মনুষ্য জন্ম বড়ই দুর্লভ। বহু পুণ্যের ফলে মনুষ্যকুলে জন্মগ্রহণ করে মানুষ। কথাটা কতটুকু সত্য তা আমার জানা নেই, তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। শুধু তা নয়, নিজ নিজ কর্ম অনুযায়ীই মানুষ সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ভোগ করে। আবার এমনও আছে, জীবিকার তাগিদে যারা প্রতিদিন কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত থাকে, দুঃখ-দীনতাই যাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। মাথা গোঁজার ছাদ থাকে তো পরনের বস্ত্র থাকে না, দু'বেলা অন্ন জোটে তো বিদ্যার্জনের সামর্থ্য থাকে না। বেঁচে থাকে নামমাত্র। আবার কেউ কেউ আছে, যারা জন্মলগ্ন থেকেই অপরের উপর নির্ভরশীল, অপরের দান-দক্ষিণায় জীবিকা নির্বাহ করে। ভিক্ষের ঝুলি পেতে রাস্তায় বসে ভিক্ষে করে, পেটের ক্ষুধা নিবৃত্তি করে। আত্মরক্ষা করে শহরের অখ্যাত কুখ্যাত অলি গলিতে কিংবা রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের আন্ডারগ্রাউন্ডে পাখীর বাসার মতো গাছের ছালবাকল আর ছেঁড়া বস্তা ঘেরা ছোট্ট ঘুপচি ঘরে। যেখানে সামান্য বর্ষণে রাজ্যের কীট-পতঙ্গ, মশা-মাছি, পোকা-মাকড়, বিষধর সাপ, কেঁচো-ব্যাঙ গিয়ে বাসা বাঁধে। আবার কারো কারো সেটুকুও জোটে না । দীর্ঘ বিনিদ্র রজনী পোহায় উন্মুক্ত নীল সামিয়ানার নীচে। আমরা যাদের ভিক্ষারী বলি। যারা আজও আমাদের সভ্য সমাজে অতি নগণ্য, অশৌচী এবং নিম্ন স্তরের মানুষ। যাদের স্পর্শ করতে আমরা ঘৃণা করি, অবজ্ঞা করি, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করি। যাদের সংস্পর্শ থেকে আমরা সর্বদা দূরে সড়ে থাকি, উপেক্ষা করে চলি। তুলনামূলক ভাবে এদের সংখ্যা আমাদের দেশেই সবচে' বেশী। অথচ একই ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেও দেশের নাগরিক হিসেবে এরা কখনো বিবেচিত হয় না, তালিকাভুক্ত হয় না। কিন্তু আমরা একবারও ভেবে দেখি না যে, একমাত্র আর্থিক অভাবেই এরা মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত এবং নিগৃহীত। যার ফলে এরা ভাষা জানে না, ব্যবহার জানে না, সভ্য মানুষের মতো শান্তি ও সুশৃঙ্খলভাবে জীবন যাপন করতে জানে না, নিজের প্রাপ্য অধিকারটুকুও দাবী করতে জানে না। এমন কী, সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ভক্তি-শ্রদ্ধা-আদর-স্নেহ-মায়া-মমতা ও ভালোবাসার মূল্যবোধের অভাবে নিজের অস্তিত্বই এরা জাহির করতে পারে না। ক্রমান্বয়ে দুঃখের দহনে জীবনের মূল্যবোধ, মানবিক চেতনা, মনুষ্যত্ব বোধ, মান-অভিমান বোধ বলতে এদের কিছুই নেই। এদের শরীর আছে, আবেগ-অনুভূতি নেই, প্রাণ আছে, হৃদয় নেই। কৃতদাসের মতো ধিক্কার, তিরস্কার, লাঞ্ছনা আর গঞ্জনাই যাদের প্রতিদিনকার খোরাক। তাতেও বোধহয় তৃপ্তি হয় না। অবলীলায় নিজের প্রাণটাই নির্বিকারে দিয়ে দেয় বিসর্জন। যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়েও আমরা অপারগ, উপেক্ষা করে চলি। প্রতিবাদ করতেও আমরা কুন্ঠিতবোধ করি।
আমার আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, ঘটনাটি ঘটেছিল, ১৯৯১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি নাগাদ। যাচ্ছিলাম চাকুরীর ইন্টারভিউ দিতে। রাশ আওয়ার। যাত্রীর হুড়োহুড়ি। প্রচণ্ড গাড়ির ভিড়, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়। নির্ধারিত সময়ে এ্যাটেন্ড করতে না পারলে দেবে ডিস্কোয়ালিফাই করে। যাবে চাকুরীর বারোটা বেজে।
এইভেবে একটা ট্যাক্সি ৱনিয়ে দ্রুত রওনা হয়ে গেলাম। পৌঁছেও গিয়েছিলাম প্রায়। কিন্তু ভাগ্য অবিরল। গন্তব্য স্থলের কাছাকাছি এসে চলন্ত ট্যাক্সি হঠাৎই বিকট শব্দে থেমে গেল। আমি চমকে উঠি। দেখলাম, সামনে ট্রাফিক জ্যাম। অনবরত হর্ন বাজজে। শব্দ দূষণে কানে একেবারে তালা লাগার যোগার। পাশেই রোডের গা-ঘেঁষে নদীর মতো এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে রাজ্যের নোংরা আবর্জনায় ভর্তি বিশাল একটি খাল। তার সংলগ্নে ঘন কর্দমাক্ত চড়। না আগে, না পিছে, গাড়ী ঘোরাবার জায়গাই নেই। পড়ে গেলাম বিপাকে। কি করি!
ভাবতে ভাবতে মুহূর্তের মধ্যে চুতর্দিক থেকে লোকজন ছুটে এসে প্রচণ্ড ভিড় জমে গেল। একেবারে লোকে লোকারণ্য। গাড়ির জানালা দিয়ে গলা টেনে দেখি, অবাক কাণ্ড! ন্যাতার মতো ছেঁড়া ময়লা লুঙ্গি পড়া একুশ-বাইশ বছরের একটি তরুণ যুবক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে রাস্তার মাঝখানে। পলক মাত্র দৃষ্টিপাতে মনে হচ্ছিল, লোকটি মাঝবয়সী। অকালে বার্ধক্যে ঢলে পড়েছে। জরা-জীর্ণের মতো রুগ্ন, বস্ত্রহীন শরীর। শুধু চামড়া দিয়ে মোড়া। শরীরের হাড্ডিগুলি যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে। একদম কঙ্কালের মতো চেহারা। এমন একজন দুর্বল মানুষকে চার-পাঁচজন একসাথে এলোপাথাড়ি পিটচ্ছে। বৃষ্টির ফোটার মতো অনবরত পড়ছে কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড় আর লাথি। একজনের হাতে ছিল লম্বা একখানা বাঁশের ফালি, সেও দেখি ধোবিখানার কাপড় পেটানোর মতো বাঁশ দিয়ে ইচ্ছে মতো পিঠাচ্ছে।
ততক্ষণে যুবকটির মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে এসেছে। তার কিছুক্ষণ পর ফিনকি দিয়ে গলগল করে ঝড়তে লাগল রক্তের স্রোত। একজন অসহায় দুর্বল মানুষকে এতগুলি লোক একসাথে অবিশ্রান্ত প্রহার করলে কি থাকে তার শরীরে। বেচারা প্রচণ্ড আঘাতে অর্ধমৃত অবস্থায় যন্ত্রণায় ডানাকাটা পাখীর মতো ছটফট করতে করতেই নিস্তেজ শরীরটা তার লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। আর সঙ্গে সঙ্গে শিকারি বাজপাখির মতো ওর গলাটা চিপে ধরে ওরা হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে ওকে টেনে নিয়ে গেল ঐ নোংরা খালের ধারে। আবর্জনার মতো ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো নোংরা কর্দমাক্ত গভীর চড়ে।
কি হৃদয়বিদারক সেই দৃশ! যা ভাষায় বয়ান করা যায় না। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম বিস্ময়ে। এরা কি মানুষ না জানোয়ার! বন্য পশুর মতোই এদের পৈশাচিক আচার, আচরণ! এদের এতটুকু দয়া-মায়াও কি নেই শরীরে!
দৃশ্যটি প্রবল রেখাপাত করলো আমার মুমূর্ষু হৃদয়ে। আমি বিমূঢ় হয়ে পড়ি। ক্ষোভে দুঃখে গহীন বেদনায় ভীষণভাবে মর্মাহত হলাম এইভেবে যে, এত বড় শহর, কেঁচোর মতো চুতর্দিকে কিল বিল করছে উচ্চ সম্ভ্রান্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। দিনে দুপুরে এই বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের মতো এমন অমানবিক ভাবে পিটালো, আঘাত করলো, অথচ কারো বিবেকে এতটুকু দংশন করলো না? প্রতিবাদই করলো না কেউ? শহরের এতগুলি মানুষ নীরবে নির্বিকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখলো সবাই!
তার কারণ, ওরা পথের ভিক্ষারী। যাদের পড়নে বস্তাপচা ছেঁড়া ফাটা ময়লা দুর্গন্ধ জামাকাপড়। কাকের বাসার মতো রুক্ষ শুষ্ক এলোমেলো চুল। কাঙ্গাল লম্পটের মতো চেহারা। যারা ঠিকানা হীন, আশ্রয়হীন, স্বজনহীন, সম্বলহীন, যারা নালা-নর্দমার সংলগ্ন অশুচি নোংরা ঘৃণ্য জগতের বাসিন্দা। আহত যুবকটি ওদের দলেরই একজন সদস্য। পড়ে থাকে গাছতলায়, ফুটপাতে। কিংবা যেদিন যেখানে আশ্রয় মেলে সেখানেই রাত কাটায়, নিদ্রা যায়। কিন্তু বিধির বামে বেচারা দীর্ঘদিন যাবত অভুক্ত অনাহারে অসুস্থ শরীর নিয়ে আহত পাখীর মতো পড়েছিল রাস্তার ধারে।
কে নেবে এদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার? কে করবে এদের কেচ্ছা-কাহিনীর বিচার? কেইবা দেবে সাহারা? ওরাও কারো অপেক্ষার ধার ধারে না। নিজেরাই বিচারক সেজে হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের মতো গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ করে। প্রতিশোধ নেয়। মরলো কি বাঁচল, সেদিকে কারো হুঁশ থাকে না। অথচ যুবকটির অপরাধ মারাত্মক কিছুই নয়, ওরই জাতভাই আরেক ভিখারির ঘর, যার কাকের বাসার মতো খড়ের ছাউনি, শলাকাঠির দেওয়াল। হেলান দিয়ে দাঁড়ালে মড় মড় করে ভেঙ্গে পড়বে, এমনিই একটি ঘর থেকে কয়েক দিনের বাশি শুকনো একখানা রুটি চুরির দায়ে যুবকটির ঐ নিমর্ম পরিণতি।
হয়তো তার কিছুক্ষণ পর আহত যুবকটির প্রাণটাই বোধহয় নিঃশব্দে বেরিয়ে গেছে। যার মৃত্যুই ছিল অনিবার্য পরিণতি। যাকে শনাক্ত করার মতোও ভাই-বন্ধু-স্বজন তিনকুলে কেউই ছিল না। যার মৃত্যুতে একফোঁটা চোখের জল কেউ কোনদিনও ফেলবে না। মনেও রাখবে না কেউ কোনদিন। হয়তো ঐ চড়ের কাদামাটিতেই পঁচে গলে ঝরে যাবে ওর মৃতদেহ। একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে। সেখানেই হয়ে যাবে ওর সলীল সমাধি। আর আমার মতো যারা ঐ ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী, তাদের প্রত্যেকেরই স্মৃতিপটে জলছবির মতো চিরতরে গেঁথে থাকবে, জীবনে চলার পথে সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্যের একখণ্ড বেদনাময় স্মৃতি। যা কোনদিনও ভোলবার নয়।
মহান স্রষ্টার কাছে করজোড়ে শুধু প্রার্থনা করি,-"হে ঈশ্বর, হে বিধাতা, যদি কাউকে মানুষ করেই দু'দিনের এই ভরের সংসারে পাঠাও, তবে তাকে মানুষের মতোই বাঁচতে দিও! অন্তত নিজের বাসস্থানে দু'বেলা দু'মুঠো খেয়ে পড়ে সে যেন বেঁচে থাকতে পারে এই সুন্দর পৃথিবীতে!"