সোনার বল

রাত (মে ২০১৪)

হোসেন মোশাররফ
  • ৪৫
এমন একটা দিন ছিল যখন ছিল না কোন দুঃখ, ভয় কিংবা অশান্তি। মানুষের মধ্যে ছিল না কোন মিথ্যা অহংকার। মানুষ মানুষের ভালটাই চাইত। কেউ কখনো ভুলেও কারো কুৎসা কারও কাছে বলেছে এমনটা কেউ কখনো শোনেনি। মানুষ তখন কেবল হিংস্র বন্য প্রাণীকেই শুধু ভয় পেত।
এখান থেকে অনেক দূরে.. .. ..সাত সমুদ্দুর আর তের নদীর ওপারে এক দেশ। যে দেশের কথা কেউ কখনো শোনেনি। সে দেশের মানুষ গুলো ছিল সাদা মনের। দেশটাও দেখতে ছিল ভারি সুন্দর। চারদিকে পাহাড় ঘেরা আর ছোট ছোট গুল্ম জংলি ফুলে ভরা ছিল সে দেশের মাঠ প্রান্তর। গাছের ফলই ছিল তাদের প্রধান খাদ্য।
আর ছিল নদীর মিষ্টি পানির মাছ। নদীর মাছ ধরা আর বনের ফল আহরণ করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। এভাবে তাদের দিনগুলো সুখেই কেটে যেত আরও অনেক দিন। কিন্তু কে জানতো মানুষের সুখ বেশিদিন কপালে সয় না। কথায় আছে ভাল দিন যায় আর মন্দ দিন আসে।
একবার সেই গ্রামের উপর দিয়ে এক শয়তান উড়ে যাচ্ছিল। সে নিচে যখন তাকিয়ে দেখল তখন তার ভীষণ হিংসা হল সেই দেশের মানুষের সুখ দেখে। সে তখন মনে মনে ভাবল একবার যদি এখানে মানুষের মধ্যে হিংসা আর অহংকার ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলেই তার উদ্দেশ্য সফল হয়। তারপর সে আর দেরি করল না সাথে সাথে তার গতি পরিবর্তন করে নিচে নেমে এল। আর নিচে এসেই সে পূর্ণাঙ্গ মানুষের রূপ ধারণ করল। তারপর ইয়া বড় এক গাছের নিচে সাধু সেজে বসে রইল।

দেশের মানুষ সহজ সরল। তারা কখনো শয়তান দেখেনি। আর শয়তান যে দেখেনি সে তার কৌশলও জানে না। শয়তানও এমন মানুষই মনে মনে খুঁজছিল অনেকদিন থেকে। সেই দেশের সহজ সরল মানুষগুলো যখন তার চারদিকে ভিড় করছিল। তখন সে মনে মনে বলতে লাগল,
‘এই তোরা কাছে আয়, ধরে ধরে কলজে চিবাই
আর যদি ভাল চাস, দূর হ্ সব আমিও পালাই। ’

কিন্তু লোকেরা তার হাতে বড় এক মালার মতো তজবি দেখে আর তা গুণতে দেখে ভাবল সাধু লোকটা নিশ্চয় খুব খোদা ভক্ত। আর সে মালা টিপে টিপে খোদার নামই জপছে। যা ভাবা তাই কাজ। দলে দলে লোক ছুটে আসতে লাগল তার কাছে। আসলে মনে মনে সে যা বলছে তা যদি কেউ জানতো, তাহলে আর কেউ কাছেও ভিড়তো না তার। মানুষ যা ভাবে তাই যদি সত্যি হতো তাহলে শয়তানের শয়তানি আর চলতো না পৃথিবী জুড়ে।
তারপর যখন দেখল তার অনেক ভক্ত তৈরি হয়েছে আশে পাশে তখন সে করল কী মাটি দিয়ে একটা বড় বল তৈরি করল। তারপর সে সবাইকে ডেকে বলল, ‘এই বলটা মাটির কিন্তু যে কেউ এই বলটার মালিক হবে সে হবে অনেক বিত্ত বৈভবের মালিক। চাই কী, মাটির বলটাও তার জন্য সোনার বল হয়ে যাবে।’
এমন লোভনীয় প্রস্তাব কে হেলায় হারাতে চায়, সবাই তখন মাটির বলটা পেতে চাইল। শয়তান তখন মনে মনে বলল এমনটাই তো চাইছিলাম। মানুষ যত লোভী হবে আমার পরিশ্রমও তত কম হবে। বিনা পরিশ্রমে কাজ উদ্ধার হবে। তখন আমার কাজ হবে শুধু তাদের মধ্যে একটু হিংসা আর মিথ্যা অহংকার ঢুকিয়ে দেয়া। ব্যস তারপর আর আমাকে পায় কে, আমি তখন শুধু নাকে তেল দিয়ে ঘুমাব আর ঘুমাব।
যথা ভাবনা তথা কাজ। শয়তানের কাজ শুরু হয়ে গেল পুরোদমে। মাটির বলটা সে সুন্দর করে সোনালি রঙে রাঙিয়ে ফেলল। যারা লোভী তারা আগেই শুনেছিল মাটির বলটাই সোনার বলে পরিণত হবে। আর শয়তানের কথায় তারা বিশ্বাসও করেছিল পুরোপুরি। এখন রঙ দেখে আর তাদের সন্দেহ রইল না যে ওটা সোনার বল হয়ে গেছে। সবাই তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলল যে করেই হোক্ , সোনার বলের মালিক সে হবেই। আর যায় কোথায় শুরু হয়ে গেল হিংসা আর রেষারেষি। শয়তান এদিকে মহাখুশি।
দিন যত যায় শয়তানের শয়তানির মাত্রাও তত বাড়ে। আর তার খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। ধরতে গেলে প্রায় বিনা পরিশ্রমে এমন মোক্ষম মওকা সে আগে কখনো পায়নি। যে দেশে কোন অভাব বলতে গেলে নেইই। মানুষ আছে সুখে শান্তিতে, খাদ্য-খাওয়া অফুরন্ত। কেউ কারো পিছনে কখনো লেগেছে এমন কথা কস্মিন কালে কেউ কখনো শোনেওনি। সেই দেশে ধরতে গেলে একেবারে নির্লোভী গো-বেচারা, বোকা লোকগুলোর মধ্যে সে ঝগড়া বাধাবে কী করে। শেষে কিনা একটা সামান্য মাটির ঢেলা দিয়েই তা সম্ভব হল।
এমন কথা তার ওস্তাদ যদি শোনে তাহলে তাকে যে শুধু বাহবা দেবে তাই না, রীতিমতো পিঠ চাপড়ে দিতেও কসুর করবে না। কাজেই সে মনের সুখে এবার আরো জোরে সোরে তার ক্রিয়া কর্ম শুরু করে দিল।
কথায় আছে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। মানুষ যত লোভী হবে শয়তান তত খুশি হবে এতে আর সন্দেহ কী?
শয়তানের ছিল একটা ইয়া বড় ঝোলা। সেটা সে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে ঐ গাছেরই নিচে রাতে ঘুমিয়ে থাকতো। ঐ দেশে যে লোকটি সবচে’ লোভী ছিল সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল, যে করেই হোক, সে ঐ সোনার বলটি চুরি করে নিজের কাছে রেখে দেবে। যেই কথা সেই কাজ। আর শয়তানও জানতো লোভ থেকেই পাপের সূত্রপাত হয়। সুতরাং সে তার ঝোলা টা সবার অগোচরে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে বেশ নিশ্চিন্ত মনে নাকে ডেকে ঘুমাতে লাগল। তারপর যা হবার তাই হল। চোর ব্যাটা রাতে ঠিক এসেছে। চুপি চুপি সে ঝোলাটা নমিয়েও ফেলেছে গাছের ডাল থেকে।
অমনি শয়তান টের পেয়ে গেল কী ঘটতে যাচ্ছে। আর যাই কোথায়, সে কষে একটা হাঁচি দিয়ে ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভান করল। চোর তো পড়ি মরি করে দৌড়ে পালায় আর কী; কিন্তু শয়তান পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আবার নাক ডাকতে লাগল। চোর নিশ্চিত হল সাধু গভীর ঘুমে অচেতন। শয়তানও জানে চোর নিশ্চিন্ত মনে চুরি করতে না পারলে তারও কার্য সিদ্ধি হবে না। এবার চোর ব্যাটা নিশ্চিন্ত মনে শয়তানের ঝোলাটা আবার নামাল। তারপর সে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করে ফেলল সেই মাটির বল। সে মনে মনে ভাবল এবার, যাক্ বাবা পেয়েছি এবার সোনার বল। তারপর ঝোলাটা আবার যেমন গাছের ডালে যেমন ঝোলানো ছিল তেমনি ঝুলিয়ে রেখে একবার পরখ করে দেখল; না, ঘুমের একটুও ব্যাঘাত হয়নি তার। তারপর পা টিপে চুপি চুপি প্রস্থান করল সেখান থেকে।
পরদিন সকালে উঠেই বনের ধারে হৈ হৈ রৈ রৈ শুনে সবাই ছুটে গেল সাধুর কাছে। তারপর যা শুনল তাতে সবার চক্ষু চড়ক গাছ। এই দেশে এর আগে কেউ কখনো শোনেনি কারও কিছু চুরি হয়েছে। যে দেশে খাদ্য-খাওয়া অফুরন্ত সে দেশে মানুষ চুরি করবে কোন দুঃখে। কিন্তু শয়তানের হায় হায় শুনে কারও আর বুঝতে বাকি রইলো না তাদের মধ্যেও চোর আছে। আর লোভে পড়েই সে চুরি করেছে সাধুর সোনার বলটা।
তারপর যা হওয়ার তাই হল। সেই লোভী চোরটা মাটির বলটা তার বড়িতে মেঝে খুঁড়ে সেখানে লুকিয়ে রাখল। সে মনে মনে ভাবল এখন থেকে সে অনেক বিত্ত আর বৈভবের মালিক হয়ে যাবে। এদিকে দেশে শুরু হল রেষারেষি আর হানাহানি। চোর খুঁজতে গাঁ উজাড়। সবাই সবাই কে সন্দেহ করতে লাগল। শয়তান বুঝল এবার তার স্বার্থ সিদ্ধি হয়েছে। সুতরাং অনর্থক এখানে আর থেকেও তার লাভ নেই। এবার ফুড়ুৎ করে সে বিদায় হল। পরদিন থেকে বনের ঐ সাধু বাবাজির আর পাত্তা পেল না কেউ। সবাই তখন ভাবল সাধুর সেই সোনার বলটা চুরি হয়ে যাওয়ার জন্যই সে রাগ করে চলে গেছে।
এদিকে শয়তান সেখান থেকে যাওয়ার সময় মনে মনে বলতে বলতে গেছে,
তোরা সব মারামারি করে মর, আমি বাঁচি;
তোরা সব হিংসায় জ্বলে পুড়ে মর, আমি সরি।

শয়তান কারো ভাল দেখতে পারে না। সে চায় সবাই তার মতো অভিশপ্ত হয়ে জ্বলে পুড়ে মরুক। কারণ সে নিজেও সব সময় জ্বলে পুড়ে ছারর্খা হতে থাকে আর অপরের সুখ দেখে হিংসায় জ্বলতে থাকে। তাই সে চায় সবাই তার মতোই হোক।
সোনার বলটা যতক্ষণ শয়তানের হাতে ছিল ততক্ষণ সবার তা পেতে আগ্রহ ছিল। কিন্তু চুরি হওয়ার পর সবার তাতে ষোলআনা লোভ বেড়ে গেল। আর তাতেই ঘটল যত বিপত্তি। সন্দেহ থেকে অনাসৃষ্টি আর অনাসৃষ্টি থেকে যত গণ্ডগোলের উৎপত্তি। সব কিছু থেকেও মানুষের মধ্যে আর শান্তি নেই। ভালবাসা দূরে থাক নিরাপত্তাটুকুও হারাল তারা। তাদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান ছিল তারা ভাবল বনের পশু হিংস্র হলেও তারা তো আর সোনার বল পেতে চাইবে না। কাজেই মানুষের চাইতে এখন বনের পশুর কাছে থাকাই বেশি নিরাপদ। কেননা ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা যদি থাকে তাহলেই আর অতিরিক্ত চাহিদা তাদের নেই।
তেমনি এক বুদ্ধিমান লোক মনের দুঃখে শেষে একেবারে বনে গিয়ে বসবাস শুরু করল। দেখতে দেখতে বনের বাঘ ভল্লুক, সাপ খোপ সবাই তার বন্ধু হয়ে গেল। বনের নিরিবিলি পরিবেশে যেখানে সোনার বল কেউ পেতে চায় না সেখানে শান্তি ছাড়া অশান্তি মোটেও নেই। সন্দেহ নেই তাই শত্রুও নেই; এর চেয়ে শান্তি আর কী থাকতে পারে। তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাই একে একে চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। কেউ তাকে আর লোকালয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারল না।
এদিকে সেই দেশের রাজা পড়ল মহা ফ্যাসাদে। দেশে অশান্তি, কোন কিছুর অভাব নেই অথচ শান্তি ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কি দিলে মানুষের মনে শান্তি আবার ফিরে আসবে, ভেবে নাকাল হল রাজা। আর ওদিকে সেই চোর; সে মনে মনে মহাখুশি। সে একপ্রকার ধরেই রেখেছে যখন সবাই ভুলে যাবে সোনার বলের কথা তখনই সে মাটির নিচ থেকে ওটা বের করবে। তারপর সে যে শুধু সোনার বলের মালিক হবে তাই না রীতিমতো অল্পদিনের মধ্যে বিপুল বিত্ত বৈভবেরও মালিক হয়ে যাবে। তখন আর তাকে পায় কে-
শেষ মেশ রাজার কানে একদিন খবর পৌঁছাল সে দেশের এক বোকা লোক অল্প কিছুদিন থেকে বনে গিয়ে বসবাস শুরু করেছে। সে রীতিমতো তার ঘর-সংসার আত্মীয়-পরিজন সব বাদ দিয়ে বনে থাকা টাকেই বেশি পছন্দ করেছে। এমন লোককে কেউই পছন্দ করে না বনের বাঘ ভল্লুক যার বন্ধু হয়, সাপ-খোপ যার অনিষ্ট করে না। রাজা ভাবল যারা বোকা হয় তাদের কাছ থেকে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান হয়। কেননা সমাজে যাদের কোন লোভ নেই তারাই বোকা বলে সবার কাছে পরিচিতি পায়। আদতে তারা সহজ সরল আর নির্লোভী মানুষ। রাজা মনে মনে ঠিক করে ফেলল যে করেই হোক বনের বোকা লোকটির সাথেই তাকে দেখা করতে হবে।
কথায় আছে রাজার ভাবনা; যেই কথা সেই কাজ। কাউকে কিছু না বলে রাজা একাই অতি সাধারণ বেশে এক রাতে সবার অগোচরে রওনা হয়ে গেল। কাক পক্ষী দূরে থাক্ স্বয়ং রাজরানিও জানল না রাজার খবর। এই যখন অবস্থা, পরদিন সকাল থেকেই দেশময় রাষ্ট্র হয়ে গেল; রাজা কোথায় নিরুদ্দেশ। রাজ্যময় চারদিকে হায় হায় পড়ে গেল। কিন্তু যেই রাজা! তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। আসল কথা রাজা জানত, স্বয়ং রাজা যাচ্ছে কিনা বনের কোথায় এক ভাবুকের সাথে দেখা করতে; এ কথা বললে তো কোন পাগলও বিশ্বাস করতে চাইবে না। তাই কিছু কথা আছে যা বলার চাইতে না বলাই ভাল। তাতে দশের লাভ হয়, দেশের মঙ্গল হয়।
এদিকে হয়েছে কি, সেই জ্ঞানী লোক; সে রাজাকে চিনতে পারেনি। চিনবেই বা কী করে? অতি সাধারণ বেশে কৃষকের পোশাক পরে কেউ যদি কারও কাছে হাজির হয় তাকে কে চিনবে রাজা বলে। তবে শুধু রাজা বলে না, সেই জ্ঞানী লোকটি সবাইকে সমান চোখে দেখত। আর প্রকৃত জ্ঞানীরা এমনই হয়। আর সেই কারণেই হয়তো সেই লোকটি রাজা কে সম্মান করেই বসতে দিল তার হাতে তৈরি শুকনো পাতার বিছানায়। রাজা তাতেই উপবেশন করে জানতে চাইল, ‘আপনি এত কষ্ট করে এখানে কেন পড়ে আছেন?’
রাজার কৌতূহল নিবারণ না করে বরং উল্টো তাকেই প্রশ্ন করল লোকটি, ‘তার আগে জানতে চাই কোন দুঃখে এই গভীর বনে আমার মতো এক বেকুবের সাথে দেখা করতে এসেছেন?’
রাজা তখন নিজের পরিচয় গোপন করে বলল, ‘এসেছি আপনার কোন দুঃখ মোচন করা যায় কিনা তাই দেখতে।’
লোকটি তখন বলল, ‘আমার তো কোন দুঃখ নেই, আমিতো সুখী মানুষ।’
রাজা ভারি অবাক হল লোকটির কথা শুনে। তারপর চারদিক একবার ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, ‘বেশ, তাহলে এই বিবারণ বনে একাকী কেন পড়ে আছেন? এতেই কি আপনার সুখ?’
লোকটি এবার মিটি মিটি হাসতে লাগল। তারপর বলল, ‘এতেই-তো মহা-সুখ। এখানে কেউ সোনার বলের পিছনে ছুটছে না, তাই আমিও সুখে আছি; বনের পশু-পাখিরাও সুখেই আছে। ’
রাজা তো এবার যারপরনাই অবাক হল তার কথা শুনে। থতমত খেয়ে বলল এবার রাজা, ‘সোনার বল? সে আবার কী জিনিস?’ রাজার কথা শুনে লোকটি কিন্তু মোটেও অবাক হলো না। মিটি মিটি হাসতে হাসতে সে তখন বলল,‘তাহলে আপনি এ দেশের মানুষ না; দেশে বাস করেন অথচ দেশের খবর কিছুই জানেন না।’
অপমানিত রাজা মনে মনে বাকরুদ্ধ হয়ে ভাবতে লাগল সত্যিই আমি এ দেশের মানুষ না। যে রাজা তার প্রজার সুখ দুঃখের খবর রাখে না সে প্রকৃতই সে দেশের মানুষ হতে পারে না।’
রাজা লজ্জায় পড়ে সেদিন আর কিছুই বলতে পারল না তাকে। উপায়ান্তর না দেখে সেদিনকার মতো রাজপ্রাসাদে ফিরে এল রাজা। তারপর একাকী চুপি চুপি ভাবতে লাগল সোনার বলের রহস্যের যদি সমাধান করতে না পারে তাহলে তার রাজা হওয়ার কোন যোগ্যতাই নেই। রাজা তখন মনে মনে চারদিকে গোয়েন্দা পাঠাল সোনার বলের রহস্য জানতে। শেষে দেখা গেল সোনার বলের রহস্য এক রাজা ছাড়া বাকি দেশের লোক সবাই কম বেশি জানে। সেটা চুরি হওয়া নিয়েই যে মুল সমস্যা তাও গোয়েন্দা খবরদারিতে উঠে এল। সব খবর সংগ্রহ করার পর হতোদ্যম রাজা নড়ে চড়ে বসল। তারপর নূতন এক ফন্দি আঁটল। রাজ্যময় সে ঘোষণা করে দিল, চুরি হওয়া সোনার বলটি যে রাজার কোষাগারে জমা দিতে পারবে সেই হবে দেশের রাজা।’
রাজার ঘোষণা শুনে সবাই অবাক। সামান্য একটা সোনার বলের লোভে রাজা তার রাজ্যই ছেড়ে দেবে। এমন বোকা আর খামখেয়ালি রাজার কথা এর আগে কেউ শোনেওনি। কিন্তু রাজা যতক্ষণ রাজা ততক্ষণ রাজাই তো, কে আছে তার আদেশের বিরুদ্ধে কথা বলে? তাই সবাই ভাল মন্দ জেনেও চুপ চাপ রইল।
এদিকে সেই চোর; মনে মনে মহাখুশি। এখন তার শুধু রাজা হওয়াই যা বাকি। গভীর রাতে সে মনে মনে তার ঘরের মেঝে খুঁড়ে সোনার বলটা বের করতে গেল। কেননা বিষয়টা কেউ জানলেই বিপদ, এমন কি তার স্ত্রী ও। রাজার ঘোষণাঃ যে জমা দেবে বলটা, সেই হবে রাজা; কাজেই যে কেউ যদি জেনে ফেলে তবে তার বদলে সেই হবে দেশের রাজা। এমন মূর্খতা করা তো মোটেও চলে না। অন্ধকারে সে কোদালের এক কোপ মারে আর মনে মনে বলে, ‘তিন কোপে রেখেছি, তিন কোপেই বের হবি।’
আবার এক কোপ মারে আর মনে মনে বলে, ‘তিন কোপে রেখেছি.. ..’
কিন্তু চোর ব্যাটার তো আর মনে নেই আগের তিন কোপ সে গায়ের জোরে মেরেছিল না গায়ে হাওয়া লাগিয়ে মেরেছিল। তাছাড়া চোর ভেবেছিল কোদালের কোপ যদি সোনার বলের গায়ে লাগে তাহলে অন্তত ঠং একটা শব্দ তো হবে। তবে সে কোপ গুলো মারছিল বেশ আস্তে কেননা কেউ রাত-বিরেতে ঠং শব্দটা শুনে ফেললেই তো সব ভেস্তে যাবে। মনে মনে আবার ভাবল সে,
কপাল যদি না হয় ফাটা,
এবার সে হবেই রাজা।
তারপর খুব আস্তে করে মারল এবার তৃতীয় কোপ। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই। আবার মারল কোপ কিন্তু তাও নেই। আবার..আবার.... প্রমাদ গুনল মনে মনে এবার চোর ব্যাটা। চোরের মন, ভাবল সে নিশ্চয় কেউ তার সোনার বলটার খোঁজ জেনে গেছে আর চুরি করে পালিয়েছে। কিন্তু এত সহজে সে বিশ্বাস করতে পারল না নিজের ভাবনাটা। অন্ধকারে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে গিয়ে মাটির বলটাই ভেঙে চুরে মিশে গেল মাটির সাথে। সারা রাত ধরে তার পরিশ্রমটাই ধরতে গেলে মাটি হল।
এভাবে সারারাত কেটে গিয়ে ভোরের আলো ফুটে বের হল। কিন্তু সোনার বলের আর দেখা নেই। দেখা পাবেই বা কী করে সারা রাতের কোদালের ঘা আর বেপরোয়া মতিগতির খোঁজা খুঁজিতে নকল সোনার বলের অস্তিত্বই বিলীন হয়েছে। বলটা এখন ঝুর ঝুরে মাটি ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু দিনের বেলায় যখন সে দেখল তার বলটা আর সেখানে নেই তখন তার মাথা গেল বিগড়ে। কথায় আছে চোরের মন বোচকার দিকে। তার মনে এবার বদ্ধমূল ধারণা হল বলটা নিশ্চয় কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। আর তাতেই তার হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হল। সে একবার বুক চাপড়ে বলে আমার সোনার বল..আবার বুক চাপড়ে বলে কোথায় বল..
সকালে উঠে তার কাণ্ড-কারখানা দেখে কারও আর বুঝতে বাকি রইল না, সোনার বলের চোর কে ছিল। সবাই তখন বুঝল সোনার বল পাওয়া না গেলেও সোনার বলের চোর কে পাওয়া গেল। কথাটা এ কান ও কান হয়ে রাজার কানে পৌঁছাতে দেরি হল না। রাজার আদেশে তখন রাজার লোকেরা সোনার বলের চোর কে ধরে নিয়ে গেল।
চোর কিন্তু আর ভাল হল না, তার শুধু একটাই কথা, ‘সোনার বল কোথায় বল।’ রাজা তাকে দেখেই বুঝল সোনার বলের লোভই তাকে আর তার সাথে যারা লোভ করেছিল তাদের সবাই কে পাগল করেছিল। রাজা তখন তাকে বলল, ‘তোমার চুরির শাস্তি তুমি নিজেই পেয়েছ, এখন তুমি বদ্ধ উন্মাদ। সোনার বল যদি এনেও দাও তবুও কেউ চাইবে না তুমি এ দেশের রাজা হও। তুমি এখন থেকে পথে পথে ঘুরে বেড়াবে আর সবাই কে বলে বেড়াবে তুমিই সোনার বলের চোর; এটাই তোমার উপযুক্ত শাস্তি।’
এই তো গেল চোরের শাস্তি। রাজা কিন্তু মোটেও অবহেলা করল না বনের ঐ জ্ঞানী লোকটিকে। মনে মনে আবার চলে গেল বনে। তবে এবার কিন্তু সাধারণ বেশে মোটেও না, গেল একেবারে রাজ পোশাক পরে আর ঘোড়ায় চড়ে। তবে সঙ্গী সাথিদের রেখে এল দূরে বনের এক প্রান্তে। কেননা রাজার মোটেও ইচ্ছা ছিল না তার শান্তি নষ্ট করা। তারপর রাজা তাকে যা বলল তা শুনলে যে কেউ অবাক হবে। রাজা তাকে বলল, ‘আপনি সেদিন আমাকে ঠিকই বলেছিলেন দেশে বাস করে দেশের খবর না রাখলে সেই দেশের মানুষ সে হতে পারে না। আজ আমি দেশের মানুষ হয়েই আপনার কাছে আবার এসেছি। আমি এ দেশের রাজা আর আপনি আমার রাজা, রাজার রাজা। চলুন আমার সাথে; এখন থেকে আর বনে নয় আমার সাথে রাজ প্রাসাদেই আপনি থাকবেন।’
লোকটি তখন বলল, ‘আপনি আবার আমাকে সোনার বলের লোভ দেখাবেন না। আমি এখানেই বেশ ভাল আছি। ইচ্ছা হলে সারা জীবনই আমি এখানে কাটিয়ে দিতে পারি। তবে যার লোভ আছে আপনি বরং তাকেই নিয়ে যান আপনার রাজ প্রাসাদে।’
রাজাও তখন বুঝল লোকটা যথার্থই জ্ঞানী। তাই তার জাগতিক বস্তুর উপর কোন লোভ নেই। রাজা এবার তাকে বিনয়ের সাথে বলল, ‘তাহলে আজ থেকে আপনার জন্য রাজ প্রাসাদের দ্বার সব সময়ের জন্য খোলা থাকল। আপনি যে দিন ইচ্ছা রাজপ্রাসাদে যাবেন আর সেদিন থেকে আপনি হবেন এ দেশের নূতন রাজা।’
জ্ঞানী লোকটি তখন রাজা কে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, ‘হয়তো তার আর দরকার হবে না। আমি বনেই বেশ ভাল আছি, এখানে কোন রাজা নেই। আর এখানে কেউ সোনার বলের পিছনেও ছোটে না। মানুষ যখন মানুষ থাকেনা তখন পশুর কাছ থেকে শিখতে হয় মানুষ কে, এ ছাড়া কোন উপায় থাকে না। আমিও এখন তাই শিখছি, আবার যদি সমস্যা হয় তাহলে আসবেন; আমি পশুর কাছ থেকে যা শিখেছি তার হয়তো কিছু দিতে পারব আপনাকে।’
জ্ঞানী লোকটির কথা শুনে লজ্জায় রাজার মাথা হেঁট হল। কিন্তু রাজা মোটেও ঘাবড়ে গেল না। কেননা রাজা তো রাজার মতোই হয়, রাজা কী আর সাধারণ মানুষের মতো বোকামু করলে মানায়। কথায় আছে জ্ঞানী কে যে সম্মান করে সে নিজেও সবার কাছ থেকে সম্মান পায়। তাই রাজা তাকে তখন বলল, ‘আপনি মানেন আর না মানেন আজ থেকে আপনিই এ দেশের রাজা। আর আমি? .. আমি আপনার অতি সাধারণ এক প্রজা।’
কী আর করা, রাজার কথা; তাই মানতেই হল। তবে আশ্চর্য হলেও সত্য সোনার বলের পিছনে মানুষ আজও কিন্তু ছুটছে; আর সোনার বল চুরি করে যে আবার হারিয়েও ফেলে, সে তো রাজা হতে পারেই না। উল্টো সে বার বার বলতে থাকে, সোনার বল কোথায় বল.. ..সোনার বল কোথায় বল.. .. সোনার বল..
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
হোসেন মোশাররফ মন্তব্য লেখার জন্য সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি .....
আখতারুজ্জামান সোহাগ মনে হলো আপনার পাশে বসে পুরো গল্পটা শুনলাম। দারুণ শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে গল্পটাতে। চমৎকার।
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন ....আর একটা দেশ আছে, যে দেশে, রাজা ভান্ডার ভারার জন্য সবাইকে চোর...., জংগলেও কাউকে যেতে দেয় না...। ভাল লিখেছেন। শুভেচ্ছা রইল।
Gazi Nishad খুব খুব ভালোলাগা। অসাধারণ (৫) আমার কবিতায় আমন্ত্রণ রইলো ভাই।
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ আপনার গল্পের মজাই আলাদা ----------- !! খুব খুব সুন্দর লিখেছেন ভাই -- ।। অশেষ শুভ কামনা জানাই ।
ঝরা পাতা খুব ভালো লাগলো... সুন্দর ভাবনা :)
আপেল মাহমুদ ভালো লাগলো আপনার শিক্ষামূলক শিশুতোষ গল্পটি। শুভকামনা রইলো।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু শিক্ষা গ্রহণ করার মত চমৎকার গল্প। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
এফ, আই , জুয়েল # অনেক সুন্দর একটি গল্প ।।

২৫ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪