তুলির স্বাধীনতা

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১১)

হোসেন মোশাররফ
  • ২৫
  • ৮৬
ছাত্র জীবন থেকেই পুরনো বইয়ের দোকানে ঢুকে বই ঘাঁটাঘাটি করার একটা বদ অভ্যাস আমার ছিল। আর এতে করে নানা বিড়ম্বনার স্বীকারও আমাকে হতে হয়েছে। মাঝে মধ্যে নানা রকম অপমানকর পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে হয়েছে আমাকে। তারপরও কথায় আছে, 'স্বভাব যায় না ম'লে।'
আমি যথারীতি যেতাম সেখানে এবং আলো আধাঁরির ঐ দোকানটির অভ্যন্তরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম। বইয়ের দোকানে ঢোকার পর সময়গুলো কোথা দিয়ে কিভাবে যে কেটে যেত তা আমি নিজেও জানতাম না।
চট্টগ্রাম স্টেশন রোডের ছোট্ট ঐ দোকানের মালিক আমাকে আগাগোড়া ভালই চিনতেন। বেচারার আগে কোন দোকান ছিল না। ফুটপাতে গুটিকয়েক পুরনো বই সাজিয়ে শুরু করেছিলেন প্রথমটা। তারপর দেখতে দেখতে ছোটখাটো একটা দোকানই দিয়ে ফেললেন একদিন। শুরু থেকেই আমি তার নিয়মিত একজন খরিদ্দার। কিন্তু পুরনো খরিদ্দার হওয়া স্বত্বেও আমার তেমন কোন আদর যত্ন ছিল না তার কাছে। কেননা দোকানি ভালই জানে আমি যতটা না ঘাঁটাঘাটি করি তারচে' খুব অল্পই কেনাকাটা করি। একে ছাত্র মানুষ আমি তার উপর পকেট থাকে প্রায় সময়ই ফাঁকা, সুতরাং দোষটা পুরোপুরি আমাকেও দেয়া যায় না। তাছাড়া পুরনো বইয়ের দোকানে বইয়ের কোন শ্রেণিবিভাগ নেই। একটা দুষ্প্রাপ্য প্রয়োজনীয় বইয়ের উপরেই হয়তো পড়ে আছে একেবারে রগরগা একটা হিন্দি ফিল্মের পত্রিকা। কাজে কাজেই পত্রিকাটা সরিয়ে নিচের বইটা বের করতে গেলে যে, যাহোক একটা বিপত্তি ঘটবে তা তো নিশ্চিত। নিচের আরেকটা মলাট উঠা পৃষ্ঠা ছেঁড়া বই উপুড় হয়ে ধপাস করে যে নিচে পড়বে না তারও তো কোন নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং দোকানির রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। মাঝে মধ্যে পকেটে পয়সা থাকলে তাকে খুশি করার জন্য অনিচ্ছা থাকা স্বত্বেও দু'একটা পুরনো গল্পের বই কিনে ফেলি। তারপরও খুশি করা যায় না দোকানিকে। কখন যে চোখ উল্টে বলে ফেলবে, 'ভাই নিবেন আপনি বইটা? না নিলে কাটেন।'
একজন অতি পুরনো ক্রেতা আমি তার দোকানে এবং মাঝে মধ্যে বইও কিনি। তা স্বত্বেও মুখ বুঁজে তার অপমানসূচক ভাষা আর ব্যবহার দুটোই আমাকে সহ্য করতে হয়। কেননা তার সাথে গোলমাল বাধানো মানে বইয়ের সাথেই সম্পর্কটা নষ্ট করা। এছাড়া ভিতরে আর একটা রসায়নও আছে সেটা হল পুরনো বইয়ের দাম নির্ধারণ নিয়ে। সাধারণত পুরনো বইয়ের দামটা নির্ধারিত হয় দোকানির মর্জি মোতাবেক। যেমন কোন বই ক্রেতার পছন্দ হলে সেটার দাম দোকানি তার মর্জি মতো নির্ধারণ করে দেবে। এতে করে কম দামে বই পেতে দোকানিকেও সন্তুষ্ট রাখা চাই। তাই মুখ বুঁজে দোকানির সব অত্যাচার হজম করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না আমার।
তো এইভাবে দু'একটি করে বই কিনতে কিনতে আমার ছোট খাট একটা ব্যাঙ প্রায় পূর্ণ হয়ে গেল। মাঝে মধ্যে সেই ব্যাঙ কে জমা হওয়া বই গুলো ঘেঁটে আমি বেশ তৃপ্তিও অনুভব করতাম।

দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কয়েক বছর পরের কথা। প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমি ঐ দোকানটিতে বই ঘাঁটাঘাঁটিতে ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময় একজন অল্প বয়সী ছেলে এল ঐ দোকানটিতে বই বিক্রি করতে। কিছু পুরনো বই আর সাথে কিছু খাতা। সবগুলোই খুবই পুরনো। দোকানি প্রথমে কিনতে রাজি হচ্ছিল না। শেষে ছেলেটির পীড়াপীড়িতে অল্প দামে ওগুলো কিনতে রাজি হল সে। আমি দেখলাম বিরক্তির সাথে বইগুলো দাঁড়িপাল্লায় ওজন করতে লাগল দোকানি। বইগুলো গোছানোর সময়ও দোকানির চোখেমুখে যথেষ্ট বিরক্তির ছাপ সুস্পষ্ট ভাবে ফুটে বের হল। তারপর ওগুলো দোকানের এক কোনায় রেখে দিল।
পুরনো বইয়ের প্রতি আমার একটা আকর্ষণ বরাবরই আছে। সেজন্যই কিনা জানিনা, আমি দোকানে নূতন আসা ওসব পুরাতন বইগুলোর প্রতি এক রকম আকর্ষণ অনুভব করলাম। দোকানির অলৰ্যে ওর সদ্য ক্রয় করা বই খাতা গুলো ঘাটতে গিয়ে একটা পুরনো ডায়রি আবিষ্কার করলাম। ডায়রিটা এতটাই পুরনো ওটার মলাট তো নেইই; প্রথম দু'একটা পৃষ্ঠাও যেন আধ খাওয়া পোড়া। ডায়রির প্রথম পৃষ্ঠায় বেশ গোটা গোটা অৰরে লেখা 'আরিফা জাহান তুলি' তারপর নিচে লেখা আছে 'অষ্টম শ্রেণি'। এরপরের অংশটুকু ছেঁড়া থাকার কারনে হারিয়ে গেছে। সে কোন স্কুলের ছাত্রী কিংবা তার বাকি ঠিকানা-পরিচয় বা কী সেসব কিছু পাওয়া গেল না। স্কুল জীবনে যেখানে সমবয়স্কা কোন মেয়ের সাথে কথা বলা কিংবা মেলামেশা একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল আমাদের জন্য। সেখানে এমন একটা একান্ত ব্যক্তিগত ডায়রি পেয়ে দারুণ পুলকিত অনুভব করলাম মনে মনে। ডায়রিটা যেভাবেই হোক সংগ্রহ করতে হবে দোকানির কাছ থেকে।
তারপর সেটা নিয়ে দোকানির কাছে যেয়ে এমন ভাব দেখালাম যেন ডায়রির পিছনের খালি পৃষ্ঠা থাকার কারণেই ওটা আমি কিনতে চাচ্ছি। দোকানিও বেজায় চালাক। সে বইগুলোর ক্রয় দামের অর্ধেকটাই আমার কাছে চেয়ে বসল। অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও কিছুতেই তার মন ভজাতে পারলাম না আমি। কী আর করা, শেষে উপায়ন্তর না দেখে পকেট থেকে পুরো দশটা টাকা দিয়েই পুরনো ডায়রিটা আমি কিনে নিলাম। তারপর বাসায় ফিরে আমার বই রাখার বাঙ্রে গোপন জায়গায় তুলে রাখলাম ওটা। যেন মহার্ঘ বস্তুটা হাতছাড়া হয়ে গেলে ভীষণ ৰতি হয়ে যাবে আমার।
তখনো আমি মনে মনে একরকম পুলক অনুভব করছি। যেন সমবয়সী কোন মেয়ে আমাকে তার জীবনের প্রথম শিহরনের কথা জানিয়েছে; এমনই এক রকম অজানা কল্পনার সাগরে ভাসতে লাগলাম আমি। সময় যেন কিছুতেই কাটতে চায় না আমার। অধীর আগ্রহে আমার অপেৰার প্রহর আমাকে পিছু তাড়া করে ফিরতে লাগল। কখন রাত নামবে আর তখন নিরিবিলিতে আমি তুলির ডায়রিটা নিয়ে পড়তে শুরু করব।
পড়ার টেবিলে আমি নিছকই বসে রইলাম বই সামনে করে। স্নায়বিক উত্তেজনায় সেদিন পড়াশুনার দফারফা আমার। তারপর যখন রাত গভীর হল, বাসার সবাই ঘুমে জারে জার। তখন আমি খুব সংগোপনে পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লাম।
তারপর নিঃশব্দে বের করে নিয়ে এলাম আমার কেনা মহার্ঘ বস্তুটা। লাল গোটা গোটা অৰরে লেখা তুলির পুরো নামটা আবার আমি পড়লাম। সাথে সাথে রোমাঞ্চ অনুভব করলাম পুরো শরীরে। সত্যিই কোনদিন না দেখা, না চেনা অচেনা এই ডায়রির লেখিকাকে আমি মনে মনে ততৰণে ভালবাসতে শুরু করেছি।
ভিতরের পৃষ্ঠায় প্রবেশ করলাম আমি। লাল কালিতেই লিখেছে তুলি। 'আমার নাম তুলি। আমি জানিনা আমার এই ডায়রি কার হাতে পড়বে। আর কে একান্ত সংগোপনে আমার এই ডায়রিটা নিয়ে গভীর রাতের নির্জনতায় একাকী পড়তে বসবে। সে হয়তো আমাকে চেনেনা, দেখেনি কোনদিন। কিন্তু আমি তাকে চিনি, অনেকবার দেখেছি তাকে। যদি সে ছেলে হয় তাহলে আমার ভাই আর যদি মেয়ে হয় তাহলে নিঃসঙ্কোচে বলব আমার বোন সে।' প্রথম পৃষ্ঠার লেখা এ পর্যন্ত লিখেই শেষ করেছে তুলি।
জানিনা তার লেখার মধ্যে কী যাদু আছে। মুহূর্তেই আমার সব উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা আর শিহরনের উত্তাপের উষ্ণতার গোঁড়ায় যেন পানি ঢেলে দিয়ে গেল তার কথা ক'টি। আমি পরবর্তী পৃষ্ঠা উলটলাম। লাল কালিতে মোটা বর্ডার দিয়ে তুলি লিখেছে, 'আজ ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১।'
কিছুৰণের জন্য পুরো ডায়রিটা আমার চোখের সামনে থেকে ঝাপসা হয়ে গেল। লেখাগুলোও যেন সব হারিয়ে গেল কোথায়। মনঃসংযোগ ঠিক করতে কিছু সময় লেগে গেল আমার। তারপর আবার ফিরে এলাম আমি তুলির ডায়রির পৃষ্ঠায়।
তুলি লিখেছে, 'আমরা আট ভাই বোন আর বাবা মা'কে নিয়ে মোট দশজন ছিলাম এ বাড়িতে। সাত ভাইয়ের আমিই একমাত্র বোন। আমার ছোট একটি মাত্র ভাই; বাকি সবাই আমার বড়। এখন আমরা মাত্র তিনজন। ছোট ভাইটি, আমি আর মা। বাবা সহ আমার বাকি ছয় ভাই কে পাক সেনারা ধরে নিয়ে গেছে। আজ সাতদিন হয়ে গেল তাদের কোন খোঁজ নেই।'
কিছুৰণের জন্য সত্দব্ধ হয়ে গেল আমার নাড়ির স্বাভাবিক গতি স্পন্দন। এক মুহূর্তের জন্য আমি নিবিষ্ট চিত্তে চেয়ে রইলাম আমার টেবিলের সামনের খোলা জানালার অন্ধকারের দিকে। তারপর আবার আমি ফিরে এলাম ডায়রির পাতায়। তুলি লিখেছে, 'এই সাতদিন মায়ের সাথে আমি কোন কথা বলতে পারিনি। কেননা মা কোন কথা বলতে পারছেন না। তিনি কাঁদতেও পারছেন না। ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু চেয়ে থাকছেন কখনো আমার দিকে, কখনো ছোট ভাই ইমনের দিকে। কিংবা কখনো বাবা আর ভাইয়াদের ব্যবহৃত কাপড় চোপড়, অন্যান্য জিনিস পত্রগুলোর দিকে। আমার এই নিদারম্নণ কষ্টের দিনে ছোট ভাই ইমনও যদি না থাকতো তাহলে হয়তো মরেই যেতাম আমি। কেননা তার সাথে যা দু'একটা কথাবার্তা সারাদিনে হয় আমার। বেঁচে থাকতে হলে যে কথাবার্তা বলাও দরকার তা আমি এ ক'দিনে বুঝতে পেরেছি।'
আমার দু'চোখ ঝাপসা হয়ে এল। দু'হাতে মুখ ঢেকে আমি টেবিলে কিছু্্ৰণের জন্য বসে রইলাম। মাথার মধ্যে আমার ভাবনা গুলো সব এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল। একটা ডায়রির মাত্র গুটিকয়েক লেখা, আমি আর ভাবতে পারলাম না। একজন মানুষের হৃদয়কে মুহূর্তের মধ্যে কোথায় নিয়ে ফেলতে পারে তা আমি মনে মনে উপলব্ধি করতে লাগলাম। মাত্র কিছুৰণ আগেই অজানা এক তুলিকে নিয়ে আমি নানা স্বপ্নের জাল বুনছিলাম। অথচ এখন তার জন্যেই আমার হৃদয় খান খান হয়ে ভেঙে পড়তে লাগল। মনে মনে আমি তুলির নিষ্পাপ আর নিদারম্নণ যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হৃদয়ের কাছে একবার ৰমা চেয়ে নিলাম। এ পৃষ্ঠার লেখা তুলি এখানেই শেষ করেছে।
পরের পৃষ্ঠায় যাওয়ার আগে আমি কিছুৰণের জন্য ডায়রিটা একবার বন্ধ করলাম। এছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না আর; মনে মনে আমি ভাবতে লাগলাম, তুলি কী আজও বেঁচে আছে?
নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম একবার। কোন উত্তর পেলাম না। আবারও করলাম একই প্রশ্ন, এবারও কোন উত্তর পেলাম না। কিন্তু মন বলল আমার; তুলি নিশ্চয় এতদিনে বেঁচে নেই আর। কেননা সে যদি বেঁচে থাকত তাহলে তার লেখা ডায়রিটা এভাবে পাওয়া যেত না। তাছাড়া অবহেলায় অনাদরে পুরনো বইয়ের দোকানে দাঁড়িপালস্নার ওজনেও বিক্রি হত না ওটা। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস নিজেরই অজানত্দে আমার বুক চিরে বের হয়ে এল।
ডায়রির পরবতর্ী পৃষ্ঠা খুলে পড়তে শুরম্ন করলাম আমি। তুলি লিখেছে, 'আজ ১৮মে, ১৯৭১।
আমাদের এই নিঃসঙ্গ জীবনে আমরা এখন পাক বাহিনীর হাতে নজর বন্দি হয়ে দিন কাটাচ্ছি। এখান থেকে মুক্তির আর কোন আশা আমি দেখতে পাচ্ছি না। কেননা সরকারি যে বাংলো কোয়ার্টার বাসায় আমরা থাকি তার ঠিক পিছনেই পাহাড়ের উপরে পাক সেনাদের ক্যাম্প। আমাদের আশপাশেও সবই অবাঙ্গালি পরিবারের বসবাস। যাদের হাত ধরে আমরা এখান থেকে হয়তো পালাতে পারতাম (আমার বাবা ও ভাইয়ারা) তারাও কেউ আর নেই এখন। আমার মা অনেকটা শোকে কাতর হয়ে কোনরকমে টলকে টলকে চলেন। আমরা দু'জন না থাকলে মা হয়তো না খেয়ে না দেয়ে এতদিনে মরে থাকতেন। আমারও সারা শরীরে ভীষণ ব্যথা। আমাদের তিনজনের মধ্যে শুধু ইমনই এখনো ভাল আছে। কেননা ছোট হওয়ায় ওকে আমি মিথ্যে করে বুঝিয়ে রাখতে সৰম হয়েছি যে বাবা ভাইয়ারা আবার ফিরে আসবে।
কিন্তু মা আর আমি জানি ওরা কোনদিন আর ফিরে আসবে না। আমাদেরও হয়তো মুক্তি মিলবে না এখান থেকে।
পাক সেনাদের মেজর যেদিন আমার বাবা আর ভাইয়াদের ধরে নিয়ে যায় সেদিনই মাকে কথা দিয়েছিলেন। আমার মা তার কথা বিশ্বাস করতে চাননি। শেষে কোরান ছুঁয়ে উনি শপথ করে গেলেন বাবা ভাইয়াদের পরদিনই ফেরত দিয়ে যাবেন। কিন্তু পরদিন ফেরত না দেয়ার অর্থই যে মৃতু্য তা আমরা খুব ভালই জানি। কেননা এমন ঘটনার কথা আমরা এর আগে অনেকের মুখেই শুনেছি। তাদের ভাগ্যে যা ঘটেছে আমার বাবা আর ভাইয়াদের ভাগ্যেও সেরকম ঘটাটাই স্বাভাবিক। যদিও আমি এখন ভাবতে পারছি না সে কথাটা।'
এরপর কয়েকটা লেখা ঝাপসা হয়ে গেছে। সম্ভবত লেখার সময় তুলির চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়াতেই এখানকার এই লেখাগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে ডায়রির পাতা থেকে।
নিচে আবার লিখেছে তুলি, 'বাবা বরাবরই বিশ্বাস করতেন ওদের। সেজন্য এখান থেকে অনেক বাঙালি পরিবার সে রাতে অন্য কোথাও পালিয়ে গেলেও বাবা যেতে চাননি। মা বাবাকে অনেক করে বুঝিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি কোন। বাবা তার বিশ্বাসের উপরই অটল রইলেন। মা হয়তো সেজন্যই শোকে অনেকটা পাথর হয়ে গেছেন।'
তারপর নিচে হিজিবিজি অৰরে কী সব লিখেছে মর্ম উদ্ধার করা বেশ কঠিন হলো আমার জন্য। তবে যেটুকু মর্ম উদ্ধার করা সম্ভব হলো তার মর্মার্থ হল এই, 'আমরা যদি মরে যাই তাহলে আমাদের সংসার জীবনের এই কঠিন সময়ের কথা কেউই হয়তো কোনদিন জানতে পারবে না। তাই কষ্ট করে হলেও আমাদের কথাগুলো এই ডায়রির পৃষ্ঠায় লিখে রেখে যাচ্ছি। হয়তো সবার অলৰ্যে আমার ডায়রিটি অৰত অবস্থায় রৰা পেতেও পারে। এবং অলৌকিক ভাবেও কোনদিন যদি কোন সচেতন পাঠকের হাতে আমার লেখাগুলো পড়ে, তাহলে...। পৃথিবীতে অনত্দত একজন জানতে পারবে আমাদের সব কথা।'


এ পৃষ্ঠার লেখা এখানেই শেষ করেছে তুলি। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আগের চাইতে অনেকটা সচেতন হয়ে উঠেছে ততৰণে। তুলির জীবনের বাসত্দবতার সাথে যেন আমি নিজেকে এই মুহূর্তে খাপ খাইয়ে নিয়েছি। আবেগের ভাবালুতার হাতে এখন আমি আর বন্দি হয়ে নেই। তাই সহসাই পরের পৃষ্ঠায় যেতে আমার কোন অসুবিধাই হলো না।
পর পর কয়েক পৃষ্ঠা কোন লেখা জোখা নেই। খালি অথবা আঁকিবুকি কেটে পৃষ্ঠাগুলো নষ্ট করে রেখেছে তুলি। হঠাৎ আবার লিখেছে সে, 'আজ ২০জুন,১৯৭১।

বেঁচে আছি এখনো। ট্রেঞ্চের মধ্যে বসে লিখছি। আমাদের কোয়ার্টার বাসার চারদিকে যেটুকু জায়গা উঁচু করে ঘেরা আছে সেখানেই এই ট্রেঞ্চটা। ভাইয়ারা সবাই মিলে তৈরি করে রেখে গেছে এই ট্রেঞ্চটা। বাবা একদিন অফিস থেকে ফিরে বলেছিলেন ট্রেঞ্চ কাটার কথা। যুদ্ধের সময় আত্মরৰার জন্য সবার বাসার পিছনেই নাকি একটা করে ট্রেঞ্চ খনন করে রাখার কথা বলে দিয়েছে অফিস থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের; ট্রেঞ্চ খুড়ে রেখে নিজেরাই আজ কোন সুদূরে হারিয়ে গেছে যার ঠিকানা কেউ জানিনা আমরা।
সেনাক্যাম্প থেকে যখন উঁচু নিচু শব্দে সাইরেন বাজানো হয় তখন বুঝে নিতে হয় বিপদ সংকেত। আমরা তখন লুকোই এসে এই ট্রেঞ্চের মধ্যে। যতৰণ বিপদ কেটে যাওয়ার পরবর্তী সাধারণ সাইরেন না বাজানো হয় ততৰণ আমাদের ধৈর্য ধরে এখানেই বসে থাকতে হয়। আমাদের ইচ্ছা না থাকলেও মায়ের পীড়াপীড়িতেই রাত নেই দিন নেই আমরা দু'ভাই বোন এখানে এসে লুকিয়ে থাকি। আমাদের উঠোনের মাঝখানটিতে এই ট্রেঞ্চটা খোড়া হয়েছে ইংরেজি এল অৰরের আকারে। ট্রেঞ্চের একদিকে গোটা কয়েক বালির বসত্দা ফেলে ছাদ করা হয়েছে। যেন গোলাগুলি এদিকে ছুটে এলেও বালির বসত্দায় তা গেঁথে যায়। বাকি অর্ধেকটা খোলা। সেখান দিয়ে আকাশ দেখা যায়। একবার এখানে এসে ঢুকলে, কখন বের হওয়ার পরবর্তী সাইরেন বাজবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। মাটির নিচের এই গুপ্ত ঘর, কবরখানায় বসে আমরা দু'ভাই বোন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। মুক্ত আকাশে পাখিদের উড়তে দেখে আমাদেরও ইচ্ছা হয় ওদের সাথে উড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু ইচ্ছা হলেই তো আর সব আশা পূরন হয় না মানুষের। বাবা আর ভাইয়ারা যেমন ইচ্ছা থাকা সত্বেও ফিরতে পারল না বাসায়।
আমাদের সাথে সাথে মা ট্রেঞ্চের মধ্যে ঢুকলেও অল্প সময়ের জন্যই তিনি থাকেন আমাদের সাথে। বাইরে গোলাগুলি একটু বন্ধ হলেই তিনি বের হয়ে পড়েন। তারপর আর কিছুতেই ঢুকতে চান না ভিতরে। অথচ আমাদের বের হতে দেন না সাইরেন না পড়া পর্যনত্দ। হয়তো তিনি ভাইয়াদের ফিরে আসার ব্যপারেই অস্থির থাকেন সব সময়। সেজন্যই হয়তো বা তিনি বেশি সময় এখানে থাকতে চান না।
মানুষের অবুঝ মন। কোনকিছুই সে মানতে চায় না, অথচ সময়ের সাথে সাথে সব কিছুই একদিন ঠিকই মেনে নিতে হয়। এছাড়া আমাদের আর কোন উপায় থাকে না।'


তুলির এ লেখাটুকু পড়ে বোঝা গেল ইতিমধ্যে দুই মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের বাবা আর ছয় ভাইয়ের খোঁজ তারা পায়নি। তুলি অবশ্য প্রথম এক সপ্তা'র মধ্যেই তার আশঙ্কার কথা লিখেছিল। এখন যত দিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে তুলির ধারণা আর আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হতে চলেছে।
আবার কয়েক পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে তুলি লিখেছে, 'আজ ১৯জুলাই, ১৯৭১।'
বোঝা যাচ্ছে একমাস পর পর তুলি এই ডায়রিটা একেক বার হাতে তুলে নিচ্ছে। হয়তো সে তার বাবা ভাইদের হারিয়ে মানসিক অবসাদ গ্রসত্দতায় ভুগছে অথবা যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে সময় সুযোগ করে লিখতে পারছে না। তবে যত অসুবিধায় হোক সে লিখছে এবং তাদের সংসারের কথা বেঁচে থাক এটাই হয়তো এখন তার মনের গহিনে একানত্দ ইচ্ছা।
১৯ জুলাই তারিখে তুলি লিখছে, 'আমাদের বাসা থেকে শহরের প্রধান সড়ক বেশি দূরে না। ইচ্ছা করলে ঘরে বসেই আমরা রাসত্দায় কী ঘটছে না ঘটছে সবই দেখতে পারি। যুদ্ধের সময় বাইরে বের হওয়া বিপজ্জনক বিধায় আমরা আমাদের বাসার সামনে বারান্দায় বের না হয়ে দরজার ফুটোয় চোখ লাগিয়ে দেখি। বিশেষ করে যখন কারফিউ চলে কিংবা রাসত্দায় গোলাগুলি শুরম্ন হয়। ঠেলাগাড়িতে করে গুলিতে নিহত দু'একটি লাশ আমরা প্রায় নিয়ে যেতে দেখি। কারফিউ চলা কালীন একদিন দেখেছি গুলি খাওয়া একটা লোককে প্রলাপ বকতে বকতে রাসত্দা দিয়ে হেঁটে যেতে। তার পাঞ্জাবি বুকের নিচ থেকে অর্ধেকটা রক্তে ভেজা। গুলি খেলেও হয়তো সে চাইছে বাসায় আপন জনের কাছে ফিরে যেতে, ফিরতে পেরেছিল কিনা জানিনা। ভাইয়াদের কথা যখন মনে হয় তখন ঐ লোকটির দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ভীষণ খারাপ লাগে তখন।
ভাইয়ারা চলে গেছে তিন মাস হয়ে গেছে। মা দু'দিন করে বাবার অফিসে যেয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছেন। কেউ কিছু বলতে পারেনি। বাবার বেতনের ক'টি টাকা মায়ের হাতে তুলে দিয়েছেন শুধু। মা চোখের পানি ফেলে তাই নিয়ে এসেছেন। বাঁচতে তো হবে আমাদের। এখানে আমাদের কেউ চেনেনা, কোন আত্মীয়-পরিজনও নেই আশে পাশে কোথাও। তাছাড়া এখন আমরা নজরবন্দি হয়ে পড়েছি। আমাদের বাসায় কে আসে, আমরাই বা কোথায় যাই সবকিছুর রিপোর্ট সেনা ক্যাম্পে চলে যায় প্রায় সংগে সংগেই। জানিনা আমাদের এই বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতা কোনদিন মিলবে কিনা।'
এরপর কয়েক পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে তুলি আবার লিখেছে, 'আজ ১৯আগস্ট, ১৯৭১।
একমাস আগে যা লিখেছিলাম আজও তা লিখতে বাধ্য হচ্ছি। ভাল নেই আমরা। গত রাতেও প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে মধ্য রাতে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। তারপর ট্রেঞ্চে এসে ঢুকে বসে থাকি বাকি রাতটুকু। রাতভোর থেকে থেকে গোলাগুলি চলতে থাকে। এমন ঘটনা এখানে প্রায় ঘটে। তখন সারারাত আমাদের দু'ভাই বোন কে জেগে বসে থাকতে হয় ট্রেঞ্চের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে।
কখনো সকাল হলে আবার কখনো বা বেলা দুপুর পর্যনত্দ আমাদের ওখানেই কাটাতে হয়। আজও বেলা এগারটা পর্যনত্দ আমরা ট্রেঞ্চের মধ্যে ছিলাম। কিছুৰণ আগে নিরাপত্তার সাইরেন পড়ার পর আমরা বের হয়েছি। এখনো কিছু খাওয়া হয়নি আমাদের। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে।
যুদ্ধ শুরম্ন হওয়ার পর থেকে আমাদের খাওয়া দাওয়া প্রায় মাথায় উঠেছে। ভাইয়ারা চলে যাওয়ার পর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। প্রায় দিনই না খেয়ে কিংবা আধপেটা খেয়ে থাকতে হচ্ছে।
বাইরে সম্ভবত কারফিউ চলছে। সাধারণত রাতে কারফিউ থাকে। কিছুৰণ আগে দরজার ফুটোয় চোখ লাগিয়ে দেখলাম রাসত্দায় কোন লোক চলাচল নেই। দু'একটি সাঁজোয়া গাড়ি মাঝে মধ্যে চলাচল করছে।
আমাদের বাসার সবার ছোট ইমন এখন অনেকটা মনমরা হয়ে পড়েছে। সারাৰণ বাসার মধ্যে আটকা থাকতে থাকতে তার এই দশা। ভাইয়াদের কথাও এখন আর তেমন জিজ্ঞেস করে না আমাকে। কিংবা বাবার কথা। হয়তো ও বুঝে গেছে ওরা আর ফিরবে না। মা প্রায় বাকশূন্য হয়ে পড়েছেন। মায়ের কাছে যেতে ইমন এখন ভয় পায়। ও প্রায় সময় আমার কোলের মধ্যে এসে বসে থাকে।'


রাত ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু তুলির ডায়রিতে আমি এতটাই মনঃসংযোগ দিয়ে ফেলেছি যে সেটা ছেড়ে উঠা এখন আমার জন্য প্রায় অসম্ভব। যুদ্ধের স্মৃতি খুব অল্পই লিখেছে তুলি। কিন্তু শত দুঃখ আর কষ্ট কে উপেৰা করে এভাবে লেখালেখি চালিয়ে যাওয়া সত্যিই ধৈর্যেরই পরিচয়। মনে মনে তুলিকে একবার ধন্যবাদ দিয়ে পরের পৃষ্ঠার লেখাতে চলে গেলাম।

'আজ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।
'এ ভাবে আর কতদিন আমাদের বেঁচে থাকতে হবে... আমি জানিনা। আদৌ আমাদের এই বন্দি দশা থেকে মুক্তি মিলবে? নাকি আমরাও হারিয়ে যাব ভাইয়াদের মতো অন্য কোন জগতে... কিছুই জানিনা আমি।
কেন জানিনা, গত রাতে আমি ইমনের জন্য অনেক কেঁদেছি। ও এখন আর আমাকে জিজ্ঞেস করে না ভাইয়াদের কথা। একেক সময় ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে থেকে শুধু বলে, আপু, ভাইয়ারা আর ফিরবে না?
আমি তার প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারিনা। ধৈর্যও রাখতে পারিনা আর। আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া দু' ফোঁটা পানিই ওর প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেয়। আমাকে কাঁদতে দেখে ইমনও কেঁদে ফেলে। আমার দিকে তাকিয়ে ও যখন ওর বোবা দু'চোখে অশ্রম্ন ঝরাতে থাকে তখন আমি আর সহ্য করতে পারিনা। দু'হাতে মুখ ঢেকে আমি ওর সামনেই ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলি। আমাকে কাঁদতে দেখে ইমনই আমাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে। যেন ও অনেক বড় হয়ে গেছে। আমিই ওর কাছে ছোট হয়ে গেছি। ইমন আমার চুলের মধ্যে ওর ছোট ছোট হাতে বিনুনি কেটে দিতে দিতে বলে, আপু, যুদ্ধ কেন হয় বলতে পার?
আমি ওর এ প্রশ্নেরও কোন জবাব দিতে পারিনা।
মিথ্যে বলে যে আমি ইমনের কাছে হেরে গেছি, সেজন্যই আমি গত রাতে ওকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছি। ও যদি বেঁচে থাকে তাহলে বড় হয়ে হয়তো আমার এই অপরাধটুকু ৰমা করে দেবে। কেননা ও যখন জানবে, সেদিন এ ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না তখন নিশ্চয়....' এরপরের লেখাগুলো অস্পষ্ট হয়ে মুছে গেছে। হয়তো এখানে এসে তুলিকে আবার কাঁদতে হয়েছে।
কিছুৰণের জন্যে ডায়রিটা আবার বন্ধ করতে হল আমাকে। তুলিকে আমি অনত্দর থেকে অনুভব করতে লাগলাম। যেন এই মুহূর্তে সে আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি সর্বানত্দকরণে তার দেহের উষ্ণতা অনুভব করতে লাগলাম। আমি অভিভূতের মতো একবার পিছন ফিরে তাকালাম। না, কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে নেই। একবার মনে হল একাত্তর সাল এখনো শেষ হয়নি। আমার আজ রাতের ঘুম তুলির অনেক রাতের নষ্ট হওয়া ঘুমের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আজ রাতটি আমার একাত্তর সালের কোন এক রাতের মধ্যরাত। ঐ তো সাইরেনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি। গোলাগুলির শব্দ, কারা যেন দৌড়ে চলে গেল আমাদের গলির রাসত্দা ধরে শেষ প্রানত্দে। ধুপ ধাপ শব্দ হচ্ছে কোথায়? পাগল হয়ে যাচ্ছি নাতো আমি?
ডান হাতের তর্জনী আঙুল টেনে কপালের ঘাম মুছে ফেলে আমি আবার ফিরে এলাম বাসত্দবে। আজ রাতে আর ঘুম আসবে না আমার। শুধু আজ রাত কেন এই ডায়রির প্রতিটি অৰর পড়ে শেষ না করা পর্যনত্দ আমার আর ঘুম আসবে না।
নূতন করে আবার খুলে বসলাম তুলির ডায়রিটা। যথারীতি কয়েক পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে তুলি লিখেছে, 'আজ ১৬ অক্টোবর, ১৯৭১।
আজকাল ডায়রি লিখতে আর ইচ্ছা করে না। কী হবে লিখে, যত দিন যাচ্ছে ততই যেন সব অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে কোথায়। আমাদের চারদিকে চাপ চাপ অন্ধকার। আমরা বের হতে চেষ্টা করছি, কিন্তু কেউ যেন আমাদের ঠেলে দিচ্ছে আবার ঐ অন্ধকারের দিকে।
আজ সকাল থেকে আমাদের সবার মন খুব খারাপ। অবশ্য বাবা ভাইয়াদের নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই আমাদের মন আর ভাল হয়নি এক মুহূর্তের জন্যও। তার সাথে যোগ হয়েছে যেন আজ আরও একটা ৰত। গত রাতের বন্দুক যুদ্ধ চলার সময় রাতের শেষ প্রহরে আমাদের বাসার পাশেই গুলি লেগে মারা গেল একটা কিশোর ছেলে। ছেলেটাকে আমরা চিনতাম। আমাদের বাসার পিছনের পাহাড়ের নিচটায় ছোটখাট যে বসত্দি এলাকা আছে সেখানে সে থাকতো। গরিব মানুষ; হয়তো কাজে গিয়েছিল কোথাও। ফিরতে রাত হয়েছে; এদিকে কারফিউ শুরম্ন হওয়ায় আর ফিরতে পারেনি। সাথে ওর বাবাও ছিল। বাপ বেটা দু'জনেই হয়তো রাসত্দার পাশে কোন গোপন জায়গায় ঘাপটি মেরে ছিল রাত শেষ হওয়ার অপেৰায়। কিন্তু রাত শেষ হওয়ার আগেই যুদ্ধ বেধে যাওয়ায় ঘটে গেছে বিপত্তি। বেচারারা ভয় পেয়ে দৌড়ে বাসায় ফিরছিল। বাবা আগে আগে দৌড়ে পগার পার হতে পারলেও ছেলে আর রৰা পায়নি পাক সেনাদের গুলির নিশানা থেকে। ওরা যখন দৌড়ে যাচ্ছিল আমাদের বাসার পাশ দিয়ে তখন আমরা সবাই জেগেই ছিলাম। খানিক আগেই চলমান গোলাগুলিতে একটু বিরতি পড়েছিল। আমরা ট্রেঞ্চ থেকে বের হয়ে দরজার ফুটোয় চোখ লাগিয়ে বাইরে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করছিলাম। ইমন কে অবশ্য বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছিলাম। হঠাৎ বাইরে কারো ভয়ার্ত কন্ঠে চেঁচানোর শব্দ শুনে আমরা আবার ফুটোয় চোখ লাগিয়ে দেখতে পেলাম দুজন লোক এদিকেই দৌড়ে আসছে। অন্ধকারে চেনা যাচ্ছে না ওরা কারা। তবে কাছে আসতেই ছেলেটার গলা শুনে আমরা কিছুটা আঁচ করতে পারলাম। ছেলেটা বার বার তার বাবাকে চেঁচিয়ে বলছিল, "বাবা, আমি আগে যাই।" কিন্তু আর ফেরা হয়নি তার। একজন পাকসেনা পিছন থেকে দৌড়ে এসে তীব্র টর্চের আলোয় তাকে দেখে ফেলল। তারপর একবার থামতে বলেই পিছন থেকে গুলি করে দিল। এক গুলিতেই পড়ে গেল সে। অতি নিকটে গুলি হওয়াতে আমাদের কানে কিছুৰণের জন্য তালা লেগে রইল। আমাদের ঘরগুলোও সব বারম্নদের গন্ধে ভরে গেল। গুলি খেয়ে ছেলেটা আমাদের বাসার পাশেই পড়ে ছিল অনেকটা সময়। গুলিটা তার পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুৰণ অচেতন হয়ে পড়ে থাকার পর একবার শুধু মা, মাগো, বলে ডেকে আবার জ্ঞান হারাল সে।
তখন প্রায় সকাল হয়ে এসেছিল। পূবে ভোরের আলো কেবল ফুটতে শুরম্ন করেছে। একজন সৈনিক এসে ওর অচেতন দেহটা ঘাড়ে করে তুলে নিয়ে গেল।
ছেলেটাকে পাহাড়ের নিচে খোলা জায়গায় নিয়ে যেয়ে প্রাথমিক সেবা শুশূ্রষা দেয়া হল। পরে বসত্দিতে খবর পাঠিয়ে তার বাবা কে ডেকে আনা হল। মধ্যরাতের পর থেকেই আমাদের দু'চোখের ঘুম উধাও হয়েছে। আমরা উর্দ্ধশ্বাসে ফুটোয় চোখ লাগিয়ে ছেলেটার শেষ পরিণতি দেখছি। শেষ পর্যনত্দ সকালের প্রথম আলো গায়ে মেখে আহত ছেলে আর বাবাকে নিয়ে ওরা ওদের গাড়িতে চড়িয়ে রওনা দিল হাসপাতালের দিকে। কিন্তু ততৰণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
দুপুরের একটু পর ছেলের লাশ নিয়ে বাবা ফিরে এল হাসপাতাল থেকে।
এমন একটা দৃশ্য স্বচৰে দেখার পর মনে হয় কয়েক রাত আর ঘুম আসবে না আমাদের দু'চোখে। আজ সারাদিন খাওয়া দাওয়া হয়নি, বাকি দিনটাও এমনি ভাবে উপোসই কাটবে আজ।'


তুলির ডায়রিটা যতই পড়ছি ততই যেন স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্রগুলো একের পর এক ফুটে উঠতে লাগল আমার চোখের সামনে। যেন আজ রাতে আমি একাত্তরেরই কোন এক রাতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। বাইরে এখন কারফিউ চলছে। এর মধ্যে দিয়েই চলছে অসহায় মানুষের চিৎকার, চেঁচামেচি আর সেই সাথে অব্যাহত গুলির শব্দ। কী হবে আমাদের দেশের? এ দেশের মুক্তি পাগল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরা স্বাধীনতার জন্য লড়ছে।
রাত বাড়ার সাথে সাথে আমিও যেন মনে মনে উৎকন্ঠিত হতে থাকি। কিন্তু না, আমি নিজেকে আস্বসত্দ করি; এখন আর পরাধীন না আমরা। বিশ্বের বুকে সোজা হয়ে দাঁড়াবার মতো একটু হলেও জায়গা আছে আমাদের। যেখানে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়া যায়। স্বাধীন দেশের মুক্ত মানুষ আমরা।
তুলির ডায়রিতে আবার ফিরে যাই আমি। ১০ নভেম্বর,১৯৭১ তারিখে তুলি লিখেছে, 'আর বোধহয় সম্ভব হবে না ভাল থাকা আমাদের। যতই দিন যাচ্ছে ততই আমাদের আশার শেষ প্রদীপ টুকু নিভে যাচ্ছে। কেউ যদি মেরে না ফেলে তাহলে হয়তো আমরা এমনি মরে যাব। মানুষের জীবনে মৃতু্য বোধহয় এভাবেই সত্য হয়ে যায়। যখন বাঁচার কোন অবলম্বন আর থাকে না তার। স্বপ্নগুলো ভেঙে সব চুরমার হয়ে যায়। বিষণ্ন হয়ে যায় জীবনের প্রতিটি ৰণ।
যুদ্ধ এখন গা সওয়া হয়ে গেছে আমাদের। যুদ্ধ বিমান গুলো পেটে বোমা নিয়ে যখন উড়ে আসে তখনও আমরা পালিয়ে যাই না। ট্রেঞ্চেও ঢুকতে ইচ্ছা করে না আর। মৃতু্য যেন সহজ ঠিকানা এখন আমাদের। জীবনে যখন কিছুই থাকে না আর তখন মৃতু্যর মাঝেই সে যেন শানত্দি খুঁজে পায়। একাকী থাকতে থাকতে আমি যেন অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছি আমার জীবন থেকে। ভাইয়াদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মেরে হুলেস্নাড় তোলা সেই ঘরগুলো আমাদের কতদিন হয়ে গেল শানত্দ নিথর পড়ে থাকে। হুলেস্নাড় দূরে থাক এখন আমি যেন হাসতেই ভুলে গেছি। ভাইয়ারা যাওয়ার দিন যেন আমাদের সব হাসি কেড়ে নিয়ে চলে গেছে। সেই সাথে সাথে আনন্দগুলোও সব। সুখ আনন্দের অফুরনত্দ সাগরের মাঝে আমি যেন রাজকন্যা হয়ে জন্ম নিয়েছিলাম একদিন। সাত ভাইয়ের এক বোন ছিলাম আমি। দুঃখ কাকে বলে জানতাম না তখন। জানতাম না পৃথিবীটা এত দুঃখময়। তাই হয়তো এত তাড়াতাড়িই আমার জীবন থেকে সব সুখ কোথায় হারিয়ে গেল।
দরজার ফুটোয় চোখ রেখে যখন রাসত্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়া বিষণ্ন মানুষগুলোর দিকে তাকাই আমি তখন সব দুঃখ ভুলে যাই। মনে হয় না আর দুঃখটা আমার একার। ভাইয়াদের ফেলে যাওয়া কলম খাতা পেন্সিল গুলো নিয়ে যখন আমি নাড়া চাড়া করি তখন যেন ওগুলো আমার সাথে কথা বলে। আমাকে ওরা জিজ্ঞেস করে, ভাইয়ারা সব কোথায় গেল। আমি কিছু বলতে পারিনা তখন। মিথ্যা বলতে আর ইচ্ছা করেনা। কার জন্যে মিথ্যা বলব। আমার জীবনটাই যেন বড় কোন মিথ্যার কারাগারে বন্দি হয়ে গেছে। সেখান থেকে আর মুক্তি মিলবে না কোনদিন।
কখনো একা বসে ভাবলে মা এসে পিছনে দাঁড়ান। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কী ভাবছিস?
আমি কিছু বলতে পারিনা। নিজেকে আর চেপেও রাখতে পারিনা কিছুতেই। আমার অপ্রতিরোধ্য দু'চোখের পানি কিছুতেই আর বাধা মানেনা তখন। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলি মায়ের সামনেই। মা আমাকে তার কোলের শিশুর মতোই বুুকের সাথে চেপে ধরেন তখন। মা মেয়ে দু'জনেই কাঁদতে থাকি।
এক সময় বুক থেকে মাথা তুলে মা আমার দু'চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলতে থাকেন, দুঃখ পেলে ধৈর্য ধরতে হয় তাতে দুঃখ গুলো সব হালকা হয়ে যায়। বেশি কাঁদলে মৃত ব্যক্তির আত্মারা কষ্ট পায়। তাদের জন্য দোয়া করতে হয়। আমি মরে গেলে তুই কী কাঁদবি আমার জন্য?
আমি দুদিকে মাথা নেড়ে বলি, না।
মা আমাকে আদর করে বলেন, হঁ্যা, আপন মানুষ মরে গেলে কাঁদতে নেই ; দোয়া করতে হয় তাদের জন্য।
আমি ভেবে পাই না মা আমার এত শক্তি কোথায় পেলেন হঠাৎ করে। ইমনও অনেক শক্ত হয়ে গেছে। আমাকে কখনো কাঁদতে দেখলে বলে, আপু তুমি কাঁদবে না আর। আমি আছি না, তোমার কী কেউ নেই? আমি তো তোমাকে ছেড়ে কোথাও চলে যায়নি।
ছোট্ট ইমন বুঝতে পারে না বাবা আর ভাইয়ারা কেউ চলে যায়নি। যদি ও বেঁচে থাকে বড় হয়ে একদিন সব বুঝতে পারবে।
ভাইয়াদের ফেলে যাওয়া কাপড় চোপড়, বইপত্র, বাঙ্ আলমারি, আয়না চিরম্ননি , হাতঘড়ি কিংবা বিছানা পত্র গুলো মাঝে মধ্যে আমি স্পর্শ করি। তখন মনে হয় না ওরা কেউই আর নেই। আর কোনদিন ফিরে আসবে না ওরা আমাদের কাছে। ওদের পুরনো ওইসব জিনিসগুলো বড় অবহেলার সাথে ফেলে রেখে চলে গেছে অন্য কোথাও। মানুষ যখন যায় তখন বুঝি এমনি ভাবেই যায়, পিছনের কথা আর মনেও রাখে না।
ভাইয়ারা চলে যাওয়ার পর তিনজনার মধ্যে আমিই সবচে' বেশি শক্ত ছিলাম। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন আমি ভেঙে পড়ছি। এতদিন যেন ভিতরের অবচেতন মনে একটা বিশ্বাস ছিল আমার। উপরে আর যাই বলি আমি; যেন নিশ্চিত ছিলাম ওদের ফিরে আসার ব্যাপারে। কিন্তু এখন যতই দিন যাচ্ছে আমার সেই বিশ্বাসে যেন চিড় ধরছে। আমি যেন হেরে যাচ্ছি ইমন আর মায়ের কাছে। ওরাই এখন আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। জীবনের বাকি দিনগুলো কিভাবে কাটাব এখন আমি আর ভেবে পাচ্ছি না।'

তুলির ১০ নভেম্বর,১৯৭১ এর লেখা এভাবেই শেষ করেছে এখানে। তুলি নিশ্চয় তখনো ধারণা করতে পারেনি যুদ্ধ শেষ হতে আর মাত্র একমাস পাঁচদিন বাকি। তার এলোমেলো লেখা দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ ভেঙে পড়েছে সে। তার লেখার শেষ ক'টি লাইনেও যেন সেই অনিশ্চিত জীবনের দিকে তার হতাশার কথাই বলে দেয়।

তুলির ডায়রি ঘেঁটে এরপর আর কোন লেখা আমি পাইনি। হয়তো আর কোনকিছু লিখতে মন চায়নি তার। লেখার মানসিক শক্তিও হয়তো এরপর তার পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। তবু আমার কৌতুহল প্রবণ মন খুঁজে বেড়াতে লাগল তন্ন তন্ন করে ডায়রির শেষ পাতাগুলোতে। কিন্তু আর কোন লেখার অবশিষ্টাংশও আমি খুঁজে পেলাম না কোথাও। তবে শেষ পাতায় পৌঁছে আমার ভুল ভাঙল। কপাল ভাল মলাট ছেঁড়া এই ডায়রির শেষ পাতাটা কোথাও হারিয়ে যায়নি। উপর নিচে ছিঁড়ে গেলেও এখনো যথেষ্ট মজবুত হয়ে মূল ডায়রির সাথে ওটা লেগে রয়েছে। সেখানে তুলি আবার লিখেছে, 'পুনশ্চ; জানিনা আমার এই ডায়রিটা কোথায় কার হাতে যেয়ে পড়বে। আর সে আমার লেখাগুলো ধারাবাহিক ভাবে পড়বে কিনা। হোক সে মুদি দোকানের কোন নাম পরিচয়হীন কর্মচারী। অফিসের পিয়ন, রিঙ্া চালক, কুলি, মুটে কিংবা ছাত্র। তার কাছে আমার একটাই অনুরোধ দয়া করে সে যেন আমার এই ডায়রিটাকে আগুন থেকে রৰা করে। কেননা যুদ্ধের এই অবরম্নদ্ধ দিনগুলোতে আমি এমনিতেই পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে গেছি। আমি এখান থেকে একটু মুক্তি পেতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম সমুদ্রে আকন্ঠ নিজেকে নিমজ্জিত করে দেহের সব জ্বালা আর মনের সব কষ্টের আগুন কে নির্বাপিত করতে। কিন্তু তা বোধহয় আর সম্ভব হলো না। গতকাল আমাদেরই এক প্রতিবেশী আমাদের এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে পরামর্শ দিতে এসেছিলেন। তার বক্তব্য; আমরা এখানে একঘর বাঙালি থাকি সেটা মোটেও নিরাপদ না আমাদের জন্য। কিন্তু মায়ের সাফ সাফ জবাব এখানে আমার বাচ্চারা আসে প্রতিদিন আমি তাদের কে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো না। জানিনা কি হবে আমাদের। তবে বোধহয় আমার পরিবর্তে আমার ডায়রির লেখাগুলোও যদি অশানত্দ সমুদ্রের মুক্ত পানিতে কোনদিন ভেসে যাওয়ার স্বাদ পায়; তাহলে হয়তো একদিনের জন্য হলেও আমি মুক্ত পৃথিবীর স্বাধীনতার স্বাদ পাব। পারবেন আপনি আমাকে একদিনের জন্যে হলেও স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিতে?....১০ডিসেম্বর,১৯৭১।

তুলিকে আমি কখনো দেখিনি। কিন্তু তার লেখা গুলো আমি পড়ছি। আর তুলি তার কলমের তুলির আঁচড়ে তার লেখাগুলোকে জীবনত্দ ছবির মতো করে আমার সামনে উপস্থাপন করেছে। যেন আমি তার লেখাগুলো এমনিভাবে রাত জেগে কোনদিন পড়বো তুলি সেটা আগেই জেনেছিল। স্বাধীন দেশের একজন মুক্ত মানুষের কাছে সে তার জীবনে ঘটে যাওয়া একাত্তরের ভয়াবহ স্মৃতিকথা গুলো তুলে দিতে চেয়েছে। হয়তো সে কোন সুদূরের কল্পলোক থেকে জানতে পেরেছিল এ দেশের স্বাধীনতা দেখে যাওয়া তার ভাগ্যে নেই। তবুও অবরম্নদ্ধ তুলির জীবনে একটু খানি মুক্তির স্বাদ এনে দিতে তার অনুরোধ আমি ফেলতে পারলাম না। আমার কাছে মনে হল যেন তুলির ডায়রিটাই এখন আমার কাছে রক্ত মাংসের একজন জীবনত্দ তুলি। যে তুলি ছবি আঁকে, কথা বলে; ছায়ার মতো আমাকে অনুসরণ করে। আমি তাকে দেখতে না পেলেও সে আমাকে প্রতিনিয়তই দেখছে। কালও দেখেছে আজও দেখছে। সুতরাং এখন আমার কর্তব্য একটাই; তুলির স্বাধীনতা তুলির কাছে পেঁৗছে দেয়া।

দেরি করা আর মোটেও চলে না। পরদিনই আমি চলে গেলাম কঙ্বাজার। তারপর ট্রলারে চেপে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমার মনের গোপন উদ্দেশ্য একটাই। সবার অজানত্দে আমার উপর অর্পন করা তুলির এই পরম শেষ ইচ্ছাটুকু পালন করে তুলির আত্মাকে মুক্তি দেয়া।
কেউ জানল না সে কথা, জেনেছিল শুধু তুলি আর জেনে গেলাম আমি। যে তুলি অবরম্নদ্ধ ঘরের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়েও শুধু স্বাধীনতার স্বপ্নই দেখেছিল একদিন। আমি তার সে ইচ্ছাটুকু পূর্ণ করে দিয়ে গোপনে তার মৃতু্যর পর তাকে স্বাধীনতা দিয়ে গেলাম। জানিনা এতে তার বিদেহী আত্মা শানত্দি পাবে কিনা।
তবে যখন তুলির ডায়রি ভাসতে ভাসতে নিমজ্জিত হচ্ছিল সমুদ্রের অশানত্দ ঢেউ আর অথৈ জল রাশির মধ্যে। আমি তখন যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম তুলি সেই ডায়রি বুকে চেপে ধরে অদৃশ্য হল দূর সমুদ্রে।
তুলির কথামতো সেদিন সমুদ্রের কাছে যেয়ে আমি জানতে পারলাম স্বাধীনতার রূপ সৌন্দর্য আর তারম্নণ্যে ভরা বিশালতা। সীমাহীন মুক্ত স্বাধীন আকাশের নিচ দিয়ে এক একটি বিশাল ঢেউ ছুটে আসতে লাগল। মাথায় তার স্বাধীনতার মুকুট জ্বল জ্বল করে দু্যতি ছড়াতে লাগল। তারপর একসময় সে মুকুট সমুদ্রের ফেনা হয়ে ভেসে চলে গেল সীমাহীন দূর অজানায়। আমি মুগ্ধ হয়ে তুলির স্বাধীনতা দেখতে লাগলাম। তুলির জন্যে আমার চোখের দু'ফোঁটা পানি সমুদ্রের লোনা পানির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেল। পরম শ্রদ্ধাভরে বিড় বিড় করে উচ্চারণ করলাম, হে আমার মহান স্বাধীনতা তুমি আমার দুঃখ, আমার ভালবাসা। আমার চিরদিনের শানত্দি; অনত্দরের প্রশানত্দি। তুমি আছ তাই সব দুঃখ আমার আজ ভালবাসা হয়ে গেছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আহমেদ সাবের আপনার মত আমারও পুরনো বই ‘এর দোকান থেকে বই সংগ্রহের বাতিক ছিল। আমার সংগ্রহে ১৯৩০/৪০ সালের অনেক নামকরা বাংলা সাময়িক পত্রিকা ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বাড়ী লুট হয়ে গেলে আমি আমার সব সংগ্রহ এবং নিজের সব লেখা (প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত) হারিয়ে ফেলি। নয় মাসের ডায়েরী একটা ছোট গল্পে স্থান করে দেওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। আপনার গল্প পড়ে সে দিন গুলোর কথা মনে পড়ে গেল।
মদনমোহন চকরবর্তী আপনার জন্মদিন ১০ মার্চ, ২০০০- ব্যাপারটা আপনার ছবির সাথে ঠিক মিলল না। লেখা ভালো লেগেছে।
মোঃ শামছুল আরেফিন তুলি নামের একটি মেয়ের যুদ্ধ চলাকালীন জীবনের খন্দছিত্র।ভাল লেগেছে অনেক।
অদৃশ্য সুন্দর গল্প। ভালো লাগল।
বিন আরফান. বন্ধু তুমি কই কই রে এই প্রাণ বুঝি যায় রে. সরি ভাই মজা করলাম. আপনি অনেক বেস্ততার মাঝে je aste পারেন তাতেই আমি ধন্য. নিয়মিত lekha দিন. আমাদের সংগে থাকুন
বিন আরফান. তোমার তুলিতে স্বাধীনতায় মিশানো বহু মমতা . বহু বার দেখেছি আমি তা. একবার দেখে যাও আমার বঙ্গলিপি কবিতা.
শাহরিয়ার মাহমুদ গল্পটি বাস্তব তাই অনেক কষ্টের, মনে রাখার মত.

২৫ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪