মেয়েটির বিষন্ন চোখে রাগ হতাশা কিম্বা কোন ক্ষোভ নেই। আছে সীমাহীন দুঃখ আর স্বপ্ন ভাঙ্গার যন্ত্রণা। ঐ চোখে তাকিয়ে থাকার ক্ষমতা আমার নাই। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। বাইরে হালকা বাতাস বইছে। সেই সাথে শুরু হয়েছে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। ট্রেনের জানালা খোলা। বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে মেয়েটিকে।বাতাসে উড়ছে মেয়েটির খোলা চুল।বুষ্টির পানিতে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে মেয়েটির চোখের পানি। একটা জিনিস আগে কখোনো খেয়াল করি নি। মেয়েটার গালে বৃষ্টির পানি জমেছে।কিন্তু আশ্চর্য্য! বৃষ্টির পানির মাঝেও মেয়েটার চোখের পানি আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে।
বৃষ্টির পানি এসে আমাকেও ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে বললাম, “জানালাটা বন্ধ করে দেই?” মেয়েটি বিষন্ন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছোট্ট করে বলল, “প্লিজ। জানালাটা খোলা থাক।“ অনেক্ষন যাবৎ আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। দেরী না করে নিজেই নিজেকে বললাম, “সে আর আসবে না।“ মেয়েটা চমকে তাকাল আমার দিকে? তারপর আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “কে আসবে না?” আমার ঠোটের কোনায় হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে বললাম, “আপনি যার অপেক্ষায় আছেন?” মেয়েটা করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কিভাবে জানেন, আমি কারো অপেক্ষায় আছি?” আমি বিচক্ষন ভাব দেখিয়ে বললাম, “খুবই সহজ। আপনি ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। এটা প্রমান করে আপনি প্রস্তুত হয়ে বাসা থেকে বের হন নি। আপনার বয়সী একটা মেয়েকে এগিয়ে দিতে কেউ স্টেশনে আসেনি। তারমানে আপনি পালিয়ে এসেছেন। আপনি ট্রেনে ওঠার পর থেকেই কাঁদছেন। তারমানে আপনার এটা সমস্যা হয়েছে। একটু পর পর সেল ফোন বের করে কাউকে ফোন দিচ্ছেন। সে ধরছে না। আপনি ফোন বন্ধ করে দিচ্ছেন। মানে আপনি চান না যাকে ফোন করছেন সে ছাড়া অন্য কারো সাথে কথা বলতে।আপনার পাশের সিটটা ফাঁকা। মানে আপনার সাথে আরো একজনের যাবার কথা ছিল। আরো কিছু হিসাব মিলিয়ে আমি ধরে নিচ্ছি আপনি বাড়ি থেকে পালিয়েছেন।“ মেয়েটার ঠোটের কোনে এক চিলেত হাসি ফুটে উঠল। ব্যাঙ্গ করে বলল, “মিস্টার হোমস, আপনার পর্যবেক্ষণে ভুল আছে। আমার খুব মাথা ব্যাথ্যা করছে। আপাতত আমি একটু একা থাকতে চাইছি।“ মেয়েটা আবার তার আগের অবস্থানে ফিরে গেল। আমি বেকুবের মত আমার সিটে গা এলিয়ে দিলাম।
কমলাপুর রেল স্টেশন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি বসে আছি। কি করব বুঝতে পারছি না। আমার ছোট্ট জীবনে এমন বিপদে আমি কখোনো পড়িনি। আমি বসে আছি। পাশে বসে আছে নাম না জানা সেই মেয়েটা।একটু পর পর সে তার চোখ মুছছে। এখন তার নাম জানি। তার নাম ‘কণা’। বৃষ্টির পানির সাথে সাথে আমি কনা নামের মেয়েটার চোখের পানিতে ও বাধা পড়ে গেছি। আমার ধারণা ভুল ছিল না। সে আসলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু যার সাথে পালিয়েছে সে কোন যোগাযোগ করছে না। কনা, ভালবাসত তারই গ্রামের এক বড় ভাইকে। বড় ভাই ঢাকায় এসে চাকুরী পাবার পর বেড়াতে আসার কথা বলে কণা ঢাকায় এসে তাকে বিয়ে করে। তারপর দুজন একসাথে গ্রামে ফিরেছে। আজ দুজনার এক সাথে ফেরার কথা ছিল। ছেলেটা আসেনি। ফোনও ধরছে না। ওদিকে মেয়েটার বাড়িতে আর থাকার উপায় নাই। মেয়েটার বাবা তাদের বিয়ে মেনে নিতে পারে নি। একারনেই সে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। এখন যার জন্য পালিয়েছে সেই লা-পাত্তা। শুধু তাই নয়, আজ সকালেই নাকি খবর রটেছে সেই বড় ভাই অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনে বাড়িতে তুলেছে। কনা কে বিয়ে করার কথা সে বেমালুম অস্বীকার করেছে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। কণা তার ব্যাগ হাতে উঠে দাড়াল। কণা চলে যাচ্ছে। আমার কিছুই করার নেই। আমি অসহায় এই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কি করতে পারি আমি? হটাৎ নিজের অজান্তেই ডেকে উঠলাম, “কণা?” চমকে পেছন ফিরল সে। আমি জানতে চাইলাম, “কোথায় যাবেন?” সে হতাশ গলায় বলল, “জানি না। তবে চিন্তা করবেন না। ব্যবস্থা একটা হয়েই যাবে।“ আমি পকেট থেকে আমার ভিজিটিং কার্ড বের করে কণার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। বললাম, “যদি কখোনো প্রয়োজন মনে করেন, যোগাযোগ করবেন। আমি সাধ্যমত সাহায্য করার চেষ্টা করব”। কোন কথা না বলে কার্ডটা নিয়ে সে হাত ব্যাগে ভরল। তারপর আমাকে অবাক করে,”আসি ভাইয়া” বলে হারিয়ে গেল ঢাকা শহরের লাখো মানুষের ভীরে।
৭/৮ মাস পরের কথা। কণার কথা আমি ভুলেই গেছিলাম।হটাৎ একদিন রাতে তার ফোন না পেলে হয়ত কোন দিন মনেই পড়ত না। অপরিচিত একটা নম্বর থেকে কল এসেছে দেখে বিরক্ত গলায় বললাম, কে? আমাকে অবাক করে কণা বলে উঠল, “ভাইয়া, আমি কণা। ট্রেণের সেই হতভাগী মেয়েটা। তুমি বলেছিলে প্রয়োজন হলে তোমাকে ফোন করতে।“ কণা এমন ভাবে আমাকে ভাইয়া বলল যেন হাজার বছরের চেনা। আমি জানতে চাইলাম, “কেমন আছ? কোথায় তুমি?” সে আমার কথার জবাব না দিয়ে বলল, “ভাইয়া, এটা ফোন নম্বর লিখ।“ তারপর সে আমাকে একটা নম্বর দিয়ে বলল, “ভাইয়া, আমার অনেক বিপদ। কাল সকালে পারলে মমতা নাসিং হোম এ এস। আর আমার কিছু হয়ে গেলে তোমাকে যে নম্বরটা দিলাম সেই নম্বরে যোগাযোগ করো।“ আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে ফোনটা কেটে দিল।
রাত ১২ টা বাজে। মমতা নাসিং হোম এ বসে আছি আমি। কণা মা হতে যাচ্ছে। তার পাশে কেউ নেই। অনাহারে আর গাধার খাটুনি খাটা কণার বাচ্চার বিকাশ ঠিক মত হয় নি। কণাকে অপারেশন টেবিলে নেয়া হয়েছে। তার কপালে কি আছে আমি জানি না। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না, কনার দেয়া নম্বরে যোগাযোগ করব কি না? নম্বরটা কার সেটাও জানি না। হতে পারে কণার সেই ভালবাসার মানুষটির। আবার নাও হতে পারে। সেল ফোন বের করে কনার দেয়া নম্বরে রিং করলাম। রিং বাজছে বাজছে……………।
বৈশাখ মাসের কালবৈশাখী ঝড় বইছে। আমি ঝড় ঠেলে সামনে এগোনোর চেষ্টায় আছি। রাস্তায় কেউ নেই। আমি একা একা যুদ্ধ করছি ঝড়ের সাথে। কণা ও যুদ্ধ করছে। যুদ্ধ করছে মৃত্যুর সাথে। কণার বাবা ফোন ধরেছিল। তারা আসছে। কি দোষ কণার? আমি ভেবে পাচ্ছি না। ভালবেসে এই ছোট্ট মেয়েটাকে কত বড় পরীক্ষাই না দিতে হচ্ছে। হটাৎ প্রচন্ড শব্দে কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। ভয়ে শিউরে উঠল আমার শরীরের সব লোম। সেটা বাজের শব্দে নাকি কণা নামের অসহায় মেয়েটার কথা ভেবে সেটা বুঝতে পারলাম না।
১৬ মে - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪