প্রথম যেদিন আমি শুনি, আমি চমকে উঠি আমার ছোট্ট মেয়ের কথায়। প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না ও কি বলছে। ছোট মেয়ে চৈতির বয়স মাত্র তিন পার হলো। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে তার জন্ম। ডাক্তার ইচ্ছে করলে একদিন পরেই সিজার করতে পারতেন, তাহলে পহেলা বৈশাখের সাথে ওর জন্মটাও জুড়ে যেত একই উৎসবে। কিন্তু ওদিন অন্য ডাক্তাররা ছুটিতে থাকবেন বলে ডাক্তার রিস্ক নেন নি। তাছাড়া ফিটাসও নির্ধারিত দিন পার করে ফেলেছিল। কিন্তু ওর মার প্রসব বেদনা না থাকায় অপেক্ষা করছিল ডাক্তার। এ জন্য হাসপাতালে ভর্তির পরও চারদিন অপেক্ষা করতে হয় সিজারের জন্য। সে যাক, ৩০শে চৈত্র ডাক্তার রুগীর অবস্থা দেখে সেদিনই সিজার করলেন। এটি আমার চতুর্থ এবং সর্বশেষ সন্তান। জন্মের পর পরই মেয়েটি অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে থাকে। মা’র পেট চিরে যখন ওকে বের করা হলো তখন আশ্চর্যজনকভাবে কোন চিৎকার করলো না। ডাক্তার দেখলেন বাচ্চার শ্বাস-প্রশ্বাস, সেনসেটিভিটি সবকিছু নরমাল, কিন্তু তারপরও চিৎকার করছে না দেখে একটু অবাকই হলেন। নার্স ওকে পরিষ্কার করে তোয়ালেতে জড়িয়ে ওটির দরজার কাছে এনে আমার সামনে দাঁড়াতেই একবার চোখ পিটপিট করে তাকালো, তারপর ভুবন মাতানো চিৎকার দিয়ে উঠলো। নার্স বলে উঠলো, দেখলেন তো- চোখ না ফুটতেই বাবাকে চিনে ফেলেছে। আপনার মেয়েটি দারুণ বুদ্ধিমতি হবে। কই দিন দিন, আমার বখশিশ দিন।
দ্বিতীয় দিনের ঘটনা তো আরো অসাধারণ। বাচ্চাকে তখন কেবিনে দেয়া হয়েছে। বিছানায় শুয়ে আছে ছোট্ট মেয়েটি। কি ফর্সা আর মায়াময় চেহারা। আমি ডিজিটাল ক্যামেরা বের করে খাটের উপর উঠে উবু হয়ে ক্যামেরা তাক করে দাঁড়িয়েই আছি মেয়ের চোখ মেলা ছবি তুলব বলে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি মনে নেই। ক্যামেরার আই ভিউতে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখলাম আমার মেয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে কোটি টাকা মূল্যের হাসিটি উপহার দিলো। সেই হাসি ক্যামেরাবন্দি করলাম সাথে সাথেই। দু’দিন বয়সী বাচ্চার কাছে এই রকম হাসি অবিশ্বাস্য। বিশ্বাস করুন আমার হাতে তোলা শ্রেষ্ঠ ছবি এটি। যদি এই ছবিটি কোন কম্পিটিশনে দিতাম, নির্ঘাৎ প্রাইজ পেতাম।
সে যাক, বুকের নিচে তিনটি বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে পত্রিকা পড়ছিলাম। চৈতির কথা শুনে চমকে উঠে পত্রিকা থেকে চোখ তুলে তাকাই মেয়ের দিকে। আমাকে ও রকম করে তাকাতে দেখেই চৈতি বলে উঠলো, আপ এ্যায়সা কেয়া দেখ রাহে হো ড্যা.....ড? মুঝে বহু....ত ভুখ লাগি হ্যায়।
আবারো একই রকম কথা শুনে শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠলাম। মেয়েকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলাম। মুখের দিকে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি বলছো তুমি মা? তোমার ক্ষুধা লাগছে?
হাঁ পাপ্পা...., বহুত ভুখ লাগি হ্যায়।
সত্যি বলছো, তোমার ক্ষুধা লেগেছে?
হাঁ, ম্যায় সাচ বোল রাহি হো। মম কো পুছ.....
আরো কি কি বললো সে তার মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। ওকে কোলে নিয়েই দৌড়ে কিচেনে গিয়ে হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিলাম। আরে শুনছো, তোমার মেয়ের ক্ষুধা লাগছে, তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও। আর শোন তোমার মেয়ে তো পুরা হিন্দিতে কথা বলছে, আমি তো সব বুঝি না।
ওর মা রুটি বানাতে বানাতেই বললো- আর বলো না, তোমার মেয়ে কয়দিন যাবত যা শুরু করছে, অবিশ্বাস্য। কি এক সিরিয়াল শুরু হইছে কার্টুন চ্যানেলে, সারাদিন একটার পর একটা সিরিজ চলতাছে তো চলতাছেই। সারাক্ষণ ওইটাই দেখবে, অন্য কোন চ্যানেল ছাড়লেই এমন চিৎকার শুরু করে, আর পারা যায় না।
কথাগুলো বলতে বলতে প্লেটে রুটি আর ডিম পোচ এগিয়ে দেয়। আমি হাত বাড়িয়ে নেই। আর চৈতি হাত তালি দিয়ে বলে ওঠে, মম.. আপ বড়ি আচ্ছি হু। ম্যায় তো আন্ডা বহুত পসন্দ করতা হু।
চৈতির মা আমার দিকে হাসিমুখে তাকায় একবার। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আচ্ছ ঠিক আছে। যাও, সবগুলো খেতে হবে কিন্তু। বাবার সাথে গিয়ে নাস্তা করো।
চৈতি খুব অবাক হওয়ার ভান করে সাথে সাথে বলে ওঠে, আ’ ম্যায় সবকুছ খানা পড়ে গা! ইয়ে......বলে চিৎকার দিয়ে গড়িয়ে আমার কোল থেকে নেমে পড়ে। আমার দিকে হাত বাড়ায় প্লেট নেওয়ার জন্য।
আমি মেয়ের উচছলতা দেখে অবাক হয়ে প্লেট তুলে দেই ওর হাতে। আর চৈতি প্লেট হাতে নিয়ে ইয়ে... বলে চিৎকার দিয়ে ছুট দেয় শোবার ঘরে।
আমি এবার ভালো করে মনোযোগ দেই স্ত্রীর দিকে। আশ্চর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা বলো তো তোমার মেয়ে এমন হিন্দি শিখল কি করে?
আরে বললাম না, কার্টুন দেখে দেখে শিখছে। তোমাদের গোষ্ঠীর সব বাচ্চা ওর হিন্দি কথা শোনার জন্য পাগল। দেখবে একটু পরেই সবাই আসতে শুরু করবে।
আমি স্ত্রীর কথা শুনে সত্যিই অবাক হলাম। আমরাও তো বিভিন্ন হিন্দি চ্যানেল দেখি প্রায়ই, কই আমি তো এখনো শিখতে পারলাম না কিছুই। ওর বড় ভাই-বোনও তো হিন্দি বলে না। তাহলে ও শিখল কি করে? যদিও বড় মেয়েকে হিন্দি বর্ণমালা প্র্যাকটিস করতে দেখেছি, কিন্তু হিন্দিতে এ রকম অনর্গল কথা বলতে শুনি নি এখনো। আমার মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সেটা কি কষ্টের নাকি বেদনার তা কাউকে বোঝাতে পারবো না। আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম। আমার কাছে বাংলার দাবী অন্য রকম। আমি পারত পক্ষে অন্য কোন ভাষায় কথা বলি না। খুব সচেতনভাবে অন্য ভাষা চর্চা এড়িয়ে চলি। অথচ আমার মেয়েই কি না হিন্দি বলছে মাতৃভাষার মতো! উফ্ ভীষণ মর্মাহত হলাম আমি।
আরেক দিনের ঘটনা। আমি জরুরী একটা কাজে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। তখন চৈতি জুতো পায়ে দিয়ে আমার প্যান্ট ধরে টানতে টানতে বলতে লাগলো- মুঝে বাহার জানা চাহতা হু ড্যা...ড।
ওকে বাইরে নিয়ে যাওয়া মানে আমার পুরো আধা ঘন্টা সময় নষ্ট। আমি একটু তাড়া দেখিয়ে বললাম, না বাবা এখন না। তোমাকে বিকালে বাইরে নিয়ে যাব, ঠিক আছে?
আমার কথা শুনে ওর হাসি হাসি মুখভঙ্গী পাল্টে গেলো। কান্না শুরু করে দিলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। ওর কান্না শুনে ওর মা দৌড়ে এসে ওকে কোলে তুলে নিলো। আদর পেয়ে মেয়ের কান্না আরো বেড়ে গেল। আমি মহা বিপদে পড়লাম। ওকে থামানোর জন্য কোলে নিয়ে আদর করলাম। ও আমার কাঁধে মাথা রেখে বললো- তুম মুঝে প্যায়ার নেহি করতা। তুম বহুত বুরা হু। এ্যা....।
আমি ওকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বললাম, হ্যা মা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি মা। আর কাঁদে না।
এবার কান্না থামিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো চৈতি- তুম মুঝে পেয়ার করতা হ্যায়?
আমি এবার ওর সাথে সুর মিলালাম, হাঁ মা, ম্যায় তুঝে বহুত পেয়ার করতা হু।
তুম সাচ বোল রাহি হো?
হাঁ মা সাচ বোল রাহি হু।
বিলকুল?
হাঁ মা বিলকুল।
এই হলো আমার নতুন প্রজন্মের শিশু মেয়ে। আমার মাথা-মুন্ডু সব এক করার জোগাড় করে দিলো। সে কি পাকনামি বাববা, একেবারে হাড়-মজ্জা সব পাউডার বানিয়েই যেন ওর স্বস্তি। তো আমি ওর হিন্দি কথা শুনে শুনে রীতিমতো তিতি বিরক্ত। প্রায়ই ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি, মা হিন্দিতে কথা বলে না, বাংলায় বলো। কাকে কি বলি, ও ঠিকই আমার কথার জবাব দেয় হিন্দিতে। আর আমার ভিতর কষ্ট গুমরে গুমরে ওঠে।
শেষ পর্যন্ত নিজের মনে মনেই বুদ্ধি বের করলাম। ছোট্ট একটা স্কুল ব্যাগ কিনে দিলাম ওকে, সাথে কয়েকটি ছবিওলা বর্ণমালার বই। বাংলা, ইংরেজি, আরবী সব। আর এতেই কাজ হলো। আমি ঘরে থাকা অবস্থায় জামা-কাপড় পড়ে পায়ে জুতা গলিয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, আববু জানো- আমার তো হোমওয়ার্ক করা হয়নি। টিচার তো আমাকে মারবে।
আমি মজা পাই। বলি, আচ্ছা, তাহলে কি করতে হবে?
চলো, আমাকে স্কুলে যেতে হবে।’ এই কথা বলে আমার হাতের আঙ্গুল ধরে টানতে টানতে ড্রয়িং রুমে নিয়ে যায়। সোফায় বসে ব্যাগটা টি টেবিলে রাখতে রাখতে বলে, তুমি আমার টিচার, আমাকে পড়াবে এখন, বুঝলে...। আমি মজা পেয়ে যাই। সোফায় ওর পাশে বসতেই ও একটা বর্ণমালার বই বের করে উল্টো করে মেলে ধরে। আমি সোজা করে দিলে ও ধমকে ওঠে, এভাবে না, এভাবে। বলে আবারো উল্টো করে ধরে। আমি ওকে বোঝাই, আম্মু- ওটা তো উল্টা, এটা ভাও, এভাবে নিয়েই পড়তে হয়।
এবার বোঝে চৈতি। বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি বলি আর ও আমার সাথে সাথে পড়ে যায়। একটা বই শেষ হয়, আরেকটা বই ধরে। এভাবে করেই সবগুলো বই পড়ে। আমার সময় নষ্ট হয়, কিন্তু ওর আগ্রহ দেখে মনোযোগ দেই ওর দিকে। আর আমি লক্ষ্য করতে থাকি, ওর মুখ থেকে হিন্দি বুলি ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে। এখন আর ও হিন্দিতে কথা বলে না। কেউ বললেও সে বাংলায় উত্তর দেয়। আর সারাদিন স্কুলে যাওয়ার অভিনয় করে।
আমার খুব ভালো লাগে, খুব। ইচ্ছে করে আরো অনেকগুলো বাংলা বর্ণমালা, ছবি আর ছড়ার বই কিনে দেই। ওর জীবন গড়ার নতুন পাঠশালায় যোগ করি আরো নতুন নতুন আনন্দময় অধ্যায়।