আজ থেকে প্রায় ছাবিবশ বছর আগের কথা। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। আমরা সে বছরই স্বপরিবারে মফঃস্বল এলাকা ছেড়ে চলে আসি শহরে। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। সব অচেনা, অপরিচিত। ভীষণ বোর ফিল করতাম। কিছুতেই স্বস্তি পেতাম না। ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা প্রতিদিন টিফিন পিরিয়েডে হাসাহাসি, কানাকানি করতো। হাসতে হাসতে একেবারে মাটিতে লুটিয়ে পড়তো। আবার কোন কোনদিন হাস্যরোলের প্রতিঃধ্বনিতে গমগম করতো সারা স্কুল। ভীষণ অবাক হতাম মনে মনে। ভাবতাম, ব্যাপারটা কি!
একদিন দূর থেকে লক্ষ্য করলাম, আমাদের ক্লাসে নবাগতা কাকলীর অস্বাভাবিক কালো কুৎসিত চেহারা-সুরতই ওদের হাসির মূল কারণ। যেটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। সত্যিই হাসি চেপে রাখা যেতো না। আমি নিজেও কয়েকবার ঠোঁট চিপে হেসে ফেলেছি। অথচ ওর সাথে কখন যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল, হৃদ্যতা গড়ে উঠল, টের পাইনি। আমরা ওকে ‘কলী’ বলে ডাকতাম। ছোটবেলা থেকেই কলীর মুখাকৃতিটা ঠিক নেপালী মেয়েদের মতো। এতটুকু পরিবর্তন নেই। ওর নাক-চোখ-মুখ একেবারে ভোতা। নেই বললেই চলে। ওর ঠোঁটের একটু উপরে নাকের ছিদ্র দু’টোই শুধু দেখা যেতো। তন্মধ্যে চোখদু’টো সামান্য ট্যাড়া। তার জন্যে ও’ নিজেই বিবো্রতবোধ করতো। অপদস্থ হতো। বিশেষ করে মহিলাঙ্গনে। যেমন কয়লার মতো কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, তেমনি মুক্তোর মতো শুভ্র দন্তপংক্তি। অন্ধকারে ভয় লাগতো। যার জন্যে বিধাতার ওপর ওর ভীষণ রাগ হতো।
অগত্যা, করণীয় কিছুই নেই। সারাক্ষণ বিষাদে ছেয়ে থাকতো ওর শরীর আর মন। কিন্তু ওর শরীর চর্চায় এবং সুদর্শণ কেশ-বিন্যাশে ক্লাসের সবাইকে হার মানতে হতো। তেমনি ছিল চমকপ্রদ প্রসাধনের বাহার। সাজতে ভীষণ ভালো বাসতো। দুইহাত ভর্তি রঙ-বেরঙের কাঁচের চুড়ি, নাকে নোলক। মাথার ঝুঁটি বাঁধতো গাঢ় লাল রঙের ফিতে দিয়ে। একদম শাঁওতালী মেয়েদের মতো লাগতো। কিন্তু তন্মধ্যেও ওর শান্ত-স্নিগ্ধ মুখমন্ডলে এক ধরণের সৌন্দর্য্য ছিল, লাবণ্যভাব ছিল। শারীরের গঠনও ছিল আকর্ষণীয়। যা ও’ নিজেও জানতো না। কিন্তু হাইস্কুলের গন্ডি পার হয়ে অমাবস্যার চাঁদের মতো সেই যে অদৃশ্য হয়ে গেল, প্রকাশ্যে আর দর্শণই দেয় নি কাউকে। সবার অলক্ষ্যে চুপিচুপি নাইট কলেজ করতো। এছাড়া বাড়ি থেকে কোথাও আর বের হতো না। অথচ ওর মাতা-পিতার এতটুকু দুঃখ ছিল না। ওনাদের দুইপুত্র আর কাকলীই একমাত্র কন্যা। কত আদরের, মা-বাবার চোখের মণী। ওনাদের ইচ্ছে ছিল, মেয়েকে সুশিক্ষায়-দীক্ষায় স্বাবলম্বী করে তুলবে। এম.বি.বি.এস ডাক্তার বানাবে। জনতার সেবা করবে। কাকলীর চিকিৎসা এবং সেবা-শুশ্রূষায় সুস্থ্য-সবল হয়ে উঠবে লাখো লাখো মানুষ। আত্মগর্বে মা-বাবার বুকভরে উঠবে। সার্থক হবে কলীর জনম। এও কি কম সৌভাগ্যের কথা! কিন্তু একদিন তাদের আঙ্গিনাতেও যে সানাই বেজে উঠবে, বরযাত্রী আসবে, কাকলী ছাদনা তলায় যাবে, ওর বিবাহ হবে, ঘর-সংসার হবে, স্বামী সোহাগী হবে, তা স্বপ্নেও কেউ কল্পনা করতে পারে নি। যেন শাপে বর! কি আশ্চর্য্যজনকভাবে ঘুরে গেল কাকলীর ভাগ্যের চাকাটা।
শহরের এক বিশাল ইন্ডাষ্ট্রিয়াল কোম্পানীর মালিকানার একমাত্র উত্তরাধিকারী। বংশের প্রতীক। অগাধ সম্পত্তির মালিক। পাত্রী কাজেকর্মে পারদর্শী কিংবা গুণবতী এবং সুদর্শণা বাঞ্ছণীয় নয় কিন্তু তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বাক্যে ও ব্যবহারে সংযম অতি আবশ্যক। পাত্রীপক্ষ নির্দ্বিধায় ওয়েল-কাম। ঠিকানা...!
অপ্রত্যাশিত হঠাৎ কাগজের বিজ্ঞাপনটি পড়ে চমকে উঠলেও অবিশ্বাস্যকর মনে হয়েছিল চৌধুরী মশাই-এর, অর্থাৎ কাকলীর বাবার। কিন্তু তিনি নিজে যখন বিষয়টি ভেরিফাই করে দেখলেন, তখন সুযোগটা আর হাত ছাড়া করলেন না। ভাবলেন, এই সুবর্ণ সুযোগ। মেয়ে আমার সুখে থাকবে। রাজরানী হবে। আভিজাত্য ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের কূলবধূ হবে, আর কি চাই! এ তো কল্পনাই করা যায় না!
পাত্রের গুণ বিচার না করে বিনা দর্শণেই চৌধুরী মশাই এককথায় কলীর বিবাহ পাকা করে ফেললেন। শুনে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই অবাক। বলে,-‘‘এ আবার কেমন বিয়ে? পাত্র-পাত্রীর মুখ দর্শণ হলো না, একান্তে নিঃভৃতে দু’জনে মুখোমুখি বসে আলাপচারিতা হলো না! পাত্র বোবা না কালা, না ল্যাংড়া-লুলা! হয়তো বা অন্ধ!’’ কেউ কেউ বলে,-‘‘দ্বিতীয় পক্ষও হতে তো পারে!’’
হাজার প্রশ্নের ভীঁড় জমে ওঠে মানুষের মনে। -‘‘নিশ্চয়ই পাত্রের কোনো গলদ আছে!’’
দেখা গেল অনুমান একেবারেই মিথ্যে নয়। পাত্রের চেহারায় এবং বেশভূষায় স্মার্ট্নেস্, ব্যক্তিত্বের ছাপ তো দূর, পুরুষত্বই নেই। বড়লোক বাপের একমাত্র অলস কর্মবিমুখ হেবলাকান্ত পুত্র গোবরগণেশ অমিত রায়। যার নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধি, বিচার-বিবেচনা ও ভালো-মন্দের বোধশক্তি তো নেই-ই, হৃদয়কে আকৃষ্ট করার মতো বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের কোনো বৈশিষ্ঠই পাত্রের নেই। এহেন নির্বোধ, ভাবলেশহীন, আবেগ-অনুভূতিহীন একজন অপদার্থের সাথে পবিত্র বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হবার চে’ আজীবন কুমারীত্ব নিয়ে বেঁচে থাকাই ঢের ভালো।
নাঃ, এ বিয়ে হতে পারে না। ছাদনা তলায় কাকলী যাবে না। কক্ষনো না, কিছুতেই না, ইম্পসিবল! হোক সে লগ্নভ্রষ্ঠা, কুলাঙ্গার, কুলক্ষণী! মাতা-পিতার মান হানী! কাকলী কালো, কুৎসিৎ, এটা কি ওর অপরাধ? আর এইজন্যই কি ওর প্রতি এতবড় অবিচার? এতবড় ছলনা? ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা? গলায় দড়ি দিয়ে মরবে কাকলী। তবু এই নির্বোধ নিস্কর্মা অযোগ্য কু-পাত্রের গলায় কখনোই সে মালা দেবে না। দিতে পারে না।
চৌধুরী মশাই সেকেলে মানুষ। সংস্কারপ্রবণ মন-মানসিকতা। বংশ পরস্পরা সামাজিক ও পারিবারিক চিরাচরিত রীতি-নীতিই তিনি অনুসরণ করে আসছেন। তিনি সার্বিক বিচার-বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যা নেবেন, সেটাই সর্বশেষ বিবেচিত হবে। তাকেই কি না অমান্য করা! অগ্রাহ্য করা!
চৌধুরী মশাই পারলেন না মেনে নিতে। শোনামাত্রই তার হার্টএ্যাটাক হয়। তিনি চেয়েছিলেন, কন্যার ঘর-সংসার, সুখী দাম্পত্য জীবন। ওনার একমাত্র তনয়াকে পাত্রস্থ করেই মহাপ্রয়াণে শায়িত হবেন। পরলোকে গিয়েও তিনি শান্তি পাবেন। নিশ্চিন্তে স্বর্গবাস করবেন। এটাই ছিল তার একান্ত ইচ্ছা।
কিন্তু বিধিই বাম। দায়ত্বশীল এবং কর্তব্যপরায়ণ চৌধুরী মশাইএর একান্ত ইচ্ছাটা বিধাতার তৎক্ষণাৎ মঞ্জুর হলো না। দেখা দিলো বিপদ সংকেত। যমে মানুষে টানাটানি। কাকলীর বিবাহ গেল চূলোয়। সানাই-এর পরিবর্তে চৌধুরী বাড়িতে বেজে উঠল অমঙ্গলের বাঁশী। চৌধুরী মশাইএর প্রাণহানীর আশঙ্কায় নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া।
প্রায় মাস ছয়েক মৃত্যুর সাথে লড়াই করে তিনি বিপদমুক্ত হলেন ঠিকই কিন্তু বিছানায় শয্যাশায়ী পিতৃদেবের হৃদয়বিদারক দূরাবস্থার অনুতাপ অনুশোচনায় অবলীলায় হেবলাকান্ত পাত্র অমিতের সাথেই বিবাহের সম্মতি দিতে হলো কাকলীকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য অমিতের। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর হৃদয়পদ্মে জীবন দেবতার আসনে ওর এতটুকু ঠাঁই হলোনা। কাকলী পারে নি, অমিতকে স্বামীরূপে গ্রহণ করতে, সর্বান্তকরণে মেনে নিতে, স্বামীর স্বীকৃতি দিতে। শুধু তা নয়, প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হতে লাগল, তার ন্যায্য অধিকার থেকে, স্বামীত্বের আধিপত্য থেকে। কাকলীর মন-প্রাণ-ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা থেকে। অথচ কি ধূমধাম করে নহবৎ সাজিয়ে একেবারে রাজকীয় কায়দায় ওদের শুভপরিণয় সুসম্পন্ন হয়েছিল। নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন, শহরের এম.এল.এ, ম্যাডিক্যাল ডাক্তার, প্রফেসর, শিক্ষক-শিক্ষিকা, আইনজীবি, বিভিন্ন ধনী ব্যবসায়ী এবং গণ্যমান্য আরো অনেকে।
কথায় বলে,-‘অন্ধের কিই বা দিন, কিই বা রাত! অনুভব্যে রাত-দিন দুই-ই সমান!’
ঠিক তাই। প্রাণহীন, অর্থহীন সংসার কাকলীর। শুকনো মরুভূমির মতো নিরস, নিস্প্রেম, নিরুৎসাহিত দাম্পত্য জীবন। সুখ নেই, আনন্দ নেই, রূপ নেই, রঙ নেই, হৃদ্যতা নেই, আন্তরিকতা নেই, ভালোবাসা নেই। নেই কোনো আকর্ষণ, জীবনে চাওয়া পাওয়ার স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা। অথচ কি না নেই সংসারে! অর্থ -বিত্ত-ঐশ্বর্য্য, দামী শাড়ি, গহনা সবই পরিপূর্ণ। কিন্তু তাতে কি মনের চাহিদা মেটানো যায় কখনো?
মানসিক শূন্যতাবোধে নিজেকে বড্ড একা মনে হতো কাকলীর। রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এলে নিরবিচ্ছিন্ন মনটা ওর একাকীত্বের ধূসর কূয়াশায় ছেয়ে যেতো। অগত্যা, একরাশ অভিমান আর মনবেদনায় তারুণ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে সুকোমল যৌবনের একান্ত কাঙ্খিত কামনা-বাসনার ইচ্ছা-আবেগ ও ভালোবাসার তীব্র অনুভূতিগুলির গলা টিপে রুটিনমাফিক কেটে যাচ্ছিল, কাকলীর একঘেঁয়ে নিঃসঙ্গ নিরানন্দের জীবন। অথচ ওর আগমনেই অব্যক্ত আনন্দানুভূতিতে কি নিদারুণ এক অন্তর্নিহীত তাৎপর্য্য সৃষ্টি করেছিল অমিতের দেহে এবং মনে। যখন ওর ভাষায় বয়ান করবার ক্ষমতা ছিলনা। বোঝাবার ক্ষমতা ছিল না। আর ছিলনা বলেই কাকলীর প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ-ইচ্ছানুভূতিগুলি অনাদরে অবহেলায় এতিমের মতো যখন গুমড়ে গুমড়ে নীরবে অশ্রুপাতে মাথাকূটে কেঁদে মরছিল, তখন কি নীরব নির্বিকার আচার আচরণ অমিতের। মুহূর্তের জন্যেও কখনো ওর হৃদয়কে কাঁপায় নি, রেখাপাত করে নি। কখনো ভাবান্তরও হয়নি যে, দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর নিবিড়তম সম্পর্ক কতখানি মধুর, কত আনন্দদায়ক এবং কতখানি গুরুত্বপূর্ণ! এমনকী কখনো চৈতন্যেদয়ও হয় নি, মনুষ্য জীবনে দু’টি মানব-মানবীর প্রেম-ভালোবাসা এবং তাদের আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের গোপন রহস্যই বা কি!
কিন্তু মানুষ পরিবর্তনশীল। সময়ের বিবর্তনে পৃথিবীর রূপ, রঙ যেমন বদলে যায়, ঠিক তেমনিই সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে ঋতুর মতো বদলে যায় প্রতিটি মানুষ। মানুষের জীবন। ধ্যান-ধারণা, নিজস্ব রুচীবোধ, মন-মানসিকতা। যেমন করে বদলে গিয়েছিল অমিত। কিম্বা স্বয়ং বিধাতাই বোধহয় ওর উপর ভর করেছিল, তা কে জানে!
তার ঠিক বছর পাঁচেক পর, একদিন হঠাৎ অমিতের অভাবনীয় বিবর্তন রূপের দর্শণে শুধু বিস্মিতই নয়, পাড়ার সবাই হতবাক। প্রত্যেককে দৃষ্টি আকর্ষণ করে চুম্বকের মতো। আমি নিজেও অভিভূতের মতো কল্পনায় দেখতে থাকি, বিগতদিনে অমিতের শিশুসুলভ আচরণের সেই দৃশ্যগুলি। দেখতাম, অকারণেই হেঃ হেঃ করে হাসছে। দাঁতে খুঁট খুঁট করে নখ চিবোচ্ছে। কে দেখল, কি ভাবল, সেদিকে ওর কোনো বালাই-ই ছিল না। না ছিল সুন্দরভাবে গুছিয়ে কথা বলার ঢং, না ছিল চলার ঢং। তন্মধ্যে সাংঘাতিক তোতলাতো। যার পরিধানের একমাত্র বস্ত্র ছিল ফোতুয়া আর পায়জামা। পায়ে স্যান্ডেল। শুট-টাই তো দূর, কখনো বুট জুতো পড়ে হাঁটতেই পারতো না।
সেদিন ওর পরনে ছিল, ডিস্কো শার্ট, জিন্সের প্যান্ট। হাওয়ায় উড়ছে আতরের গন্ধ। চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের রঙ্গিন সান্গ্লাস। পায়ে ফ্যাশেনাবল্ দামী লেদারের হাইহিল জুতো। মুখে জ্বলছে চুরুট। দেখলাম, একগাল ধোঁয়া ছেড়ে নায়কসুলভ আচরণে প্রসন্ন মেজাজে অমিত গাড়ি থেকে নামছে। নেমে চারদিকটা একবার নজর বুলিয়ে ভি.আই.পির মতো বুটের খট্ খট্ শব্দ করে শ্বশুড়বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওর পিছন পিছন কাকলী। ওর পরনে ঢাকাই জামদানি শাড়ি। সিঁথিতে সিঁদুর। কপালে বড় লাল টিপ। খোঁপায় সুগন্ধি বেলীফুলের মালা। হাতে-কানে ভর্তি গহনা। গলায় দামী নেক্লেস। সদ্য পরিণীতা রাঙা বধূর মতো শ্বাশত লজ্জায় অাঁচলে মুখ গুঁজে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। দৃশ্যটি অবিশ্বাস্যকর হলেও সেটি ছিল সম্পূর্ণ বাস্তব সত্য এবং অবিস্বরণীয়। যা কোনদিনও ভোলার নয়!
চেনাই যাচ্ছিল না অমিতকে। তৃণের মতো দুইবাহু ভর্তি পশম। গালের দু’পাশে সুসজ্জিত দাড়ি। সর্বোপরী ওর উজ্জ্বল গৌরবর্ণের সুঠাম, সুদর্শণ মুখাকৃতিতে পৌরষের আবির্ভাবে আভিজাত্য ও মিশ্রব্যক্তিত্বের প্রগাঢ়
ছাপটাই শুধু লক্ষ্যণীয় নয়, প্রশংসণীয় ছিল বটে। চোখে তাক লেগে গিয়েছিল এবং প্রতিটি মানুষকে অত্যন্ত চমকৃত ও আকর্ষিত করেছিল।
কিন্তু মনে মনে আমার ভীষণ হিংসে হচ্ছিল। ঐতো রূপের ছিরি কাকলীর, শরীরটাকেও বানিয়েছে পাহাড়ের মতো। মন মাণিক হতেই কণ্ঠে মণিহার? এতখানি পরিবর্তন? এ সম্ভব হলো কেমন করে?
শাস্ত্রে বলে,-‘‘জগতে নারীই হলো সৃষ্টির প্রধান উৎস! একজন মমতাময়ী বিদূষী নারীর আবেগমিশ্রিত কোমল স্পর্শ শুধু মধুময়ই নয়, মিরাকলও বটে!’’
যার শান্ত-স্নিগ্ধ-শীতল ছায়াতলে একজন বিবাহিত পুরুষমানুষের সুখ আর মনের শান্তি সর্বদা বিরাজ করে। কিন্তু কখন? যখন দু’টি মানব-মানবীর আত্মার মধুর মিলনে লীন হয়ে জন্ম নেয় স্বচ্ছ, পবিত্র এবং সুকোমল ভালোবাসা।
অনেকের ধারণা, কোনো ডাক্তার, কবীরাজ কিংবা ওঝাবৈদ্য নয়, ধৈর্য্যশীলা, সহনশীলা পতিব্রতা স্ত্রীর মধুর ও কোমল সান্নিধ্যেই বদলে গিয়েছিল, কাকলীর হেবলাকান্ত স্বামী অমিত রায়। জগতে অসম্ভবের যে কিছুই নেই, সেটাই প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণিত করে নিবিড়তম আনন্দে আত্মগর্বে গৌরবাণ্বিতা কাকলীর হৃদয় মন-প্রাণ কখন যে উতলা হয়ে উঠল, টেরই পায়নি। খুশীর প্লাবনেই নিশ্চিহ্ন হয়ে মুছে গেল মনের পূঞ্জীভূত সমস্ত গ্লানি, ক্ষোভ -দুঃখ, মান-অভিমান সব। ঝড়ে গেল ওর শারীরিক, মানসিক অবসাদ এবং বিষন্নতা।
নিজেকে প্রশ্ন করতো, অপ্রত্যাশিত হঠাৎ পতিব্রতা, পবিত্রতা ও কোমলতায় ওর এই আকুলতাকে উপেক্ষা করে এতো মায়া-মমতা আর ভালোবাসার তীব্র অনুভূতিগুলি এতদিন লুকিয়ে ছিল কোথায় সব?
ভাবতেই স্পর্শকাতর কাকলীর মন বিগলিত হয়ে চকিতে রাঙা হয়ে উঠতো। অনুভব করতো, এক অভিনব তীব্র অনুভূতির নিদারুণ শিহরণ। যা রক্তের স্রোতের মতো সঞ্চালিত হতো ওর সারাশরীরে। আর এভাবেই একদিন হঠাৎ জাগ্রত হয়, অমিতকে ভালোবাসার প্রবল ইচ্ছা, আবেগ ও অনুভূতি। ইচ্ছা হতো, হৃদয়-মন-প্রাণ উজার করে ঢেলে দিতে। অথচ দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের টানাপোড়ণে বাঁধা পেতো, কিন্তু একজন রক্ত-মাংসে গড়া মানবীয় আত্মা তা উপেক্ষা করবার আর অপেক্ষা রাখে না।
অচীরেই চুম্বকের মতো তীব্র আকর্ষণের মায়ায় গভীরভাবে লিপ্ত হয়ে কাকলী একদিন স্বেচ্ছায় নিজেকে সঁপে দেয়, অমিতের হৃদয়-মন মাতাল করা প্রেম-ভালোবাসার অতল গহবরে। আর সেই প্রগাঢ় ভালোবাসার এক অভিনব সুখানুভূতির আনন্দে আপ্লুত হয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়, জীবনে চাওয়া-পাওয়ার অনন্ত সাগরের অতল গহবরে। যেদিন খুঁজে পায়, নারীর অস্তিত্ব, আপন সত্ত্বা। খুঁজে পেয়েছিল, বৈবাহিক জীবনের প্রকৃত সুখ-আনন্দ, সার্থকতা, পরিপূর্ণতা। স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদা। যেদিন মন-প্রাণ এবং শরীরের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে জীবনে প্রথম গহীনভাবে অনুভব করেছিল, একজন নারীর বৈবাহিক জীবনে এটিই পরম পাওয়া! পতীগৃহেই নারীর স্বর্গসুখ! অনুভব করেছিল, অমিতই ওর জীবনের সুখ-আনন্দ-ভালোবাসা সব! ধন্য হয়ে গিয়েছিল কাকলীর জীবন। যা কোনদিন কল্পনা করতে পারে নি। কিন্তু ওর ভাগ্য যে অবিরল, তা কে জানতো!
( ২ )
সবুজ মনের দ্বীপ্তি জাগিয়ে স্রোতস্নিনি নদীর মতো খুশীর পাল তুলে পূর্ণদ্যোমে বয়ে যাচ্ছিল কাকলীর জীবন নদীর খেয়া। উন্মুক্ত অন্তর মেলে নির্জন নিঃভৃতে মধুময় আলোকিত পূর্ণিমার অতন্দ্র মায়াবী রাতের মোহময় এক অনবদ্য ভালোলাগা আর ভালোবাসার বিশাল উপত্যকার মাঝে পাশাপাশি বসে থাকতো দু’জনে। যখন কামনা-বাসনায় আবেগ ও ইচ্ছানুভূতির সম্মোহনে স্বপ্নাপ্লুত হয়ে এক অদ্ভুদ নিস্তব্ধতায় ডুবে যেতো দুজনে। শেষ হয়েও হতো না শেষ হৃদয়পটে জমে থাকা অসংখ্য না বলা কথা। এমনি করেই আত্মমুগ্ধতায় বেমালুম পোহায়ে যেতো আবিষ্ট করে রাখা কত অগণিত মুহূর্ত, কত বিনিদ্র রজনী। কিন্তু স্বপ্নেও কি কখনো ভাবতে পেরেছিল, ওদের নতুন জীবনে নতুন দিগন্তের আলো রামধনুর মতো হৃদয়াকাশে উদ্ভাসিত হয়েই আচমকা উধাও হয়ে যাবে!
সেদিন যথারীতিই প্যান্ট-শার্ট পড়ে সদ্য এ্যাসিষ্টেন্ট্ ম্যানেজিং ডিরেক্টারের পদে নিযুক্ত হয়ে অফিস যাবার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল অমিত। সুরের মূর্ছণায় গুনগুন করতে করতে কখন যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল কাকলী খেয়ালই করেনি। খুব ব্যস্ত ছিল তখন। নিঃশ্বাস ফেলার সময়ই পাচ্ছিল না। আসছে সপ্তাহে ওর ছোট ভাই নিখিলের বিয়ে। মা বলেছে,-‘‘জামাইকে সঙ্গে নিয়ে এক সপ্তাহ আগে চলে আসতে!’’
গোছ-গাছও প্রায় শেষ! রাতটুকু পোহালেই কাল ভোরে ফাষ্ট ট্রেনেই রওনা দিতে হবে!
আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে হঠাৎ পিছন ফিরতেই চমকে ওঠে কাকলী। চোখ পাকিয়ে দ্যাখে, চোরের মতো নৈঃশব্দে চুপিচুপি ঘুরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো অমিত। ঢুকেই কৌতূক হাস্যে পশমাবৃত বলিষ্ঠ বাহুদ্বয় প্রসারিত করে অপ্রস্ত্তত কাকলীকে সজোরে আলিঙ্গনে বেঁধে নিয়ে ওর কপালে গালে চুম্বনে চুম্বনে ওকে একেবারে নাজেরহাল করে তোলে।
আচমকা বিনা নোটিশে অমিতের এহেন বিরূপ আচরণে মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল কাকলী। ভ্রু-যুগল কুঁচকে চাপা আর্তকণ্ঠে গর্জে ওঠে,-‘‘আঃ, আদিক্ষ্যেতার মতো এসব করছ কি! ছাড়ো, ছাড়ো বলছি! দেখছ না, জানালাটা খোলা! আজ হঠাৎ এ কি ভীমরতি ধরল তোমার! কি আশ্চর্য্য, ছাড়ো! তুমি না অফিসে বেরিয়ে গিয়েছিলে! ফিরে এলে যে!’’
বলতে বলতে চোখেমুখে বিরক্তি প্রকাশ করে এক ঝটকায় অমিতের আলিঙ্গন থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে। অমিতও নাছোড়বান্দা। দ্রুত এগিয়ে এসে কাকলীর হাতদু’টো জোরে চেপে ধরে ওর কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে বলে,-‘‘আরে বাবা, একটু প্রেম করছি গো, প্রেম! চটছ কেন!’’
ঠোঁটদু’টো চিবিয়ে বলে,-‘‘আজ আর ফিরছি না! রাতে ঘুমোই কিকরে বলো তো! তাই ভাবলাম, তোমায় একটু আদর করে যাই! কি হলো, এমন হাঁ করে দেখছ কি!’’
চোখমুখ রাঙিয়ে তাকিয়ে থাকে কাকলী। ক্রোধে ভিতরে ভিতরে যে ফুলছে, বোঝা যাচ্ছে। আর চটে গেলে ভারি সুন্দর দেখায় ওকে। চোখের মণিদু’টি তখন মৎচক্ষুর মতো ফুলে ওঠে। দৃষ্টি ভ্রষ্টের মতো দেখায়। হাসি চেপে রাখা যায় না। তখন পুরানো অভ্যাসগুলি অমিতের মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কি করতে কি করে, বোঝাই দায়।
সেদিনও হঠাৎ কাকলীকে কাঁপিয়ে দিয়ে হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে। হাসিটা বজায় রেখেই বলল,-‘ওঃ মাই গড্, এত্তো বেরসিক তুমি! ঠাট্টাও বোঝো না! কি জানি, হঠাৎ মনটা কেমন করে উঠল, তাই চলে এলাম!’’
ফিক্ করে হেসে ফেলল কাকলী। বলল,-‘‘এখন যাও তো! তাড়াতাড়ি ফিরে এসো! দেরী করো না কিন্তু! কাল খুব ভোরে উঠতে হবে! আঃ, দাঁড়িয়ে আছো কেন, যাও!’’
বলে শাড়ির আঁচলটা কোমড়ে গুঁজে একরকম ধাক্কা দিয়েই ঘর থেকে বের করে দেয় অমিতকে।
মুখে বুলি ফোটার পর ইদানিং কথায় কথায় হাসি-মজাক করা খুব বেড়ে গিয়েছিল অমিতের। সময় নেই অসময় নেই, যখন তখন কান্ড একটা করে বসতো। কিন্তু বাঙালি রমণীর মন, সংস্কার বিশ্বাসী। সর্বদা কু-ই গায়। কিছুতেই মন থেকে অপসারিত করতে পারে না। অপ্রত্যাশিতভাবে আকস্মিক স্বামীর সোহাগে কিঞ্চিৎ বিব্রোতবোধ করলেও অমিত বেরিয়ে যাবার পর থেকেই অজানা আশঙ্খায় বুকের ভিতরটা বার বার কেঁপে উঠছিল শুধু এইভেবে যে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে অমিত ফিরে এলো কেন? কেন এসেছিল? আর এসেই বা এমন করলা কেন? আগে তো কোনদিন এমন ঘটেনি!
মনে মনে প্রার্থণা করে,-‘‘হে ভগবান। অমিত যেন যথা সময়েই সশরীরে বাড়িতে ফিরে আসে।’’
কিন্তু তখন স্বপ্নেও কি ভাবতে পেরেছিল, অমিতের ঐ ঠাট্টা-রসিকতাই ওর জীবনে বিপদ ডেকে আনবে! ওদের সেদিনই শেষ দেখা!
কেটে গেল দু’রাত-দু’দিন। অমিত বেপাত্তা, নিখোঁজ। কিন্তু জলজ্যান্ত একটা মানুষ রাতারাতি উধাও হয়ে গেল কোথায়! দুঃশ্চিন্তায় বাড়ির সবাই অস্থির। নির্জীব পাথরের মতো শক্ত হয়ে থাকে কাকলী। মুখে ভাষা নেই, চোখে ঘুম নেই। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। চোখে বিভীষিকা। একেই পুতুলের মতো ছোট্ট মুখ। চোখমুখ শুকিয়ে একেবারে গর্তে ঢুকে গিয়েছে। তাকানোই যাচ্ছিল না ওর মুখের দিকে। ক্ষিদে নেই, তৃষ্ণা নেই, উপবাসে দিন যায় আর রাত পোহায়।
ওকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করলেন শ্বাশুড়ি মাতা রমলা দেবী। একগাল পান চিবোতে চিবোতে বললেন,-‘‘চিন্তা করো না বৌমা, পোলারে তো আমি চিনি! তোমাগো বাড়িতেই গ্যাছে গিয়া! হ্যাড় সবুর সয় নাই! শ্যালকের বিয়া না! দ্যাখবা, আইয়া পড়ব ক্ষণ!’’
কিন্তু কোথায় অমিত? কেটে গেল আরো কয়েকটা দিন। তার পর ঘনিয়ে আসে, অনাকাঙ্ক্ষিত বিষন্নময় এক সকাল। চারিদিকে নীরব, নিস্তদ্ধ। গুমোট মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। রোদ্দুর নেই, পাখীর কলোরব নেই। হাওয়া নেই, বাতাস নেই। যেন পৃথিবী জুড়ে সমস্ত মানুষ শোক পালন করছে। দূর থেকে দু-একখানা গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হর্ণ বাজিয়ে দ্রুত পাস করে যাচ্ছে।
বেলা তখন গড়িয়ে প্রায় দূপুর। হঠাৎ অটোরিক্সার আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে কাকলী। দুঃশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় মরিয়া হয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। ভারাক্রান্ত বড়ভাই অনিলকে দেখামাত্রই বুকটা ওর ছ্যাঁৎ করে ওঠে। কি বিষাদ, মলিন দেখাচ্ছে ওকে! হন্তদন্ত হয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে। কিন্তু অমিত কোথায়? আসেনি তো ও’!
মাথাটা বন্ বন্ করে ঘুরে উঠল কাকলীর। ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসে ওর চোখের সামনে। তবে কি সত্যিই কপাল পুড়লো কাকলীর?
হ্যাঁ, সত্যিই কপাল পুড়েছে কাকলীর। ওর প্রাণপ্রতিম, প্রাণেশ্বর অমিতের মৃত্যু সংবাদই বয়ে নিয়ে এসেছে অনিল। কাকলী চিৎকার করে ওঠে,-‘‘এ আমার কি সর্বণাশ হলো দাদা! ওযে ফিরে এসেছিল, আমি বুঝতে পারি নি, আমি একটুও বুঝতে পারি নি দাদা! ওকে কেন যেতে দিলাম! গায়ে ধাক্কা দিয়ে ওকে আমিই ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলাম! আমার এ কি সর্বণাশ হলো দাদা!’’
বলতে বলতে দু’হাতে বুক চাপড়িয়ে মরা কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়ে কাকলী। কিন্তু এতবড় একটা দূর্ঘটনা কিভাবে ঘটল, তা কেউই জানেনা।
পোষ্ঠ-মর্টেমের রিপোর্টে জানা গেছে, চলন্ত গাড়ির ধাক্কায় অমিতের মৃত্যু ঘটেছে। ছিটকে পড়েছিল, রাস্তার সংলগ্ন গভীর জঙ্গলে। কাকলীদের বাড়ি থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে। কারো নজরে পড়েনি। এমনকী
পশু-পক্ষীরাও টের পায় নি।
তার দিন ক’য়েক পর অমিতের মৃতদেহের উগ্র গন্ধ্য বাতাসে ছড়িয়ে পড়তেই চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। খবর পেয়ে ছুটে আসে স্থানীয় গোয়েন্দা পুলিশ, পুলিশ ইন্সপেক্টর। তারাই একটি ব্রিফ্কেস্ সহ উদ্ধার করে অমিতের মৃতদেহ। যাকে শনাক্ত করা খুবই মুশকিল ছিল। হাঁড়-মাংস থেতলে গিয়ে বীভৎস হয়ে গিয়েছিল অমিতের মুখ। গলে নরম হয়ে গিয়েছিল ওর মৃতদেহ। তন্মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে ওকে চেনাই যাচ্ছিল না।
ওর ঐ ব্রিফ্কেসটা সার্চ করে খুঁজে পায়, কাকলীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা নিখিলের বিবাহের কার্ড। সেই কার্ডের ছাপা অক্ষরে লেখা ঠিকানা ধরেই স্থানীয় পুলিশ গিয়ে হাজির হয় কাকলীর পিত্রালয়ে।
এ কেমন বিধির বিধান! ভাগ্যের কি নিমর্ম পরিহাস! রাজমূকুট পড়ে রাজসিংহাসনে বসে শ্বশুড়বাড়ির বিশাল সাম্রাজ্য শাসন ও পরিচালনা করছে ঠিকই কিন্তু অকাল বৈধব্যে একাকীত্বের নিঃসঙ্গতায় জীবনের দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে এসেও হৃদয়ের শূন্যতায় আজও নীরব নীরবিচ্ছিন্ন একাকী নির্জন সন্ধ্যায় বুকটা ওর হাহাকার করে ওঠে কাকলীর। খাঁ খাঁ করে ওর শূন্য নীড়। মন কাঁদে, প্রাণ কাঁদে। কাঁদে মনের হিয়া। প্রিয়তম স্বামী অমিতকে চিরতরে হারানোর শোকে-দুঃখে-বেদনায় আজও গুমড়ে গুমড়ে কাঁদে। কাঁদে ওর ভালোবাসা। যখন তন্ময় হয়ে বিচরণ করে এক অবিস্মরণীয় স্মৃতির মণিমেলায়। আপন মনে কথা বলে। কখনো কাঁদে। কাঁদে গভীর নিশুতি রাতের একান্তে নির্জন নিঃভৃতে।