বেশ আয়োজন করেই রঞ্জন আজ লিখতে বসেছে। রঞ্জন-পুরো নাম রঞ্জন চৌধুরী। ইতিমধ্যেই এ শহরে লেখক হিসেবে মোটামুটি পরিচিত। কতটা ভাল লেখে সে তা জানে না। কিন্তু একটা জিনিস প্রায়ই খেয়াল করে যে কোন পত্রিকাই তার লেখা ফিরিয়ে দেয় না। দু'একটা পত্রিকার অতি উৎসাহী সাহিত্য সম্পাদক আবার মাঝে মাঝে নূতন লেখার জন্য ফোন ও করে। মাঝে মাঝে তার ইন্টার্ভিউ নেয়- তাকে গোলটেবিল বৈঠকে ডাকে। এগুলো সে বেশ উপভোগ করে। যদিও এ বিষয়ে সে আত্ম অহমিকায় ভোগে না। তাই লেখক হিসেবে নিজেকে আলাদা শ্রেণীতে কখনও সে ফেলতে চায় না। স্বাভাবিক জীবন যাপনেই সে অভ্যস্ত। সকাল আটটায় অফিসে যাওয়া-রাত ন'টায় বাসায় ঢোকা। মাঝে মাঝে কিছু আইডিয়া আসলে কম্পিউটারে বসা-ব্যস। তবু আজ তার এই বিশেষ আয়োজন। তিন দিস্তা কাগজ, চারটা দামী কলম, দুই প্যাকেট বেনসন আর দামী অ্যাশট্রে নিয়ে ব্যাপক আয়োজন। আর এ আয়োজন করতে তাকে রীতিমত কক্সবাজারে এসে হোটেলে উঠতে হয়েছে। আসলে বাসায় এমনটা সম্ভব ছিল না। কেননা, সে সবসময় কম্পিউটারেই লেখে। তাই এত আয়োজনের সুযোগ নেই। এবং কখনও এর প্রয়োজনীয়তা সে অনুভব করেনি। তার ধারণা লেখালেখি হলো ভেতরকার ব্যাপার। এটা এমনিতেই চলে আসে। এর জন্য বাড়তি কোন আয়োজন দরকার নেই। সে হয়ত সারাজীবন সেটাই জানত। যদি না মেয়েটা সেদিন ওভাবে বলতো। মেয়েটা মানে তার এক মেয়ে ভক্ত। একদিন ফোন করেছিল। হঠাৎই জিজ্ঞেস করলো- আপনি কোন ব্রান্ডের সিগারেট খান- বেনসন নাকি কোন বিদেশী ব্রান্ড? কিন্তু সে যখন বললো যে সে সিগারেট খায় না তখন মেয়েটা রীতিমত বিস্মিত হয়ে গেলো। বিস্ময় মাখা কণ্ঠে বলে- সিগারেট খান না মানে! তাহলে লেখেন কিভাবে? -মানে লিখতে হলে সিগারেট খেতে হয় নাকি? -হয় না মানে! আমরা তো জানি কবি লেখকরা সিগারেট খেলেই তাদের মাথার জট খুলে যায়। তখন তারা মহৎ মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করেন। ফলাফলস্বরূপ শরীরে ক্যান্সারসহ নানা রোগ বাসা বাঁধে আর বিখ্যাত হওয়ার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। মৃত্যুর পর তারা বিখ্যাত হন। -বাহ্! তুমি তো খুব সুন্দর করে কথা বলো। কিন্তু সব কবি লেখকরাই যে সিগারেট খায় আর সিগারেট খেয়ে ক্যান্সার বাঁধায়- এ থিওরি তোমাকে কে দিয়েছে? -না মানে সবাই তো সেইটাই মনে করে। -তাই নাকি? -জানেন হুমায়ূন আহমেদের একটা নাটকের বইয়ের শুরুতে উনি লিখেছেন ওনাকে নাকি ভক্তরা কলম আর বিভিন্ন বিদেশী ব্রান্ডের সিগারেট কাটুন ভরে দিয়ে যায়। -হতে ও পারে। -আমার সেইজন্য ধারণা ছিল যে আপনার মেয়ে ভক্তরা ও বুঝি আপনাকে কাটুন ভরে বিদেশী ব্রান্ডের সিগারেট দিয়ে যায় আর সেগুলো খেয়ে আপনি এমন সুন্দর সুন্দর লেখা লেখেন। -তাই! কিন্তু তোমার ধারণাটা একদম ভুল। -হুম বুঝতে পারছি। এতদিনে আরো একটা জিনিস বুঝলাম যে আপনার গল্পের নায়কেরা এমন মাইয়া মাইয়া টাইপ কেন? -মাইয়া মাইয়া টাইপ মানে? -না মানে আগে যখন ইমদাদুল হক মিলনের বই পড়তাম তখন দেখতাম ওনার নায়কেরা কি রকম স্মার্ট, হ্যান্ডসাম। কিন্তু আপনার নায়কেরা সে রকম না। -তাই? আগে পড়তে মানে- এখন পড়ো না? -না। এখন এত সময় কোথায়। ভার্সিটিতে ক্লাস, পড়াশুনা, মোবাইলে আড্ডা, হিন্দি সিরিয়াল দেখা, পার্লারে যাওয়া- এত কিছুর ফাঁকে আর পড়ার সময় হয় না। -আমার লেখা কখনো পড়েছো? -সত্যি কথা বলতে কি আপনার বই কিনে কখনও পড়া হয়নি। তবে পত্রিকায় আপনার যে লেখাগুলো বের হয় তার একটাও মিস হয় না। আসলে আপনার প্রথম লেখাটা পড়ার পর কেমন মোহে পড়ে গেছি। আপনার লেখার ভেতরের ইমোশনটা, অদ্ভুত রকমের কষ্টটা আমাকে ভীষণ টানে। জানেন মাঝে মাঝে এমন হয় যে পত্রিকায় হয়তো আপনার লেখাটা দেখেছি কিন্তু সময়ের অভাবে পড়তে পারিনি। তখন রাত্রে ঘুমাতে যাওয়ার আগে হলেও ওটা পড়ে শেষ করে ঘুমাতে যাবো। আপনার অনেক লেখা আমি একাধিকবার ও পড়ি। -তাই। শুনে ভাল লাগলো। -আচ্ছা আপনি এত কষ্টের লেখা কিভাবে লেখেন? আগে অবশ্য ধারণা ছিল যে আপনি বোধ হয় গাঞ্জা টাঞ্জা খাইয়া নেশায় বুদ হইয়া কাঁদতে কাঁদতে এমন লেখা লেখেন। -না। কখনো না। -তা তো বুঝলাম। কিন্তু আপনার লেখার ইন্সপিরেশনটা কি? -জানি না। -আপনার কি খুব বেশি কষ্ট? -না। সেরকম কিছু না। -তাহলে? ভণ্ডামি? -বুঝি না। -বুঝলে বলবেন। পরে ফোন দেবো। বাই। সেদিন থেকেই ব্যাপারটা মাথায় ঢুকে গেছে। তাই রীতিমত অফিস থেকে দশদিনের ছুটি নিয়ে কক্সবাজারে এসেছে। এ দেখে অফিসের সবাই প্রথমে ভেবেছিল সে বোধ হয় এবার আইবুড়ো অপবাদ ঘুচিয়ে কোন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে মুক্ত করবে। কিন্তু যখন শুনলো স্রেফ গল্প লেখার জন্য ছুটি নিচ্ছে তখন সবাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, বয়সকালে বিয়ে না করলে মাথায় এ রকম গোলমাল দেখা দিতেই পারে। সে যে হোটেলটাতে উঠেছে সেটা আসলেই অসাধারণ। একেবারে সাগরের কাছে। রুম থেকে সাগরের গর্জন শোনা যায়। জানালা দিয়ে তাকালে সাগর দেখা যায়। সাথে সাগরমুখী ছোট্ট বারান্দা- সেখানে বসলেই সাগরের শীতল হাওয়া শরীর আর মনকে স্পর্শ করে যায়। এমন পরিবেশে এমনিতেই ভাব চলে আসে। লেখার জন্য আর আলাদা আয়োজন দরকার হয় না। তবু ও রঞ্জন সিগারেটের প্যাকেট খোলে। একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটের কোণে রাখতেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা লেখার কথা মনে পড়ে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছিলেন যে, সেদিন সকাল থেকেই মাথায় লেখাটা চেপে বসেছিল। তাই সকালে মা বাজারে যেতে বললে ও আর যাননি। বিশেষ করে লেখার চেয়ে ও বেশি ভাবনা ছিল কড়া রোদ নিয়ে। ফিরতে ফিরতে রোদ চড়ে যাবে সেই ভয়েই বাজারে যাননি। কিন্তু বেলা বারোটায় যখন সিগারেটের প্যাকেট এর শেষ কাঠিটায় আগুন ধরালেন তখন তার মাথায়ও যেন আগুন ধরলো। লেখা আর এগোয় না। তখন তিনি সেই কড়া রোদ মাড়িয়ে গিয়ে সিগারেট আনতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি। অতএব নিশ্চয়ই এর ভেতরে কিছু একটা ব্যাপার আছে। ভাবতেই আরো অনেক কিছু মনে পড়ে। সেদিন তার আর এক মেয়ে ভক্তও তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল। মেয়েটা ভাল রবীন্দ্র সংগীত গায়। একদিন তার বাসায় রবীন্দ্র সংগীত শুনতে দাওয়াত করলো। নাস্তাটাস্তা সারার পর মেয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো- দাদা কোন ব্রান্ড? সে তো প্রথমে বুঝতে পারেনি। জিজ্ঞেস করলো- মানে? -না মানে সিগারেট কোনটা খান? সে যখন বলল সিগারেট খায় না। তখন তো মেয়ের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। -মানে, আপনি সিগারেট খান না! সত্যিই! আপনার মত এত বড় একজন লেখক-এ ও সম্ভব! তার ও অনেক আগে। সে তখন কলেজে পড়তো। তখনও লেখক হিসেবে সে এত পরিচিতি পায়নি। কিন্তু পরিচিত সবাই তার লেখালেখির ব্যাপারটা জানতো। তখন সে প্রায়ই তার এক মেয়ে সহপাঠীর বাসায় যেত। আরো কয়েকজনসহ তারা প্রায়ই সেখানে যেতো। আড্ডা দিতো। মেয়েটার মা ও মাঝে মাঝে তাদের সাথে যোগ দিতেন। তিনি ও সাহিত্য টাহিত্য পড়তেন। একদিন চা নিয়ে এসে যখন জানলেন সে চা খায় না তখন তিনি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- চা খাও না- সিগারেট খাও? এ শুনেতো রঞ্জন 'থ। বলে- না আন্টি। -তুমি লেখক না? চা সিগারেট খাও না তো কি লিখো? সেদিনের পর ও ব্যাপারটা অনেকদিন তার মাথায় ঘুরেছিল। কিন্তু পরে ভুলে গেছে। ইদানীং আবার ঘুরছে। ভাবছে আসলেই কি এটা সম্ভব। একজন লেখক সিগারেট খেলেই কি ভাল লিখতে পারেন। আচ্ছা একজন লেখকের ইন্সপিরেশন কি? ভাল লিখতে হলে তো নিশ্চয়ই কোন ইন্সপিরেশন লাগে। সেটা কোত্থেকে আসে? তার লেখার ইন্সপিরেশনই বা কি? ভাবতেই তাল হারিয়ে ফেলে। সেদিন এক সাংবাদিক একটা ইন্টার্ভিউতে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- আপনার লেখার ইন্সপিরেশন কি? সে উত্তর দিতে পারেনি। আসলে সে কখনও সেভাবে ভাবেনি। যখনই বসেছে কিছু না কিছু লিখেছে। কেন লিখেছে- কি উদ্দেশ্যে- এগুলো কখনও ভাবেনি। তবু সেদিন ঐ সাংবাদিকের সামনে নিজেকে বেকুব বেকুব মনে হচ্ছিল। তার কয়েকদিন পরেই কবি নির্মলেন্দু গুণের একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিল। তিনি কি সুন্দর অকপটে বলেছেন- বিশেষ বিশেষ নারীকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি কবিতা লিখেন। কবিতা লেখার জন্য তার নারী মডেল দরকার হয়--- এসব, এসব। কিন্তু অনেক ভেবে ও রঞ্জন সেরকম কিছু খুঁজে পায় না। সে হঠাৎ ভাবে আচ্ছা তার প্রথম লেখাটা সে কখন কিভাবে লিখেছে। অনেক ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে- কলেজে পড়া অবস্থায়ই লিখেছিল। কেন লিখেছিল তা ও মনে পড়ে যায়। কলেজে প্রথমদিনেই একটা মেয়েকে ভাল লাগে। তার প্রতি একটু দুর্বলতা ও বোধ করে। সেই মেয়ে একদিন তার সামনেই তাকে অবজ্ঞা করে আরেকটা ছেলের সাথে কথা বলেছিল। সে ভীষণ কষ্ট পায়। বাসায় ফিরেই সে কাগজ কলম নিয়ে বসে যায়। এক বসাতেই কয়েক পৃষ্ঠা লিখে ফেলে। তারপর সেই অগোছালো লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠায়। কিন্তু কোন পত্রিকাতেই ছাপা হয় না। তারপর একদিন তাকে অবাক করে দিয়ে একটা বিখ্যাত পত্রিকা তাদের বিশেষ সংখ্যায় তার লেখা ছেপে দ্যায়। বন্ধুরা দেখে খুব প্রশংসা করে- ইভেন সেই মেয়েটাও। তারপর থেকে সেই আনন্দেই যেন সে লেখালেখি চালিয়ে যায়। এর মাঝে কখনও ভাবার অবকাশ হয়নি যে কেন লিখে, কি জন্য লিখে। তারপর তো আজকের এই অবস্থানে। আজ এসব ভাবতে ভাবতেই সেই মেয়েটার ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়। তার সেই নিষ্পাপ কিশোরী মুখ। যদিও সে জানে ও মুখ এখন হয়ত মোটেই সেরকম নেই। শুনেছে মেয়েটার খুব বড়লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে। সে কি সত্যিই সুখী হয়েছে? ভাবতেই তার বুকের ভেতর একটা চিনচিন ব্যথা অনুভব করে। মেয়েটার ছবিটা সে মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু পারে না। আরো স্পষ্ট হয়। ভারী দুটি চোখ তুলে যেন বলে- এত অভিমান কেন তোমার? রঞ্জন ঠোঁট থেকে সিগারেটটা নামিয়ে রাখে। বাইরে তাকায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না। দূরে তাকাতেই দেখে সাগরের সাদা ফেনিল ঢেউগুলো তীরে আছড়ে পড়ছে। তার শব্দ যেন রঞ্জনের বুকের ভেতর অবিরত বেজে চলে। তাকে আর সিগারেট ধরাতে হয় না- ভাবতে ও হয়না। সাদা কাগজের উপর কলমটা এগিয়ে চলে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আহমেদ সাবের
Inspiration ( প্রেরণা ) প্রসঙ্গ নিয়ে গল্পটা লেখা। নারী, বাবা, মা, বিশেষ ব্যক্তিত্ব প্রেরণা হয় বলে জানি। চা বা সিগারেট যে তা হয়, এই প্রথম জানলাম। তবে মদ, চা, সিগারেট ইত্যাদি প্রেরণা না হয়ে সহায়ক হতে পারে। সে যা হোক, আপনার লেখার সুপ্ত প্রেরণাদাত্রীকে গল্পের শেষে এসে পেয়ে গেলাম। সুন্দর সাবলীল গল্প। আপনার গল্প পড়ে ভাবতে বসলাম, আমার লেখার প্রেরণা কে ছিল?
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।