গরম ভাতের গল্প

বিশ্বকাপ ক্রিকেট / নববর্ষ (এপ্রিল ২০১১)

মাহমুদা rahman
  • ১২২
  • 0
  • ১০১
যে বাড়িতে সাজেদা সারাদিনের সমস্ত শ্রম দিয়ে আসে সে বাড়ির মহিলা যখন তাকে সন্ধ্যায় সারাদিনের বেঁচে যাওয়া ঠাণ্ডা ভাত আর বাসি তরকারি বেঁধে দেয় সাজেদা তখন ত্রস্তগতিতে পলাশী বস্তির পথ ধরে।
বস্তির খুপরি ঘরটিতে তিনটি অনাহারী-অর্ধাহারি ছেলেমেয়ের কাতর অপেক্ষার অবসান ঘটাতে সাজেদা যখন হাঁটতে থাকে তখন আর পথ ফুরোতে চায় না।
দীর্ঘ তিন বছর ধরে এ রুটিনের ব্যতয় হয়নি। অসুখ-বিসুখ ছাড়া আর মাসের যেদিন অন্যের বাড়িতে কাজের পারিশ্রমিক মেলে সেদিন এরকম করে ঘরে ফিরতে হয় না সাজেদাকে।
বেতন পেয়ে সাজেদা বাজার থেকে সস্তায় কিছু চাল কেনে। সারাটা মাস অন্যের উচ্ছিষ্ট আর বাসি-পান্তা খেয়ে তার ছেলেমেয়েরা গরম ভাতের জন্য মুখিয়ে থাকে।
সাজেদার তিন ছেলেমেয়ে স্বপ্না আর রত্না যমজ বোন। বয়স এগার। ছেলে সাজেদের বয়স সাত বছর। মেয়েদের লেখাপড়া করানোর সামর্থ্য নেই সাজেদার কিন্তু ছোট ছেলেটিকে নিয়ে যে তার অনেক স্বপ্ন। তাই বস্তির পাশে কম খরচের স্কুল অগ্রণী কিণ্ডার গার্টেনে ভর্তি করিয়েছে ছেলেকে।
স্বপ্না আর রত্না সারাদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফুল আর মালা বিক্রি করে। লোকের ফেলে দেয়া খাবার খায় আর কাউকে খেতে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে খাবার চায়।
সারাদিনে খাওয়া মন্দ হয় না কিন্তু এক সাথে পেট পুড়ে না খেতে খেতে হয়ত বুঝতেই পারে না ক্ষুধা আছে কি নাই তাই যাকেই খেতে দেখে তার কাছে গিয়েই হাত বাড়ায় তারা।
সাজেদার বেতন পাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসতেই দু'বোন মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘেঁষা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক এসব জায়গা থেকে গাছের ডাল, শুকনো পাতা, কাগজ জড়ো করতে থাকে। তাদের মা তাদের জন্য অনেকদিন পর নিজ হাতে গরম ভাত রান্না করবে। সেজন্য তারা জ্বালানি সংগ্রহ করে।
তারপর রূপকথার গল্পের মত তাদের সত্যি সেদিন আসে। মাটির চুলার চারপাশে তিনটি শিশুর লোভাতুর দৃষ্টি।
-মা,আর কতক্ষণ?
-এই তো বাপ আর একটু সবুর কর।
সাজিদ চুপ করার কিছুক্ষণ পর আবার স্বপ্না অথবা রত্না চিৎকার করে উঠে,"ও মা, আর তো সহ্য করতি পারতিছিনা নাড়ি-ভূড়ি যে পইচে গেল খিদেয়"
ছেলে সাজিদের জন্য উত্তরটা নমনীয় হলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে একটু কড়া গলায় সাজেদা উত্তর দেয়, "চুপ করতো আমি কি হাত-পাও জ্বাল দিয়া রান্ধুম?"
মা বিরক্ত হচ্ছে দেখে তিন ভাইবোন নির্বাক হয়ে গরম ভাতের উত্তপ্ত ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
গরম ভাতের সাথে সস্তায় কেনা ঋতুকালীন সবজি, আলু ভর্তা বা গলে যাওয়া পচে যাওয়া ছোট মাছের চচ্চরি। কোন কোন দিন স্বপ্না-রত্নার কল্যাণে ঢাকা শহরের পুঁতিগন্ধময় ডোবা নালা থেকে তোলা বিভিন্ন শাক যেদিন যেমন হয় তাই অমৃতের মত লাগে তাদের কাছে।
ছেলেমেয়েরা যখন গেগ্রাসে খেতে থাকে সাজেদা তখন মুগ্ধ হয়ে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
'আহা আজ যদি মানুষটা থাকত.....কি দোষ ছিল তার আর সন্তানদের........'
এ হিসাব সাজেদা মেলাতে পারে না। ভালই তো ছিল মাগুরার শত্রুজিতপুরের গ্রামটিতে। সারাদিন মানুষের জমিতে কামলা খেটে সন্ধ্যায় সানুষটা ঘরে আসত। কেমন সুখের একটা ছোঁয়া ছিল। কিন্তু ঢাকা শহরে রিক্সা চালাতে এসেই মানুষটা কেমন বদলে গেল।
ঠিক এমনি হাজার ক্ষুধা আর দারিদ্রের গল্প আবহমান বাংলার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন 'চর্যাপদ' এ যে জীবন ও জীবিকার পটভূমি পাওয়া যায় সেখানে নিম্নবর্গের মানুষের কথাই লেখা। গরম ভাতের গল্প যেন সেখানে রূপকথা!
সাজেদার কোলে শুয়ে যখন শিশু সাজেদ মায়ের স্বল্পজ্ঞানে বানানো গল্প শুনতে থাকে। ছেলের ভবিষ্যৎ স্বপ্নে বিভোর মা হঠাৎ ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, "বাপ, বড় হয়ে যখন ম্যালা টাকা কামাবি তখন কি করবি?"
-ম্যলা চাল কিনি আনি বউরে কমু তিন বেলা গরম ভাত রানতি আর আমি বসি বসি খাতি থাকব।
ছেলের এমন উত্তর শুনে অশিক্ষিত বোক-সোকা মা তখন নিজের অক্ষমতায় ভাষাহীন।
দু'বোনের যুগ্ম হাসির ফোয়ারায় সাজেদ বুঝতে পারে সে হয়ত খুব ভাল উত্তর দেয়নি কিন্তু সে কি করবে, ছোট এই মাথাটায় যে আর কোন চিন্তায় আসেনা অনেক টাকা হলে সে কি করবে?
সাজেদার কড়া নির্দেশ সাজেদকে নিয়ে দু'বোন যেন বাইরে না যায়। সাজেদা চায় না স্বপ্না-রত্নার মত জীবন যাপন সাজেদ করুক।
তার চাওয়া তার ছেলে বড় লোকের ছেলেমেয়েদের মত মানুষ হবে। জজ-ব্যারিস্টার হবে।
বোন দু'টিও ভাবতে শুরু করেছে তাদের ভাই তাদের মত নয়। তবু স্কুলের পড়া শেষ করে সাজেদ অপেক্ষা করতে থাকে কখন বোনেরা তাকে তাদের সারাদিনের গল্প শোনাবে।
ক্যাম্পাসের কোন আপু-ভাইয়াকে দেখলেই ওরা বুঝতে পারে ফুল কিনবে, কোন আপুটা খাবার দিবে। কেমন করে বাধ্য করে ফুল কিনতে।
মাঝে মাঝে আপুটির গলায় মালা পড়িয়ে দিয়ে ভাইয়াকে বলে কিনতে। সদ্য প্রেমে বিভোর তরুণ-তরুণীরা কোমল হয় বেশি তারাই বেশি ফুল কেনে। কেউ কেউ আবার খুব খারাপ ব্যবহার করে, বকাও দেয়। এসব গায়ে মাখলে কি আর চলে? ওরা তখন উল্টো একটা বাজে কথা বলে ওখান থেকে পালায়।
এসব গল্প শুনে সাজেদের ভীষণ ইচ্ছে করে ওদের সাথে সারাদিন বাইরে থাকতে। কিন্তু মা কষ্ট পাবে বলে স্কুলেই সময় কাটায় সে।
স্বপ্না-রত্নার কত গল্প বিভিন্ন দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কত মজাই না হয়! ১৬ই ডিসেম্বর, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ, ভ্যলেনটাইন ডে, পহেলা বসন্ত, পহেলা বৈশাখ আরো কত কি? হয়ত ওরা দিবসগুলোর নাম বলতে পারেনা কিন্তু জানে।
আর কিছুদিন পরেই পহেলা বৈশাখ। স্বপ্না-রত্না জানেনা মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা নববর্ষের সূচনা করেছিলেন।
চৈত্রের শেষদিনে খাজনা শোধ করার পর বৈশাখের প্রথম দিনে রাজার বাড়ি প্রজাদের আমন্ত্রণ জানানো হতো মিষ্টিমুখ করার জন্য। হাল-খাতার সে প্রচলন থেকেই পহেলা বৈশাখে ভাল খাওয়া, ভাল পড়ার প্রচলন চলে এসেছে বাঙালির কাছে।
বাঙালির চিরাচরিত ধারণা এ দিন ভাল খাবার খেলে ভাল কাপড় পড়লে সারা বছর ভাল থাকা যাবে।
কিন্তু বাংলার প্রাণের মেলা পহেলা বৈশাখে কেমন করে যেন হুঁশ করে পান্তা কালচার ঢুকে পড়েছে।
মাটির সানকিতে পান্তা ভাতে ইলিশ মাছ, নানান রকম ভর্তা। কত মজা করেই না সবাই খায়।
স্বপ্ন্-রত্না তাদের ভাইকে জানায় "ভাই, তুই কি যাবি আমাদের সাথে? খুব মজা হবে ইনবার্সিটিতে"।
-মা যদি বকা দেয়?
-মাকে জানাব না
সাজেদ সম্মতি জানায়।
সাজেদ কখনো এত মানুষ আগে দেখেনি। মেয়েরা সব লাল সাদা শাড়ি পড়া, ছেলেরা সব পাঞ্জাবী। অনেক ছোট ছেলেমেয়েও এসেছে বাবা মার সাথে। তাদের হাতে মুখে কি সব আঁকা। সারা ক্যাম্পাস জুড়ে কত রকম খাবার, খেলনা, নাগরদোলা আরো কত কি। সাজেদ খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।
স্বপ্না-রত্না সাজেদের হাত শক্ত করে ধরে থাকে যেন হারিয়ে না যায়। অনেক ভিড় ঠেলে সাজেদকে রমনা বটমূলে নিয়ে যায় তারা।
স্বপ্না-রত্নাও প্রথমবারের মত এখানে এলো। ভিড়ের কারণে কখনো ওরা আসতে পারেনি। আজ খুব কষ্ট করে এসেছে।
লাল পাড় সাদা শাড়ি আর মাথায় বেলি ফুলের মালা পড়ে মেয়েরা গান গাচ্ছে 'এসো হে বৈশাখ এসো এসো.........তাপস নি:শ্বাস বায়ে........"
তিনটি ভাইবোন তখন খুব আনন্দ নিয়ে অর্থহীন গানটি মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে।
সারাদিনের আনন্দ শেষে মায়ের ফেরার আগেই বস্তির পথে পা বাড়ায় তিন ভাইবোন। ভাইকে অনেক খাবার কিনে দিয়েছে দু'বোন। একটা বেলুনও সাথে। সাজেদের আনন্দ আর ধরে না।
বাড়ি ফেরার পথে তারা ভাবতে থাকে পহেলা বৈশাখ দিনটি খুব আনন্দের কিন্তু ছোট ছোট তিনটি মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না কেন সবাই এত টাকা দিয়ে পান্তা ভাত কিনে খাচ্ছে।
একদিন গরম ভাত খাওয়ার জন্য ওরা কত কষ্টই না করে। মা যদি জানত তাহলে মা ও খুব হাসত এটা ভেবেই মনে মনে হেসে ওঠে সাজেদ।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে মা পান্তা ভাত নিয়ে ঘরে ফিরবে। বোনদের সাথে আরো জোড়ে পা চালায় সাজেদ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ডাঃ সুরাইয়া হেলেন একদম বাস্তব একটা চিত্র দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখিকা ।১লা বৈশাখ পান্তা ভাত খাওয়া ধনীর বিলাসিতা,গরীবদের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ বলেই মনে হয় আমার,এ আমাদের ঐতিহ্য নয়,অক্ষমতা ।শুভকামনা ।
আসন্ন আশফাক গত কোরবানির ঈদ এ ফুলার রোডে সন্ধায় দেখেছিলাম একটা বোকা লোক (পাগল) ডাস্টবিনে খাবার খাচ্ছে........... এই ব্যাপারগুলো আমাদের হৃদয় ছুয়ে যায়
ম্যারিনা নাসরিন সীমা আমাদের বোধোদয় হওয়া উচিত । সানকিতে পান্তা ভাত খাওয়া আমাদের যেমন একটা বিলাস তেমনি দরিদ্রদের গরম ভাত খাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই একটা স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে ।ধন্যবাদ এই সুন্দর লেখার জন্য ।
মৃন্ময় মিজান ভাল লাগল। একটু দেরীই করে ফেললাম বোধহয়। আসলে নতুন তো এ পাড়ায় সব ফিচার জানা হয়নি এখনো।
মেহরাব ছোট্টু wow! Khub shundor. Bt apuni,shestay ar ektu shundor korte parta.ar vashay ar ektu vinnota anle mondo hoto na.
পাভেল ভালো লাগলো । সংসদ নির্বাচনের পর আবার ভোট দিলাম । হা হা হা । একটা বাণী আমার ভাল লাগে * "যদি লেখক হবার বাসনা থাকে তবে লেখ। - ইপিকটিটাস"
মাহাতাব রশীদ (অতুল) আবার পড়ে ফেললাম।শেষ দিনে সবাই কে উতসাহিত করছি,
পার্থ প্রতীম ভালো লাগলো । বাস্তব উঠে এসেছে। আশা করছি আপনার লেখনী আরো পোক্ত হবে। গল্প এবং ধারাবর্ণন ভালো হয়েছে। আপনার উন্নতি কামনা করছি।

২৫ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪