আমার সহজ সরল বন্ধুটি

সরলতা (অক্টোবর ২০১২)

ডাঃ সুরাইয়া হেলেন
  • ১৩
আমার বান্ধবী লুসি(ডা.সুফিয়া সুলতানা),প্রায় ৫০বছর ধরে আমাদের বন্ধুত্ব অটুট আছে!এতাটুকু ফাটল ধরেনি!এই ৫০বছরে কখনও তার সাথে আমার ঝগড়া বা সামান্য মনোমালিন্যও হয়নি!অন্য বান্ধবীদের সাথে কত খুনসুটি,অকারণ ঝগড়া,মন খারাপ একটু আধটু হলেও লুসি এখানে ব্যতিক্রম!ও ছিলো আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে!মেডিকেল কলেজে ওর নাম ছিলো ‘ইন্দিরা গান্ধী’!সেই ছোটবেলা থেকে আমরা একসাথে স্কুল ও একই মেডিকেলে পড়েছি!শুধু মাঝে এইচ.এস.সি ২বছর ও ঢাকায় আর আমি ময়মনসিংহের আনন্দ মোহনে!চাকুরী জীবনে দুজন রয়েছি দূরে দূরে!লুসি বহুবছর কাটিয়েছে সৌদি আরবে!আমিও দেশ বিদেশ ঘুর অবশেষে ঢাকায় এলাম!এক দুপুরে এক মহিলা কণ্ঠ ফোন করে বললো,‘আপনি কি ডা.সুরাইয়া?’
আমি বলি,‘জি!আপনি?’
মহিলা বলে,‘আমার নাম সুফিয়া সুলতানা।আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?’
আমি রেগে গিয়ে বলি,‘দেখ লুসি,ভালো হবে না কিন্তু!মারবো এক থাপ্পড়,আপনি আপনি করে বলছিস কেন?আবার ঢং করে সুফিয়া সুলতানা!’
ও হেসে ফেলে!বলে,‘তুই যদি চিনতে না পারিস?কোথায় হারিয়ে গেছিলি?কতদিন কতদিন পর বলতো?’
আবার আমরা নিজেদের খুঁজে পেলাম!
পরদিনই ও ওর দুই মেয়েকে নিয়ে হাজির!মেয়েরা আমার সাথে গল্পে মেতে উঠলো!সে সময় আমি ইন্টারন্যাশনাল একটা ব্লগে লিখি!বাংলা ব্লগ তখনও শুরু হয়নি!মেয়েরা বিস্ময় নিয়ে লুসিকে বলে,‘আন্টি নেটে লেখে আর তুমি ভালো করে মোবাইলই ব্যবহার করতে পারো না!নেট তো দূরের কথা!’
ও শুনে হেসে কুটিকুটি হয়!বলে,‘কার সাথে কার তুলনা!কোথায় আগরতলা আর কোথায় চকির তলা?তোদের আন্টি হলো ক্লাশের ফার্সট,ব্রিলিয়ান্ট আার সট্যান্ড করা স্টুডেন্ট আর আমরা ছিলাম লাস্ট বেঞ্চের,,গাধা ছাত্রী!’
আমি তুমুল প্রতিবাদ করি!‘তুই গাধা হলে ডাক্তার হলি কী করে?খালি বেশি বেশি!’ও বলে,‘গাধা ডাক্তারের সংখ্যাও কম নয়!’ আমরা হাসতে হাসতে ঘর ফাটিয়ে ফেলি!
এই হলো আমার বন্ধু লুসি!
মেয়েদের স্কুলে সাধারনত কয়েকটি দল থাকে!
১।১নম্বর দলে থাকে সব ভালো ছাত্রীরা!এরা মুখ গম্ভীর করে শুধু ভালো ছাত্রীদের সাথে মেলামেশা করে!অন্য ছাত্রীদের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকায়,ওদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে,যেন গায়ে গা লেগে গেলেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে!স্কেুলের টিচার আর ভালো ছাত্রী ছাড়া এরা কারো সাথে বিশেষ কথাবার্তা বলে না!
২।এই দল হলো দুষ্টু দল!এরা পড়াশোনায় মাঝারি মানের হলেও দুষ্টুমিতে সেরা!এমন কোন দুষ্টুমি নেই যা ওরা করতে না পারে!টিচারদের সাথেও এরা নানানধরনের দুষ্টুমি করে,বকা খায়,শাস্ত পায়!আসলে এরাও ভালো ছাত্রী,তবে নানান কিসিমের দুষ্টুমির পদ্ধতি উদ্ভাবন ও তার কার্যকরণে ওদের সময় অতিবাহিত হয় বলে,পড়াশোনার সময় পায় কম!রেজাল্ট খারাপে এদের কিছু আসে যায় না!তবে নতুন নতুন দুষ্টুমি,শয়তানি না করতে পারলে ওদের মনমেজাজ খারাপ হয়ে যায়!
৩।এই দল হলো সুন্দরী নায়িকা দল!এরা সাজুগুজু করে স্কুলে আসে!ব্যাগে বইপত্রের সাথে লিপস্টিক,ফেস পাউডার,পারফিউম,চিরুণি,নেল পলিশ সব লুকিয়ে নিয়ে আসে!সময় পেলেই রূপচর্চা শুরু হয়ে যায়!এরা পেছনের বেঞ্চে বসে সারাক্ষণ গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে!ক্লাশের ফাঁকে এবং টিফিন পিরিয়ডেেএরা দোতলার বারান্দা,ছাদ বা দেয়ালের পাশে গিয়ে স্কুলের বাইরে উঁকিঝুঁকি মারে,ইশারা ইঙ্গিতে বাইরে দাঁড়ানো ছেলেদের সাথে প্রেম করে,চিঠি ছোঁড়াছুঁড়ি করে!সময় পেলেই সিনেমার গল্প,নায়ক নায়িকাদের নিয়ে গসিপ করে!এই গ্রুপের মেয়েদের টিচাররা ও ভালো ছাত্রীরা দুই চোখে দেখতে পারে না!
৪।এই গ্রুপের মেয়েরা একটু বয়স্ক!ভারিক্কি চালচলন,মাতব্বরী ধরণ!এরা ভালো ছাত্রীদের অভিভাবকের মত ছায়া দিয়ে রাখে!কোন দুষ্টু,খারাপ ছাত্রী,বিশেষ করে নায়িকা গ্রুপ থেকে ভালো ছাত্রীদের রক্ষার দায়িত্ব এরা নিয়ে নেয়!টিচারদের সাথেও এদের ভালো খাতির!
তো লুসি সুন্দরী হয়েও নায়িকার দল থেকে সবসময় নিজকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতো!আমি,শেলী(প্রফেসর ড.সেলিনা আক্তার জাহান,চ্যানেল আই-এর মেধাবিকাশ এর উপস্থাপিকা),জিনাত এই ৩জন ক্লাশে ১ম,২য়,৩য় হতাম!কিন্তু দুষ্টু দলের সাথে আমাদের অকৃত্রিম মেলমেশা ছিলো!বলতে গেলে,শেলী ছিলো অলরাউন্ডার!সে দুষ্টামী,সাজগোজ,প্রেমট্রেম ,মাতব্বরী সবকিছুতেই লিড করতো!আর আমি কী এক অজ্ঞাত কারণে সবার কাছেই গ্রহণীয় ছিলাম,সব দলের সাথেই মেলামেশায় সহজ ছিলাম!দুষ্টু দলের সেরা ছিলো শেফালী(জিন্নাত আরা,এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী)!এমন এমন জোক বলতো,হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করতো আমাদের!টিচারদেরও হাসাতো!কোন শাস্তিই তাকে দুষ্টুমি থেকে দূরে রাখতে পারেনি!
লুসির বাবা ছিলো ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন!ও একটা জীপে করে আসতো স্কুলে!দেখতে যে কী সুন্দর ছিলো!সবাই ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেও,ও কারো দিকে তাকাতো না!মাথা নিচু করে হাঁটতো,কারো সাথে তেমন মেলামেশা ছিলো না!ক্লাশে পেছনের বেঞ্চে চুপ করে বসে থাকতো!আর আমি,ফার্সট বেঞ্চ থেকে গিয়ে ওর পাশে বসতাম প্রায় সময়ই!ক্লাশ নাইনে উঠে ও চলে গেলো হোম ইকনমিক্স গ্রুপে ,আমি
সায়েন্সে।এই দুই গ্রুপের ক্লাশ হতো একসাথে,আমি আর লুসি তখনও এক ডেস্কে বসি!ওদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশে খুব ভালো ভালো খাবার দাবার রান্না হতো!টিচাররা খেয়ে পরীক্ষা করতো!লুসি ওখান থেকে সবসময় আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতো!সেই ধারাবাহিকতা আজও সে বহাল রেখেছে!
ও যখনই আমার কাছে আসবে,নিজের হাতে রেঁধে কখনও ফ্রায়েড রাইস,চিকেন,কাবাব,পিঠা,বিভিন্ন ধরনের ডিশ করে নিয়ে আসবে!আমাকে নিজের হাতে সামনে বসিয়ে খাইয়ে দেবে!বেশ কিছুদিন আগে এলো,নিজে পুলি পিঠা আর ডালপুরি বানিয়ে নিয়ে!আমি বললাম,‘খেতে পারবো না রে লুসি!আমার সুগার হাই!’
শুনে ফর্সা মুখটা কালো হয়ে গেলো!জোর করে একটু মুখে তুলে খাওয়ালো!
কয়েকদিন আগে নর্থ সাউথ ভার্সিটিতে এসেছিলো ওর এম.পি.এইচ এর সার্টিফিকেট তুলতে!এই বয়সেও ও সৌদী থেকে ফিরে এসে,আলটাসনোগ্রামে ডিগ্রি করেছে এম.পি.এইচ করেছে!একটা ক্লিনিকসে বসে!কী এনার্জি!আমি অবাক হয়ে যাই!
ভারিসটি থেকে এলো আমার কাছে!হাত খালি!এই প্রথম কিছু না নিয়ে এলো!মুখ কালো করে বললো,‘জানিস,ক্যান্টিনে গরম গরম ফুচকা,চটপটি বানাচ্ছে!তোর জন্য আনতে চাইলাম,তুই তো খেতে পারবি না,তাই আমিও খাইনি,তোর জন্যও আনিনি!’
আমি বললাম,‘আরে আমার সুগার তো এখন নরমালের চেয়ে কম!খেতে পারতাম তো?’
শুনে আফসোস করতে লাগলো,‘আমাকে একটু জানাবি না?তোর সুগার কমে গেছে,কেন বললি না?
মন খারাপ করে চলে গেলো!কখনও বেশিক্ষন বসতে পারে না!দৌড়ের ওপর থাকে ও!
আবার গত পরশু এলো হন্তদন্ত হয়ে!হাতে ব্যাগের মাঝে চটপটির বক্স,অনেকগুলো ফুচকা,তেঁতুলের টক!এনেই হাঁকডাক,প্লেট নিয়ে এসো বুয়া,গরম গরম খেতে হবে!’
নিজেই ফুচকাতে চটপটি টক মিশিয়ে আমাকে মুখে তুলে খাওয়াতে লাগলো!
আমি বললাম,‘আরে থাম থাম,আর কতো খাবো,মেরে ফেলবি নাকি?তুই খা!’
ও খেলো,সঙ্গে আমাকে আরও খেতে হলো!আমাকে খাইয়ে দাইয়ে,তৃপ্তি আর হাসিমুখ নিয়ে যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিলো,তেমনি চলে গেলো!বললো,‘সেদিন থেকে আমার মন খারাপ!তোকে কিছু না খাইয়ে চলে গেছিলাম!আজ শান্তি পাচ্ছি!’
আমি হাসি,‘পাগল একটা!’ভাবি,কী সহজ সরল আমার এই বন্ধুটি!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক রীতিমত অবাক হচ্ছি...ছাত্রীদের নিয়ে একটা দারুন রিসার্চ...বয়সটা কম হলে কাজে লাগত..আর সবচাইতে বড় যে বিষয়টা এই যে, এই বয়সে বন্ধুদের নিয়ে এমন সরল একটা আনন্দের অংশীদার হতে পেরেছেন..অনেক ভালো লাগলো আত্মকাহিনী....
ঝরা পড়তে বেশ লাগল বৈকি!
ধন্যবাদ ঝরা ।ভালো থাকবেন ।
এশরার লতিফ আবারও এই পরাণ ভক্তর জুড়াইয়া দেলেন ডক্টর সুরাইয়া হেলেন :) । অভিনন্দন ।
অনেক ধন্যবাদ এশরার ।ভালো থাকুন নিরন্তর ।
জিয়াউল হক সরলতা সংখ্যার প্রকৃত সরলতার গল্প । আটপৌরে কাহিনীর নিখুঁত আর অসাধারণ গল্পগাথা ।
অনেক ধন্যবাদ জিয়া ।ভালো থাকুন সতত ।
প্রিয়ম ডাক্তার আপু আপনার লেখা আমার এমনিতেই ভালো লাগে আর সুন্দর বলে ছোট করবনা |
ধন্যবাদ প্রিয়ম ।কেমন আছেন?
আহমেদ সাবের আপনার বন্ধু ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হলাম। আপনার সহজ সরল মনের বান্ধবী লুসি (ডা.সুফিয়া সুলতানা) কে শ্রদ্ধা জানাই আর সেই সাথে আপনাদের বন্ধুত্বের গল্পটা আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ সাবের ভাইয়া ।আপনার শ্রদ্ধা তাকে জানিয়ে দেবো ।ভালো থাকবেন ।
হিমেল চৌধুরী চমৎকার গল্প। অনেক ভালো লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ হিমেল ।
অমিত বাগচী কিছু মনে করবেন না, আপনার চেয়ে আপনার বন্ধুটিকেই আমার বেশি লাগলো!!
ধন্যবাদ অমিত ।এটা তো আমার বন্ধুরই গল্প!
অষ্টবসু bhabchi cheleder kata dal hobe?apnar kon dal chilo ballen nato galpe?1 kimba 4 hobe mane hoche...
আমার দল লেখাতেই বলা আছে!ছেলেদের দল,ছেলেরাই ভালো বলতে পারবে!
abaro pare bujlam sab dalei tai to?

২৩ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪