ভাওয়াল রাজের উপাখ্যান

বৃষ্টি (আগষ্ট ২০১২)

সালেহ মাহমুদ
  • ৩৪
একটা মিষ্টি স্বপ্ন দেখছিল টুকু। খুব গভীর এবং পরিপূর্ণ স্বপ্ন। ঘুমের মাঝেই স্বপ্নের সাথে সাড়া দিতে গিয়ে শব্দ করে হেসে ফেলে সে। আর তখনই ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। মিটমিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কেউ খেয়াল করলো কিনা। না, কেউ নেই ঘরে। দরজাটা আলগোছে ভেজানো।
যাক আশ্বস্ত হয় সে। ঘুম ভাঙলেও ঘুম ঘুম আবেশ জড়িয়ে ধরে টুকুকে। চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে পড়ে থাকে। তন্দ্রা এসে ভর করে তার ওপর। এই আধো ঘুম আধো জাগরণের ভিতরই তার মনে হয় বাইরে এক ঝাঁক চড়ুই এসে কিচির মিচির শুরু করে দিয়েছে। থেকে থেকে ডেকে উঠছে একটা অচেনা পাখি। কোত্থেকে যেন কয়েক রকম তাজা ফুলের মিশেল গন্ধ ভেসে আসছে। গন্ধটি আসেত্ম আসেত্ম যেন তার শিয়রে এসে থমকে গেলো। টুকু খুব মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করে, আসলে কি এটাও স্বপ্ন, নাকি সত্যি সত্যি। মনোযোগ দিতেই সে কারো গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ উপলব্ধি করে তার শিয়রে। সে বুঝতে পারে এটা তন্দ্রা এবং বিষয়টি আসলেই সত্যি। কেউ তার শিয়রে ফুলের ডালি নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
আড়ষ্ট হয়ে যায় টুকু। এই নতুন পরিবেশে তার গভীর ঘুম হয়েছে তাতেই সে অবাক। কারণ নিজের বিছানা ছাড়া আর কোথাও ঘুমাতে পারে না সে। অথচ একেবারে ভিন্ন পরিবেশে কি গভীর ঘুম হলো তার। শিয়রে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকাতেও লজ্জা করছে তার। তার শিয়রে কে দাঁড়িয়ে? চন্দ্রমল্লিকা নয় তো? সে-ই হবে, আর কেউ তো হবার কথা নয়।
আরো কি সব ভাবছিলো টুকু। এমন সময় তার কানে কানে কেউ বলে, টুকু তোমার তো ঘুম ভেঙ্গে গেছে, ওঠো। দেখ, কত ফুল এনেছি তোমার জন্য। বাইরে কি সুন্দর ঝরঝরে প্রকৃতি, পাখি ডাকছে, সূর্য কি সুন্দর করে হাসছে, চেয়ে দেখো- এক ঝাঁক চড়ুই তোমাকে বরণ করার জন্য অপেক্ষা করছে লিচু গাছ জুড়ে। ওঠো, এমন সকাল আর পাবে না হয়তো।
টুকু লজ্জায় মরে যায়। এমন অভূতপূর্ব আবাহন সে কল্পনাও করতে পারে নি। ধীরে ধীরে চোখ মেলে টুকু। দেখে, তার মুখের উপর ঝুঁকে আছে চন্দ্র। মুখে তার মোহনীয় হাসি। টুকু সেই হাসিতে মোহিত হয়ে যায়। মিষ্টি হেসে কাব্য করে ওঠে,
ওই চন্দ্রবদন দেখে ঘুম ভাঙ্গে যদি
লাজ রাঙা চোখে যদি চোখ পড়ে যায়
তাহলে ভিড়াও তরী সময়ের মাঝি
সুখের সায়রে যেন পৃথিবী হারায়।
চন্দ্রমল্লিকা অদ্ভূত মোহিত হয়ে যায়। টুকু এত সুন্দর কাব্য করতে পারে! লজ্জায় তার চেহারা লাল হয়ে ওঠে। চোখ সরিয়ে নেয় সে টেবিলে। ট্রে থেকে দুধের গ্লাসটা তুলে নেয়। বাড়িয়ে ধরে টুকুর দিকে। টুকু ততক্ষণে উঠে বসেছে। গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলে, আমার তো বাসিমুখে কিছু খাওয়ার অভ্যেস নেই। একটু ফ্রেশ হয়ে নেই আগে।
একটু না হয় ব্যতিক্রম হলোই বা, তাতে কি। আগে দুধটুকু খেয়ে নাও। পেটের সমস্ত ঝামেলা একদম দূর হয়ে যাবে। দেখবে শরীরটাও বেশ ঝরঝরে লাগছে।
টুকু আর কিছু বলে না, কুসুম গরম দুধটুকু দু’তিন ঢোকে সাবাড় করে দেয়। তার মনে হয়, সত্যিই তো অন্য রকম লাগছে শরীরটা। দুধটুকু শেষ হলেও দুধের গ্লাস হাতে কি যেন ভাবছিল টুকু। চন্দ্র এবার সাজানো ফুলের ডালি থেকে একটা বড় বকুল ফুলের মালা তুলে নিয়ে টুকুর গলায় পরিয়ে দেয়। টুকু ইতস্তত করতে করতে বলেই ফেলে, আরে আরে এসব হচ্ছে কি?
চন্দ্র মিষ্টি করে হাসে। তুমি তো আমাদের বাড়ীতে প্রথম এলে, প্রথম রাত কাটালে, তোমাকে তো কোন আপ্যায়ন করতে পারলাম না। এটুকু শুভেচ্ছাও কি জানাতে পারবো না তোমাকে?
টুকু লজ্জা পেয়ে যায়। কি করবে বা কি বলবে কিছুই বুঝতে পারে না। শুধু এতটুকু বোঝে- বাড়াবাড়ি রকমের যত্নআত্তি করা হচ্ছে তাকে।
চন্দ্র বাইরের দিকে মুখ করে কাউকে ডাকে, আয়রে তোরা আয়।
চন্দ্র’র ডাকের অপেক্ষায়ই যেন ছিল ওরা। তিনচারজন ছোট ছোট বাচ্চা এসে ঢোকে ঘরে। একজনের হাতে কাঠের একজোড়া খড়ম, সে ওটা রাখে খাটের সামনে। আরেকজন একটা তোয়ালে এনে রাখে খাটের ওপর। আরেকজন ছোট ছোট করে কাটা অনেকগুলো চিকন ডালসহ একটা কাসার থালা এনে রাখে টেবিলে। আরেকজন একটা কাসার থালায় করে টুথপেস্ট, টুথ পাউডার, একটা কৌটায় মিহি সাদা ছাই এনে রাখে টেবিলে। চন্দ্র’র ইশারা পেয়ে আবার যার যার মতো সবাই চলে যায় ঘর থেকে।
টুকুর হতভম্ব ভাবটা আরো বেড়ে যায়। তারপরও সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করে। বিছানা থেকে নেমে খড়ম পায়ে দেয়, তোয়ালে তুলে নেয় কাঁধে। কাঁসার থালা থেকে বেছে বেছে একটা নিমের ডাল তুলে নেয়, হাতের তালুতে টুথ পাউডার ঢেলে নিমের ডালের নরম অংশটুকু দাঁত দিয়ে কামড়াতে কামড়াতে টুক টুক করে এক পা দু পা করে দরজার দিকে যেতে থাকে।
খড়ম পায়ে টুকু’র নিখুঁত হাঁটা দেখে অবাক হয় চন্দ্র। পরক্ষণেই মিষ্টি হেসে স্বগতোক্তি করে ওঠে, আমাকে হারিয়ে দিলে টুকু।

হারান কাকা সণান সেরে ফিরতেই নাস্তার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। বিছানার উপরে পাতা বড় দস্তরখান ভরে যায় নাস্তার বিভিন্ন পদে। হরেক রকম পিঠা, পায়েশ, গরম গরম লুচি, চিকন চালের ভাত, বেগুন ভাজি, মুরগীর মাংসের ঝোল তরকারী, বড় মাছের দোপিয়াজো, মুড়িঘন্ট ইত্যাদি আরো কত কি। নাস্তার বহর দেখেই টুকুর চোখ কপালে ওঠে। সে এক প্রকার অসহায়ের মতো তাকায় হারান কাকার দিকে। হারান কাকা দরাজ হাসে। চন্দ্রকে ডাক দিয়ে বলে, মারে তোর আব্দুল্লা কাকারে ডাক দে না মা। আমি দাদারে কাপড় পড়তে দেইখা আইছি।
আব্দুল্লা কাকা নাম শুনে অবাক হয় টুকু। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় হারান কাকার দিকে। হারান কাকা বোঝে ব্যাপারটা। বলে, আরে আব্দুল্লা হইলো আমার আপন কাকাত ভাই। আমাদের এই পাড়ায় তো জাত-পাত নিয়া কারো কোন মাথা ব্যথা নাই। তোমার বাজানের লাইগ্যাই আমাগো ভিতরে এমুন একটা সর্বংসহা মনোভাব গইড়া উঠছে। তো অইছে কি, দাদা গতবার পুরা পরিবার লইয়া মুসলমান হইয়া গেছে। উনি তোমার বাজানরেও চিনে খুব ভালা কইরা। সকাল বেলা দাদারে তোমার কথা কইলাম। দাদায় তো দারুন খুশি। তোমার লগে দেহা করানো আর নাস্তা খাওয়ানো এক কামে দুই কাম অইয়া গেলো আর কি, হাহ্ হাহ্ হা।
কথাগুলো বলতে না বলতেই আব্দুল্লা কাকা এসে ঘরে ঢুকেই লম্বা করে সালাম দেয় টুকুকে। টুকু সালামের জওয়াব নিয়ে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে মুসাফাহা করে। আব্দুল্লা কাকা বুকে জড়িয়ে ধরে টুকুকে। স্পষ্ট উচ্চারণে দরাজ গলায় দোয়া করে- আল্লাহুম্মা জিদ মুহাববাতি লিল্লাহে ওয়া রাসুলিহি। টুকু মুগ্ধ হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে আব্দুল্লা কাকা খুব ভালো করে জেনে বুঝেই মুসলমান হয়েছে। তার মতো নাম কা ওয়াস্ত মুসলমান নয়। আব্দুল্লা কাকা বলে, বাবা তোমার কথা সকালে দাদার কাছে হুনছি। তারপর থেক্যাই তোমার লগে দেহা করনের লইগ্যা মনটা আনচান করতাছে। তুমি বসো বাবা, ভালো আছ তো তুমি?
জ্বি কাকা, ভালো আছি। আপনিও বসুন, আসুন।
বলে টুকু আব্দুল্লা কাকাকে বিছানায় ওঠার জায়গা করে দিয়ে নিজেও বিছানায় উঠে বসে।
নানান পদের নাস্তা খুব বৈঠকী চালে খেতে থাকে সবাই। এটা সেটা নিয়ে কথাবার্তা হয়। কথা বলতে বলতেই টুকু প্রসঙ্গ টানে, কাকাবাবু, কাল রাতে রানীর ঘাট দেখলাম।
কথাটা বলতে বলতেই পাশে দাঁড়ানো চন্দ্রমল্লিকার দিকে তাকায় টুকু। টুকুর কথা শেষ হবার আগেই চন্দ্রমল্লিকা দু’চোখ বড় বড় করে জিহবায় কামড় দিয়ে ফেলে। টুকু থতমত খেয়ে যায়। কথা গুলিয়ে ফেলে বোকার মত তাকায় হারান কাকার দিকে। হারান কাকা অবাক হয়ে টুকুর দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি রানীর ঘাট দেখছ? গত রাত্রে? কি কও তুমি? এত রাতে তুমি ওইদিকে গেছিলা? সাথে কেউ ছিল তো?
‘হ কাকা, তুমি জোছনার মধ্যে ঘুমাইয়া গেলে উনি কি মনে কইরা ওইদিকে যাইতে থাকেন। তখন আমি খেয়াল কইরা ওনার সাথে যাই। আমিই ঘাট দেখাই ওনারে।’ অনেকটা কৈফিয়তের সুরে টুকু’র হয়ে জবাব দেয় চন্দ্রমল্লিকা।
হারান কাকা এবার আশ্বস্ত হয়। বলে, ওহ্ বাঁচা গেলো। আমি তো ডরাইয়াই গেছিলাম। ওইদিকের জায়গা তো ভালা না বাবা। শ্মশান ঘাট হইল ভুত-পেত্নির আড্ডাখানা। ওইদিকে যাও নাই তো!
না কাকা, ওদিকে যাই নাই। ঘাট দেইখাই ফেরত আইছি। আইয়া ঘরে হুইয়া ঘুমাইয়া গেলাম, আপনে তহনো বাইরে।’ একেবারে গেরস্থালি ভাষায় কথা বলে টুকু।
হারান আর আব্দুল্লা কাকা খুশি হয়ে যায়। হারান কাকা বলে, আইচ্ছা ঘাট দেখছ বুঝলাম। তুমি জানি কি জিগাইতে চাইছিলা, জিগাও এইবার।
হ কাকা, ঘাট তো দেখলাম। কিন্তু রানীর প্রাসাদ তো দেখলাম না!
ও, এই কথা। এই বিষয়ডা তোমার এই কাকায় ভালো জানে। দাদা, আপনের কাছে অনেকবার হুনছি প্রাসাদের কথা, আজকাও আবার হুনমু।
আব্দুল্লা কাকা খাবার থেকে মুখ তুলে বললেন, আইচ্ছা ঠিক আছে, আগে নাস্তা শেষ করো, তারপর বেকতে মিল্যা প্রাসাদ দেখতে যামু নে, ঠিক আছে?

রানীর ঘাট পার হয়ে শ্মশান ঘাটে এসে ঢোকে হারান কাকা, আব্দুল্লা কাকা, রায়হান টুকু আর চন্দ্র মল্লিকা। পুরো শ্মশান ঘাট জুড়ে অদ্ভূত নিরবতা। শ্মশান ঘাট এর সীমানা বেশ বড়। বিঘা চারেক তো হবেই। সীমানা জুড়ে পুরনো ভেঙ্গে যাওয়া প্রাচীরের চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে। শ্মশান ঘাটের ঠিক মাঝখানে এসে পুরো সীমানা জুড়ে চোখ বুলালেন আব্দুল্লা কাকা। তার দেখাদেখি সবাই সীমানাটা একবার দেখে নিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, এটাই সেই রানীর প্রাসাদ। এখানেই ছিল সর্বশেষ ভাওয়াল রাজার গোপন প্রেম মন্দির।
আব্দুল্লা কাকা বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। অনেকটা ইতিহাসবেত্তার মতো গাম্ভীর্য নেমে এলো তার মাঝে। তিনি নির্ভেজাল শুদ্ধ ভাষায় বলতে শুরু করলেন- এই যে সীমানা প্রাচীর দেখা যাচ্ছে, এর চারদিক দিয়ে ভাওয়াল রাজের একান্ত বিশ্বস্ত একদল অনুচর পাহারায় থাকতো। দোতলা ভবনের পুরো নীচতলা ছিল অনুচর, সৈন্য, আস্তাবল, ভাড়ার ঘর ইত্যাদি। দোতলা ছিল শুধুমাত্র রানীর জন্য নির্ধারিত। সেখানে নানা প্রকোষ্ঠে রানীর সেবা করার জন্য সেবিকারা থাকতো। একেবারে পূবে নদীর ধারে বিশাল উন্মুক্ত গৃহ ছিল একটা। এখানে রাজা রানীকে নিয়ে অবসর সময় কাটাতেন। এখানে কোন রাজকার্য হতো না। রাজা শুধুমাত্র অবসর যাপন করতেন। এই রানীর বিষয়ে তার একান্ত বিশ্বস্ত কয়েকজন ভৃত্য আর অনুচর ছাড়া আর কেউ কিছু জানতো না। তিনি প্রতি মাসেই সেই রাজেন্দ্রপুরের রাজবাড়ী থেকে জমিদারী তদারকীর নাম করে বজরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। আর দিনে দিনে এখানে এসেই কাটিয়ে দিতেন কয়েকদিন। কখনো কখনো সপ্তাহও পার হয়ে যেতো।
রাজার এই রকম অনিয়মের কারণে রাজমহিষীর মনে এক সময় সন্দেহ দেখা দেয়। তিনি গোয়েন্দা নিযুক্ত করেন এবং রাজার একান্তু গোপন এই প্রেমের বিষয়ে অবগত হন। ওদিকে রাজমহিষীও যুবক রাজবৈদ্যর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। এই সুযোগ তিনি গ্রহণ করতে চাইলেন।
এটুকু বলেই থামলেন আব্দুল্লা কাকা। মনে হলো তিনি খুব বিমর্ষ হয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে তিনি বলতে চাচ্ছেন না আর তার পরের কাহিনী। টুকু, চন্দ্র খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল তার কাহিনী। টুকু আর ধৈর্য ধরতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসে, তারপর কি হলো কাকা?
তারপর, তারপরের কাহিনী খুব ধোঁয়াসাপূর্ণ অথবা করুণ। আমার কাছেও এ নিয়ে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। এর পেছনে যুক্তিও আছে। সেই কাহিনীই বলি।
রাজমহিষী রাজাকে শায়েস্তা করার জন্য একটি বিশেষ বাহিনী গঠন করেন। যে বারের ঘটনা বলছি সেবার খুব বৃষ্টি হয়। বর্ষার শুরুতেই নদীতে পানি থৈ থৈ করতে শুরু করে। এ রকম ভরা বর্ষায় রাজা এই প্রেম প্রাসাদে আসেন অবসর যাপনের জন্য। যেদিন তিনি এখানে এসে ওঠেন ঠিক তার দু’দিন পর রাজমহিষীর সেই বিশেষ বাহিনী আক্রমণ করে রানীর প্রাসাদ।
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। রাজা মগ্ন ছিলেন নৃত্যগীত নিয়ে। জলসা শেষ হয় মধ্যরাতে। যার যার মতো সবাই নিজ নিজ কক্ষে গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে যায়। এমনকি প্রহরীরাও। এই সুযোগটুকু কাজে লাগায় বিশেষ বাহিনী। তারা নদীর দিকের খাড়া দেয়াল বেয়ে বেয়ে উঠে যায় রাজপ্রাসাদে। তারা প্রতিটি কক্ষে প্রবেশ করে যাকে পায় তাকেই কচুকাটা করে ফেলে। শুধুমাত্র রাজা আর রানীকে ধরে প্রাসাদ থেকে বেশ খানিকটা দূরে নিয়ে যায়। তাদের দু’জনের মুখে বিষ ঢেলে দিয়ে তারা রাজপ্রাসাদে আগুন ধরিয়ে দেয়। এদিকে রাজপ্রাসাদ জ্বলতে থাকে দাউ দাউ করে আর ওদিকে বিষক্রিয়ায় অচেতন হয়ে পড়ে থাকে তারা দু’জন। এভাবেই করুণ সমাপ্তি ঘটে এই রাজপ্রাসাদের। তারপর ধীরে ধীরে এটা শ্মশানঘাটে পরিণত হয়।
এই করুণ ঘটনা শুনে সবাই খুবই মর্মাহত হয়, টুকুও থমকে যায়। ভাবে, এমন নিষ্ঠুর কি হতে পারে কোন স্ত্রী? নিজ স্বামীকে এভাবে বিষ পান করিয়ে মেরে ফেলাটা খুব খুব জঘন্য কাজ। কিন্তু কাকা তো বললেন, তারা বিষক্রিয়ায় অচেতন হয়ে যায়। তাহলে কি তারা মারা যায় নি? প্রশ্নটি মাথায় খেলতেই সে আব্দুল্লা কাকাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা কাকা আপনি তো বললেন- তারা দু’জন অচেতন হয়ে যায় বিষক্রিয়ায়। তাহলে কি তারা মারা যায় নি? তারা কি বেঁচে ছিল?
এবার আব্দুল্লা কাকা সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালেন টুকু’র দিকে। তুমি তো কথার ভালো মারপ্যাচ বোঝ বাপু। বাহ্ সুন্দর প্রশ্ন করেছ। এখানেই সেই ধোঁয়াসাপূর্ণ অথবা করুণ কাহিনীর রহস্য। এ নিয়ে বিশাল কাহিনী আছে। কেউ কেউ বলেন তারা মারা গেছে, কেউ কেউ বলেন তারা বিষপানে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, মারা যান নি। কোন এক সন্যাসি তাদের উদ্ধার করে গাছগাছালির সাহায্যে চিকিৎসা করে তাদের সুস্থ করে তোলেন। তারপর তারা দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকা চলে যান বার্মায়। সেখানে তারা দশ কি বারো বৎসর সুখে দিন কাটান। এক সময় কঠিন অসুখে পড়ে রানীর মৃত্যু হলে তিনি আবার ফিরে আসেন জামিদারীতে। কিন্তু মহারানী প্রথমে তাকে অস্বীকার করলেও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। কিন্তু সেই প্রেমিক রাজবৈদ্যের পরামর্শে মহারানী তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। রাজা নিরূপায় হয়ে চলে যান কলকাতায় এবং ইংরেজ কোর্টে জমিদারী ফেরত পেতে মামলা ঠুকে দেন। দীর্ঘদিন চলে এই মামলা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাজা তার জমিদারী ফেরত পেয়েছিলেন, কিন্তু ততদিনে ইংরেজ রাজত্ব শেষ। রাজার জমিদারীও শেষ হয়ে যায় সেই সাথে।
খুব সংক্ষেপে হলেও ভাওয়াল রাজের কাহিনী বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয় টুকুর কাছে। খুব ভালো লাগে তার। অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলে না। সবাই শুধু রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ দেখে চেয়ে চেয়ে।
টুকু কি মনে করে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় পূর্ব দিকে নদীর ধারে। সীমানা প্রাচীর থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে এসে দাঁড়ায়। যেখানে দাঁড়ায় সে জায়গাটা একটু অন্যরকম মনে হতেই মাটির উপর ঝুঁকে পড়ে মাটিতে কান পাতে টুকু। কি আশ্বর্য, অপূর্ব সুরলহরী শুনতে পায় সে। তার দেখাদেখি চন্দ্রমল্লিকাও এসে কান পাতে সেখানে। সেও আশ্চর্য হয় খুব। হারান কাকাও বাদ যান না এই কৌতুহল থেকে। শুধুমাত্র আব্দুল্লা কাকা তাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে হাসতে থাকেন।
টুকু বিষয়টা খেয়াল করে মাথা তুলে বলে, কাকা বিশ্বাস না হয় আপনিও কান পেতে দেখুন কি সুন্দর সুরলহরী।
কাকা হাসতে হাসতে বলেন, তোমরা একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছ তাই এমন মনে হচ্ছে। আরো একটা ঘোরে আমি তোমাদের ফেলতে পারি, যদি তোমরা রাজি থাক।
সবাই একবাক্যে বলে, হ্যা রাজি। আপনার সেই ঘোরটা দেখতে চাই আমরা।
তাহলে তোমরা সবাই ওখান থেকে সরে এসো। আমার জায়গায় এসে দাঁড়াও। যাই দেখো, ঘাবড়াবে না, একচুল নড়বে না, শুধু দেখে যাবে, ঠিক আছে।
ঠিক আছে। সবাই একবাক্যে সায় দিয়ে আব্দুল্লা কাকার জায়গায় এসে দাঁড়ায়। আব্দুল্লা কাকা সরে এসে তাদের কান পাতা জায়গাটার উপর পূর্বমুখী হয়ে দাঁড়ায়। দু’হাত আসমানের দিকে প্রসারিত করে বিড়বিড় করে কি যেন আওড়াতে থাকে। আর কি আশ্চর্য ধীরে ধীরে আকাশ কালো হয়ে যায়। বিজলী চমকাতে শুরু করে আকাশজুড়ে। মুহুর্মূহু বজ্রপাত হতে থাকে। ঝমঝম করে নেমে আসে বৃষ্টি। সেই সাথে তারা আশ্চর্য হয়ে দেখতে থাকে একটি রাজপ্রাসাদ দৃশ্যমান হতে থাকে তাদের চারপাশ জুড়ে। দ্বিতল রাজপ্রাসাদের দোতলার সেই উন্মুক্ত গৃহে রাজা-রানী বসে আছেন নিবিড় ভাবে। বৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে রাজা গান গেয়ে ওঠেন-
ও লক্ষা রে..., ও.... লক্ষা রে...
অঝোর ধারায় বৃষ্টি যে তোর
বুকের উপর পড়ে রে,
তোর বুকের উপর পড়ে...
তাই কি রে তোর বুকেরি ঢেউ
উথাল পাথাল করে রে...
উথাল পাথাল করে...

ও লক্ষা রে... শীতলক্ষা রে
দেখ না চেয়ে আমার পিয়ার
বক্ষে তুফান উঠছে রে.... বক্ষে তুফান উঠছে
সেই তুফানে ডুবছি আমি
ডুবছি সেই তুফানে রে... ডুবছি সেই তুফানে
ও লক্ষা রে... শীতলক্ষা রে.....
শীতলক্ষা রে...

অদ্ভূত সেই মোহনীয় গানের রেশ কাটতে না কাটতেই সবকিছু ছায়াবাজীর মতো মিলিয়ে যেতে থাকে। আর তন্দ্রাহত হয়ে অদ্ভূত ঘোরের ভেতর নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে শ্মশানঘাটের সেই কৌতুহলী ক’জন মানুষ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিজানুর রহমান রানা সুন্দর গল্প, অনেক শুভেচ্ছা।
ধন্যবাদ রানা ভাই।
মনির মুকুল দাদীর কাহিনী বলা সেই ছোটগল্পটা পড়েই বুঝেছিলাম এই ধরনের গল্পে আপনার হাত কতটা পরিপক্ক। ....চমৎকার লেখনী। পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মুগ্ধতার ছোয়া....
ধন্যবাদ মনির মুকুল ভাই। দাদীর কাহিনী’র কথা মনে আছে বলে খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ আপনাকে।
শুধু কি দাদী! হৃদয়বান মাস্টার সাহেবের কথাও আছে...
ফয়সাল বারী Excelent
ধন্যবাদ ফয়সাল বারী।
মিলন বনিক এত সুন্দর স্বপ্ন...আর অসাধারণ সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মনে হয়নি স্বপ্ন....অনেক অনেক ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম...অনেক শুভ কামনা...
ধন্যবাদ এবং শুভো কামনা
Azaha Sultan দাদা, অসাধারণ.......আর খড়মের চলটা কি এখন আছে.......হাহাহা......অনেক ভাল লাগল
ধন্যবাদ দাদা। গল্পের ঘটনার কালপ্রবাহ কিন্তু নব্বুইয়ের দশকের মোবাইল প্রচলনের ঠিক আগের সময়ের। খড়ম এখন আনুষ্ঠানিকতা কিংবা মজা করার জন্য অনেকে ব্যবহার করে, ঠিক প্রচলন নেই।
মোঃ আক্তারুজ্জামান ভাওয়াল রাজের উপাখ্যান- এ ও চন্দ্র মল্লিকা বর্তমান! দেশী ভাই স্বমহিমায় আপনি সমুজ্জ্বল।
আক্তার ভাই অনেক ধন্যবাদ এই ক্ষুদ্র ব্যক্তিটিকে এতটা ভালোবাসার জন্য।
ইসমাইল বিন আবেদীন সালেহ ভাই , পাঠক কে বসিয়ে রাখতে পারেন আপনি | ভালো লাগল | সুভকামনা |
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আনিসুর রহমান মানিক ভালো লাগলো ...
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জাফর পাঠাণ (ঘোরের ভেতর নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে শ্মশানঘাটের সেই কৌতুহলী ক’জন মানুষ।) আমাকেও ঘোরে ফেলে দিয়েছিলেন ।পড়তে পড়তে কি বোর্ডের উপর কখন যে কপাল স্পর্স করেছিলো বুঝতেই পারিনি ।তখন বুঝলাম যখন মোবাইল ফোনটা বেঁজে উঠলো ।আর চেয়ে দেখি কপালের চাঁপ কি বোর্ডে পরাতে হ-য-ব-র-ল অবস্থা ।যাক কবিকে ঘোরমুক্ত মোবারকবাদ ।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মো. ইকবাল হোসেন সুন্দর একটা গল্পের জন্য ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

২৫ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪