আজকে আমার মন খারাপ

শীত (জানুয়ারী ২০১২)

জুয়েল দেব
  • ৪৫
  • 0
  • ১৭
প্রতিদিনকার মত আমি পদব্রজে শহর পরিভ্রমণে বের হলাম। শহরের সিটিবাসগুলোর পেছনে ছুটতে ছুটতে আমি যখন ক্লান্ত হয়ে যাই, তখন উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াই ফুটপাত ধরে। ইটকাঠের জঞ্জালে ভরা শহরটা আমার একটুখানি মনোযোগও আকর্ষণ করতে পারে না।

আমি হাঁটতে হাঁটতে মানুষ দেখতে থাকি। মানুষ আমার অতি পছন্দের একটি বিষয়। বিচিত্র রকমের মানুষ ঘোরে এই বিচিত্র শহরটাতে। রাত বাড়তে থাকলে মানুষের আনাগোনাও সম্ভবত বেড়ে যায়। তবে ইদানীং শীত শুরু হয়ে গেছে বলে মানুষের স্রোত ঘরমুখী হয়ে গেছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে মানুষের ঘরে ফেরা দেখি। যাদের ঘর নেই তারা ফুটপাতে অস্থায়ী ঘর বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকে। শীতের বিরুদ্ধে ছোট্ট একটা যুদ্ধ ঘোষণা। তবে শীত এই ঘরহীন মানুষগুলোকে মোটেও পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। আমি প্রবল পরাক্রমশালী শীতের বিরুদ্ধে পাত্তা না পাওয়া এই দুর্বল মানুষগুলোর ছোট ছোট পাল্টা আক্রমণকে আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকি।

রাস্তার পাশে চুলা জ্বেলে ভাপা পিঠা বিক্রি করছে এক লোক। আমি খুব খুশী হলাম। ভাপা পিঠা আমার অতি পছন্দের একটি খাদ্য। পৃথিবীতে ভাপা পিঠার উপর কোনো পিঠা নেই। আমি এগিয়ে গেলাম পিঠা খেতে, ‘মামা, গরম গরম পিঠা দেন।’
আমার কথায় পিঠাঅলা মোটামুটি উৎসাহ পেল, ‘আপনে এক মিলিট খাড়ান মামা, আমি রকেটের মতন আপনেরে পিডা বানায় দিতেসি। আপনে হাত গরম করতে থাকেন।’
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত গরম করতে লাগলাম। পিঠাঅলা বললো, ‘আপনের হাত গরম হওনের আগেই দেখবেন পিডার কাম শ্যাষ! বাঁশপাতা নড়ে চড়ে, তোমার কথা মনে পড়ে। ক্যাঁক কুরুত!’
বেশী কথা বলা সম্ভবত লোকটার স্বভাব। পিঠাঅলার পরের কথাগুলো শুনে আমি আমার শৈশবকে দেখতে পাই। আহা, তখন আমরাও এরকম অর্থহীন ছড়া বলতাম। কোনো মানে ছিল না, শুধুই মজা পাওয়া।’
পিঠাঅলা আমার চোখের সামনে একটি প্লাস্টিকের প্লেট উঁচিয়ে ধরে বলে, ‘লন মামা, এক্কেরে ফাশ কেলাশ কইরা বানাইসি। খায়া যুদি ভালা না লাগে তাইলে এই মজিদ মিয়ার গালে দুইডা চড় মারবেন। দুই কান ধইরা পিডা বানানি ছাইড়া দিয়া বৈরাগী হইয়া যামু!’

পিঠাঅলা অনেক দূরে ফেলে আসা আমার সবুজ গ্রামটার কথা, আমার উজ্জ্বল ছেলেবেলাটার কথা মনে করিয়ে দেয় আমাকে। ছোটবেলায় শীতকালগুলোতে কারও কাছ থেকে দু-এক টাকা পেলেই আমি দৌড়ে চলে যেতাম বাজারে। তারপর রাস্তার পাশ থেকে ভাপা পিঠা কিনে খেতাম। ধুলোবালি, ময়লা মাখানো এই পিঠাগুলোই অমৃত মনে হত। একদিন মা’র কাছে ধরা খেয়ে গেলাম। মা ভয়ংকরদর্শন একটা সতের নম্বুরি বেত সাঁই সাঁই করে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, ‘তুই এতবার বাজারে যাস কেন?’
আমি ভয়ে আধমরা, ‘পিঠা খেতে!’
মা আরো বেশী খেপে গেলেন, ‘তোর এত পিঠা খাওয়ার শখ! যে লোকগুলো রাস্তার পাশে বসে পিঠা বানায়, ওরা বাথরুম করে এসে হাত না ধুয়ে পিঠা বানাতে বসে। সেই পিঠা তুই এতবার দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে খেয়ে আসিস। দাঁড়া, আজকে তোর জন্য আমি এক ড্রাম পিঠা বানাব। তারপর সবগুলো তোকে খাওয়াবো।’
আমি মায়ের হাতের বেতটার দিকে তাকিয়ে সাহস করে বলেই ফেললাম, ‘তোমার বানানো পিঠার চেয়ে ওদের পিঠাগুলো খেতে ভাল।’

পিঠাঅলা মজিদ মিয়ার কণ্ঠ আমার শৈশবটাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, ‘মামা, খাইতাছেন না ক্যান! টেস হয় নাই?’
মজিদ মিয়াকে কী করে বোঝাই আমার সেই সবুজ গ্রামের কুয়াশাছন্ন শীতকালের কোনো একটি শুভ্র সকালবেলায় আমার মায়ের হাতে বানানো একটি ভাপা পিঠার জন্য আমি এখন পুরো পৃথিবীটা দিয়ে দিতে পারি।
মজিদ মিয়ার কন্ঠ আমি আবছা শুনতে পাই, ‘মামা কান্দেন ক্যান! মন খারাপ হইসে? গাল ফেন্ডের লগে ঝগড়া?’
আমি মজিদ মিয়াকে ধমক লাগালাম, ‘ওই মিয়া, মন খারাপ আবার কী জিনিস! মনখারাপের অসুখ থাকলে এতদিন ধইরা এই শহরে থাকতে পারতাম?’

আমি আবার উদ্দেশ্যহীন হাঁটা শুরু করলাম। ফুটপাতে শুয়ে থাকা লোকগুলো শীতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। করুক। বেঁচে থাকতে হলে অনেক যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধ আছে বলেই বেঁচে থাকায় অনেক আনন্দ।


আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রিফাতুল ইসলাম রাফি অসাধারন লাগলো ভাই...
ভালো লাগেনি ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
এফ রহমান আপনার লেখার হাত বরাবরই সুন্দর। বিমোহিত হইলাম।
ভালো লাগেনি ২৮ জানুয়ারী, ২০১২
নীলকণ্ঠ অরণি সাদা সিধে কথায় অসাধারণ গল্প...
ভালো লাগেনি ২৮ জানুয়ারী, ২০১২
আসন্ন আশফাক শুধু ভাপা পিঠার জন্য এত দরদ!!!!!!!!!!! ভালো বেশ ভালো, আমার কাছে ভালো লেগেছে
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১২
সৌরভ শুভ (কৌশিক ) আজকে আমার মন খারাপ ,লেখাটিত নয়কো খারাপ /
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১২
Lutful Bari Panna "আমি আবার উদ্দেশ্যহীন হাঁটা শুরু করলাম। ফুটপাতে শুয়ে থাকা লোকগুলো শীতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। করুক। বেঁচে থাকতে হলে অনেক যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধ আছে বলেই বেঁচে থাকায় অনেক আনন্দ।"- এই শেষ লাইনের চমকগুলো...
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১২
Lutful Bari Panna লেখাটাকে প্রতিবারই অপঠিত রেখে যাই আবার পড়ব বলে। তাই বলে কমেন্ট করা হয়নি এটা ভাবিনি। স্বভাবসুলভ হিউমারের পাশাপাশি যেটা খুব ভাল লাগল..
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১২
সাজিদ খান ছোট গল্প হিসেবে দারুন হয়েছে । আসলেই আমাদের শৈশব কে বার বার মনে করিয়ে দেয় । দারুন লিখেছেন ।
ভালো লাগেনি ২০ জানুয়ারী, ২০১২
বিন আরফান. আবার এলাম, পাঠক আগের অবস্থানে. সবাই মুখ চিনে পড়ে. দারুন অগ্রগতি.
ভালো লাগেনি ২০ জানুয়ারী, ২০১২
বশির আহমেদ অতি শীতে ও ভাপাপিঠার কথা হলে নষ্টালজিয়ায় পেয়ে বসা স্বাভাবিক । মজিদ মিয়া কি করে বুঝবে লেখকের মন খারাপের কারণ । ধন্যবাদ লেখককে ।
ভালো লাগেনি ১৮ জানুয়ারী, ২০১২

১২ মে - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী