গোধূলির রক্তিম জবার লালিমা যখন সারা আকাশ জুড়ে? হৃদয়ের অলিগলিতে তখন যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে,তা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। কেউ না জানুক এই আমি তো জানি কতটা ঝড়ের তাণ্ডবে তোলপাড় হয়ে যাবে আমার সারা পৃথিবী। আর মাত্র কয়েকটা মুহুর্ত...। তারপর সব কিছু তছনছ করে দিয়ে স্তব্ধ করে দেবে এই সময়! ভারী উলঙ্গ চোখে আকাশটাকে আজ অনেক বেশী গাঢ় লাগছে...লাল টকটকে লাল। বুকের উপর ভারী হয়ে বসে আছে কিছু। নিঃশ্বাস নিতে তাই কষ্ট হচ্ছে।
-দীপ দীপ তাড়াতাড়ি এসো বাবা। দেখো না ডাক্তার কীসব বলছে! শীঘ্রি আসো বাবা আমার মামনিটাকে...।
শাশুড়ির কথা শেষ না হতেই আমি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করি। উনার চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে আমার ভীষণ ভয়। মনে হল উনি আমার চোখ দেখে সব পড়ে ফেলবেন। বুঝে নেবেন আমার ভুল,আমার চাওয়া আর আমার অপরাগতা। যেখানে আমি সমুদ্রের স্রোত বইতে দেখছি?সেখানে উনি খুঁজে খুঁজে তুলে আনবেন হাজারো মৃত শব্দ। যে শব্দগুলো মৃত হয়েও নির্বিঘ্নে বলে যাবে উনার বিশ্বাস যোগ্য কঠিন সব মিথ্যে। কিন্তু সত্যিই কী সব মিথ্যে!?
আমি কখন কীভাবে যে বাড়ীতে এসে পৌঁছেছি তা নিজেও জানিনা। বাড়ী ভর্তি মানুষ...! মনে হল সবাই খুব গভীরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা উঁচু করে তাকালেই সবাই আমার দিকে তেড়ে আসবে। কান্না! একটা কান্নার শব্দে আমি উতলা হয়ে উঠেছি...। তৃষা...উফঃ মেয়েটার কথা তো একেবারেই মনে ছিল না। ও কাঁদছে কেন এতো? ও কী বুঝতে পেরেছে যে ওর আম্মুকে আমিই...! কোথা থেকে দৌড়ে এসে ঝাঁপ দিয়ে কোলের উপর মাথা রাখল তুলতুলে মেয়েটা। কোথায় কান্না? ওতো খিল খিল করে হেসে যাচ্ছে...! দুই বছরের মেয়েটার চোখে কী চোখ রাখব!? শিশুরা নাকি অনেক কিছু আগেভাগে বুঝে নিতে পারে। না না যদি ধরা পড়ে যায়...! যদি প্রশ্ন করে বাবা তুমি মামনিকে...? আর ভাবতে পারছি না। পেটের ভীতর গড়গড় করে ডেকে নাড়ীভুঁড়ি মোচড় দিয়ে উঠে। ভীষণ বমি আসছে...। "আরে দীপ পড়ে যাবি তো!” বন্ধু শাহিন চিৎকার দিয়ে উঠে। কখন যে একেবারে সিঁড়ির কাছে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। হুইল চেয়ারের চাকাটা আর একটু সামনে গেলেই...! নাহঃ পড়ে গেলেই ভাল ছিল...। কী হবে এখন? তিথি আমাকে ছেড়ে যায়নি,এই আমিই ওকে ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছি! ভালো হয়েছে ...আমি শান্তি দিতে পারিনি। এখন ও নিজেই শান্তি খুঁজে নিয়েছে। না হয় সেই শান্তি খুঁজে নিতে আমি কিছুটা সাহায্য করেছি। হ্যাঁ আমি করেছি,ভালবেসেই করেছি। শান্তি দেবার ক্ষমতা যদি আমার না থাকে? তাহলে যন্ত্রণা দেবার অধিকারও আমার নেই।
মনে পড়ে সেদিনের কথা। যেদিন প্রথম আমি তিথিকে দেখতে ওদের বাড়ীতে যাই। সেদিন কেন যেন মনে হয়েছিল মেয়েটা স্যাটেল মেরেজ করতে ঠিক পছন্দ করছে না। ওর কপাল কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করছে! সাধারণত মেয়ে দেখতে গেলে,মেয়েরা বেশ সাজগোজ করে সামনে আসে। হাসিখুশি না থাকলেও বেশ নার্ভাস থাকে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ দেখাতে ওদের মাঝে একটা অহমিকা কাজ করে। এই পর্যন্ত বেশ কয়েকটা মেয়ে দেখেছি। কিন্তু তিথির মত কাউকেই এমনটা মনে হয়নি। ওর ভাবি বারবার ওর গায়ের ওড়নাটা উঠিয়ে দিচ্ছে ডান কাঁধে। যাতে দুই কাঁধেই ওড়নাটা সুন্দরভাবে থাকে। আর তিথি বারবারই নামিয়ে দিয়ে ওড়না বাম কাঁধের উপর একপাশে ফেলে রেখেছে। ওর ভাবি আর মা ইশারায় ওকে কী যেন বলছে। কিন্তু ও সেদিকে তাকিয়ে মুখটা কেমন করে যেন ভেংচে দিচ্ছে!
মেয়েটা যেন ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে আমার সামনে বসে আছে। "তবে কী ওর কারো সাথে প্রেমের সম্পর্ক আছে?" কথাটা মনে আসতেই অচেনা অজানা ছেলেটার প্রতি ভীষণ ঈর্ষা বোধ হয়েছিল।
-"কীরে মেয়ে পছন্দ হয়েছে!" দুলাভাইয়ের কণ্ঠ শুনে কিছুটা আঁতকে উঠলাম। আমি অপলক দৃষ্টিতে তিথিকে দেখছিলাম।
-"শোন এই নিয়ে কিন্তু দুইমাসে ছয়টা মেয়ে দেখা হল। আর দুইমাসের মধ্যে কোন মেয়ে দেখা হবে না বলে দিলাম" শাহিন ফিসফিস করে আমার কানে কানে কথাটা বলল। আমিও ফিসফিস করে বললাম
-"ভালোই তো আছিস। ফ্রি ফ্রি খানাপিনাও ভালো পাচ্ছিস!" একটা সমুচাতে কাপড় বসিয়ে শাহিন বলে
-"তা যা বলেছিস দোস্ত। কিন্তু পেট বেঈমানি করছে। একটু রেস্ট নেয়া দরকার!"
-"আরে এসব কেন বলছ! এই মেয়েটা কিন্তু অনেক সুন্দর। শালা তুমি পছন্দ করে ফেল তো!" দুলাভাই যে আমাদের কথা শুনছে এইটা কেউ খেয়াল করিনি। উনার কথা শুনে শাহিন বেশ লজ্জা পায়। দুলাভাইয়ের সাথে আমার বেশ ইয়ার্কির সম্পর্ক। প্রায়ই দুজন দুজনকে বেশ ইয়ার্কি করে খোঁচা মেরে কথা বলি। আর তাই দুলাভাইকে বললাম-
-"দুলাভাই মেয়ের সাথে কী একা একা কথা বলার সামান্য একটু ব্যবস্থা করা যায়?"
-"ইস শালার বুঝি আর তর সইছে না! হু …কী তাই না,তাই না!" বলে হো হো করে হেঁসে দেয়। দুলাভাই তিথিদের যেন কেমন আত্মীয় হয়। দুলাভাইই এক রকম জোর করে এই মেয়েকে দেখাতে নিয়ে এসেছে। আমি সাধারণতঃ কারো বাসায় গিয়ে এই আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখা পছন্দ করিনা। তবুও জোর জবরদস্তি করে দুইমাস ধরে মেয়ে দেখার মিশনে নেমেছে। আপু রীতিমত ইমোশন্যাল ব্লাকমেইল শুরু করে দিয়েছে। যত বলি বিয়ে করব না এখন। তত উনি নাকি কান্না করে বলে এতে বাবা মায়ের কাছে তাকে কৈফত দিতে হবে। সে নাকি বাবা মায়ের আদরের সন্তানকে ঠিকভাবে মানুষ করতে পারেনি! এভাবে কেউ মেয়ে দেখে? কত আনুষ্ঠানিকতা করে মেয়ে দেখা তারপর মেয়ে অপছন্দ হলে বিয়ে না করা। এতে মেয়েটার উপর কত মানসিক চাপ পড়ে এটা একবারও কেউ ভেবে দেখেছে!? আরে আজকাল কত রকমভাবে মেয়ে দেখা যায়। শপিং মার্কেটে,রেস্টুরেন্টে,সিনেমা হলে এমন কী পার্কেও। মেয়ে অনেক সময়ে টেরও পায় না যে তাকে বিয়ে করার জন্য কেউ পছন্দ করছে। এই পদ্ধতিটা আমার খুব পছন্দের। কিন্তু কিছু কিছু পরিবারের মুরুব্বীরা এ পদ্ধতি ঠিক পছন্দ করেন না। তাঁদের কথা "মেয়ে কী রাস্তার নাকি যে রাস্তায় দেখে পছন্দ করবে!" আমার আপুটাও হয়েছে ঠিক এমন। বাবা মা মারা গেলে এই আপুই তো আমার সব। আমার ভালো মন্দ সবকিছুর ভার এই আপুর উপরেই। তাই আপুকে কষ্ট দিয়ে কিছু বলতে পারিনা।
তিথিকে আমার বেশ পছন্দ হল। নাহ সেদিন একা একা কথা বলার ব্যবস্থা দুলাভাই করতে পারেনি। দুলাভাই আপাকে কথাটা বলতেই রেগে গেলেন। বললেন-
-"কেন আমি কি বিয়ের আগে তোমার সাথে একা একা কথা বলেছিলাম!" দুলাভাইকে কথাটা বলতেই সে আপাকে রসিয়ে রসিয়ে আস্তে করে বলল
-"কেন আমরা তো দুজন বিয়ের আগে রিকসায় করে ঘুরিয়েও বেড়িয়েছি,মনে নেই তোমার!" আপা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। মৃদ্যু রাগে বলে
-"আরে সেইটা তো এনগেজমেন্টের পরের কথা! তুমি না..." দুলাভাই আর কিছুই বলেনি। তিথির সাথে আমার ঐদিনই এনগেজমেন্ট হয়ে যায়। কোন মেয়ে আঙটি পরানোর দিনও যে এত কাঁদতে পারে? এটা আমার জানা ছিল না। আর ওর এই কান্না আমার অনুমানকে অনেকটাই পাকা করে দিয়েছিল। ওর সাথে কথা বলে সবকিছু জানার প্রয়োজন অনুভব করলাম। পরেরদিন আমি নিজেই তিথির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু লজ্জায় বেশিদূর এগোতে পারিনি! ওর ভাবি রীতিমত জেরা শুরু করে দিলেন। উফঃ কী যে কঠিন সময় ছিল ওটা। এর কয়েকদিন পরেই আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের দিন সেই একই তিথিকে আমি আবিষ্কার করলাম অন্য রকমভাবে! কেমন দুঃখী দুঃখী লাগছিল। মনে মনে ভাবলাম "মেয়েটার যদি কারো সাথে প্রেম থাকে? তাহলে কেন সে আমাকে বিয়ে করছে!? কি জানি কী আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছি!" বিয়ের যে আনন্দ মনে থাকার কথা তা কেন যেন পাচ্ছিলাম না। কারো সাথে বিষয়টি নিয়ে যে কথা বলব বা পরামর্শ চাইব? তাও পারছি না। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। বাবার বাড়ী থেকে বিদায় নেবার সময়ে তিথির সেকী কান্না! বাবার বাড়ী ছেড়ে যাবার কান্না? নাকি কোন বিশেষ মানুষকে ছেড়ে যাবার জন্য!? কী যে ভীষণ অসস্থি লাগছে বুঝাতে পারব না।
বাসায় আসার পরে যখন রাত হল। নিজের রুমে ঢুকে দেখি ডিম লাইট জ্বলছে! আর আমার সিঙ্গেল চৌকিটার জায়গায় ডাবল বেড। বেডটা কী সুন্দর করে তাজা ফুলে সাজিয়েছে। কিন্তু বেডের উপর বউ,মানে তিথি নেই! মনটা ছ্যাঁত করে উঠলো "আরে নতুন বউ গেল কোথায়!?"বেডের নীচে,বাথরুম,দরোজার আড়ালে সব জায়গায় খুঁজেও ওকে পেলাম না! আর একটু হলেই দরোজা খুলে আপাকে ডাকতে যেতাম। আধো আলো আধো অন্ধকারে দেখি জানালার কাছে পর্দার আড়ালে একটা ছায়ামূর্তি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে! "তিথির প্রেমিক নয়তো!?" ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম জানালার কাছে। জ্যোৎস্নার খানিকটা আলো এসে পড়েছে তিথির মুখে। "ও এভাবে কেন দাঁড়িয়ে আছে!?" কী করব ভেবে পাচ্ছি না। একেতে সারাদিনের ধকল। তার উপর বিয়ের মত একটা কঠিন কাজকে সম্পন্ন করা। তাও আবার নানা রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মাঝে! রাগ হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছি না। ক্লান্ত লাগছে কিন্তু বিশ্রাম নিতে পারছি না! উফঃ কতক্ষণ অভাবে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা। এক সময় বললাম
-"জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে,আপনার ঠাণ্ডা লাগবে!"আমি আমার কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হলাম। এত মোলায়েম করে আমি কথা বলতে পারি!? তিথি কিছু না বলে বেডে গিয়ে বসে। আমিও একটু পরে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসে পড়ি। মনের মাঝে কত হাজার প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে! নিজের ঘরটাকে পর মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তিথি নয় আমিই নতুন এ বাড়ীতে! যদিও লজ্জা লাগছিল তবুও বেশ কয়েকবার হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙলাম। কীভাবে যে পুরো রাতটা কাটাবো এই ভাবনায় নিজেকে অসহায় লাগল। এই রাতটা নিয়ে কত হরোম্যান্টিক স্বপ্ন দেখেছি! এইটা করব, ঐটা বলব। বিবাহিত আর অবিবাহিত দুই রকম বন্ধুরা দুই রকম বুদ্ধি দিতে লাগল। বিবাহিতরা যে বুদ্ধি দিচ্ছে তা শুনে মনে হচ্ছে বাসর নয় পুরো যুদ্ধক্ষেত্র এটা। হারজিৎ বড় কথা। আর অবিবাহিতরা একেবারে সিনেমায় দেখা বাসর ঘরে যা যা ঘটে তাই বলতে লাগল। একজন তো রীতিমত ছবি দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল বাসর ঘরে কীভাবে বউয়ের ঘোমটা উঠাতে হবে! সবাই বেশ মজাই নিচ্ছিল আমাকে নিয়ে। সেসব কথা মনে করে ভীষণ হাসি। কিন্তু হাসতে গিয়ে হাই চলে এলো। জানিনা কীসের অপেক্ষায় বসে আছি। অনেকক্ষণ পরে তিথির কণ্ঠ ভেসে আসে-"আপনাকে একটা কথা বলতে চাই!" বুকের মাঝে ধুকপুক ধুকপুক শুরু হয়ে গেছে। এই মেয়ে নিশ্চয় এখনই বলবে সে আমার সাথে থাকবে না। সে আমাকে স্বামী হিসাবে মেনে নেবে না! ও কেন আমার সামনে এসে প্রথম দেখায় অমন ব্যাবহার করেছিল? কেন ও বউ সেজে বেডের উপর না বসে অভাবে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়েছিল!? প্রশ্নগুলো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে মনটা। তারপর আমার কিছুই বলতে হল না। মেয়েটা এত সহজ সরল আমি ভাবতেই পারিনি! ও যা বলল তাতে আমি বিস্ময়ে একেবারে পাঁথরের মত শক্ত হয়ে গেছি। বলে-
-আপনি যেদিন প্রথম আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন। সেদিন আমি আপনার সামনে আসতে চাইনি। আমি আসলে ঐদিন বাসা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম বান্ধবীর বাসায়। আমাকে একরকম জোর করে ধরে এনে আপনার সামনে বসিয়ে দিয়েছিল।
-মানে!
-আমি আপনাকে বর হিসাবে পেতে চাইনি!
-মানে!
-আসলে আপনার ছবি দেখে আমার আপনাকে পছন্দ হয়নি। আর আপনি যে চাকুরী করেন ঐটাও আমি পছন্দ করিনি।
-একটু খুলে বলবেন?
-আমার খুব ইচ্ছে ছিল একটা ছেলেকে বিয়ে করব। যে দেখতে মোটামুটি হবে। কিন্তু মনটা হবে খুব সুন্দর। আর একটা ভালো বেতনের চাকুরী করবে। যেন অভাবের সাথে আমার কোনদিন দেখা না হয়। আপনার ছবি দেখে আপনাকে কেমন যেন হ্যাঙলা হ্যাঙলা মনে হয়েছে। আর প্রাইভেট কোম্পানিতে অল্প বেতনে চাকুরী করেন। এসব শুনে আমি…
-আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। তাহলে পরে কেন বিয়ে করলেন!?
-আপনাকে দেখার পর আমার মনে হয়েছে আপনি মানুষটা আসলে অনেক ভালো মনের একজন। আর...
-আর কী?
এবার তিথি কিছু বলতে পারলো না। ওর চোখ আমার চোখে আটকা পড়ে গেল। ওর লাল রঙা ঠোঁট দুটো থিরথির করে কাঁপছে। পুরো রাত আমরা গল্প করে কাটালাম। ওর সাথে গল্প করতে করতে ওকে অনেক ভালবেসে ফেললাম। সকাল হতে হতে গল্পের ছলে দুজনেই অনেক কাছে এলাম। ঘুম ভাঙতেই দুজনে আবিষ্কার করলাম আমার বুকে তিথি মাথা রেখে ঘুমিয়েছে। আর আমাদের দুজনের হাত দুজনে ধরে আছি।
সেই থেকে আমাদের সংসার। কীভাবে যে দুটো বছর কেটে গেছে টেরই পাইনি! টের পেলাম যখন ডাক্তার নতুন অতিথি আসার খবরটা দিল। এই সামান্য বেতনে কীভাবে কী করব? চারিদিকে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। আমার মাঝে মাঝে মনে হল ওর মায়ের গর্ভেই ওকে হত্যা করি। কিন্তু না পারিনি। তৃষা...ওর মায়ের কোল জুড়ে শুধু এলনা আমার ঘর আলো করে এলো। মেয়েটা হবার দুদিন পরেই আমার প্রমোশন হল। তিথি ভীষণ খুশি। আমিও খুশি...।
তবে সে খুশি আমাকে বেশিদিন ভালো রাখতে পারলো না। সন্তানকে মানুষ কত ভালো ভালো স্বপ্ন দেখে-সন্তান বড় হবে,ভালো স্কুলে যাবে। বড় হয়ে ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার হবে এসব। আর আমি সারাক্ষণ শুধু টাকার চিন্তায় মগ্ন থাকি। মেয়েটাকে আদর করতে গেলেও আমি টাকার গন্ধ পাই! ওর হাসি,নরম তুলতুলে হাত, গাল সবকিছু আমাকে আমার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়! ধীরে ধীরে সংসারে চাহিদা বাড়তে থাকে। বিয়ের চার বছর যেতেই তিথি আমাকে প্রেসার দিতে থাকে এই চাকুরী ছেড়ে মোটা বেতনে অন্যকোন চাকুরী নিতে। কিন্তু চাকুরী তো আমার হাতে না! তার উপর বয়সও হয়েছে। দেরি করে বিয়ে করলে কী হবে? চাকুরী তো করছি বেশ কয়েক বছর ধরে। নতুন করে আর কিছু শুরু করার মন মানসিকতা নেই। কিন্তু তিথির কথা "মেয়ে বড় হবে,ওকে ভালো স্কুলে দিতে হবে। কতদিন আর ভাড়া বাসায় থাকব!? একটা ছোট গাড়ী দরকার!" ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি সব হবে। একটু ধৈর্য ধর।
হ্যাঁ তিথি ধৈর্য ধরেছিল। জাগতে শুতে আমার শুধু টাকা পেতে হবে এই ভাবনা! ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একটা ছোট সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনলাম। একটা ছোট ফ্ল্যাটও দেখেছি। গাড়ী নিয়ে যখন বাসায় এলাম। তিথি যেন ছোট বাচ্চাদের মত হয়ে গেল! ও গিয়ে সোজা ড্রাইভিং সিটে বসলো। আমি হায়হায় করে উঠলাম-
-"আরে আরে কী করছ? তুমি তো গাড়ী ড্রাইভ করতে পারো না!"
-কে বলেছে তোমাকে? আমি কত আমার বান্ধবীদের গাড়ী ড্রাইভ করেছি!
-কিন্তু তোমার তো লাইসেন্স নেই
ও কোন কথা না শুনেই গাড়ীতে স্ট্রাট দিল। আমি দৌড়ে গিয়ে ওর পাশের সিটে বসলাম। ওকে আর কিছুই বললাম না। নাহ সে বেশ ভালোই ড্রাইভ করল।
এরপর আমি অনেক দেনায় জড়িয়ে গেলাম। প্রায়ই তিথির সাথে আমার ঝগড়া হতে লাগল। পৃথিবীটাই বিষিয়ে গেল। কিছু ভালো লাগেনা। রাতে ঘুম আসে না। অফিসে কাজ করতে ভালো লাগে না। কিন্তু একটা চিন্তা আমাকে শান্তি দিতে লাগল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম এই কাজটা আমাকে করতে হবে। প্রায়ই সুযোগ পেলেই কাজটা কীভাবে করব তার হোমওয়ার্ক করে নেই। যে কোন কাজ করার আগে প্রাকটিসটা খুব জরুরি! এ ছাড়া কিছুই করার নেই আমার। এখনও গাড়ীর লোনের টাকা দিতে পারিনি। অথচ তিথি ফ্ল্যাট কেনার জন্য আমাকে চাপ দিতে লাগল। আমিও ওকে বুঝাতে লাগলাম। কিন্তু ও যেন বুঝতেই চায়না কোনকিছু। বিকালে অফিস থেকে মেজাজ বিগড়েই বাসায় এলাম। আজ এতগুলো বছর অফিসে আমি কাজ করছি,কোনদিন কেউ আমাকে কোন কথা বলতে পারেনি! আজ বসের ছেলে বলে আমি নাকি অফিসের একাউন্ট থেকে টাকা মেরেছি! বাসায় এসে দরোজা দিয়ে ঘরে পা দিতেই দেখি তিথি অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে…
- এসব কী শুনছি?
-প্লিজ এখন কথা বলনা। কিছু শুনতে বা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
-তা ইচ্ছে হবে কেন? তুমি এত বড় একটা কাজ করতে পারলে? আমাদের কথা একবারও ভাবলে না? মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবলে না?
খুব করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল-
-লে হালুয়া তুমিই তো সারাক্ষণ আমার মাথায় ভুস ভুস করে বাজে চিন্তা ঢুকিয়ে দিচ্ছ! এইটা লাগবে, ঐটা কর,হেনতেন বলে মাথা খাচ্ছ!
কিন্তু কিছুই বললাম না। সত্যিই কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তিথি আমার হাত ধরে বাইরে টেনে এনে গাড়ীতে বসাল। নিজে ড্রাইভিং সীটে বসে গাড়ীতে স্ট্রাট দিল। আজ আমি কিছুই বললাম না ওকে। ওর মাথার ঠিক নেই। ও জোরে জোরে বলছে
-"আজকে তুমি তোমার চাকুরী ছেড়ে দেবে। এই গাড়ী ফেরত দিয়ে দেবে। এত বড় অপবাদ আমি সইব না। গরীব হতে পারি কিন্তু আমার স্বামী অফিসের টাকা...। না আমি মানি না...। তুমি বসের মুখের উপর টাকা ছুঁড়ে মারবে...রেজিগ্নেশান লেটার ছুঁড়ে মারবে!"
এমন সময় সামনের রাস্তায় তাকিয়ে আমি হিম হয়ে যাই! দেখি একটা বড় ট্রাক দৈত্যের মত আমাদের গাড়ীটাকে গিলে খেতে এগিয়ে আসছে! আমি ইচ্ছে করলে স্টিয়ারিং হুইলটা বাম দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারতাম। তাতে হয়ত আমাদের গাড়ীটা ট্র্যাকটাকে পাশ কাটিয়ে বের হয়ে যেতে পারত! কিন্তু ইচ্ছে হল না...! তিথির বকবক কানে ভীষণ বাজছিল! ধ্যাত এভাবে কী জীবন চলে...? আমার অজান্তেই আমি চিৎকার দিয়ে উঠি...তিথি...! ধা...ড়া...ম করে একটা বিকট শব্দ! আহঃ আ...মা...র পা...।
ধড়ফড় করে বেডের উপর উঠে বসলাম। দেখি ঘেমে একেবারে গোসল করে ফেলেছি। আমি সাইড টেবিলে গ্লাসে রাখা পানিটা এক চুমুকে ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম! প্রথমেই আমার পায়ের কথা মনে এলো। পা দুটো অনেক ভারী লাগছে কেন? হয়ত অনেকক্ষণ একভাবে থাকার কারণে। খসখস শব্দ হতেই পিঠের নীচ থেকে টেনে বের করলাম রাতে শোবার সময় একটা কাগজে কীভাবে কী করব তাই লিখেছি! কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম মেঝেতে। তিথি কী তবে সত্যিই মারা গেছে...! ডুকরে কান্না এলো...। চেয়ে দেখি আমার পাশে তিথি নেই...! ছুটে বের হলাম। পাশের রুমের দরোজা খুলে দেখি ছয় মাসের ছোট্ট তৃষাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে তিথি। ওদের মা মেয়েকে কত নিষ্পাপ লাগছে। কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইলাম আমার পৃথিবীর দিকে। তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে আদর করে দিলাম। ছোট্ট বাচ্চাদের মত করে "হুম্মম্ম" করে শব্দ করে আবার ঘুমিয়ে গেল।
আমার ভীষণ সিগারেটের তৃষ্ণা লাগল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের ঝুল বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরালাম। তখনো পূব আকাশ বেগুনী রঙ ধরেনি। ঠাণ্ডা বাতাস এসে শীতের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। ঘোরটা তখনো কাটেনি। সবকিছু চোখের সামনে ছবির মত করে ভাসছে! বুকে চাপচাপ ব্যথা অনুভব করছি। "নাহ গাড়ী বাড়ী এসব না হলে কী হয়? এই যে যাদের জন্য চুরি করা? সেই প্রিয়জনরাই তো যে কোন অপবাদ সইতে পারবে না! কী লাভ এক জীবনে অসৎ পথে গিয়ে ক্ষণস্থায়ী সুখ পাওয়ার? এই তো বেশ আছি...শান্তিতেই তো আছি!" পিছনে ভালবাসার স্পর্শ! গলা জড়িয়ে ধরে তিথি। আহ্লাদী সূরে বলে - "কী হল ঘুম আসছে না তোমার? চল আমি তোমার মাথা টিপে দেই,তাহলে ঘুম আসবে! কী যে এত টেনশন কর বুঝিনা"এক রকম জোর করেই তিথি আমাকে বেডে নিয়ে আসে। তখনও অজানা ভয়ে কেঁপে যাচ্ছি! হৃদয়ের দুকপুকানি এতটাই জোরে হচ্ছে যে,যে কেউ শুনতে পাবে! তিথিকে হারানোর আতঙ্কে আমি ওর কোলে মাথা রাখি...! ঘড়ির কাঁটায় তখন পাঁচটা পঁচিশ। একটু একটু করে পাখিদের ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে।
২৭ মে - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১২০ টি
সমন্বিত স্কোর
৪.৮৭
বিচারক স্কোরঃ ২.৮৭ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪