আর বাঁচবে..." ওর কথা শেষ না হতেই জলি বলে"সিস্টার ওর জামার পকেটে কোন ঠিকানা বা ফোন নাম্বার আছে কিনা দেখ। ঐ কাগজটা আমাকে পড়তে দাও। এমন ওতো হতে পারে ঐ কাগজে ওর আপন কারো কথা লেখা আছে! যাকে লোকটা শেষ দেখা দেখতে পাবে!" জলি ভেবে পেলো না একজন অচেনা অজানা ফুটপাতের মানুষের জন্য কেন ওর এত খারাপ লাগছে! ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে! নার্স ওর হাতে প্লাস্টিকের জিপলগে রাখা কাগজটি ধরিয়ে দিয়ে বলল-" প্লিজ তুমি এইটা দেখে এখুনি আমাকে দাও,আমি আবার জায়গায় রেখে আসি।" কাগজটা কেমন হলুদ ময়লা হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। বুঝা যায় চোখের জলে কিছু কিছু অক্ষর অস্পষ্ট হয়ে গেছে! তারপরও লোকটা বেস যত্ন করে আগলে রেখেছে। জলি ধীরে ধীরে খুব যত্ন নিয়ে কাগজটা খোলে…
প্রিয়...
হ্যাঁ প্রিয়ই তো! আমাকে তুমি ভালো নাইবা বাসো! আমি আজীবন তোমাকে...থাক সেসব কথা। সম্বোধন করতে হয় ধরে নিও তাই করলাম। তোমার মনে আছে তুমি প্রায়ই বলতে আমার কোন যোগ্যতা নেই। তুমি আমার থেকে আরও শিক্ষিত মেয়ে ডিজার্ভ কর? এই কথাটা যে আমাকে কতটা লজ্জায় ফেলে দেয়,তা তুমি কোনদিন বুঝবে না। তুমি সব সময় আমার মাঝে কী কম আছে তাই তুলে ধর! আশে পাশে কাউকে দেখেই তুমি কথা বল না। যখনই আমি কষ্ট পেতাম! তুমি বলতে-আমাকে সংশোধন করতেই তুমি সত্যটা বল! কিন্তু সব সত্য সব সময় সব জায়গায় বলতে হয় না-এটা কী জানো না?
জানো? নিজেই আমি নিজের চোখের দিকে তাকাতে পারি না। আয়নার সামনে দাঁড়াতেও কী এক গভীর জড়তা আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমাকে তো জেনে শুনেই বিয়ে করেছিলে। তাহলে আজ এতদিন পরে কেন এসব বলে আমাকে অপমান কর? হ্যাঁ আমি জানি এই অনুভূতি তোমার কেন হয়েছে। শিলার সাথে আমার পরিচয়টা যে কাকতালীয়ভাবে ছিল না! তা আমি কয়েকদিনেই বুঝে গিয়েছিলাম। আমি জেনে গিয়েছিলাম শিলা কে? কেন ঐদিন হঠাৎ করে আমার বাসার কাছে তার গাড়ী নষ্ট হয়েছিল? কেন সে আর কোন বাড়িতে না গিয়ে আমার বাড়িতেই সাহায্যের জন্য এসেছিল। এসব আমি দেরিতে হলেও বুঝেছিলাম। তুমি একবার বলতে আমাকে...আমি সব ছেড়ে তোমাদের জীবন থেকে হাসি হাসি চলে যেতাম। জীবনের চেয়ে,হৃদয়ের চেয়ে মানসম্মান বড় হয় কীভাবে মিঠু? তোমাকে তো আমি আমার জীবন ভেবেছি। তোমার কষ্ট আমার হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ করে এইটা কেন বুঝলে না?
আমাকে ভালোবাসো এইটা দেখাতে তোমার মনের নদীতে যে ভাঙন শুরু হয়! তার শব্দ তুমি দূরে গেলেও আমি শুনতে পাই। আমি তোমার অভিনয় দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে উঠেছি! তোমার সাথে এক বিছানায় তো দূরে থাক,এক ছাঁদের নিচে থেকে নিঃশ্বাস নিতেও আমার প্রচণ্ড কষ্ট হয়! তুমি শিলাকে নিয়ে একটা নাটক করলে। তোমাকে সুখী দেখতে,আমার কাছ থেকে তোমাকে মুক্তি দিতে আমিও একটা নাটক করলাম। বুঝনি তো!
ক্যানসার ফ্যানসার আমার কোন কিছুই হয় নি। আসলে যা ভেবেছ যে সবাইকে ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি। এটা মিথ্যে ছিল। আমিই ডাক্তারকে বলেছি এভাবে বলতে। তুমি আমাকে যে কয়েকদিন ধরে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখ! এই আমি সেইটা বুঝব না কীভাবে ভাবলে? আমি ঘুমিয়ে থাকব আর তুমি সারা রাত শিলার সাথে কথা বলবে? ছুটে তার বাসায় গিয়ে রাত কাটাবে! যে তুমি অন্য নারীর জন্য আমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পড়াতে পারো! সেই তুমি যে আমাকে আর আমার সন্তানকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলবে না,তার কী কোন গ্যারান্টি আছে? আমই ভয়ে ভয়ে থাকি। আমার বলতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না যে,তোমার প্রতি আমার একফোঁটা আস্থা নেই।
তোমাকে ভালবেসেছি তাই শুধু তুমি যা ডিজার্ভ কর,তাই তোমাকে পাইয়ে দিয়েছি। কোন বাঁধা হয়ে থাকিনি। যাক সবকিছু ভালোই ভালোই হয়ে গেলো। মেঘ আর বর্ষা আমার সাথেই আছে। শুধু শুধু তোমাদের দুজনের মাঝে বাচ্চা দুটো তোমাদের সুখ নষ্ট করত। তুমি যা করেছ ছেলে মেয়ে জানলে তোমাকেই লজ্জায় পড়তে হবে। আমার যোগ্যাতা নিরূপণ করে তুমি আমাকে অবহেলা করতে পারতে। কিন্তু বাবা হয়ে ছেলেমেয়ের যোগ্যতা বিচার করবে কী করে? ওদেরকে তুমি কীভাবে ধোঁকা দিলে মিঠু? তাই ওদেরকে নিয়েই গেলাম। অনুরোধ এবার অন্তত আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিও। প্লিজ খোঁজাখুঁজি কর না। শিলা অবশ্য সবকিছুই জানে। ও নিশ্চয় তোমাকে অনেক ভালোবাসে? আমার চেয়েও অনেক বেশি! তাই না?
শিলা চায়নি বর্ষা আর মেঘকে আমি নিয়ে যাই। ও বলেছিল-ও নাকি কোনদিন মা হবে না। কারণ মা হলে নাকি মেয়েদের ফিগার নষ্ট হয়ে যায়। ও হয়ত জানে না মাতৃত্বের গভীরতা,আনন্দ কতখানি। একজন মা সব ছাড়তে পারে। কিন্তু নিজের সন্তান ছেড়ে কোনদিন থাকতে পারে না। যাইহোক,আমি ভণিতা করতে পারি না বলে সরাসরি যা কিছু সত্য তাই লিখে গেলাম। এবার তুমি যা ডিজার্ভ কর তাই পেলে। অনেক সুখে থেকো…।
ইতি-জলি
জলি কিভাবে যে সম্পূর্ণ চিঠিটা পড়ে ফেলল সে জানে না! কষ্টে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে! দ্রুত হেঁটে ক্যাবিনে ঢোকে। কাঁপা কাঁপা হাতে মিঠুর হাত নিজের হাতে তুলে নেয়! আজ বহুদিন পর যেন বুকের ভীতরে জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করেছে। যেন শুকনো ভাঁজা পোড়া মাংসের দলা থেকে আতরের সুবাস বের হচ্ছে। শিলাকে ভেবে যে হিংসায় জ্বলে সে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল,আজ তা কস্তূরী হয়ে ওর বুকে মিশে যাচ্ছে! মাঝখান থেকে চলে গেছে কতগুলো বছর...! মনে হচ্ছে বহুদিন ভ্যাপসা গরমের যন্ত্রণা শেষে,অ্যাটলান্টিকের খানিকটা তৃপ্তির বাতাস এসে সব যন্ত্রণার অবসান ঘটাল! যেন শুকনো নদীতে জোয়ার এসে চারদিকে "জা...আআআআন,জা...ন!"প্রতিধ্বনি তুলেছে! ওর স্পর্শ পেয়ে মিঠুর হার্টবিট বেড়ে গেছে! নার্স বলে-
"মিস তোমার কিছু হয় এই হোম..."জলির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে! কঠিন জোরালো কণ্ঠে বলে-
-"ও হোমলেস নয়। আমার সন্তানদের বাবা! আ... আমার...।"কথাটা শেষ করতে পারে না! হু হু করে কেঁদে প্রিয়তমর বুকে হাত রাখে।
একদিনের জন্যও জলি এই মানুষটাকে ভুলে থাকতে পারে নি। বরং ভুলতে চেয়েছে বলেই অনেক বেশি করে দুজনের স্মৃতিগুলো মনে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠেছে। এই স্মৃতিগুলোই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আজ মনে হচ্ছে ভালোবাসায় আসলে হারজিত বলে কিছু নেই। আছে শুধু তোমার জন্য আমার অসীম ত্যাগ! তুমি সুখে থাকলে,সুখী হয় হৃদয়! জলি ভালোবাসা দিয়ে মিঠুর জন্য ভালোবাসার সুখ কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু সে ভালোবাসা মিঠুকে নিঃসঙ্গ করে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। অথচ খুব কাছে এসেও,একটা ভুলের বোঝা মিঠুকে মুখোমুখি হবার সাহস কোন দিন দেয়নি! জলির মনে হল ভালোবাসার দু'জন মানুষ এতদিন দু'দিকে গিয়েও একসাথেই ছিল। খুব কাছে...একজনের ভীতরে আরেকজন।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
ভ্যালেন্টাইন ভালোবাসার দৃষ্টান্ত,জীবন্ত প্রতীক! ভালোবাসা মানেই তোমার জন্য আমার অসীম ত্যাগ! তুমি সুখে থাকলে,সুখী হয় হৃদয়! ভালোবাসার আলো জীবনকে করে মধুময়। কিন্তু যেখানে ভালোবাসা সেখানে ভুল বুঝাবুঝি,অভিমান,আবেগ সবকিছু যেন"মেঘ বৃষ্টির খেলা"
২৭ মে - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১২০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী