কয়েদি

কষ্ট (জুন ২০১১)

Md. Tanvir Ahmed
  • ১৬
  • 0
  • ৫৯
সাইরেনের তীক্ষ্ণ আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। আসামীর পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা চলছে, কিছুক্ষণ পর ফজরের আযান দিবে তার আগেই একছোট দৌড়া দৌড়ি হয়ে যাচ্ছে, এই জেলে আসার পর থেকে প্রায়ই শুনি এই আওয়াজ। সাইরেনের শব্দে আর চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুমের গুষ্টি সুদ্ধ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। চোখের পাতা আর লেপটে থাকতে পারলনা খোলে যাবার চেষ্টায় আছে। ঘুম জড়ানো চোখ, আধো আধো ভাবে খুলবার চেষ্টা করছি। আমি জানি এই চেষ্টা বৃথা। অন্ধকারের কারণে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আর পারবই বা কেমন করে অল্প কয়দিন হল আমাকে এই কক্ষে দেয়া হয়েছে, কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি, তবে পেরেছি যা তা'হল ছোট্ট একটা কক্ষ চারদিক থেকে তীব্র অন্ধকার ঘ্রাস করে রেখেছে, দিনের বেলায় ভাল করে কিছু দেখা যায় না আর রাত্রে আরো মহা বিপদ, মনে হয় রাতকানা হয়ে গেছি, হাতরিয়ে হাতরিয়ে চলতে হয় কিছুই করা নেই। লাইট পোষ্টে একটা ২৫ কি ৫০পাওয়ারের লাইট ছিল তাও আবার গত কয়েকদিন যাবত নষ্ট হয়ে পড়ে আছে, ঠিক করার নাম গন্ধও নেই কারোর। কক্ষে একটু জায়গা আছে শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস বের হবার আর প্রবেশের জন্য আর ঠিক মাথার উপর একটা চেপ্টা গুহা প্রায় ১০ফুট উপরে হবে। ঐ গুহা দিয়েই যা একটু আলো আসে, তাও না আসার মতই। তারপরওতো আলো আসে ঐযে ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে না ÒSomething Is The Batter Than Nothing” এরই বাস্তব উদাহরণ। গত ৮টি বছর ধরে এই জায়গায় পড়ে আছি। কক্ষ বদল হয় কিন্তু স্থান বদল হয় না। থাকতে থাকতে এখন এটাকে একটা অভিশপ্ত গুহা বলে মনে হয়। আমার সাথে অনেকেই এসেছিল এই গুহায় সবারই এক এক করে জামিন হয়ে গেল, ফাঁসি হয়ে গেল, কেউ বা আবার পালিয়ে গেল কিন্তু আমি আমিই রয়ে গেলাম, শুধু একটু পরিবর্তন হয়ে গেছি। দাঁড়ি, গোঁফ গুলো বড় হয়ে গেছে চেহারাটা পাল্টিয়ে একটা দাগি আসামির চেহারা বনে গেছে এ ছাড়া আর কিছুই নয়। কত কয়েদির সাথে কতজন দেখা করতে আসে কত কথা বলে কত পরামর্শ দেয় আর আমি, এই সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি কিছু বলতে পারি না। কি করে পারব আমার তো আর আপন কেহ নেই। তিন কূল আপন বলতে ছিল এক বৃদ্ধা মা। বছর খানিক পূর্বে মা এসেছিল আমাকে দেখতে, তারপর আর আসেন নি। কে জানে কি হয়েছে? হয়ত বার্ধক্যজনিত কারণ, নয়ত আসতে কষ্ট হয় বলে আসেন না নতুবা আমার উপর ঘৃণা জন্মেছে। আর যাই হোক মা আসেন না সেটা আরেকটা ভাল, মার কষ্ট সহ্য হয় না মা চলে গেলে নীরবে কাঁদি। আজকাল মার কথা মনে হলে এই কান্নাটুকুও আর আসে না। কি করে আসবে হয়ত কান্নার জন্য বাজেট কৃত পানি শেষ হয়ে গেছে। আমি সহসা কাঁদি না, কিন্তু মার কথা মনে হলে না কেঁদে থাকতে পারি না। আমাকে দেখার জন্য মা সেই সাঁঝ সকালে রওনা দিতেন আর আসতেন বিকালে বা দুপুরে। মা যখন আসতেন মায়ের মুখটার দিকে আমি তাকিয়ে থাকতাম। মা কথা বলতে পারেন না, শুধু হাতের ইশারায় সব বুঝাতে চাইতেন। মা রওনা দেবার সময়ও কিছু খায়নি এখনও কিছু খায়নি। মুখটা শুকিয়ে আছে। আমার ক্ষুধার্ত মা। একদিন মা দুপুরের তীক্ষ্ণ রৌদ্র দিয়ে এসে আমার কাছে একঢুক পানি চাইলেন। মায়ের মুখটা দেখে আমি আর থাকতে পারলাম না, দৌড়ে কক্ষের কলসের কাছে গেলাম। কিন্তু খোদা একি উপহার আমার জন্য তৈরি করে রেখেছেন। আমি ছেলে হয়ে মায়ের জন্য একফোঁটা পানির ব্যবস্থা করতে পারলাম না। ফিরে এলাম শূন্য হাতে, মা আমার দিকে দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে ছিল এক জিজ্ঞাসু এক কান্না এক ঝলক না পাওয়ার বেদনা। মা হাতের ইশারায় বুঝালেন উনি আসছেন। মা চলে গেল, বুড়ো শরীরটা নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হয় তারপরও নাড়ির টানে ছুটে আসেন তার ছেলেকে একটু দেখতে সঙ্গি একটা লাঠি। মা ফিরলেন কাররক্ষী সাহেবকে নিয়ে মা হাতের ইশারায় বুঝালেন আর আমি তা বলে সাহেবকে বুঝালাম তিনি পানির ব্যবস্থা করে দিলেন। মা তৃপ্তি সহকারে পান করলেন। সেবার মা আসার সময় হাতের পুটলিতে করে দুটো চিতই পিঠা নিয়ে এসেছিলেন। জিজ্ঞাস করাতে বলে ছিল পাশের বাসা থেকে দিয়েছে ছিল গতকাল। তুমি খেয়েছ মা হাত দিয়ে ইশারায় বুঝালেন খাননি। তার সন্তানের জন্য কাপড়ের আচঁলে বেধে নিয়ে এসেছেন। মা একটা পিঠা নিয়ে আমার মুখে তুলে দিতে চাইলেন, পারলেন না বাধা হয়ে দাঁড়াল লোহার ছোট ছোট শিকগুলি। মা শিকের নিচে দিয়ে ঠেলে দিলেন পিঠা, পিঠার নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখি মা কাঁদছেন। সন্তান জেলে কি খায় না খায় তাই নিজ হাতে খাওয়াবেন বলে আঁচলে করে পিঠা নিয়ে এলেন। কিন্তু হায় আফসোস মা'র সেই চাওয়াটাও পূরণ হল না।
হঠাৎ আবার সাইরেনের তীক্ষ্ন আওয়াজে মায়ের ভাবনাটা ভেঙ্গে গেল। ১ম বারের চেয়ে এবার সাইরেনের আওয়াজটা বিষণ খারাপ লাগছে, শব্দটা কানে দিয়ে প্রবেশ করে মাথার মগজটা কামড়ে ধরেছে, ঘাড়ের কাছে চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভব করলাম। মাথাটা আর কাজ করতে পারল না। একবার উঠতে চেষ্টা করে পরক্ষণে আবার শুয়ে পড়লাম, মাথাটা ব্যাথা করছে। আর কিছু মনে নেই।
যখন উঠলাম তখন শুনলাম কারারক্ষী ডাকাডাকি করছে খাবার দেবার জন্য। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলাম। খাওয়া, দাওয়া শেষ কিছুক্ষণ পর কারা অফিসার সাহেব আসলেন, হাতে নীল রংয়ের একটা ফাইল। দেখেই বুঝা যায় অনেক পুরুনো, এর আগেও কয়েকবার একে জনাবের হাতের তালুতে বন্দি অবস্থায় দেখেছি। কারারক্ষী আমার কক্ষের তালা খুলে দিল, দরজাটায় ধাক্কা পড়তেই একটা রুগ্ন ব্যাক্তিরমত আর্তনাত করে উঠল। বিশাল অথচ ছোট একটা লোহার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন কাচা-পাকা চুল দাড়িতে ভরপুর অফিসার। আমার জন্য বরাদ্দকৃত টিবিটায় বসলেন। অনেক কথা বললেন সাথে উপদেশও ফ্রি ঝাড়লেন লাভ হবে বলে মনে হয় না। যাক সে সব কথা কোন কথায় মাথায় ঢুকলনা হঠাৎ শেষের একটা কথা আমার কথা শুনার প্রতি আগ্রহটা প্রবল করে তুলল। আজ তোমার সাথে মানবাধিকারের চেয়ারম্যান সাহেব দেখা করতে আসবেন। পান খাওয়া ঠোটগুলোকে যতটুকু পারা গেল ছড়িয়ে একটা মিষ্টি হাসি হাসলেন, পুলিশ যে এমন সুন্দর করে হাসতে পারে তা আমি জানতাম না। প্রশ্ন করার বোধ হারিয়ে ফেলেছি। কেন আসছে? কি কারণে আসছে? কে তাদের খবর দিল? কেন দিল? ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন মনের একাউন্টে জমা হতে থাকল। কিন্তু আমি বলতে পারলাম না। এতদিন কোন মানুষের সাথে কথা না বলতে বলতে হয়ত কিভাবে কথা বলে তাও হারিয়ে ফেলেছি। আমার চোখের চাউনি দেখে অফিসার কি আন্দাজ করলেন জানি না, শুধু এতটুকু জানি তিনি হয়ত আমার দিকে পরমুহুর্তে একবারও তাকান নি, আর তাকালেও কিছু করার নেই তার চোখ এখন ফাইলটা খোলে কি যেন খুজছে।
আবার চলে গেলেন তিনি। একই ভাবে দরজাটা আবার আর্তনাদ করে উঠল। আবার আমি একা।
কে খবর দিল তাদের? মা নাকি। না মা পারবেন না, যদি পারতেন তাহলে আরো আগেই তিনি তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য কিছু একটা করতেন। তাহলে কে করল? কার এত মহৎপ্রাণ আমার জন্য। জেলার সাহেব না তো। হতেও পারে তার মত এমন একটা ভাল মানুষের পক্ষে ভাল যেকোন কাজ করা সম্ভব। সেবার'ত তিনি নিজে উকিল ডেকে আমার পক্ষে কোটে লড়ার জন্য আমাকে প্রস্তাব দিলেন। আমি শুধু একটু হে বললেই হত। কিন্তু কেন যেন তখন তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম মনে করতে পরছিনা।
কক্ষটার দিকে তাকালাম, মাকড়সার আশ ঝুলে আছে, একপ্রান্তে মাটির কলসিটা তার উপর ঢাকনা দিয়ে একটা মগ রাখা। বিছানা বলতে ঐ টিবিটা আর এই ছেড়া তেল চিটচিটে চাদরটা। পোশাক যা আছে তাতে চলবে। ৪২৮নাম্বার সিল সম্বলিত সাদা-কালো ডোরাকাটা জেলীপোশাক, মাথায়ও একই ডোরাকাটা টুপি আর গাড় হতে দু-পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত লোহার বেরী তাতে শিকলও আছে, হাটলে মনে হয় আওয়াজে দুনিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। গত ৮বছরের মধ্যে বেরী পড়ে আছি ৫বছর। ১ম যখন এসেছিলাম তখন শুধু পোশাকাটা ছিল।
আবার দরজায় ধাক্কা পড়ল, চোখা জোড়াকে ডানদিকে ঘুরাতেই দেখি জেলার সাহেব ঢুকছেন পিছনে দরজা ঠেলে আরেকজন ঢুকলেন মোটা ফ্রেমের কাচের তৈরী একটা চশমা নাকের ডগায় ঝুলছে। প্যান্ট শার্ট আছে তবে কোট নামের তোশকটা নেই। অনেককেই দেখি গরমের সময়ও এটা লাগিয়ে দিবি্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে। কি যে আনন্দ লাগে তাদের, আমার দেখলেই ঘাম ঝড়তে শুরু করে। চোয়াল জোড়া বসে গেছে, চুল দাড়িতে একাকার হয়ে আছেন। দেখলেই বুঝা যায় যুবক বয়সে কতটুকু খাটাশ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। জোতা জোড়া দেখলে মনে হয় ছোটকালের। জেলার সাহেব পরিচয় করে দিলেন। ইনি হচ্ছেন মানবাধিকার চেয়ারম্যান ডঃ মোখলেছুর রহমান পিশু। পিশু শুনেই আমার হিশু ধরে গেছে। ছিঃ এমন নাম কারো হয়, যতসব উৎভট বিশ্রী লোকদের সাথে জেলার সাহেবের পরিচয়। মানুষ না একটা জন্তু দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। মোটা কন্ঠ ফ্যাস ফ্যাস করে কথা বলে উঠল জীবটা। কী নাম তোমার? মোঃ ইয়াসিন ইমরান। দেখলাম নাম বলাতে তার চোখের পাতার জোড়া সরু হয়ে এল। দৃষ্টি এখন পুরুপুরি আমার উপর। আবার বলে উঠল জীবটা।
কিন্তু ফাইলে যে নাম দেখলাম মোঃ ইয়াসিন এমরান।
বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল ফাইলে নাম দেখলে আবার আমাকে জিজ্ঞাসা করিস কেন বেটা খাটাশ। কিন্তু না পরলাম না কোন উত্তর দিতে, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তার দাড়ি ভরা মুখের উপর চেয়ে থাকলাম। চোখের পানে তাকতেই বুঝলাম সে আমার মাঝে কি যেন একটা খুজছে। আমি আর কিছু বললাম না শুধু তার একের পর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেলাম। প্রায় ১ঘন্টা পর জেলার সাহেব আর জীবটা বেরিয়ে গেল সাথে একটা উকিলও কথার ফাঁকে উকিল মিয়াও এসেছিল, যিনি আমার মামলা নিয়ে আদালতে লড়বেন। তাকে নাকি আগেই খবর দেয়া হয়েছিল। যানজটের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে দেরী হওয়ায় ক্ষমা চাইল সবার কাছে।
পরদিন আমাকে আদালতে নেয়া হবে। এইবার যদি আমার মামলাটা মিথ্যা প্রমাণিত হয় আর কি। ছাড়া পেয়ে মুক্ত মনে নিজের গায়ে ফিরে যাব। মায়ের খবর নিতে হবে আগে, কেমন আছে আমার গর্ভধারিনি। কষ্টত আর কম করলেন না। বিয়ে করে এসে বাবার সংসারে কয়েকটা দিন ভালই কাটল তারপর শুরু হল আগুন, এরি মধ্যে আমার জন্ম। জন্মের ৮বছর পর বাবা ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকে পাড়ি জমালেন। বাবা সামান্য কুলি মজুর ছিলেন। অন্যের ক্ষেতে শ্রমিকের কাজ করতেন। দিন যা পেতেন তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হলেও তার মদ্যপানটা ছিল সবার আগে। বাজারেই এর সব রকমের বন্দোবস্ত ছিল। দিনে কাজ করতেন আর রাতে মদ খেয়ে বাড়ি যেতেন। মা কিছু বলতেন না, শুধু নিরবে কাঁদতেন। বাবা মদ্যপায়ী হলেও স্বভাব মোটামেটি ভাল ছিল। অন্যসব মদ্যপায়ীর মত বাবা মাকে মারধর করতেন না। চুপচাপ আসতেন নিজের জন্য নির্ধারিত স্থায়ে শুয়ে যেতেন। কোন রকম উচ্চবাচ্য করতেন না, কোন রকম মাতলামিও না। আমার বয়স তখন ৮, হঠাৎ বাবাকে দেখলাম মাটিতে পড়ে জবাই করা মুরগির মত ছটফট করছেন। মা এদিক সেদিক ছুটছেন গায়ের সবাই এল কিন্তু ততক্ষণে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বাবার বুকের উপর পড়ে মা বোবা কান্না কাদলেন, লাভ হলনা সন্ধ্যায় লোকেরা কাধে তোলে নিয়ে মাটি চাপা দিয়ে আসল।
আমার ব্যাপারটা আলাদা রাত্রে মাতবরের বাড়ি গেলাম কাজের জন্য যিনি কাজ দেবার দায়িত্বে থাকেন তার সাথে বসে ঘন্টা খানেক আলাপ করলাম কাজের ব্যপারে, কাজ পেয়ে ফিরে যাই। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি পুলিশ আমাকে নেবার জন্য প্রস্তুত। আমার বৃদ্ধা মা অনেক অনুনয় করলেন, লাভ হল না। পুলিশরা বোবা মানুষের ভাষা বুঝে না। কেন নিচ্ছে, কি কারণে নিচ্ছে তাও জানি না। যেতে বলেছে যাচ্ছি। ২য় দিন যখন কাঠগড়ায় দাঁড়ালাম তখন শুনলাম আমি না কি ম্যানেজারকে খুন করেছি। আমার হাতেই নাকি তিনি খুন হয়েছেন। কত গলা ফাটিয়ে বললাম, চিৎকার করলাম কেউ কথা কানে তুলল না, আমার পক্ষে কোন উকিল না থাকায় কাজ হল না। এরপর থেকে আজ অবদি কোন উকিলের চেহারা কেমন বলতে পারি না। আদালত আমাকে ৩০বছর স্ব-শ্রম কারাদন্ড দিয়েছে আর সেই থেকে আজ অবধি আমি এখানে।
যাক দেখি এবার কিছু হয় নাকি।
পরদিন সকাল ১০.০০টা আমাকে একটা ভ্যানে করে আদালত প্রাঙ্গনে নেওয়া হল। বসানো হল সেল হোমে। ১০বেজে ১৫মিনিটে আমাকে ডাকা হবে। ইতি মধ্যে উকিল সহ চেয়ারম্যান সাহেব জেলার সাহেব আমার সাথে দেখা করেছেন। শুধু আমি নই এই সেল হোমে আরো অনেক অপরাধী। দেখে কাউকে পরিচিত বলে মনে হল না। চুপচাপ বসে আছি। নীরবে মিনিট গুলি পার হচ্ছে।
অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ এল আমার ডাক । সেল হোম থেকে আমাকে হাঁটিয়ে নেওয়া হচ্ছে, পেছনে সামনে রক্ষী বাহিনীর অভাব নেই। মনে হচ্ছে কোন রাজা রাজ্য শাসনে বের হয়েছে। চারদিক ঝনঝন শব্দে মাতিয়ে অবশেষে এসে হাজির হলাম কাঠগড়ায়। হাকিম সাহেব আগে থেকেই হাজির। কাঠের হাতুরি দিয়ে টেবিলে আঘাত করে সবাইকে শান্ত করে উকিলদের ঝগড়া করার অনুমতি দিলেন।
দীর্ঘ ২ঘন্টা এই তর্কবিতর্ক চলছে। স্বাক্ষী আসে স্বাক্ষী যায়, উকিল সাহেব প্রশ্ন করেন তার উত্তর দেই। মাঝে মাঝে উকিলের কথা শুনে আদালতে খানিকটা গুঞ্জনে ভরে উঠে হাকিম সাহেব হাতুরী ঠুকে সবাইকে শান্ত থাকার নির্দেশ দেন, আদালতখানা আবার শান্ত হয়। এই ভাবে চলল বিরতী পর্যন্ত। হাকিব সাহেব হুকুম দিলেন বিরতীর পর রায় শোনানো হবে। আমাকে আবার সেল হোমে রাখা হল। ১ম এসে যেমন মানুষ দেখলাম তার ছিটেফোটাও এখন নেই। কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই বিদায়। আমার জন্য খাবার আনা হল। খাওয়া শেষে জেলার সাহেব এলেন। এইবার তিনি কিছু বলার আগে আমিই মুখ খুললাম। আমার ব্যাপারে এতকিছু কে জানাল উকিলকে? জেলার সাহেব আবার সেই হাসিটা উপহার দিয়ে বললেন "কাল তোমার ওখান থেকে বের হয়ে মানবাধিকার সংগঠন তোমার এলাকায় গিয়ে সব খবরা-খবর নিয়ে এসেছে আর আমিও কিছু সাহায্য করেছি", উত্তরটা শুনে আর কিছু বলতে পারলাম না। জেলার সাহেব আমাকে আশ্বাস দিলেন, এবার মনে হয় "বোঝলে বাচাধন তুমি ছাড়া পেয়ে যাবে", আমরা আর তোমাকে রাখছি না। বলেই হা হা করে হাসলেন। ভাল মানুষেরা এমনই হয়। কারো ভাল করতে পারলে তারা আনন্দ পায়, জেলার সাহেবও তেমনি মানুষ। তার হাসির মাঝে হঠাৎ আমি বললাম, মা কেমন আছে কিছু জানেন? প্রশ্নটা করতেই জেলার সাহেবের মুখ থেকে হাসিটা উড়ে গেল, বোঝলাম তিনি কিছু আমার কাছে লুকাচ্ছেন। কিছুক্ষন আগে যেই চেহারাটায় মুক্তি করার আনন্দে আন্দলিত ছিল তা এখন মেঘে ঢাকা আকাশের মত গোমরা হয়ে গেছে, মাথা নিচু করে শুধু একটা কথাই বললেন "তুমি নিজে গিয়ে দেখ"। এখন চল আদালতের সময় হয়ে গেছে।
দীর্ঘ ৩০মিনিট পর আবার হাকিম সাহেব আসলেন। এবার রায় শুনানোর পালা। হাকিম সাহেব পড়ছেন তার নিজ হস্ত দ্বারা লিখিত আদেশ নামা। সারা আদালত তার দিকে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণের জন্য একটা থমথমে ভাব বিরাজ করা শুরু হল। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না, হাকিম সাহেব পড়ছেন আর অন্যেরা মনযোগ সহকারে তা শ্রবণ করছে।
"সমস্ত স্বাক্ষী প্রমাণের উপর ভিত্তি করে আদালত এই মর্মে উপনিত হয়েছে যে, আসামি মোঃ ইয়াসিন ইমরান সম্পূর্ণ নিদোর্ষ ও নিরাপরাধ। তার উপর আনিত অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হওয়ায় এই আদালত তাকে বেকুসুর খালাস প্রদান করছে এবং এই আদালত আদেশ দিচ্ছে প্রকৃত খুনিকে আইনের কাঠগড়ায় এনে শস্তি প্রদান করতে।" হাকিম সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন, অন্যেরাও গুজন করতে বেরিয়ে যাচ্ছে।
আমি যতটানা খুশি হয়েছি তার চেয়ে বেশি খুশি চেয়ারম্যান, উকিল আর জেলার সাহেব। আমি চেয়ারম্যানের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম, এই জন্তুটা হাসতেও পারে তাও এতসুন্দর করে।
বাহিরে আসলাম, এখন শুধু আমার সাথে জেলার সাহেব। চেয়ারম্যান আর উকিল অনেক আগেই হাত মিলিয়ে বের হয়ে গেছেন। চোখ খুলে আকাশটার দিকে তাকালাম। আজ কত বৎসর আকাশটা দেখি না, তার রং কেমন তাও ভুলতে বসেছি। আদালতের বাহিরে হইহট্টগোল চলছে, কিন্তু আমার থেকে মনে হচ্ছে মুক্ত পাওয়ার আনন্দে সবাই আমাকে স্বাগতম জানাচ্ছে। স্বাগতম জানাচ্ছে পৃথিবী, ১টা নিরাপরাধ লোক খাচায় আটকা থাকুক এটা পৃথিবীও চায় না। এক ঝাক জালালি কবুতর ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে আর যেন বলে স্বাগতম হে মানব সন্তুান, তোমাকে স্বাগতম। অপলক দৃষ্টিতে সবকিছু মুগ্ধ হয়ে দেখছি। মৃদু বাতাস ছুয়ে গেল আমার এই দেহ, যেন আমাকে স্নান করিয়ে সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা দূর থেকে দূরে বহুদূরে ফেলে দেবে। এরই মাঝে শরীরে একটা ঝাকুনি অনুভব করলাম।
কি ব্যাপার চল।
জেলার সাহেবের কথায় আমি ফিরে এলাম কল্পনা জগত থেকে। তাকে কি প্রশ্ন করব ভেবে পাচ্ছি না, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। আজব একটা মানুষ। সারাক্ষণ পান খায়। মনে হয় ভাত না পান'ই তার প্রধান খাদ্য। হাসিখুশি মুখ, জেলার সাহেবদের যেমন মেজাজ থাকে তার তেমন নেই। মনটা মনে হয় খুব ভাল, মাটির মানুষ। আজকের এই কতৃজ্ঞা তাকে জানানোর ভাষা আমার নেই, শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসতে চায়।
আমাকে নিয়ে আবার জিপে উঠলেন, চাবি ঘুরাতেই ইঞ্জিনটা জ্যান্ত হয়ে গাড়ি চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা। কিছু বোঝে উঠার আগেই গাড়ির ব্রেক কষলেন, গাড়ী থামল একটা পান দোকানের সামনে। দোকানে দোকানী সহ খদ্দের অনেক সবাই বসে কিছু না কিছু খাচ্ছে, কেউ চা, কেউ সিগারেট আবার কেউ জেলার সাহেবের মত পান চিবুচ্ছে। জেলার সাহেবকে দেখেই দোকানী সালাম ঠুকে বেরিয়ে এল। হাতে একটা পান। বোঝা গেল এই দোকানে তিনি এই ১ম'ই নন, আরও বহুবার এসেছেন।
গাড়ী আবার চলতে শুরু করল। এবার চলছে জোরে।
বুঝলে ইয়াসিন। জেলার সাহেবের মুখে নিজের নাম শুনে শুধু অবাকই হয় নি রিতিমত যেন আকাশ থেকে পড়লাম!
এই পৃথীবিতে ভাল মানুষ যেমন আছে খারাপ মানুষ তেমনই আছে। ভাল যারা তারা সর্বদা ভাল করার চেষ্টা করে। আর যারা খারাপ তারা ভাল কাজের কথা বলে খারাপ করে, এতে ভাল কাজগুলি দূষিত হয়। মানুষ কে ধোকা দেবার জন্য ভাল কাজের কথা বলে। একটু থেমে,
বুঝতে পারছ আমি কি বলছি।
হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম।
গাড়ীতে আর কোন কথা হল না। গাড়ী থেকে নেমে পোশাক পরিবর্তন করলাম। বেরি আগেই খোলে নেয়া হয়েছে বাকি ছিল সাদা-কালো জার্সি।
আরও কিছু উপদেশ ঝেড়ে হাতে ৫০০টাকা গুজে জেলার সাহেব আমাকে মুক্তি দিলেন।
পোশাক গুলোর দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন করে উঠল। লুঙ্গি আর একটা পাঞ্জাবী সাথে গামছাও আছে শুধু ছিল না জুতা। কিন্তু আমার সময় জেলার সাহেব জুতো জোড়া টাকার সাথে উপহার দিলেন।
আহারে সব মানুষ যদি তার মত ভাল হত। বাহিরে এসে জোরে একটা শ্বাস টান দিলাম। ফুসফুসটা ভরে গেল ঠান্ডা মুক্ত বাতাসে। বদ্য গুহায় থেকে থেকে ফুসফুসটা পঁচতে বসেছিল। মনটা আনন্দে ভরে গেল। গ্রামে যাব আবার মা'র সাথে দেখা হবে। মা' কে মা বলে কতদিন ডাকিনা। মা হয়ত তার ছেলের এই জেলে থেকে ছাড়া পাবার খবর বিস্ময় ভরে দেখবেন, দেখবেন তার আদরের ছেলে ফিরে এসেছে। কি করবে মা? বুকে জড়িয়ে নেবে, নাকি ছোট বেলার মত শাসন করবে।
কেন এত বড় হয়েছি, তবু ভাল মন্দ শিখতে পালাম না?
না'কি
আয় বাবা আমার বুকে আয় বলে মা আমাকে বুকে নিবেন।
চোখ বন্ধ করে যেন মায়ের হাতের ইশারা দেখতে পাচ্ছি। মা কথা বলতে পারে না, তবু যেন তিনি বলছেন। বাবা আয় বাবা আয়। আমার শূন্য বুকটা তোকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। বাবা আয় বাবা আয়। কতদিন তোকে আদর করি না, বকি না। তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়...............
স্যার চা খাইবেন চা।
মায়া ভরা কন্ঠে কে ডাকল দেখার জন্য চোখ খুললাম।
ছেলেটা আবার ডাকল। স্যার চা খাইবেন চা। গরম চা লেবু দেয়া।
না, আমি চা খাব না।
বলতেই ছেলেটা মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। আর কোন প্রশ্ন করল না।
যখন গ্রামে ফিরলাম তখন সূর্যটা হলুদ হয়ে আসতে শুরু করেছে। ক্ষেতের আইলে পা দিতেই সবুজ ধানের পড়ন্ত বিকেলের ছুটন্ত বাতাস এসে গায়ে দোলা দিল। প্রাণটা জুড়িয়ে গেল, অবলিলায় যেন মুহাম্মদ (সঃ) এর সেই বাণীটি বেরিয়ে আসতে চায় "হে আমার জন্মভূমি,আমার গোত্রীয় লোকেরা যদি আমার বিরুদ্ধে শত্রুতা না করত তা হলে আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না"। হাটা শুরু করলাম আইল ধরে। পায়ের নিচে সবুজ ঘাস, সামনে হলুদ আবায় আলোকিত দিগন্ত তারপরই আমার ছোট্ট কুড়ে ঘর, যেখানে আমি আর মা মিলে বসবাস করতাম। ভাবছি আর হাটছি। মা কি আমার পথ চেয়ে বসে আছে, না কি আমি আসব তা জানেনা। মা' কে একটা বিস্ময় দেখানো যাবে। তার কলিজার টুকরা ৮বছর পর ফিরে এসেছে।
৮বছর পর এলাম মনে হচ্ছে কতযুগ পর এলাম। মা মাতৃভূমিকে ছেড়ে যেন কত কাল পড়ে রইলাম প্রবাসে।
গ্রামে ঢুকতেই মাষ্টার সাহেবের সাথে দেখা।
আরে ইয়াসিন না।
মৌমাছির মাথার মত একফোটা অশ্রু টলমল করতে লাগল স্যারের চোখের কোণে।
নুয়ে সালাম করতে যাব, স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিলালেন।
বাবা, কতদিন তোমারে দেখি না। আমার সেরা ছাত্র ছিলা তুমি। আমি প্রথমে যখন তোমার খুনের কথা হুনলাম আমারতো বিশ্বাসই হয় নাই, আমি জানি তুমি এই কাম করতে পার না।
বলতে বলতে স্যারের গলা ধরে এল। তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না।
স্যার, আমার মা কেমন আছে?
মা'র কথা জিজ্ঞাসা করতেই জেলার সাহেবের মত মাথা নিচু করে নিলেন স্যার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।
বাবা গ্রামে আইচ নিজে গিয়া দেখা কর মার সাথে। বলেই স্যার আর এক মুহুর্ত দাড়ালেন না। চোখ মুছতে মুছতে মাথাটা আগের মতই রেখে চলে গেলেন। পথের পাশে একটু বাক নিয়েই হারিয়ে গেলেন অন্যপাশে। ক্ষণিকটা তাকিয়ে থেকে বাড়ির দিকে হাটা ধরলাম।
মা, মা।
বাড়িতে পৌছে গেছি। কিন্তু মায়ের কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। এক পলকের জন্য বাড়িটাতে চোখ বুলিয়ে নিলাম। ভেঙ্গে গেছে রান্নাঘর। থাকার ঘরের অর্ধেকটাও ধসে পড়তে চাইছে। এবার কালবৈশাখি আসলে আর রক্ষা করা যাবে না বাড়িটাকে। বাড়িটা বন জঙ্গলের মত হয়ে আছে। কিন্তু মা কোথায়। ঘরে ঢুকলাম পেলাম না মাকে, শুধু দেখলাম বেড়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত মায়ের একটা কাপড়, বাতাসে হালকা ভাবে ক্ষণিক পর পর দোল খাচ্ছে। কবে বা কখন যে মা শুকাতে দিয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই। বিছানাটা কখন বিছানো তা জানি না, তবে অনুমান করতে পারি বিছানো হয়েছিল অনেক আগে। ঘরের এক কোণে কয়েকটা থালা-বাসন আর একটা মাটির কলসি। উপর হয়ে পড়ে আছে, পানিটা বহু আগেই চুষে নিয়েছে মাটি। এর চিহ্ন মাত্র নেই। বেরিয়ে এলাম। ডাকাডাকি শুনে পাশের বাসার এক বৃদ্ধা আসলেন। চিনি তাকে, খালা বলে ডাকতাম। বৃদ্ধা আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। কে? দীর্ঘ একটা ক্ষণ আমার মুখের পানে চেয়ে আছেন। চাহনি দেখে বুঝা যায় কিছু একটু খুজছেন আমার মাঝে। কে? ইমরান, গলা ধরে এল বৃদ্ধার।
কোন কিছু বলার আগেই বৃদ্ধা আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
জোর করে ধরে ছাড়ালাম তাকে। মুখ পানে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
খালা, আমার মা কোথায়?
কান্না থামিয়ে আবাক চাহনিতে তাকিয়ে আছে বৃদ্ধা আমার দিকে।
কি হল খালা, আমার মা কোথায়?
২য় বার কথাটা বলাতে যেন তার বোধ শক্তি ফিরে এসেছে, কিন্তু চাহনিটা ঠিক রেখে গোরস্থানের দিকে হাত তাক করলেন।
ওদিকে তাকিয়ে বুকটা যেন জ্বালা করে উঠল। বৃদ্ধা হাত ধরে টেনে নিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
কবরটা শুকিয়ে গেছে বটে কিন্তু মাটির স্তুপটা তেমনি আছে। পাশে গিয়ে বসলাম। হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম।
সমস্ত পৃথিবী যেন আমার দিকে ভেঙ্গে পড়তে আরম্ভ করেছে। হৃৎপিন্ডের ধাক্কাটা আর সইতে পারছিনা। ছিড়ে বেরিয়ে যাবে। মুক্ত আকাশে তাকালাম। সব দিক নিরব, কোন সাড়াশব্দ নেই। হালকা বাতাসে বাশ বনের খসে পড়া পাতার আওয়াজ পেলাম।
মন আর মানছে না, হু হু করে কাঁদতে চাইছে চিৎকার করে জগৎ সংসারকে জানিয়ে দিতে চাইছে মা আমার নেই, নেই মা আমার। কাঁদতে পারলাম না, কারণ মনটা যে কাঁদতে ভুলে গেছে। যেই মা বাবা মারা যাবার পর কষ্ট করে লালন পালন করেছে। ভিক্ষা করে ধার করে আমাকে খাবার দিয়েছে কিন্তু আমি এমনই ছেলে যে কি না মায়ের জন্য ২ফোটা অশ্রুও ফেলতে পারলাম না।ছিঃ ছিঃ, ধিক্কার, শত ধিক্কার। পাষন্ড নরপশু হয়ে গেছি আমি। আমি পারলাম না, পরলাম না মাকে আর জড়িয়ে ধরে মা বলে ডাকতে। মা আমাকে একা রেখে গেছেন। ছেড়ে চলে গেছে দূর থেকে দূরে বহু দূরে। আমি একা রয়ে গেলাম এই পৃথিবীতে। আকাশের পানে চেয়ে আছি। মা তার হাতটা রাখল আমার ঘাড়ে আলতু করে যেন দুঃখ ভুলানোর জন্য ডাকচ্ছে। ঘাড়টা ফেরাতেই চোখে পড়ল খালার মুখটা।
বাবা, মনটা শক্ত কর। মা মরছে তো কি হইছে আমরাতো আছি। আস। মুখটাতো একদম শুকায়া গেছে ক'ডা খাইয়া লও।
এই বৃদ্ধা হয়ত জানে না আমার ক্ষিধা বলতে যা ছিল তা ক্ষণকাল আগেই মারা গেছে। বেঁচে আছে এই দেহটা, মনটাতো পাথর তাই কাঁদতে পারলাম না।
দাঁড়ালাম বৃদ্ধার কাছ থেকে একটু দূরে। অপ্রস্তুত হয়েই বলালাম...........
খালা আমি আসি।
বৃদ্ধা আশ্চার্যের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমি সেই দিকে একবার মুখ তোলে উল্টো পথে হাটা ধরলাম। বৃদ্ধা কিছু বলতে পারলেন না, শুধু আমার গন্তব্য পানে তকিয়ে আছেন। যেমন ভাবে তাকিয়ে ছিলেন আমার মা। পুলিশ আমাকে হাতকড়া পরিয়ে নেবার সময় মা'ও একইভাবে তাকিয়ে ছিলেন। শুধু পার্থক্য হল মায়ের চোখে অশ্রু ছিল আর বৃদ্ধার চোখ অশ্রুসিক্ত।
আমি থামলাম একবারের জন্য পশ্চিম পানে একটু চাইলাম, যেই সূর্যটা সারাটাক্ষণ তুমুল দাপটের সাথে সমস্ত পৃথিবীটাকে তাপের শাসন করে এসেছে সেই সূর্যটা এখন নিস্তেজ হয়ে ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে। আমি হাটছি পেছন থেকে মা যেন ডেকে বলছেন "খোকা ফিরে যাচ্ছিস যা, আর আসিস না এই নরক পুরীতে। যেখানে একটা বৃদ্ধ মায়ের আর্তনাতের কোন মূল্য নেই। যা বাবা হারিয়ে যা ভাল মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যা। আর আসিস না আসিস না।"
আবার আমি দাঁড়ালাম, পেছন পানে আরেকটিবার তাকালাম। বৃদ্ধা নেই চলে গেছেন কখন কে জানে? শুধু দেখা যাচ্ছে গোরস্থানটা আর আমার মায়ের সমাদিটা। দূর থেকে সবছোট দেখছি কেন জানি মনে হচ্ছে মায়ের কবরটা অকারণেই হঠাৎ বড় হয়ে গেল।
আবার আমি ফিরলাম আমার চলার পথের পানে, একঝাক পাখি ঝাক বেধে উড়ে চলে গেল দিগন্তে বাসার খোজে। হাটছি, আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে সূর্যটা বাড়ি ফিরল, আমি কয়েদি হেটে চলছি এবার দ্রুত গতিতে, কোথায় যাচ্ছি জানি না। হাটার ছন্দে বালু গুলি মহানন্দে খানিকটা উড়াউড়ি করে নিয়ে আবার চুপ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আধাঁর ঘনিয়ে আসছে, নিরব হয়ে আসছে পৃথিবী, সব্ধ হয়ে গেছে সব, থেমে গেছে প্রকৃতির কোলাহল শুধু থামেনি কয়েদির উদ্দেশ্যহীন পথচলা।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এম এম এস শাহরিয়ার খুবই কষ্টের লিখা .......................
আহমেদ সাবের একটা চমৎকার বিষয় নিয়ে খুব যত্ন করে লেখা হয়েছে গল্পটা। পৃথিবীর যে কোন দেশেই অন্যায় ভাবে সাজা পাওয়া লোকের সংখ্যা কম নয়। মানবাধিকার কর্মীর উপর ইয়াসিনের ক্ষোভের কারনটা ঠিক বুঝা গেলো না। “মানবাধিকার চেয়ারম্যান ডঃ মোখলেছুর রহমান পিশু। পিশু শুনেই আমার হিশু ধরে গেছে। ছিঃ এমন নাম কারো হয়, যতসব উৎভট বিশ্রী লোকদের সাথে জেলার সাহেবের পরিচয়। মানুষ না একটা জন্তু দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।“ - যেখানে তিনি এসেছেন ইয়াসিনকে সাহায্য করতে।
উপকুল দেহলভি আবার আমি ফিরলাম আমার চলার পথের পানে, একঝাক পাখি ঝাক বেধে উড়ে চলে গেল দিগন্তে বাসার খোজে। হাটছি, আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে সূর্যটা বাড়ি ফিরল, আমি কয়েদি হেটে চলছি এবার দ্রুত গতিতে, কোথায় যাচ্ছি জানি না। হাটার ছন্দে বালু গুলি মহানন্দে খানিকটা উড়াউড়ি করে নিয়ে আবার চুপ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আধাঁর ঘনিয়ে আসছে, নিরব হয়ে আসছে পৃথিবী, সব্ধ হয়ে গেছে সব, থেমে গেছে প্রকৃতির কোলাহল শুধু থামেনি কয়েদির উদ্দেশ্যহীন পথচলা। অসাধারণ, ভোট দিতেই হলো, ভোট চিনিয়ে নিল খুব ভালো লাগলো
omor siddique কাহিনীটা চমত্কার । লেখার হাতও বেশ ভালো । সব মিলিয়ে অসাধারণ ।
মিজানুর রহমান রানা ধীরে ধীরে আধাঁর ঘনিয়ে আসছে, নিরব হয়ে আসছে পৃথিবী, সব্ধ হয়ে গেছে সব, থেমে গেছে প্রকৃতির কোলাহল শুধু থামেনি কয়েদির উদ্দেশ্যহীন পথচলা।-----খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
খোরশেদুল আলম কয়েদির জীবণ, অনেকের জীবণের ঘটনাই এই গল্পের সাথে মিলেযায়, পত্রকায় পওয়াযায় ঠিক এমনি একটি বিষয় নিয়ে লেখা গল্পটা ভালো হয়েছে। শুভকামানা লেখকের জন্য।
Md. Tanvir Ahmed পড়ুন আর মন্তব্য করুন। ভালই লাগে আমার বন্ধুদের মন্তব্য পড়তে। সবাইকে আবারো আমার গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানাই।
sakil গল্প পড়তে পড়তে মুগ্ধ হয়ে গেলাম . কিছুদিন আগে এমন একটা ঘটনার খবর পত্রিকায় দেখেছিলাম . ভালো laglo . এমন ekti golper jonno লেখক ধন্যবাদ পাবার যোগ্য
Md. Tanvir Ahmed আমার গল্প পড়ার জন্য আমার সকল বন্ধুদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

২৬ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪