সকাল সাতটা বাজতে প্রায় বিশ মিনিট বাকি। ঢাকাগামী সূবর্না এক্সপ্রেস চট্টগ্রাম রেল ষ্টেশনে দুই নম্বর প্লাটফর্মে দাড়িয়ে আছে । আমি আমার টিকেট অনুযায়ী নির্দিষ্ট বগীতে প্রবেশ করলাম । আমার সিট নম্বর মিলাতে গিয়ে তরুণীটিকে দেখে চমকে উঠলাম ! এত সুন্দর কোন মানুষ হতে পারে ভাবতেও পারিনি ! আমি একজন ডাক্তার। মেয়েটাকে দেখে আমি আমার আসন নম্বর দেখার কথা ভুলে গেলাম। চোখে সান গ্লাস আর পরনে হালকা হলুদ রংয়ের কামিজ আর ওড়না ও হালকা কমলা রংয়ের সেলোয়ারে মনে হছ্ছে অন্য জগতের অনন্য এক অপরূপ রুপসী। কিছুক্ষন পরই নিজেকে সামলে নিলাম তারপরই খেলাম আরেক ধাক্কা। হায় হায় একি! সৌভাগ্য না দূর্ভাগ্য ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তরুণীটির পাশের আসনটাই আমার আসন। এখন কি করি ? এত সুন্দরী মেয়ের পাশে বসাও তো একটা সমস্যা। নড়তে চড়তে অসস্থিবোধ হবে । আমি আবার বেশিক্ষন সুস্থির হয়ে বসে থাকতে পারি না। ভয় হচ্ছে ট্রেনের যে ছোট আসন তাতে না আবার শরীরের সাথে স্পর্শ লাগে। বুজতে পারছি না কি করব !! ট্রেন ছাড়তে আরও দশ মিনিট বাকি। আমি আমার আসনে না বসে একটু দুরে অন্য একটা খালি আসনে বসে পড়লাম। কিছুক্ষন পর আমার বসা আসনে নির্ধারিত যাত্রী এসে পড়ায় উঠে যেতে হল। ইতিমধ্যে ট্রেনও চলতে শুরু করেছে। আমি উঠে আমার সিটের দিকে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। “ এক্সকিউজ মি “ বলতেই আমার দিকে ঘুরে তাকালো। আমি বোধহয় আমার একটা হার্টবিট হারিয়ে ফেললাম। ঃ বসতে পারি ? মেয়েটি একটু নড়েচড়ে বসে বললঃ বসুন। আমি খুব সাবধানে আস্তে করে বসে পড়লাম। দেহটাকে যতটা সম্ভব চেপেচুপে ছোট করার ব্যার্থ চেস্টা করলাম । ইতিমধ্যে ট্রেন পূর্ণ গতিতে চলা শুরু করেছে। আমি কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকলাম। মেয়েটি মাথাটা সিটের সাথে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে । আমি ভাবছি মেয়েটির সাথে কথা বলব কিনা । আমি চাইলেই সেকি আমার সাথে কথা বলবে ? এটাত ইউরোপ বা আমেরিকা নয় । ওখানে চাইলেই যে কোন অচেনা মেয়ের সাথে কথা বলা যায়। শুধু প্রথমে একটা বন্ধুত্বপূর্ন হাসি দিয়ে বুঝে নিতে হবে সে ইছ্ছুক কিনা। যদি সেও একই হাসি দেয় তাহলে বুঝতে হবে সিগন্যাল গ্রীন। কিন্তু বাংলাদেশি মেয়েরা এখনো অতটা ফ্রী হতে পারেনি। তাই ভাবছি কি করব? হঠাৎ করেই নিজেকে কেমন যেন মনে হল। যদিও প্রকাশ করিনি, তারপরও নিজেকে কেমন যেন নিজের কাছে হ্যাংলা মনে হল। আমি মেয়েটার কথা ভাবা ছেড়ে দিলাম । এই মেয়েটাকে নিয়ে এত ভাবছি কেন ? বিদেশে এত বছর ছিলাম, কত সুন্দরী মেয়ে আহ্ববান করেছিল, সাড়া দেইনি। নিজেকে পবিত্র শুদ্ধ রাখার জন্য। এ জন্য কত জনে হাসি-ঠাট্টা করেছে। পাত্তা দেইনি। আর আজ এই মেয়েটাকে নিয়ে আমার রাজ্যর যত ভাবনা। নাহ। আর নয়। মেয়েটাও কেমন যেন অন্য রকম। নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত । আচরন দেখলে মনে হয় মাথাটা একটু কাত করে সারাক্ষন কি যে যেন ভাবছে । আমি ব্যাগ থেকে একটা গল্পের বই বের করলাম । বইটা নিয়ে কয়েক পাতা পড়ার চেষ্টা করলাম পারলাম না । এত সুন্দরী মেয়ে পাশে বসে থাকলে অন্য কিছুতে কি মন সংযোগ করা সম্ভব ? এই সময় চা লাগবে কিনা বলতে বলতে ট্রেনের টি-বয় এল । বাসা থেকে নাস্তা খেয়ে বের হয়েছি তারপরও একটা চায়ের অর্ডার দিলাম। মেয়েটা কোন কিছুই নিল না । আমি ওর জন্য চায়ের কথা বলব কিনা এই কথাটা মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করতে যেয়ে থেমে গেলাম, কারন মনে পড়ে গেল সাবধান বানীর কথা । “বাসে বা ট্রেনে যাতায়াত করার সময় অচেনা লোকদের থেকে কিছুই খাবেন না।” আমি চুপচাপ চায়ের অপেক্ষায় বসে থাকলাম । ইতিমধ্যে পাশেই কোথাও মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠল। মেয়েটা নড়েচড়ে উঠল। পাশে রাখা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে রিসিভ করল। রূপ দেখে আধা মরা কন্ঠ শুনেত জিন্দালাশ। যেন হাজার লক্ষ কাচের চুড়ি ভেংগে পড়ল ট্রেনের ভিতর। কান পেতে শুনতে থাকলাম মেয়েটির কথা গুলো । ঃ এইত কিছুক্ষন আগে ট্রেন ছেড়েছে। ঃ ………। ঃ নাহ কোন সমস্যা হয়নি। ঃ…………। ঃ নাহ এখনও খাইনি । ঃ……………। ঃ ঠিক আছে। ঃ……………। ঃ আছ্ছা। ঃ………। ঃ না না লাগবে না। ঃ…………। ঃ এখন রাখতো আমি পরে করব। এই বলে মেয়েটি লাইন কেটে দিল। আমার চা এসে গেল । চায়ে চুমুক দিতে যাব এই সময় এক গর্দভ আমার হাটুতে ধাক্কা খেল। চা ছলকে কিছুটা আমার রানের উপর পড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি চায়ের কাপটা রেখে পকেট থেকে টিসু বের করে ভিজে যাওয়া জায়গাটা মুছতে লাগালাম। লোকটা আমাকে বার বার সরি বলত লাগল । আমি টিসু ঘষছি এই সময় পাশের সিটে একটু উচু হাসি শুনে মাথা তুলতেই দেখলাম। লোকটা আমাকে বার বার সরি বলছে ঠিক কিন্তু তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। আমি রেগে গেলাম বললামঃ ভাইয়া চা উনার গায়ে পড়েনি, আমার গায়ে পড়েছে । আপনি উনার দিকে তাকিয়ে বার বার সরি বলছেন কেন ? আশেপাশের সবাই আবার হো হো করে হেসে উঠল। লোকটা লজ্জা পেয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। আমি একটা ব্যাপার দেখে অবাক হয়ে গেলাম এত কিছু হয়ে গেল। এতে মেয়েটার কোন প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না। সে কানে হেড ফোন লাগিয়ে এক মনে গান শুনছে। কানে না শুনলেও চোখেত দেখেছে তারপরও কোন প্রতিক্রিয়া নাই। এ এক আজব মানুষত। আমি টিসুটা ফেলে দিয়ে চা টা শেষ করলাম। তারপর কাপটা আসনের নিচে রেখে উঠে দাড়ালাম । একটু হেটে আসি। হেটে বগীর দরজায় দাড়িয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম কি দ্রুত ট্রেনটা ছুটে চলছে । লাইনের দুপাশের ঘর বাড়ি গাছপালা পিছনে চলে যাছ্ছে। অনেকক্ষন এভাবে দাড়িয়ে থাকলাম । আসনে ফিরে যেতে ইছ্ছে করছে না। এত বড় ঘটনায় মেয়েটির নিষ্পৃহতা আমাকে আহত করেছে । সহযাত্রী হিসাবে একটু সহানুভুতি পাওয়ার অধিকারত আমার আছে। কি জানি বাংলাদেশে হয়ত এরকম। অনেক দিন বিদেশ ছিলামত তাই এখানকার কালচার অনেকটাই এখনও বুঝে উঠতে পারিনা। আমি আস্তে আস্তে আমার আসনের দিকে এগিয়ে গেলাম। আসনের সামনে এসেত আমি অবাক, একি আমার আসনে আরেকজন বসে আছে। শুধু বসে আছে বললে ভুল হবে। হালকা নাসিকা গর্জন করে আরামে ঘুমাছ্ছে। আমি আস্তে করে ডাকলাম । কোন সাড়া নাই। এবার একটু জোরে ডাক দিতেই চোখ খুলল। ঃ এটা কি আপনার আসন ? লোকটি কিছু না বলে উঠে চলে গেল। আমি আমার আসনে বসে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বের করলাম । অন করলাম। এরপর একমনে নেট ব্রাউজ করতে লাগলাম। কি নেট ব্রাউজ করব ! মনে পড়ে আছে মেয়েটির দিকে । আর মেয়েটা সেইরকম নিষ্পৃহ আর আত্মমগ্ন হয়ে আছে। যথা সময়ে ট্রেন বিমানবন্দর ষ্টেশনে পৌছল। আমার এখানে নামতে হবে। ট্রেনটা দাড়াতে বয়স্ক এক ভদ্রলোক ঢুকল । এসে সোজা আমার আসনের সামনে । আমি তখনও উঠে দাড়াইনি। লোকটা বললঃ বাবা আপনি একটু উঠলে, আমি ওর লাগেজটা নিতে পারি। আমি দ্রুত আসন থেকে উঠে দাড়ালাম। লোকটি মেয়েটাকে বলল “মামনি তুই এবার বের হয়ে আয়, উনি সরে দাড়িয়েছেন।“ লোকটির কথা শুনে আমি অবাক হয়ে লোকটির দিকে তাকাতেই বললেনঃ আমার ভাতিজি চট্টগ্রাম থাকে। অন্ধ। তাই চোখের ডাক্তার দেখানোর জন্য ঢাকা নিয়ে এসেছি। কিছুদিন আগে লন্ডন থেকে চক্ষু বিষেশগ্গ ডাক্তার যুহাইর হোসেন এসেছেন উনাকে দেখাবো। লোকটার কথা শুনেত আমি পাথর হয়ে গেলাম। আমি একজন চোখের ডাক্তার হয়ে মেয়েটির এই আচরনটা বুঝতে পারলামনা। কি করে সম্ভব। একটু চিন্তা করতেই আমার ভুলটা ধরতে পারলাম । মেয়েটির অসম্ভব রুপ আমাকে এতটাই বিভোর করে করে ফেলেছে যে, তার স্বাভাবিক আচরন বুঝতে আমায় বাধা গ্রস্থ করেছে। আমি নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হয়ে গেলাম। কারন আমিই লন্ডন ফেরত সেই চোখের ডাক্তার!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু
গল্পটায় খুব চমক আছে। --- এত সুন্দর মেয়ে, অথচ অন্ধ। বিষয়টা খুব দুঃখজনক। অনেক ভাল লাগল। আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ করবেন। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী
চমৎকার একটি গল্প। অনেক ভালো লাগলো। আপনার মন তো তার রুপের কাছে ছিল, তাই তো তার রোগের কথা বুঝে উঠতে পারেননি। আর এটা স্বাভাবিক। শুভেচ্ছা সহ শুভকামনা রইল। ভালো থাকুন নিরন্তর....
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।