খসড়া

ঈর্ষা (জানুয়ারী ২০১৩)

সালেহ মাহমুদ
  • ২৩
  • ৬২
এক.
বাস থেকে নেমেই ঘড়ির দিকে তাকায় তুহিন। মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে। ক্লাসের এখনো আধ ঘন্টা বাকী। বাস থেকে নেমে আসা ক’জন ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ে না তার। মধুর ক্যান্টিনে যাবে কি-না ভাবতে ভাবতে আর যায় না। ভাবে, ঝাড়-মোছের কাজই হয়তো এখনো শেষ হয় নি। সুতরাং সে ধীরে-সুস্থে উঠে আসে চার তলার পুব-দক্ষিণের ক্লাস রুমটায়।

আটটায় এই ক্লাসটা দারুণ ভোগায় তুহিনকে। যেদিন ঘুম না ভাঙ্গে সেদিন ক্লাস মিস হয়, আর প্রথম বাসটা ধরতে পারলে অন্তত মিনিট বিশেক একা একা বসে থাকে ক্লাসরুমে।

আজো একদম ফাঁকা রুমে এসে ঢোকে তুহিন। বেঞ্চে জায়গা রেখে রেলিংয়ে ভর করে দাঁড়ায়। চমৎকার আবহওয়া। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। মৃদু কাঁপন তুলে দুলে উঠছে কৃষ্ণচূড়ার পাতাগুলো। তুহিন একেবারে নিমগ্ন হয়ে যায় প্রকৃতিতে।

করিডোর ধরে এগিয়ে আসে ওর দু’বান্ধবী আফরোজা আর হেনা। কাছে এসে আফরোজ গলা খাকারি দেয়। কণ্ঠে সুর তুলে বলে, সালাম তুহিন কেমন আছ?

তুহিন খুব খশী হয়। হাসিমুখে বলে, খুব ভালো, তোমরা?
এই তো আছি আর কি। তো খবর টবর কি তোমার? আফরোজার চোখে কৌতুক। দুষ্টুমিভরা চোখে সে তাকায় হেনার দিকে। হেনার মুখেও মৃদু হাসির রেখা। তুহিন ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ব্যাপারটা। খানিকটা বোকা বনে যায় যেন। একটু সপ্রতিভ হতে চেষ্টা করে, আমার কোন্ খবর জানতে চাচ্ছো?
তোমর মানে তোমার ঐ ইয়ের আর কি। চোখ নাচিয়ে সাঙ্কেতিক উত্তর দেয় আফরোজা। কাব্যি করে ওঠে তুহিন,
শুণ্য পুষ্পোদ্যানে ভ্রমিছে ভ্রমর
পুষ্প নেই পত্র নেই গাছে
অসীম শূন্যতা তার বুকের ওপর।
তুহিনের কাব্যিক উত্তরে ওরা পুলকিত হয়। একটু শব্দ করেই হেসে ওঠে ওরা। হাসতে হাসতেই হেনার দৃষ্টি হঠাৎ কৃষ্ণচূড়ার দিকে যায়। খুব উৎসাহ নিয়ে বলে ওঠে, দেখ দেখ ফুলগুলো কি সুন্দর লাগছে তাই না।
ওরা তাকায় ওদিকে। কৃষ্ণচূড়ার মুগ্ধতায় ওরাও আবিষ্ট হয়। তুহিন সুন্দর করে বলে, তোমার মনের মতই সুন্দর হেনা।

হেনা একটু লজ্জা পায়। আফরোজাও কেমন একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায় যেন। কৃষ্ণচূড়ার ডালপালাগুলোও যেন নেচে ওঠে এক পাক। এক ঝাপটা বাতাস বয়ে যায়। আফরোজা একটু ব্যস্ত হয়ে হাতঘড়ি দেখে বলে, এই ক্লাস মনে হয় হবে না। চলো নীচে থেকে ঘুরে আসি।

ফোন করবে নাকি? মজা করে বলে তুহিন।
আফরোজা কোন উত্তর দেয় না, লাজুক হাসে।

ভাগ্যবতী আফরোজা, কয়েন বক্সটা এখনো তাজা আছে। কলাভবনের তিন তলায় কয়েন বক্সটা কোনদিন ভালো ছিল কি-না কে জানে। এমবিএ ভবনের এই ফোনটাও প্রায়ই নষ্ট থাকে। আবার হুটহাট ভালোও হয়ে যায়।
আফরোজা ফোনে কথা বলে। ওরা নোটিশবোর্ডে চোখ বুলায়। হেনা কি ভেবে তুহিনের খুব কাছে চলে আসে। বোর্ডে চোখ বুলাতে বুলাতেই বলে, তুমি কি প্রেম-ট্রেম করো না কি?
কেন কার সাথে করবো? হেসে ফেলে তুহিন।
ক্লাসে কি মেয়ের ঘাটতি আছে? তুহিনের দিকে তাকিয়ে গুটি গুটি হাঁটতে হাঁটতে বলে হেনা।
ধ্যাৎ, কি সব যে বলো না। সহপাঠীদের সাথে আবার প্রেম হয় নাকি?
হয় সাহেব হয়। তোমর কাছে ব্যাপরটা কেমন কেমন মনে হলেও কেউ কেউ প্রেম করেই যাচ্ছে।
চমকিত হয় তুহিন। গরম খবর। ভীষণ উৎসাহ নিয়ে বলে ওঠে, দারুন। একটা গল্প লিখে ফেরা যায়। আচ্ছা, জুড়িটির নাম বলতে পার?
উহু বলা যাবে না।
হেনা তুহিনকে নিরুৎসাহিত করতে চায়। তুহিনের কৌতুহল বেড়ে যায় আরো। সে বলে ওঠে, আহা বলোই না। আমি তো আর কাউকে বলে দিচ্ছি না। ওরা করিডোরে পায়চারী করতে করতে কথা বলছিলো। হেনা কি যেন ভাবে খানিকক্ষণ। তুহিন তাড়া দেয়। হেনা মৃদু হেসে বলে, কিন্তু ব্যাপারটা যে একতরফা।
ছেলের না মেয়ের পক্ষ থেকে? জেরার ধরনে তুহিন প্রশ্ন করে।
ধরো ছেলের।
ছেলেটার নাম বলা যায় না?
না, নাম বলা যাবে না।
তাহলে বলো ছেলেটা কেমন লম্বা না খাটো?
লম্ভা মানে এই মাঝারি গোছের।
ওর কথায় একটু চিন্তায় পড়ে যায় তুহিন। লম্বা শুনেই কিরনের কথা তার মাথায় ঝিলিক দিয়েছিল। কারণ সে-ই পারে মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করতে। কিন্তু মাঝারি শব্দটায় খটকা লাগে। সে আর কারো কথা ভাবতে পারে না। বলে কিরণ নাকি?
ধ্যাৎ, কি সব ছেলের নাম যে বলো না। আর কাউকে খুঁজে পেলে না।
ভীষন বিরক্তি প্রকাশ করে হেনা। ছেলেটি কে ছেলেটি কে ভাবতে ভাবতে তুহিন জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ছেলেটি কেমন?
শুনে একটু ভাবে হেনা। বলে- ভালো, ভদ্র এবং হাসিখুশী। আ..র ছাত্র হিসেবেও ভালো। তবে ছেলেটির পক্ষ থেকে ওসব কিছুই হচ্ছে না। ছেলেটি জানেও না কিছু। ব্যাপারটা একতরফা মেয়ের পক্ষ থেকেই হচ্ছে।
শুনে খুব অবাক হয় তুহিন। এমন একটা ব্যাপার ঘটছে অথচ ছেলেটি কিছুই জানে না। তুহিন অবাক কণ্ঠে বলে, আশ্চর্য ছেলেটি কিছুই জানে না। কেন মেয়েটি কি কিছু বলেনি ছেলেটিকে? ছেলেটিকে জানালেই পারে।
না, তা সম্ভব নয় মেয়েটির জন্য। ওর অবস্থা অনেকটা রবি ঠাকুরের নষ্টনীড় এর চারুর মত। কখন যে অমলকে ভালোবেসে ফেলেছে তা সে নিজেই জানে না। অবশ্য এ চারুর কোন ভূপতি নেই।
উপমাটা খুব চমৎকার লাগলো তুহিনের । সে ঢঙ্ করে অভিনয়ের সুরে বলে, তাহলে তো বিরাট সমস্যা। হৃদয়ের রক্তক্ষরণে মারা যেতে পারে মেয়েটি। বেশ গভীর ভাবনায় হিসাব মিলে যাওয়ার মতো মাথা দোলায় সে, দাঁড়াও লিখেই ফেলবো একটি গল্প। তবে তার আগে নায়ক-নায়িকাকে আরেকটু জানতে হবে।
হ্যা, লিখে ফেলো। তবে একটা কথা গল্পটি কিন্তু প্রথমে আমাকেই পড়তে দিতে হবে। তার আগে কেউ পড়তে পারবে না। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।

আফরোজা এতক্ষনে টেলিফোন ছাড়ে। হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে ওদের দিকে। তুহিন ওর চোখে দুষ্টুমির ছায়া দেখে নিজের ভিতর একটু গুটিয়ে যায়। কিন্তু কেন তা সে বুঝতে পারে না।

দুই.
গল্পটি লিখতে গিয়ে ভীষণ সমস্যায় পড়ে তুহিন। আসলে তার কল্পনাশক্তি এত প্রখর নয়। যাচ্ছেতাই একটা কিছু লিখতেও তার ভালস্নাগে না। তার মাথার ভেতর সেই চরিত্রটি ছায়ার মতো ভেসে ওঠে। তুহিন সার্চ লাইটের আলো ফেলে ছায়ার ওপর। ছায়াটা আরো ছায়াময় হয়ে ওঠে।
ক্লাসের ফাঁকে সে আবার হেনার সাথে আড্ডা দেয়। ওরা গিয়ে বসে জারুল তলায়। হেনা কিছুতেই ছেলেটির নাম বলে না। তুহিন ভাবে মেয়েটি যে হেনা তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ছেলেটি কে? রেজওয়ান নয় তো। সে রেজওয়ানকে নিয়ে গল্প করে। হেনার কোন প্রতিক্রিয়া সে বুঝতে পারে না। তুহিন কথায় মাঝখানে জিজ্ঞেস করে বসে আচ্ছা হেনা ঐ ছেলেটির সাথে মেয়েটির সম্পর্ক এখন কেমন?
হেনা ভাবে খাকিক্ষণ। বলে, কেমন আর, একেবারে সাধারণ বন্ধুর মতো। দেখা হয়, ভালো আছি-নেই ধরণের আলাপ-টালাপ হয়। এই আর কি।
কথা কয়টি বলেই হেনা স্বপ্নচারিতায় মেতে ওঠে। দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। তার চোখে-মুখে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। মোহগ্রস্ত হয়ে যায় হেনা। মোহমুগ্ধ কণ্ঠে বলে, জানো ছেলেটি না খুব সুন্দর। চমৎকার করে কথা বলে। বেশ কটা টিউটোরিয়ালে ক পেয়েছে। আর... এটুকু বলেই বাস্তবে ফিরে আসে হেনা। নিজের বোকামীতে নিজেই লজ্জা যায়। ওর মুখ লাল হয়ে ওঠে। হো হো করে হেসে ফেলে তুহিন।
ধরা পড়ে গেলে হেনা। যাক এবার নিশ্চিন্তে গল্পটি লিখতে পারবো। ক্লাসে যাই চলো। ওরা ক্লাসে যায়। রেজওয়ানের সাথে দেখা হয় করিডোরে। রেজওয়ান তুহিনকে ছোট্ট করে বলে, কিরে মাথায় লবন রেখে কুল খাচ্ছিস নাকি আজকাল?
তুহিন একটু অপ্রস্ত্তত হয়ে যায়। হেসে ফেলে বলে, ধ্যাৎ না বুঝে শুনে কি সব মন্তব্য করিস। তুই না একটা...
তুহিনের কথায় হাসে রেজওয়ান। খুব মজা করে হাসে। তুহিন দমে যায়। যা খুশী ভাবুক ও। তাতে কি? তবে একটি গল্প হবে চমৎকার। আর মশলাপাতি যদি ঠিকমত দেয়া যায়, তবে তো কথাই নেই। দারুণ হিট করবে গল্পটি। ভাবতে ভাবতে গল্পের প্লট সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ক্লাস থেকে ফেরার পথে রিক্সা নেয় তুহিন। রেজওয়ান খোঁচা দেয়, কিরে কি ভাবছিস? খুব মজে গেছিস মনে হয়।
‘আরে না। একটা প্লট নিয়ে ভাবছি। গল্পের।’ তুহিন প্লটটি আদ্যোপান্ত বলে। রেজওয়ান জিজ্ঞেস করে, ‘প্লটটি কি হেনার কাছ থেকে আমদানী?’
তুহিন মিথ্যে বলতে যেয়েও বলে না। সত্যিই কথাই বলে ফেলে। আর যায় কোথায়! তুহিনকে পেয়ে বসে রেজওয়ান, ‘চালিয়ে যা দোস্ত, চালিয়ে যা। আমি আছি তোর সাথে।’
‘কি যা তা বলেছিস?’ প্রতিবাদ করে তুহিন।
‘যা তা নয়, সত্যি কথাই বলছি। ভেবে দেখ ও তোকেই কেন এ ঘটনা বলতে গেল? নায়িকা যে সে নিজেই তা স্পষ্ট। আর তার সেই ভদ্র পাত্রটি হলি স্বয়ং তুই। না হলে সে তোকেই এ গল্পটি বলতে যেত না। সরাসরি বলতে পারবে না বলেই সে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।’
রেজওয়ানের কথায় ধড়ফড় করে ওঠে তুহিনের বুক। কথার পেছনে যুক্তি আছে। এ যুক্তিকে সে কাটাতে পারে না। পারে না বলেই সে আরো ছটফট করে ওঠে ভেতরে ভেতরে। যাকে সে নায়ক ভাবতে শুরু করেছিল , সে-ই তাকে নায়কের আসনে বসিয়ে দিল! কিছুতেই মেলাতে পারে না সে। কিছু বলতেও পারে না রেজওয়ানকে।
সে রাত ছিল এক ঘোরের রাত। কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারলো না তুহিন। অনেক অনেক কথা তার বুকের ভেতর আঁকুপাঁকু করতে লাগলো। প্রস্তত হয়ে গেল তার গল্পের কিয়দংশ।

তিন.
ক্লাস ফাঁকি দেয় তুহিন। ক্যফেটেরিয়ায় বসে থাকে। ক্লাসের বন্ধুরা আসে, রেজওয়ান আসে। ওদের সাথে চা খায়, আড্ডা দেয়। কিন্তু ওর চোখ বারবার ঘুরেফিরে দরজার দিকে চলে যায়। কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। তার প্রতীক্ষার পালা শেষ হয়। কয়েক বান্ধবীসহ ভিতরে প্রবেশ করে হেনা। তুহিন না দেখার ভান করে বাইরে তাকিয়ে থাকে। তুহিনকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় হেনা। ছেট্ট কর একটা চিমটি কাটে ওর ঘাড়ে। ফিরে তাকায় তুহিন। মিষ্টি হাসে ওরা। ফাঁকা টেবিলে বসেই হেনা তুহিনকে ডাকে। তুহিন উঠে গিয়ে বসে ওর পাশে।
হেনা জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন ছিলে?’ ওর মুখে দুষ্টু হাসি।
‘ভালো। তুমি কেমন ছিলে?’
‘ভালো না।’
মাথা সামান্য নেড়ে বলে হেনা। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুহূর্তের জন্য তার মুখে একটা আন্দের কিংবা লজ্জার শিহরণ খেলে যায়। বলে, তোমার কাছে একটা চিঠি লিখেছিলাম।
চিঠি আমার কাছে কোথায় সেটা?
খুব আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে তুহিন। এ রকম কিছু কল্পনাও করতে পারে নি সে। কি লিখতে পারে হেনা? সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। হেনা বলে, আছে আমার ব্যাগের ভিতর।
দাও না, পড়ি একটু।
পড়তে পার তেব একটা শর্ত আছে।
কি সেটা?
পড়া শেষ করেই আমাকে ফেরত দিতে হবে।
ঠিক আছে দাও। বলে হাত বাড়ায় তুহিন।
হেনা ব্যাগ থেকে একটা সুন্দর খাম বের করে তার ওপর সযতনে তার নাম লেখা। ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে তুহিনের হাতে দেয়। সাগ্রহে চিঠিটি পড়তে থাকে সে-

তুহিন, তোমাকে আমার বিশ্বাস একশোভাগ। তবুও পারছি না। তোমাকে তো আমি একটি গল্প বলেছি। সেটিকে গল্পই মনে করো। সেদিন যে কেনো আমি তোমাকে বলতে গেলাম আমার জীবনের প্রথম প্রকাশিত ভুলের কথা, জানি না। জানি এ অন্যায়, এ অনুচিৎ। কিন্তু কি করবো বলো। এতকাল তো চুপ করেই ছিলাম। কিন্তু আর পারলাম না। জানি না তুমি আমাকে কতটুকু শেড দিতে পারবে!
আমি আজ আসতে পারলাম না। তুমি এসো। হ্যাঁ একা এসো। অনেক কথা বলার আছে। আর বিরক্তি কিংবা অস্বসিত্মর কারণ হলে ক্ষমা করো মধুরী কে। ইতি।

মধুরী হেনার গৃহজ নাম। ওর বাবা তাকে এ নামেই ডাকে। তুহিন জানতো সেটি। চিঠিটি দু’বার পড়ে তুহিন। মনে মনে ফন্দি আটে ফটোকপি রাখার। সে চিঠিটি ভাজ করে ঢুকিয়ে ফেলে পকেটে। আপত্তি করে হেনা। তুহিন কেবল হাসে। তুহিন কাউকে লক্ষ্য করছে এমনভাবে তাকায় বাইরে। কাৎ হয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে লোকটি চলে যাচ্ছে। ঝট করে উঠে দাঁড়ায় তুহিন। বলে, ‘এক মিনিট, আসছি।’

দ্রুত বেরিয়ে যায় সে। ঝটপট ফটোকপি করে ফেলে। ফিরে আসে আবার নিজের চেয়ারে। চেয়ার টেনে নেয়া হেনা, ‘আগে চিঠিটি দাও।’
তুহিন হাসতে হাসতে চিঠিটি বের করে দেয়। ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলে হেনা। চেয়ারে বসেই ঝিম মেরে যায় তুহিন। বেখেয়ালী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাইরে। যেন কিছু বলার নেই, ভাববার নেই। কি যেন হারিয়ে গেছে তার। আকাশ পাতাল খুঁজতে থাকে সে। নেই, কিছু নেই। তার মানসী প্রিয়ার যে ছবি এতকাল তার মনে গাঁথা ছিল সে ছবিটি নেই। কেমন যেন কান্নার বুদবুদ উঠে আসতে চায় বুক থেকে। কি একটা নতুন ভাব এসে জড়ো হয় মাথার ভেতর, সে ডায়েরী মেলে ধরে লিখে ফেলে এক টানে-
জারুল তলায় জারুল পড়ে না, শুকনো বকুল ঝড়ে
দখিনা বাতাস, কাড়ে সে সুবাস, জীবনকে ভাঙ্গে-গড়ে।
লাইন দুটো লিখেই যেন নির্ভর হয়ে যায় তুহিন।
ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল হেনা। তুহিনের ডায়েরীটা টেনে নিয়ে পড়ে ফেলে লাইন দুটো। তারপর কি ভাবে কে জানে। অন্যমনষ্ক হয়ে যায় সে।

তুহিন বারবার জানতে চায়, কি বলতে চেয়েছিল হেনা। কেন সে দেখা করতে বলেছিল। কোন উত্তর দেয় না হেনা। শুধু বলে, তোমাকে খুব আপন ভেবেছিলাম তুহিন। এখন দেখছি তুমি অনেক দূরের।

কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগে তুহিনের । সে এখনো সন্দেহ-দোলায় দুলছে। সে বুঝতে পারছে না, কিসের শেড চেয়েছিল হেনা। কি এমন কথা বলতে চেয়েছিল- যার জন্য আড়াল প্রয়োজন! সে ঠিক বুঝতে পারে না।
সেই ছেলেটির নাম জানতে পীড়াপীড়ি করে তুহিন। হেনা কেবল হাসে। খুব রহস্য করে বলে, ইডিপাসের মতো খুঁজে যাও, পেয়ে যাবে।

কথাটির অর্থ বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়। কারণ, গ্রীক ট্রাজেডীর নায়ক ইডিপাসের জীবন ছিল নিয়তির ঘূর্ণচক্রে আবদ্ধ। সম্পূর্ন অজ্ঞাতে দৈব-বিপাকে পড়ে যে অন্যায়-পাপাচারে ইডিপাস লিপ্ত হয়, সে সম্বন্ধে কিছুই জানতো না সে। এ জন্যই তার ঘোষিত চরম শাসিত্ম তার নিজেই উপরই আপতিত হয়। তবে কি যে ছেলেকে সে খুঁজছে- সে স্বয়ং তুহিন? ..... সেতার টংকার ধ্বনি হলো।

হেনা-আফরোজা বাস ষ্টপেজের দিকে এগিয়ে যায়। তুহিনও গল্প করতে করতে চলে ওদের সাথে। বাসের জন্য অপেক্ষা করে ওরা। বাস আসে না। সবাই যে যার মতো চলে যায়।

নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে তুহিন। ওর ভিতরে যেন কিসের দহন চলছে। কড়া রোদ ছাড়িয়ে বৃষ্টির ধারা নামে চারপাশ জুড়ে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয় কতক্ষণ। তারপর থেমে যায়। হাল্কা ভাপ উড়তে তাকে রাসত্মার কালো বুক থেকে। কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ উঠে আসে তার সাথে। ছটফট করে ওঠে তুহিন। ভ্যাপসা গরমে সে অস্থির হয়ে ওঠে। ত্রস্ত-বিচলিত পায়ে হাঁটতে শুরু করে পাবলিক বাস ষ্টপেজের দিকে।

চার.
রাতে বিছানায় অস্থিরভাবে গড়াগড়ি যায় তুহিন। চিঠির ফটোকপিটা বার বার পড়ে সে। তার বুকটা কেমন ভার ভার লাগে, মনে হয় বুকের ওপর যেন কি চেপে বসেছে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে মাঝরাতে। টিনের চালে বিরামহীন বৃষ্টির ছন্দ কান পেতে শোনে তুহিন। তার বুকের গহীন থেকে কান্না উঠে আসতে চায়।
বুকের নীচে বালিশ চেপে ধরে সে। আঙ্গুল দিয়ে বিছানায় আঁকিবুকি করে। হেনার কথা মনে পড়ে যায়, ইডিপাসের মত খুঁজে যাও, পেয়ে যাবে। ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ে সে। বিড় বিড় করে প্রলাপ বকে, ইডিপাস... ওহ্ ইডিপাস
গল্পের বাকী অংশ লেখা হয়ে যায় তার। একটি ঝরঝরে গল্পের খসড়া।

পাঁচ,
সকল থেকেই কালো হয়ে আছে আকাশ। কেমন একটা গুমোট ভাব চারদিকে। এক ফোঁটা বাতাস নেই। একটা কাকের কর্কশ ডাকে ঘুম ভাঙ্গে তুহিনের। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে অনেক বেলা হয়ে গেছে। লাফ দিয়ে উঠে পড়ে সে। তাড়িয়ে দেয় কাকটাকে।
ক্যাম্পাসে পৌঁছতে অনেক বেলা হয়ে যায়। আকাশের গুমোট ভাবটা তখনও কাটে নি। ক্যাম্পাসও যেন কেমন থমথমে। খারাপ লাগে তার। ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে না। ক্যাফেতে ঢুকে চা খায় তুহিন। একটু চাঙ্গা বোধ করে। ক্যাফে থেকে বেরিয়ে কলাভবনের দিকে হেঁটে যায়। কলাভবনের গাড়ি বারান্দায় হেনা রেজওয়ান সহ ক’জন বন্ধুকে দেখে খুশী হয় তুহিন।
লেকচার থিয়েটারের দিক থেকে জঙ্গী মিছিলের শব্দ ভেসে আসে। খোশ মেজাজে হাঁটতে থাকে তুহিন। হঠাৎ তার নজরে পড়ে কয়েকজন ক্যাডার। রেজওয়ানদের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে তারা। তারা একটু নড়েচড়ে গাড়ি বারান্দা কভার করে দাঁড়ায়। মিছিলটা কলাভবনের পশ্চিম পাশ ঘুরে পুবমুখো হতেই ক্যাডাররা এক যোগে পকেট থেকে অস্ত্র বের করে আনে। ফায়ার করে মিছিলের দিকে।
সবাই দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। হেনা আর রেজওয়ানকে তখনো বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুহিন। তুহিন দৌড় দেয় ওদের দিকে। চিৎকার করে বলে, ভিতরো যাও তোমরা।
তুহিনের চিৎকারে ওদের হুঁশ ফেরে। ভিতরের দিকে দৌড় দেয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। মিছিল থেকে পাল্টা গুলি ছোঁড়া হয়। তুহিন মরপণ এক ঝাঁপ দেয় হেনা আর রেজওয়ানের দিকে। তার প্রচ- ধাক্কায় ওরা দু’জন ছিটকে পড়ে। আর শূন্যে ভাসমান অবস্থায়ই একটা গুলি এসে বিদ্ধ হয় তুহিনের বুকে। আর্তনাদ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে সে। ফিনকি দিয়ে তীব্র বেগে বেরিয়ে আসে রক্তের ধারা।
রেজওয়ান আর হেনা নিজেদের সামলে নিয়েই তুহিনের দিকে ফিরে তাকায়। চিৎকার করে ছুটে আসে ওরা। রক্তাক্ত দেহটিকে জাপটে ধরে দু’জনে।
তুহিনের দেহ তখনো ছটফট করছে্, কাঁপছে ওর ঠোঁট। ওরা দু’জন কি করবে ভেবে পায় না। হেনা তুহিনের প্রসারিত হাতের দিকে তাকায়। ডায়েরীটি খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। সদ্য রচিত গল্পের খসড়াটিও ছড়িয়ে আছে এলোমেলো।
গল্পের খসড়াটা হাতে তুলে নিয়ে তাকায় হেনা। তুহিনের দেহ তখন শান্ত, স্পন্দনহীন।
চিৎকার করে ওঠে হেনা, তুহিন না।
ওর বুকফাটা আর্তনাদ ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়। রেজওয়ানের দু’গাল বেয়ে নেমে আসে অশ্রুর বণ্যা।
বাইরে তখনো গুলিবৃষ্টি চলছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি ওর বুকফাটা আর্তনাদ ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়। রেজওয়ানের দু’গাল বেয়ে নেমে আসে অশ্রুর বণ্যা।. বাইরে তখনো গুলিবৃষ্টি চলছে।.......// অদ্ভুত ফিনিসিং 'চলছে' ...ঘটনা বহুল বর্তমানকে নির্দ্দেশ করার একটিইতো মোক্ষম শব্দ....বাহ...সালেহ ভাই ভীষণ ভাল লাগলো...অনেক অনেক শুভকামনা আপনার জন্য.....
ভালো লাগেনি ৩১ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি ভাই। ভালো থাকবেন।
ভালো লাগেনি ৩১ জানুয়ারী, ২০১৩
জাকিয়া জেসমিন যূথী অসাধারণ একটা গল্প। একেবারে শুরু হতে শেষ পর্যন্ত চুম্বক আকর্ষণে পরে গেলাম। খুব ভালো।
ভালো লাগেনি ২৮ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ জুঁইফুল।
ভালো লাগেনি ২৮ জানুয়ারী, ২০১৩
তাপসকিরণ রায় হ্যাঁ,পড়লাম,ভালো লাগলো গল্পটি।ভাব ভাষা ধারাবাহিকতা সামঞ্জস্যপূর্ণ--তবে মনটা খারাপ হয়ে গেল নায়কের মৃত্যুতে।লেখককে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।
ভালো লাগেনি ২৭ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ২৭ জানুয়ারী, ২০১৩
Lutful Bari Panna দারুণ সালেহ ভাই। একটা বাস্তব নগ্ন চিত্র আর অনেকদিন পর আপনার তাজা হাতটির ছোঁয়া...
ভালো লাগেনি ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ পান্না ভাই।
ভালো লাগেনি ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩
পন্ডিত মাহী গল্পটি বেশ পড়তে। তবে শেষের অংশে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচানোটা একটু সিনেমাটিক লেগেছে।
ভালো লাগেনি ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ পণ্ডিত মাহী।
ভালো লাগেনি ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩
শাহ আকরাম রিয়াদ কাউকে বিশ্বাস নেই। এত সুন্দর রোমাস্টিজম এর পরিনতি ট্রাজিক হয়ে গেলো। কষ্ট পেলেও ভাল লাগল।
ধন্যবাদ শাহ আকরাম রিয়াদ।
মামুন ম. আজিজ ছাত্র জীবনের গল্প...যুবক যুবতীর মন মানসিকতার পূর্ণ পরিস্ফুটনে এক বাস্তবতার দশর্ণ যেন
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ মামুন ভাই। ঠিকই বলেছেন, ছাত্র জীবনের সমাপ্তি লগ্নে লেখা এই গল্পটি।
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১৩
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ ক্ল্যাসিক গল্প । হৃদয়ের গহনে দোলা দিয়ে যায় অজান্তে । ধন্যবাদ সালেহ ভাই ।
ভালো লাগেনি ২০ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ জালাল উদ্দিন মুহম্মদ ভাই।
ভালো লাগেনি ২০ জানুয়ারী, ২০১৩
প্রিয়ম কিন্তু আমাদের প্রতিষ্টানের এই চিত্র বন্ধ হবে কবে ??????????????????????????
ভালো লাগেনি ১৯ জানুয়ারী, ২০১৩
তা তো আমিও জানি না ভাই। আদৌ বন্ধ হবে কি না কে জানে! এই দেখুন না গতকালও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গুলি বিনিময়ের শিকার হলো এক শিশু!!! আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থার অবসান হবে না। রাজনীতি থেকে পেশীবাদ দূর করতে হবে। আদর্শিক রাজনীতির প্রবর্তন করতে হবে। শুধুমাত্র ক্ষমতার হাত বদল হতে থাকলে এই অবস্থার অবসান কোনদিনও হবে না। ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ১৯ জানুয়ারী, ২০১৩
স্বাধীন দারুন একটা গল্প। তুহিনের জন্য খুব মায়া লাগছে।
ভালো লাগেনি ১৩ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ স্বাধীন। ভালো থাকবেন।
ভালো লাগেনি ১৩ জানুয়ারী, ২০১৩

২৫ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪