[ পরীক্ষামূলক কাব্যগল্প ]
[ উৎসর্গ : গল্প-কবিতার ঝিমিয়ে পড়া সকল সদস্যকে ]
পড়ন্ত বিকেলের আলোটুকু মুছতে না মুছতেই অবিশ্বাস্য ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটমান বাস্তবতায় রূপ নিতে শুরু করলো পৃথিবী জুড়ে। আমরা ক’জন তখন ওয়েব পেইজের সূত্রগুলো মেলানোয় বুঁদ হয়ে ছিলাম, আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কাউন্ট ডাউন করছিলাম- ঊনষাট সেকেন্ড, আটান্ন সেকেন্ড, সাতান্ন সেকেন্ড...
বাইরে রাস্তায় তখনো অনেকেই খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রাত্যহিক কর্মে ব্যস্ত। এ রকম একটা সংবাদ নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবত মাতামাতি হলেও সবাই এটাকে পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর এ প্রান্তে শুধুমাত্র আমরা ক’জন পর্যবেক্ষণ করছি, আর একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশংকায় অতিবাহিত করছি প্রতিটি মুহূর্ত।
কাউন্ট ডাউন এর শেষ সেকেন্ড। আমরা ক’জন টানটান উত্তেজনায় উন্মুখ হয়ে আছি। না, কিছুই ঘটছে না। দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে রাস্তার দিকে তাকালাম।
একজন চিৎকার করে বলে উঠলো- দেখো দেখো ওই যে।
আমরা সবাই তাকালাম। ঝালমুড়িওয়ালার মাথার ডিশ থেকে ছুরিটা ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগলো। তারপর চামচ এরপর পুরো ডিশটা। ঝালমুড়িওয়ালা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ডিশটা ধরতে যায়, ডিশের সমস্ত মসলা উপুড় হয়ে পড়ে তার মাথার উপর। শুধুমাত্র ধাতব পদার্থগুলো ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। আর ঠিক তখনই আমাদের রুমের ভিতর ঝনঝনাৎ শব্দে চমকে উঠি আমরা। দৌড়ে রুমে ঢুকে দেখি রুমের যাবতীয় মেটালিক পদার্থগুলো দেয়াল ও কাঠ থেকে ছিটকে ছিটকে উঠে যাচ্ছে আর বাতাসে ভাসতে শুরু করেছে। আমরা দরজা-জানালা সব খুলে দিয়ে মেঝের উপর শুয়ে পড়লাম। আর ঠিক তখনই বাইরে কোথাও বিকট শব্দ হলো। বিদ্যুৎ চলে গেলো সাথে সাথেই। কম্পিউটার এর সিপিইউ হঠাৎ লাফিয়ে উঠলো। সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে বাতাসে ভাসতে শুরু করলো। পাওয়ার কেবল, মনিটর যেখানে যেখানে মেটালিক বস্ত্ত রয়েছে সবকিছু অবিশ্বাস্যভাবে বাতাসে ভাসতে ভাসতে দরজা জানালা দিয়ে ঠোকর খেতে খেতে বাইরে বেরিয়ে যেতে লাগলো। আমরা ক’জন প্রস্ত্তত ছিলাম বলেই মেঝেতে শুয়ে পড়ে গায়ের উপর লেপ-কাঁথা চাপিয়ে নিঃসাড় পড়ে রইলাম।
বাইরে থেকে শোরগোল শোনা গেলো। বাড়ীঘর থেকে সবাই বেরিয়ে এলো রাস্তায়, উদভ্রান্তের মতো ছুটতে লাগলো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। এরই মধ্যে আগুন আগুন বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পেলাম বাইরে। আমরা তেমনি মেঝেতে শুয়ে রইলাম নিঃসাড় হয়ে। বাইরের ভয়াবহ দৃশ্য দেখার ইচ্ছা জাগলেও আমরা একজন আর একজনকে চেপে ধরে মেঝেতেই পড়ে রইলাম।
বাইরে তখন চিৎকার-চেঁচামেচি-হুড়োহুড়ি লেগে গেছে। কান পেতে শুনতে থাকলাম ভয়ানক সব বিস্ফোরণের শব্দ, সাথে গগণবিদারী আহাজারী আর চিৎকার। হয়তো কোন বাড়ী ধ্বসে গেছে। হয়তো কোন গুদামে আগুন লেগে গেছে। হয়তো লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সবকিছু। রোজ কেয়ামতের প্রস্ত্ততিপর্ব হয়তো শুরু হয়ে গেছে। আমরা বেশিক্ষণ নিজেদেরকে ধরে রাখতে পারলাম না। একসময় আমরা বাইরের দৃশ্য দেখার জন্য হামাগুড়ি দিয়ে বারান্দায় চলে এলাম। বারান্দার লোহার গ্রিলগুলো দেখতে পেলাম না, মনে হলো কেউ একটুক্ষণ আগেই তা খুলে নিয়ে গেছে। মানুষের মর্মবিদারী আহাজারী আর ক্রন্দনের শব্দে আমাদের পিলে চমকে গেলো। রাস্তায় দেখলাম মানুষেরা একজন আরেকজনকে পায়ে পিষে দৌড়াচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। রাস্তায় পড়ে আছে সারি সারি নিস্তব্ধ মানুষ। চারিদিকে ধ্বংসস্ত্তপ, রাস্তার বিদ্যুতের খুঁটিগুলো উধাও হয়ে গেছে।
এতসব মর্মন্তুদ দৃশ্য দেখে আর আমরা নিজেদেরকে সজ্ঞান রাখতে পারলাম না। আমরা অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলাম স্ব স্ব স্থানে।
আমাদের যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করলাম ধ্বংসস্ত্তপের মাঝে।
ভোর হয়েছে কেবল। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। আমরা হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে এলাম বাইরে। নির্বাক হয়ে গেলাম আমরা। চারিদিকে কেবল ধ্বংসস্ত্তপ। রাস্তায় এলোপাতাড়ি পড়ে আছে মানুষ। নারী-পুরষ-শিশু-বৃদ্ধ, কারো কোন প্রাণ আছে বলে মনে হলো না। তারপরও আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কেউ বেঁচে আছে কিনা খুঁজে দেখব। আমরা খুঁজতে শুরু করলাম। ভোর থেকে শুরু করে আমাদের অভিযান চললো সারাদিন। কত মাইল পথ আমরা পাড়ি দিয়েছি জানি না। কিন্তু কোথাও জীবিত প্রাণ খুঁজে পেলাম না।
আমরা এখন কোথায় তা-ও আমরা জানি না। ধ্বসংস্ত্তপ পাড়ি দিতে দিতে আমরা এক সময় এক নদীর তীরে এসে দাঁড়ালাম। প্রচ- ক্ষুধার্ত আমরা ক’জন পানি পানে চাঙ্গা হয়ে এসে বসলাম খোলা প্রান্তরে।
এই পৃথিবীর পুরোটাই হয়তো ধ্বংস হয়ে গেছে- বললো একজন।
হয়তোবা আমরা ক’জনই মাত্র বেঁচে আছি অলৌকিকভাবে- বললো আরেকজন।
আচ্ছা পৃথিবীর অন্য প্রান্তে কি হচ্ছে তার কি কোন খোঁজ নেওয়া যায় না?
তাহলে তো ভালোই হতো, কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব?
তাই তো, আমরা তো এখন নিঃস্ব। আমাদের হাতে এখন আর কোন প্রযুক্তি নেই।
তাহলে কি আমরা আদিম যুগে প্রবেশ করেছি?
হ্যাঁ, তাইতো, আমরা তো আবার আদিম যুগে প্রবেশ করেছি।
এই, আমার না ক্ষিধে পেয়েছে, বড্ড ক্ষিধে।
আমারও, কিন্তু খাবার পাবো কোথায়?
চলো, আমরা খাবার খুঁজি।
চলো তাই করি, কিন্তু কোথায় খুঁজবো খাবার?
চলো দেখি কোন ফলবান বৃক্ষ পাওয়া যায় কি না?
চলো, তাই খুঁজি, আচ্ছা নদী থেকে মাছ শিকার করলে হয় না?
হয়, কিন্তু কি দিয়ে শিকার করবে? ধারালো কিছু কি খুঁজে পাবে কোথাও?
তা ছাড়া মাছ না হয় শিকার করলে, রান্না করবে কিভাবে?
তাহলে তো মাছ শিকার করেও কোন লাভ নেই,
তাহলে আমাদের খাবার জুটবে কিভাবে?
চলো আমরা কোন বন খুঁজে বের করি। সেখানে নিশ্চয়ই ফল আহরণ করা যাবে।
বন কোথায় পাবো আমরা? সব তো ধ্বংস হয়ে গেছে।
না, বন ধ্বংস হয় নি। এই দেখো দেখো, আমি প্রিন্ট করে নিয়েছিলাম এই দুর্যোগের প্রকৃতি এবং ধ্বংসযজ্ঞের ভবিষ্যদ্বানীকে। সেখানে কিন্তু বন ধ্বংস হওয়ার ব্যাপারে কিছু উল্লেখ নেই।
তাহলে কি কি ধ্বংস হওয়ার বিবরণ আছে ওতে?
প্রিন্ট আউট কপিটা বের করতেই আমরা সবাই হুড়মুড় করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে- পৃথিবীর নামক গ্রহের ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের যাবতীয় মেটালিক পদার্থ সব মহাকর্ষ শক্তি টেনে নিয়ে যাবে। শুধুমাত্র মাটির ভেতরের এবং দৃঢ়ভাবে প্রোথিত মেটাল বাদে বাকী সব মেটাল। সামান্য প্যারেক, স্ক্রু ইত্যাদি মহাকর্ষের টানে ছুটে ছুটে উঠে যাবে। শুধু নগর সভ্যতা এবং আধুনিক সমস্ত উদ্ভাবন, বিমান, জাহাজ, রাডার, কৃত্রিম উপগ্রহ ইত্যাদি সব কিছুই টেনে নিয়ে যাবে সেই মহাকর্ষ শক্তি। নগর সভ্যতা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। শুধুমাত্র গ্রাম এবং বনাঞ্চল, নদী-নালা আর প্রাকৃতিক অধাতু সব কিছুই রয়ে যাবে আগের মত।
ইউরেকা বলে চিৎকার করে উঠলো একজন।
কি পেয়েছো? সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো।
পেয়েছি, গ্রাম। চলো আমরা সবাই গ্রাম খুঁজে বের করি।
কিন্তু গ্রাম কোনদিকে আছে কেউ বলতে পারো?
চলো আমরা হাঁটতে থাকি, যেদিকেই হোক এক সময় গ্রাম পেয়ে যাব আমরা।
সেখানে গিয়ে কি হবে? সেখানে কি আমরা খাবার পাবো? থাকার মতো জায়গা? লজ্জা নিবারণের পোষাক?
একটা কিছু পাবোই। চলো গ্রাম খুঁজে বের করি।
সেখানে কি কোন মানুষ পাব আমরা? নাকি সেখানেও সবাই মারা গেছে।
না সেখানে কেউ মারা যাবে না। কারণ, মেটালিক পদার্থ মহাকর্ষ শক্তি টানলেও তো সেখানে মানুষ মানুষকে পায়ে মাড়ায় নি। সেখানে সবাই এখনো জীবিত, নিঃসন্দেহে জীবিত।
তাহলে চলো আমরা গ্রাম খুঁজে বের করি। যেখানে মানুষ পাওয়া যাবে। বৃক্ষ পাওয়া যাবে। ফল পাওয়া যাবে। আমরা সবাইকে এই আশ্চর্য ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবো। তাতে তারা আমাদের বন্ধু হয়ে যাবে। পৃথিবীকে আবার নতুন করে গড়ার যাবতীয় কাজ আমরা আবার নতুন করে শুরু করতে পারবো।
তাহলে চলো।
আমরা ক’জন নতুন এক স্বপ্নের আশায় আবার পথ চলা শুরু করলাম।
আমরা আবার নতুন এক বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলবো।
যেখানে নগর সভ্যতা থাকবে না।
যেখানে আধুনিকতা হবে প্রকৃতির সন্নিহিত।
আমরা এক নতুন পৃথিবী গড়ে তুলবো- যেখানে যান্ত্রিকতা থাকবে না, থাকবে শুধু আদি ও অকৃত্রিম ভালোবাসা, স্নেহ আর মমতা।
সেই থেকে আমরা ক’জন পথ চলছি তো চলছিই।
আমাদের যাত্রা কবে শেষ হবে আমরা জানি না।
শুধু জানি-
আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আমরা পাবো সুন্দর এক নতুন পৃথিবী...।
২৫ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
২৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪