আজকের আকাশটা ধূসর মেঘে ঢাকা! বৃষ্টির মত টুপটুপ করে শিশির পড়ছে...! ফজরের নামাজ পড়ে মিনহাজ উদ্দিন বারবার জানালার কাছে গিয়ে রাস্তার দিকে দেখছে। সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে নিজের উপর তার ভীষণ রাগ লাগছে...! অনেকক্ষণ ধরে সে বুঝতে চেষ্টা করছে এখন কয়টা বাজে? উনি যে ঘরে থাকেন সে ঘরে কোন ঘড়ি নেই। "রিটায়ার্ড মানুষের সময় জেনে কী হবে...! তাদের ঘড়ির কোন প্রয়োজন আছে নাকি!?” আপন মনে কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কাঠের লাঠিতে ভর দিয়ে আবার জানালা দিয়ে দেখে- "নাহ কুয়াশায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না! রাস্তায় কেউ যেমন বের হয়নি তেমনি আকাশেও সূর্যের দেখা নেই!” এদিকে বাসার সবাই এখনো ঘুম! খাবার ঘরে অনেক অন্ধকার। ঘরটা ডিঙিয়ে বাথরুমে যেতে হয়! কিন্তু লাঠির ঠক ঠক শব্দে যদি সবার ঘুম ভেঙ্গে যায়? এই ভাবনাও তাড়া করে ফেরে বারবার...! দরোজাটা সামান্য ফাঁক করে উঁকি দেয় রান্না ঘরের দিকে। বাম কানটা খাঁড়া করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করে! “নবাবজাদি এহনও নাহে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে! ছেমড়ি তুই জানিস সকালে উঠে এককাপ র'চা আর দুইখান টোষ্ট বিস্কুট না খালি আমার গ্যাস্টিকের ব্যথা ওঠে! তোর ঘুম ক্যান ভাঙে না!” রাগে গজগজ করতে করতে আবার এসে বিছানায় বসে। ব্যথাটার কথা ভেবে দুই গ্লাস পানি খেয়েছে। এখন তো আবার বাথরুমে যেতে হবে। অস্থিরতায় হাঁটাহাঁটি শুরু করে দেয়। তবে ফ্লোরে লাঠি লেগে যেন কোন শব্দ না হয় সেই দিকে খুব সতর্ক সে। আস্তে আস্তে অনেক কষ্টে বাথরুম সেরে কেবল বের হয়েছে...! শোনে খুব নিচু স্বরে কুলসুম বলছে-"দাদা আপনের ঠকাঠকে মোর তো ঘুম ছুইটা গ্যাছে! আইজ গো ছুটির দিনে কারো ঘুম ভাঙে না। আর আফনে সেই বিহানবেলা থাইকা খট্টর খট্ট্রর শুরু করছেন!” -আরে ছেমড়ি আমার ঘরে চা আর টোষ্ট দিয়া যা। কথা কম ক না লি ফরে থাপড়াই দিবানি। মেয়েটা বেহায়ার মত মুখে শাড়ীর আঁচল দিয়ে হাসে। হাসতে হাসতে বলে - -দাদা আপনের কী মুইতের রোগে ধরছে? চোখ বড় বড় করে রাগ দেখায় মিনহাজ উদ্দিন। মনে মনে বলে "এই মেয়ে তো অনেক পাকনা। ডায়াবেটিকসকে বলে মুইতের রোগ! বেয়াদব কোথাকার।" জানালা দিয়ে খাবার রুমে আসা সামান্য আলোতে দেয়ালে রাখা ঘড়ির দিকে তাকায়। মনে পড়ে এই ঘড়িটা যেবার কোলকাতা গিয়েছিল মলিকে নিয়ে,সেবার কিনে এনেছিল। ঘড়ির সেকেন্ড ও ঘণ্টার কাঁটা অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে! এখন বাজে সাড়ে সাতটা! নিজের ঘরে ঢুকে পায়জামাটা পরে নেয়। অনেক ঠাণ্ডা পড়েছে আজ। সাধারণত যেদিন কুয়াশা পড়ে সেদিন ঠাণ্ডাটা একটু কম থাকে। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে উল্টো। সে এতদিন যেখানে যা দেখে এসেছে, তার সব কিছুই আজকাল উল্টো হচ্ছে...। সে যা কিছু দেখেছে এখন সেসব সবাই ব্যাকডেটেট বলে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে! তারপর যার যার মত করে নিজেরাই নিজেদের কাজে অত্যাধুনিকতার লেবাস পরিয়ে নিচ্ছে! "আধুনিকতা যদি হয় অসম্মান অশ্লীল অসভ্যতা অকল্যাণ তাহলে সে আধুনিকতার প্রয়োজন কী!”
মিনহাজ উদ্দিন সেই ছোটবেলায় দেখেছে তার মা প্রতিদিনই;বাসার সবাই ঘুম থেকে উঠার আগেই দাদা দাদীকে সকালের নাস্তা দিত! তারপর নিজের হাতেই ওষুধ খাইয়ে দিত। কতদিন সে নিজেই দাদা দাদীর ওষুধ পড়ে পড়ে মায়ের হাতে দিয়েছে! সেই সময়ে বাড়ীর বউয়েরা ঘরে থাকা শিশু ও মুরুব্বীদের প্রতি অন্যদের থেকে যেন একটু বাড়তি খেয়ালই নিত! এই বাড়তি খেয়ালে বাড়ীর বউ ঝিয়েরা অন্যরকম এক স্বর্গীয় আনন্দ খুঁজে পেত। মুরুব্বীদের সেবা শুশ্রূষা করতে পেরে তৃপ্তি নিয়ে সারাদিন আনন্দে কাঁটিয়ে দিত। মলিকেও দেখেছে মা বাবার সেবা করতে। মনে পড়ে একদিনের ঘটনা- সেদিন মলির প্রসব বেদনা উঠেছে। যা দেখে মিনহাজ অফিসে যেতে চেয়েও আবার যায়নি। ফোন করে অফিসে বলে দিয়েছে সে আজ আসতে পারবে না। মলির সারা মুখ ব্যথায় নীল হয়ে গেছে অথচ ঘরের কাউকেই বুঝতে দিচ্ছে না। ওর মনে হচ্ছিল ওকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দেয় অথবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু ওর জেদ বাবাকে আগে খাবার খাইয়ে ওষুধ খাওয়াবে তারপর সে ডাক্তারের কাছে যাবে। বাবা কিন্তু মলির কষ্ট বুঝতে পেরেছিল! সেদিন আমার অসুস্থ্য প্যারালাইজড বাবাও ছেলে বৌয়ের পাগলামি দেখে রেগে গিয়েছিলেন। সেদিন অবশ্য মলিকে হাসপাতালে নিতে হয়নি। বাসায় নার্স নিয়ে আসলে জন্ম নিয়েছিল আফজাল।
কিন্তু এখনকার ছেলে বউ মেয়েরা বড়দের নিয়ে কোন ভাবনা নেই। কাজের মেয়েই তাঁদেরকে দেখাশোনা করে! মাঝে মাঝে সে চোখেও ভাল দেখে না। ওষুধের নাম পড়তে কষ্ট হয়। ডায়াবেটিকস হলে এই এক সমস্যা,চোখের জ্যোতি কমে যায়! "নাহ ছেমড়ি এখনও চা দিয়ে গেল না।" মিনহাজ আবার দরোজায় কান লাগিয়ে শব্দ শোনার চেষ্টা করে। "কেউ আসছে এদিকে!" খট খট আওয়াজ তুলে দ্রুত খাটে গিয়ে বসে। দীনা কী সব যেন বলছে কাজের মেয়েটাকে। মনে হচ্ছে আজকে তার মেজাজ অনেক খারাপ! "নবাবজাদী ঘুম তাহলে ভেঙেছে! সারা রাত জেগে থাকবে আর দুপুর পর্যন্ত ঘুমাবে! ছেলেও একখান হয়ছে বউকে কিছুই বলতে পারে না! আরে এটাকে কী সুখে থাকা বলে? লাট সাহেবের ব্যটা রাত করে ঘরে ফিরবে...! বাবা হয়ে কিছু বলতে গেলেই বলবে- -"আপনি এখনকার কাজ বাজ বুঝবেন না আব্বা,অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়!” -"নাহ তা কী আর আমি বুঝিনে! আমি তো আর চাকরি বাকরি করিনি! হাওয়া খাওয়াই তোগের বড় করিছি! সবাই ভাবে বুড়ো হইছো,রিটায়ার্ড হইছো এখন বাপু ওপারের ট্রেনে উইঠে পড়! আমার কী আমি আর কয়দিন...” হাতের লাঠির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মিনহাজ উদ্দিন বিড়বিড় করতেই থাকে! দরজা ঠেলে ঘরে আসে কুলসুম। ওর হাতের ব্যগটাই আগে নজরে আসে! মেজাজ বিগড়ে যায়। এমনিতে কাল রাত থেকে জ্বর জ্বর লাগছে তার উপর হাড় কাঁপানো শীত...! এখন সে বাইরে যাবে না! কুলসুম যে ট্রেতে চা আর বিস্কিট নিয়ে এসেছে সেদিকে না তাকিয়েই,মুখটা ঘুরিয়ে নেয় ছোট্ট বাচ্চাদের মত করে! রাগ দেখিয়ে বলে- -এই ছেমড়ি এখন তোর ঐ শরবত আমি খাব না! কয়টা বাজে দেখিসনি? নাস্তা দে...! -দাদা আটা নাই...আগে আনতে হবে হেরপর রুটি বানামু...! -তোর রুটি তুই খা...! মুখ ঝামটা দেয় মিনহাজ উদ্দিন।সে এমনটা আগে কখনো করেনি। কিন্তু ইদানীং তার প্রতি সবাই অবহেলা করছে। যা দেখে সে অবাক হয়! নিজেকে বোঝা ভেবে নিজেকেই ধিক্কার দেয়। ওর জন্য কারো সমস্যা বা অশান্তি হোক সে কোনদিন চায়নি! একমাত্র আদরের সন্তান আফজাল। ছেলেটা কখন ঘরে আসে আর কখন বের হয় তার কিছুই সে জানে না।"বুড়ো বাবাকে একটু দেখে যেতে পারে না! এইটা কোন কথা হল?” কুলসুমই ওর দেখাশুনা করে! যত রাগ সে মেয়েটার উপর ঝাড়ে। দীনা মাঝে মাঝে এসে বলবে- বাবা কী ঘুমাচ্ছেন?মিনহাজ উদ্দিন হেসে বলে - না মা এসো ভীতরে...কেন কিছু বলবা? - না ঠিক আছে কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছি না তো তাই! হু হু করে বুকের ভেতর থেকে গরম বাতাস বের হয়! মেয়েটা ছেলে মেয়ের দেখাশোনা ওদের লেখাপড়া সবকিছুই করে! অনেক কাজ এটা তাও সে বোঝে! কিন্তু তাই বলে কী দিনে একবার একটু এসে দেখবে না সে বেঁচে আছে না মরে গেছে? ছেলে ছেলে বউ সবাই যেন কেমন একটা ছাড়া ছাড়া সম্পর্ক রেখেছে ওর সাথে। সে সম্পর্কে নেই কোন দায়িত্ব বোধ! নেই কোন আন্তরিকতার লেশমাত্র...। এই সম্পর্ক ঠাণ্ডা শীতল অনুভূতি এনে ওকে ভীষণভাবে কষ্ট দেয়!
মাঝে মাঝে ভাবে সে গ্রামে চলে যাবে। কিন্তু গ্রামে বাবার রেখে যাওয়া ভিটে মাটি মৃতপুরির অসুস্থ্য নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে। আফজাল খদ্দের দেখছে পেলেই গ্রামের ঠিকানাটাও পর হয়ে যাবে। গ্রামের কথা মনে এলেই ছবির মত ভেসে উঠে হাজারো দৃশ্য! যে ছবি জ্বলজ্বল করে আগুণের মত...! যে ছবির তাপ এখনো মনে উত্তাপ এনে দেয়...! মনে পড়ে- মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সে যুদ্ধে গিয়েছিল বলে পাকসেনারা রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে ওদের ঘরবাড়ি সব জ্বালিয়ে দিয়েছিল। মনে পড়ে দেশ স্বাধীন হবার পরে যখন সে গ্রামে ফিরে আসে!এসে দেখে তাদের বাড়িঘর এবং আশেপাশের বেশ কয়েকটি বাড়িঘর নিয়ে জায়গাটা একেবারে জ্বলন্ত শ্মশান হয়ে আছে। তখনও ভিটে মাটি আগুনে পোড়া গন্ধ ছড়াচ্ছে।
মিনহাজের মনে পড়ে যখন বাড়িতে এসে মা বাবা মলি কাউকেই পেল না! সে ধরেই নিয়েছিল ওরা কেউ হয়ত বেঁচে নেই! ও ভেবেই নিয়েছিল সবাই আগুনে জীবন্ত পুড়ে মারা গেছে ! আর হয়ত মলিকে তুলে নিয়ে গেছে। রাগে দুঃখে সেদিন প্রায় উম্মাদ হয়ে গিয়েছিল সে। কেউ বলতে পারে না ওরা সবাই কোথায়...! এই গ্রামে পাকসেনাদের সবচেয়ে পরম বন্ধু ছিল গ্রামের মাতব্বর। মিনহাজ মনে মনে ভাবে আজ সে অস্ত্রটা মেজরের কাছে দিয়ে এসে ভুল করেছে! খালি হাতেই ছুটে যায় গ্রামের মাতবরের বাড়িতে...! কিন্তু সেখানে গিয়ে মাতবরকে পায় না। সে মাতবরের অপেক্ষায় বাড়ীর সামনের নাড়ার পালার আড়ালে বসে অপেক্ষা করে। সে সিদ্ধান্ত নেয় আজ এই মাতবরের সামনেই তার বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নেবে। অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাবা মা আর প্রিয়তমাকে নিয়ে কত স্মৃতি মনের পাতায় ভেসে উঠে! যে মানুষ আজ ছয়টা মাস শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে! সেই মানুষ আজ বাচ্চাদের মত করে প্রিয়জনের কথা ভেবে ফুঁপিয়ে কাঁদে! নিজেকেই নিজে ধিক্কার দেয়! ভাবে দেশ ও দেশের মানুষকে শত্রুর কাছ থেকে রক্ষা করতে পারলেও,আপন প্রিয়জনদের সে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে! এই দুঃখ ও অপরাধ বোধ তাকে দুর্বল করে দেয়। মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পায়! কুয়াশা ঘেরা অন্ধকারে চোখ তুলে দেখে কেউ একজন তার সামনে দাঁড়িয়ে! পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো কাপড়ে ঢাকা। এক নারী কণ্ঠ খুব নিচু স্বরে বলে-"কোন কথা কইও না বাজান...আমার লগে আও" মিনহাজ কিছু না বলে অনুসরণ করে তাকে। গ্রামের জঙ্গলের অলিগলি পার হয়ে ওকে নিয়ে হাঁটতে থাকে রহস্যে আবৃত নারী। মিনহাজ এক সময় দেখে জঙ্গলের একেবারে গভীরে এসে থেমে গেছে নারী ছায়াটি। কোন ভণিতা না করে কথা বলে সে- -"তোমার বাবা মা যখন বুঝতে পারলো মিলিটারিরা বাড়ীর উঠানে আইসা পড়ছে। তখন তারা তোমার বউ রে নিয়া বাড়ীর পিছন দিকের দরজা দিয়া বাইর হইয়া আইছিল। কোন দিশা না পাইয়া ওরা সবাই আমাগো বাড়ীর ডোবার মধ্যে পলাইয়া আছিল।" মিনহাজ আর শুনতে চায়না। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে -তাইলে ওরা কই? সবাই বাইচা আছে? নারী কণ্ঠ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলে-সেই রাইতে এতো শীত পরছিল যে ডোবার পানি বরফের নাহান ঠাণ্ডা আছিল!
মিনহাজ অন্ধকারেই নীচে বসে পড়ে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। সে জানে ওর বাবার শ্বাস কষ্ট ছিল। নিশ্চয় সে ওই ঠাণ্ডা পানিতে...! আর ভাবতে পারে না...! "সব আমার দোষ! আমারে আব্বা মা নিষেধ করিল যুদ্ধে না যাতি! সব আমার দোষ!” এমন সময় কেউ একজন ওর হাত দুটো ধরে! চেনা স্পর্শ অনুভব করে মিনহাজ। ওর কান্না থেমে যায়...! সে অবাক হয় একজনের কণ্ঠ শুনে- -"আমি বাইচে থাকতি আফনার আব্বা মায়ের কিছু হতি পারে আপনি ভাবলেন কেমনি?” মিনহাজ থরথর করে কেঁপে যায়! সমস্ত কথা যেন ফুরিয়ে যায় তার। হঠাৎ করে দাঁতে দাঁত লেগে ঠকাঠক শব্দ হতে থাকে। খুশির কাঁপন তোলে সারা শরীর...। দপ করে জ্বলে উঠে হ্যারিকেন! সে দেখতে পায় সে এতক্ষণ যেখানে দাঁড়িয়েছিল তা মাটির নিচের একটা ঘর! তখনও চেনা স্পর্শ হাতদুটো ধরে রেখেছে। "মলি...! " বুকের সাথে লেপটে ধরে মিনহাজ প্রিয়তমাকে। সামনে বাঁশের চৌকিতে চোখ যায়! বুড়ো অসুস্থ্য বাবা মা কে দেখে। ছুটে যায় তাদের কাছে। -কিন্তু এইহেনে তালি ক্যামন করে আসলো ? আর আমারে ওবা কিডা নিয়ে আসলো?"কথা শেষ হতেই রহস্যের সেই নারী এবার সামনে আসে। চমকে উঠে মিনহাজ উদ্দিন -"চাচী আফনে এইহানে!?” -"হ্যাঁ বাবা আমি...! সেদিন তোমার বউ কোন কিছু না ভাইবাই তোমার বাবা মারে আমার কাছে নিয়া আসে! আমি কী করব বুইজা পাই না। তোমার চাচা যা করছে আমি লজ্জাই মইরা যাই। তোমার চাচা জাগো শত্রু ভাইবা পুইড়া মারতে চাইছে? আমি তাগর জান বাচাইছি জানলে আমার উপরও নাইমা আইব মরণ!” মাতবর চাচার বউ কথা বলে যায় দৃড়তার সাথে। মিনহাজ আজ অন্যরকম একজন নারীকে দেখে। এই যুদ্ধ একজন সহজ সরল গ্রাম্য নারীকেও কত কঠোর হতে শিখিয়েছে! চাচী আবার বলে- -"আমার তখন মনে হইল স্বামীর এই অত্যাচার থামাইতে হয়ত আমি পারব না... কিন্তু যাদের উপর অত্যাচার করছে? আমি গোপনে হইলেও তাদের পাশে থাকবো! আর তাই আমার বিশ্বস্ত চাকর মতিরে দিয়া জঙ্গলের মধ্যে মাটির নিচে ঘর বানাইছি। যখন মাতবর দেশের শত্রুদের সাথে মিলে প্লান বানায় মানুষের ক্ষতি করার জন্য! আমি তখন মতিরে নিয়া বানাই তাদেরকে লুকাই রাখার জন্য এই ঘর। আর এই ঘরই একদিন কাজে লাগে বীর সন্তান মিনহাজ মিয়াঁর বাবা মা রে বাঁচাইতে! তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা দিতে।”
মিনহাজ অবাক হয়ে দেখে টিমটিমে হ্যারিকেনের আলোতেও চকচক করছে চাচীর দুচোখ! আজ প্রায় তিনমাস ধরে বাবা মা আর মলিকে এখানে লুকিয়ে রেখেছে সে! জানে বেঁচে গেলেও শীতের রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় অনেক সময় ধরে ডোবার মাঝে থাকাতে! এবং অনেক ভয় পাবার কারণে বাবা সেদিন ছোট্ট একটা মাইল স্ট্রোক করে। যা সেই সময়ে কেউ বুঝতে পারেনি। সেই থেকে বাবার শরীরের নীচের অংশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে! মিনহাজ সেদিন মাতবরের বউয়ের কাছে বাবা মা এবং মলিকে বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞ হলেও, মাতবরকে সে ছেড়ে দেবেনা বলে প্রতিজ্ঞা করে। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে পারেনি এই মাতবরেরই বউয়ের অনুরোধে। স্বামীকে ক্ষমা করে দেবার জন্য সেদিন চাচী মিনহাজের কাছে হাত জোড় করেছিল। যে মানুষ বাবা মা প্রিয়তমা স্ত্রীকে হায়েনার লোভী দৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রেখে নতুন জীবন দিয়েছিল! সেই হায়েনাকে মেরে ফেলে মানুষটাকে বিধবা করে শাস্তি দিতে চায়নি সে! তবে একেবারে সাঁজা না দিলে যে অনেক স্বার্থপর হয়ে যাবে! আর তাই সে একদিন মাতবরকে প্রচণ্ড মারধর করে পা ভেঙে পঙ্গু করে দেয়। যা সে কাউকেই বুঝতে দেয় না। একজন দেশদ্রোহী রাজাকারের জন্য বেঁচে থেকে প্রতিক্ষণ মৃত যন্ত্রণার অনুভব পাওয়া! এর চেয়ে বড় সাঁজা আর কী হতে পারে!? তারপর মিনহাজ গ্রাম ছেড়ে সবাইকে নিয়ে চলে যায় শহরে...।
মলি অনেক শখ করে এই বাড়িটা করেছে! এই শহরেই ও সবচেয়ে বেশিদিন চাকুরী করেছে এবং এখানেই রিটায়ারমেন্ট নিয়েছে। চেনা বাগান,চেনা গাছপালা! চেনাজানা সব মানুষগুলোর কারণে এই শহরের উপর কেমন যেন একটা মায়া জড়িয়ে গেছে! কিন্তু গ্রাম...! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে...। ঠাণ্ডা চায়ে টোষ্ট ডুবিয়ে কামড় বসায় মিনহাজ উদ্দিন। খক খক করে কেশে যায়! "আরে ছেমড়ি পানি দিয়ে যায়নি!” কাশতে কাশতে দম বন্ধ হবার জোগাড়। কুলসুম গ্লাসে করে পানি নিয়ে দৌড়ে এসে এগিয়ে দেয়। মিনহাজ উদ্দিন পানি মুখে দিয়েই চিৎকার করে উঠে - উউরে ঠাণ্ডা রে...এই ছেমড়ি তোরে না কইছি গরম পানি মিশায়ে দিবি! ঠাণ্ডা পানিতে আমার দাঁত মাড়ি সিরসির করতিছে! ওহ রে...। বেহায়া মেয়েটা আবার হাসে - "হি হি দাদা আপনার দাঁত তো মোডে চাইরহান আর তো সব ফাঁকা...হি হি হি" মেয়েটা মাঝে মাঝে এভাবেই দাদার সাথে মজা করে। মিনহাজের সব রাগকে ও হাল্কা করে নেয়। মেয়েটা মাঝে মাঝে অনেক আপনের মত করে ওর যত্ন করে। ট্রে নিতে নিতে একটা লিস্ট আর টাকা এগিয়ে দেয়- -দাদা খালাম্মা বলছে লিস্ট ধরে ধরে বাজার আনতে -তোর খালু কই গেছে? ওরে বল বাজারে যেতে... -খালুই তো টাকা দিয়ে কইল আপনারে দিতে! সে অফিসে চলে গেছে। কথাটা বলে টাকা লিস্ট আর ব্যাগ রেখে গটগট করে চলে যায়। মিনহাজ সোয়েটারের উপরে শাল আর মাথায় মাঙ্কি টুপিটা জড়িয়ে অনিচ্ছায় বাসা থেকে বের হয়।
বাইরে তখনও টপটপ করে বৃষ্টির মত বড় বড় ফোঁটায় শিশির পড়ছে। লিস্টটা মেলে ধরে চোখের সামনে। তারপর মোড়ানো টাকাটা খুলে আঁতকে উঠে- "আরে এই টাকায় এতো কিছু হবে নাকি!? বাজারের যে চড়া দাম এতে তো অর্ধেক সদাইও হবে না।" নিজের পকেটে হাত দেয়। এইমাসে পেনশনের টাকা যা পেয়েছে তার থেকে এক হাজার টাকা হাত খরচ রেখে সব পাঠিয়ে দিয়েছে গ্রামে। গরীবদের মাঝে শীতের কাপড় কিনতে। গরীব বলতে দূরের কেউ না...খালাতো মামাতো আত্মীয় স্বজন। এই অভ্যাসটা মলির...আর সেইখান থেকে সঙ্গ দোষে ওর মাঝে ঢুকে গেছে। পকেটে হাত দিয়ে দেখে পুরো টাকাটাই পকেটে আছে! বের করবে করবে করে আর বের করে রাখা হয়নি! "এই টাকা বাজারে খরচ করলে সারা মাস সে যে একটু বিড়ি আর মাঝে মাঝে ঘোষের দোকানে দৈ মিষ্টি খায় এইটা কীভাবে চালাবে? আর ওষুধ...? আচ্ছা আফজাল না হয় ওষুধের টাকাটা দিলো কিন্তু ওর অন্য খরচের কী হবে? নাতিগুলাও মাঝে মাঝে দাদুর কাছে হাত পাতে! কী করবে সে...?” ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে কি করবে।
আচ্ছা আজকাল প্রায় মাসেই সে দেখছে পেনশনের টাকা পাবার পরপরই কোন না কোনভাবে ওর টাকা সংসারের কাজে খরচ হয়ে যায়! ছেলের কী কম আছ? মাঝে মাঝে ভাবে সত্যি কী আফজাল ওকে বাজার করতে বলে? ছেলেটা তো ওকে সরাসরিও বলতে পারে! এই উছিলায় না হয় একটু কথা বলা হবে! আহা ছেলেটার সাথে কতদিন একসাথে বসে খাওয়া হয় না! আবার কী বাড়ীর ভীতরে ঢুকে দীনার কাছ থেকে টাকা আনবে? "না না এইটা ঠিক হবে না!” দ্বিধাদ্বন্দ্বে বাড়ির সামনেই অনেকটা সময় পার করে দেয়। বাজার বেশ দূরে। ঠাণ্ডা না হলে সে হেঁটেই যেত। তখনও ঘন কুয়াশায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না! অসস্তি লাগছে। এমন সময় কুলসুম গেইট থেকে বের হয়ে তাকে দেখে প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠে- - দাদা আফনে এহনতরি সদাই আনেন নাই! নাস্তা বানামু কহন! মিনহাজ উদ্দিন যেন লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চিন্তা করছিল আর ঝিমুচ্ছিল। চমকে উঠে বলে - এই ছেমড়ি আস্তে কতা ক! তোর খালু যে টাকা দিছে তাতে তো অর্ধেক মালও হবে না! - না হইলে আফনে টাকা পুরাই আনবেন। আপনে না দুইদিন আগে পেনশনের টাকা পায়ছেন? অবাক হয় মিনহাজ উদ্দিন কুলসুমের মুখে এমন কথা শুনে। ওর খুব রাগ হয়। রাগ হয় ছেলের উপর। রাগ হয় নিজের উপর! ঠাণ্ডাটা যেন ওর হাড়ের মজ্জাকে জমিয়ে দিচ্ছে। ঠকঠক করে কাঁপছে সে। মনে হচ্ছে পড়ে যাবে...! সামনে একটা রিক্সা এসে টুং টুং করে বেল বাজায়-খালু যাইবেননি?
কিছু না বলে রিকসায় উঠে বসে...! বাতাসে সাঁতার কেটে রিকসা ছুটে চলে...! শীতটা যেন এখন আরও বেশী লাগে! মনে পড়ে যুদ্ধের সময়ে শত্রুদের ধ্বংস করতে প্রচণ্ড হিম ঠাণ্ডা পানিতে ডুব দিয়ে থেকেছে! আবার ছুটে গিয়ে বাজ পাখি হয়ে উড়াল দেবার মত করে সাঁতার কেটেছে। একসময় শত্রুর জাহাজ থেকে কিছুটা দূরে ঠাণ্ডা পানিতে দম বন্ধ করে ডুব দিয়ে দিয়ে জাহাজে এসে মাইন সেট করে রেখেছে। তখন কঠিন ঠাণ্ডাকেও ঠাণ্ডা মনে হত না। শত্রুকে শেষ করার লক্ষ্যে সমস্ত শরীরে ঠাণ্ডা যেন ভিড়তেই পারতো না। মনে পড়ে যেদিন সে মুক্তিসেনাদের নিয়ে প্রথম গ্রামে পা রেখেছিল? সেদিনও ছিল কনকনে ঠাণ্ডার দিন! সেদিন ওদেরকে দেখে গ্রামের সবাই উল্লাস আর চিৎকার করে বলেছিল"জয় বাংলা...বাংলাদেশ জিন্দাবাদ!যুদ্ধ শেষ...আর যুদ্ধ হইব না!” চারিদিকে কেবলই আনন্দের জোয়ার বয়েছিল! একও একজন মুক্তিসেনাকে এক মুহূর্ত জড়িয়ে ধরার জন্য মানুষের সেকি উল্লাস...! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে গভীরভাবে নিঃশ্বাস নেয়।
-"চাচা কই যাইবেন!" রিকসা চালকের কথায় বাস্তবে ফিরে আসে মিনহাজ। সাঁ সাঁ করে রিকসা ছুটে চলে " মিয়া একটু আস্তে চালাও...উফ একেবারে মাঘের শীত!”হঠাৎ খেয়াল করে পায়ে মুজা পরে আসেনি! এই এক সমস্যা...আজকাল অনেক কিছুই সে ভুলে যায়! "এইটাও কী ডায়াবেটিকসের কারণে!?”ভাবনায় পড়ে যায় সে...! কিছুদূর যেতেই দেখে রশিদ সাহেব রিকসার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। "এই থামা থামা থামা!” -কি হে বন্ধু রিকসা লাগবে? বহুদিন পর বন্ধুকে দেখে সহাস্যে বলে মিনহাজ উদ্দিন।এই কিছুক্ষণ আগে যত অস্থিরতা আর শীতের কাঁপন ছিল সব যেন কোথায় উড়ে যায়। রিকসায় উঠতে উঠতে নকল দাঁত বের করে হেসে দেয় রশিদ সাহেব। -হে হে হে তুমি কী বন্ধু এই ঠাণ্ডার মধ্যে রিকসায় লিফট দিতে বের হয়ছো? না কী অন্য কিছু? মিনহাজ উদ্দিন মুখ চেপে হেসে দেয়। দাঁতহীন মাড়ি দেখাতে সে লজ্জা পাচ্ছে। রশিদ সাহেবকে দেখলে তার কিছুটা হিংসে হয়। ছেলে ছেলে বউ অনেক খেয়াল রাখে। সেই কবে থেকে আফজালকে বলছে দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে একটা নকল দাঁত সেট করে দিতে! কিন্তু সময় করতে পারছে না। আজ তিন বছরেও সময় হল না! সময় হবে মরলে! নিজে যাবে তাও যেতে দেবে না।ওর কোন বন্ধুর পরিচিত ডাক্তার আছে গেলে ডিস্কাউন্ট পাওয়া যাবে! খেতা পুড়ি তোর ডিস্কাউন্টের! কিন্তু মুখ না খুলে কথা বলবে কীভাবে?তাই যতটা সম্ভব ঠোঁট চেপে কথা বলে। বাজারে যাচ্ছে এইটা বলতে গিয়েও কী ভেবে যেন বলল না। মুচকি হেসে বলল- -তুমি গাড়ী চড়া মানুষ রিকসা লিফট কী তোমার ভাল লাগবে? -হা হা হা যা বলেছ...গাড়ি যদি গ্যারেজে থাকে রিকসাই তখন ঘোড়ার কাজ দেয়। হা হা হা "বিখ্যাত ঘোষের দৈ মিষ্টি" দোকানের কাছে আসতেই রশিদ সাহেব রিকসা থামায়। মিনহাজকে বলে -আরে নেমে আসো এখানে আজকে ভাপা পিঠা বানাবে! -ভাপা পিঠা...! মিনহাজ উদ্দিন নেমে আসে রিকসা থেকে। ভাড়া মিটিয়ে দুই বন্ধু ঢুকে যায় হোটেলে। ভাপা পিঠা কত বছর হয়েছে সে খায় না। মলি এই পিঠাটা খুব মজা করে বানাতে পারতো! মলি বলত "মিনহাজ অনেক পছন্দ করে বলেই না সে এতো মজা করে বানানো শিখেছে!” পিঠার ঘ্রাণে পেটের মাঝে গড়গড় করে শব্দ হয়। দুই বন্ধু বসে অনেক কথা বলে আড্ডা দেয়। পেট ভরে ভাপা পিঠা আর দৈ মিষ্টি খায়। মিনহাজ ভুলে যায় তার ডায়াবেটিকস কতটা হাই! মিষ্টি খাওয়া মানে তার জন্য বিষ। রশিদ সাহেব হেসে হেসেই বলে- বন্ধু আজকে কিন্তু আমাকে তুমি খাওয়াচ্ছ! আরেকদিন আমি খাওয়াব মনে রেখ। খুশিতে মিনহাজ উদ্দিনও হেসে হেসে বলে- আরে বন্ধু ভেবো না...! যত খুশি খাও...পরে ঠিকই সুদ আসলে আদায় করে নেব! হা হা হা রশিদ সাহেব একটু খেয়াল করলে দেখতে পেত মাঝে মাঝেই অজানা এক ভাবনায় মিনহাজের চোখ ভিজে ভিজে যাচ্ছে। "বিখ্যাত ঘোষের দৈ মিষ্টি" দোকান থেকে আরও কিছু পিঠা আর দৈ নিয়ে বের হয়ে আসে। ঘড়িতে দেখে একটা বাজে! সময় যে কীভাবে চলে গেছে সে টেরই পায়নি! রশিদ সাহেব চলে গেছে কিন্তু ওর বাসায় যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। "একটা জরুরি কাজ আছে!” এই বলে বিদায় জানিয়েছে বন্ধুকে। লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে পার্কের ভীতরে ঢোকে! মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কুয়াশা ঘেরা মেঘের ফাঁক গলে সূর্যটা ঝিমুনি নিয়ে উকি দিয়েছে। সবুজ ঘাসে জমে থাকা খানিকটা শিশির হাতে নিয়ে মুখে মাখে মিনহাজ। একটা কষ্ট বুকের বাম দিকে চিনচিন করে ব্যথা বাড়ায়। হাজারো চিন্তা মাথার মাঝে ভনভন করছে।"আফজাল আজকাল ছুটির দিনেও অফিস করছে? ছেলেটা কী করে তা ওকে কখনো বলে না। জিজ্ঞাসা করলেও বিরক্ত হয়। কিন্তু কেন? ” ভাবনা হতেই ভীষণ কষ্ট বাড়ে...! পাশেই দেখে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা এই মধ্য দুপুরেও রিকসার পুরনো টায়ার আর কাগজ জ্বেলে আগুণ ধরিয়ে গোল হয়ে বসে আছে। আগুনের চেয়ে ধোঁয়া হচ্ছে বেশী। চোখ জ্বালা করছে। তবুও কি ভেবে সেও গিয়ে ওদের পাশে মাটিতে বসে পড়ে। আগুণের ওম নেয়...! বাচ্চাগুলো খিল খিল করে হেসে যায়। কেউ কেউ বারবার ওর কাছে থাকা পিঠা দৈয়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেটে নেয়। মিনহাজ ব্যাগটা খুলে দুইটা পিঠা ওদেরকে দেয়। ওরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। "কী আশ্চর্য! সবাই ভাগা ভাগি করে পিঠাগুলো হাতে নেয়! ওদের মাঝে কত মিল মহব্বত!" কোথা থেকে যেন হিম ঠাণ্ডা একটা বাতাস এসে ওকে জড়িয়ে ধরে! অনেক শীত লাগে...! ভীষণ বাথরুমের বেগ আসে। অনেক কষ্টে রাস্তায় এসে একটা রিকসা নেয়।
"সারাদিন ঘরের ভীতরেই তো থাকে! মাসে একটা দিন একটু বাজারে পাঠাই তাতেও কত ঢং করে! গিয়ে দেখ এই বুড়ো বয়সে কোথায় বসে আড্ডা মারছে!” দরোজার কাছে এসে দীনার উঁচু স্বরে চিৎকার শোনা যায়! মিনহাজ বাসায় ঢুকতেই দেখে দীনা কুসুমের সাথে কথা বলছে! ওকে দেখে থেমে যায়! বাইরে থেকে কথাগুলো সে শুনতে পেয়েছে! বুকের মাঝে তোলপাড় করে অচেনা ব্যথারা! কুলসুম ওকে দেখে এগিয়ে এসে হাত বাড়ায়। মিনহাজ ব্যাগে আনা পিঠা আর দৈ মিষ্টি উড় হাতে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে। দীনা চিৎকার করে বলে উঠে- -এইসব রাস্তার জিনিষ কেউ খায় নাকি...ফেলে দে! েই দে আমাকে আমি নিজেই ফেলে দিচ্ছি এইসব খাবে আর বাথরুম নষ্ট করবে! যতসব...!” জানালা দিয়ে কিছু ফেলে দেবার শব্দ কানে এলো। মিনহাজ ভীষণ ঘামছে তবুও শীত লাগছে। বাথরুম সেরে উঠে দাঁড়াতেই...চারিদিকে অন্ধকার করে ঠাণ্ডা একটা কাঁপন ঝাঁকুনি দিয়ে ওকে ফেলে দিতে চায়! সুগারটা যে ভয়াবহ আকারে বেড়েছে তা বুঝতে বাকি থাকে না! দরোজা খুলে বের হয় কিন্তু মনে হয় এসব কিছুই করছে বাতাসে ভেসে ভেসে! -"দাদা বাজার কই? কিছুই তো আনেন নাই! খালাম্মা রাগ করছে অনেক। শেষমেষ পিজা ডিলিভারি অর্ডার দিয়া আনছে! ও দাদা বাজার না হইলে দুপুরে রান্দুম কী? খাইবেন কী?” মিনহাজ উদ্দিন কিছুই বলে না। দীনা কীসব যেন বলছে তাও ঠিকমত শুনতে পায়না! রাগে গজগজ করছে মেয়েটা! ও সোজা ঘরে ঢুকে জানালা দিয়ে দেখে পাশের বস্তির কয়েকটা বাচ্চা কী অসীম তৃপ্তি নিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা ভাপা পিঠা দৈ মিষ্টি খেয়ে যাচ্ছে। ভীতর থেকে একটা কষ্ট উগরে বের হতে চায়! কিন্তু বের হতে না পেরে বুকে জ্বালা ধরায়। পায়ে পায়ে বাড়ি লাগে...সে কোনভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। -"উহহ আহ...উহহ" করতে করতে লেপ গায়ে জড়ায়। বুঝতে পারছে আজকের অভিমানটা অনেক বেশিই হয়ে গেছে। "মলি অনেক শীত করছে...জানালা দরজা সব বন্ধ করে দাও! উফ...মলি শুনতে পাওনা!” চোখ বুজে আসে! তবুও থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে জলে ভরা ঘোলা চোখ মেলে তাকায়,দেয়ালে ঝুলানো প্রিয়তমার ছবিটার দিকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।