মৃত্যুর কয়েক দিন আগে

দুঃখ (অক্টোবর ২০১৫)

ফয়সল সৈয়দ
  • ১১
  • ২৬
বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন আতাউর রহমান। বিধ্বস্ত শরীর, নিস্তেজ ও অসাড়। প্রাণটুকু ছাড়া শরীরে আর কিছু অবশিষ্ট নেই তার। চোখ দুটো খটখটে, শূন্য। সমস্ত শরীর যেন হাড্ডির উপত্যকা। আসিফ সোবহান, আতাউর রহমানের বড় ছেলে, বাবার শিয়রে এসে বসে। বাবা চোখ খুলতে চেষ্টা করে। চকর-বকর করতে থাকা চোখে তিনি কাকে যেন খুঁজছে। ছেলের দিকে অগ্নিচোখে তাকায় এবার। বাবার এমন দৃষ্টি ছেলের কাছে বেখাপ্পা ঠেকে। বাবা কিছু বলবে? নিরুত্তর বাবা অন্ধের মতো হাতড়ায়। একসময় ছেলের হাত শক্ত করে ধরে, দাঁতে দাঁত কামড়ে।
-বাবা কেমন লাগছে তোমার? ছেলে আসিফ আগ্রহের সুরে জানতে চায়।
-ভালো লাগছে নারে। কথা বলতে গিয়ে বাবার মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে যায়। মনে হচ্ছে কে যেন ভেতরে ভেতরে শরীরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। তার চোখ-মুখ ভেঙে আসে।
-ডাক্তার ডাকব। ছেলের মুখে আগ্রহের ছাপ।
-ডাক্তার ডেকে কী আর হবে? আমার সময় শেষ। খাপ ছেড়ে কথা বলতে থাকে বাবা। শরীরে একদম বল নেই, জোর নেই। শুয়ে শুয়ে শরীরটা চিনচিন করছে। আমাকে একটু তুলে বসাতে পারবি?
বাবার পিঠ আগলে ধরে নিচে বালিশ বসিয়ে দেয় আসিফ। শরীরটা ভেঙে তার চোখে-মুখে কিঞ্চিৎ স্বস্তির আভাস পায় সে।
-আসিফ দেখ তো কুরআন শরীফে, জীবন্ত মানুষকে কবর দেওয়া যায় কিনা? আবার কথা বলতে শুরু করে আতাউর রহমান।
-কী যা তা বলছ বাবা? বাবার কথা শুনে ছেলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এ-সব কথা মুখেও আনিও না, আল্লাহ নারাজ হবেন।
-কী করব আমি? ছোট ছেলের মতো প্রশ্ন করে বাবা। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। তোরা আমাকে নিয়ে কষ্ট করছিস, আর আমিও কষ্ট পাচ্ছি।
-তোমাকে কে বলল আমাদের কষ্ট হচ্ছে? ছেলের মুখে রক্ত জমল এবার।

বাবা নিরুত্তর। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে চায় না। আর কত? বয়স এখন বিরানব্বই। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু যেখানে পঞ্চাশ-একান্নে ; সেখানে তার বয়স তাকে এ-শহরের প্রাচীনতম বটবৃক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। ছায়া দিতে না-পারলেও সে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ভুষণ্ডীর কাক। তার সময়ে রচিত হয় পাকিস্তান, আর পাকিস্তান ভেঙে প্রিয় বাংলাদেশ। নাতির (আসিফ সোবহানের একমাত্র ছেলে আদনান) পাঠ্য বই খুলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় অধ্যায়টি পড়তে পড়তে মুচকি হাসেন। তার সময়ে চা দোকানে বসে যে-সব কথা হত সে-সব আজ পাঠ্যবইয়ের পাতায় কালো কালির অক্ষরে লেখা। এইতো ভুট্টোর নাম, শেখ সাহেবের নাম। ছাত্রনেতা তোফায়েল শেখ সাহেবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছেন, তাও লেখা আছে বইয়ে। লেখা আছে কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে আসসালামু-আলাইকুম বলেছেন সে কথাও। সময় গড়িয়ে যায়, কিন্তু কিছু কথা খাদে পড়ে উতরে যায়।

ফজরের নামাজ পড়ে ছেলে আসিফের বউ মমতা শ্বশুরকে একবার দেখে এসে কাজের মেয়ে সাহেনাকে ডাকতে থাকে।

-সাহেনা উঠ্, উঠ্, উঠ্। সাহেনা নিশ্চুপ। চিৎকার করে উঠে মমতা। সাহেনা উঠ্, উঠ্, কিরে মরে গেলি নাকি? সাহেনা নড়ে না। একটি কঞ্চি দিয়ে ঘুমন্ত সাহেনাকে এক ঘা বসিয়ে দিতেই লাফিয়ে উঠে সে। উঠ্, তোরা ভালা কথার মানুষ না। গজগজ করতে থাকে সে। নাস্তা বানিয়ে আদনানকে ডাকার নির্দেশ দেয় সাহেনাকে।

-আদনান ভাইয়া, অ আদনান ভাইয়া, নাস্তা খাইতে উঠেন, খালাম্মা ডাকতেছে। আদনান বালিশের নিচে মাথা ঢুকিয়ে তাকে চলে যেতে বলে। নাছোড়বান্দা সাহেনা ফের ডাকতে থাকে।
-আদনান ভাইয়া, আদনান ভাইয়া, খালাম্মা বকবো, নাস্তা খাইতে উঠেন। ক্ষিপ্ত শরীরে লাফিয়ে উঠে আদনান সাহেনার মুখে এক চড় বসিয়ে দেয়। চড় খেয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় মমতার কাছে নালিশ জানায় সাহেনা। মমতা ক্ষেপে উঠে -তোকে ডাকতে বললাম, জান দিতে তো বলিনি। সাহেনা দাঁত কামড়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।

-আব্বু উঠ। নাস্তা খেতে উঠ। মমতা পরম আদরে ছেলে আদনানের মাথায় হাত বুলায়।
-প্লিজ আম্মু, আমাকে আরেকটু ঘুমাতে দাও।
-আব্বু নাস্তা খেয়ে ঘুমাও। নাহলে শরীর খারাপ করবে যে। আদনান মায়ের কথার তোয়াক্কা করে না। কিন্তু মা মমতা ছেলেকে দু-হাতে শক্ত করে ধরে কোলে তুলে নেয়। আদনান মায়ের কোলে হাত পা নাচাতে থাকে।
-না, আমি নাস্তা খাব না, আমি ঘুমাব। পাশে দাঁড়িয়ে থেকে খিলখিল করে হাসতে থাকে সাহেনা।
নাস্তা খেতে খেতে ছেলেকে উপদেশ দেয় বাবা আসিফ সোবহান।
-বাবা, একজন ছাত্রের এতক্ষণ ঘুমানো ঠিক না।
-আমি কি প্রতিদিন ঘুমায় নাকি? বাবার কথায় ছেলে পাল্টা প্রশ্ন করে। আজকে স্কুল বন্ধ তাই একটু ঘুমাচ্ছি। বিড়বিড় করে বাবার কথার উত্তর দিতে থাকে ছেলে।

আতাউর রহমানের শরীরে তেমন কোনো জটিল রোগের লক্ষণ পেলেন না ডাক্তার। তার এখন একটি রোগ-বার্ধক্য—যে-রোগে সে কাবু, নাস্তানুবাদ, শয্যাশায়ী। আজ কয়েক দফা চেষ্টা করেও আসিফ তাকে এক টুকরো রুটিও খাওয়াতে পারছে না-খাওয়ায় অরুচি, ক্ষিধে নেই। আরেকটু পরে খাব বলে না-খাওয়ার নানা ফন্দি আঁটেন তিনি।

স্বামীর হাত থেকে রুটি কেড়ে নিয়ে শ্বশুরের পাশে বসে মমতা। একেবারে ঘেষাঘেষি করে হাঁটু গেড়ে। হাতের ইশারায় ছেলের বউকেও বিরক্ত করতে নিষেধ করেন আতাউর। যেন বুঝাতে চাচ্ছেন তিনি নিজের ভালটা নিজে ভালই বুঝেন। মমতাও নেই আঁকড়া।
-খাবেন না বললে হল, না-খেয়ে-না-খেয়ে শরীরের কী অবস্থা হয়েছে, দেখেছেন? ছেলে-বউয়ের পীড়াপীড়িতে একসময় অনুরোধের ঢেঁকি গিলেন তিনি। পেটে দানা-পানি পড়তে-না-পড়তেই তার শরীরটা একটু চাঙ্গা হয়ে উঠে। দাদুর পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে আদনান। হাতের আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে নিজে নিজে খেলছে।
-কে, দাদু? ঘাড় ফিরিয়ে নাতিকে দেখার চেষ্টা করে তিনি।
-দাদু আমি, আমি আদনান।
-দাদু তোমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছি, তাই না? অপরাধীর ভঙ্গিতে নেতিয়ে পড়ে তার কথা। পরক্ষণে আশ্বস্ত করে নাতিকে।
-দোয়া কর, আর বেশিদিন তোমাদের কষ্ট করতে হবে না।
দাদুর কথার গভীরতা বুঝতে পারে না নাতি।
-দাদুু, আমি তোমার জন্য প্রতিদিন দোয়া করি। ফেনা চেটে বলে উঠে আদনান।

মমতার শরীরে প্রচন্ড জ্বর। ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো করছে সে। সাহেনা আছে বলে যা রক্ষে। অসুস্থ শ্বশুর, স্বামীর ব্যস্ততায় নিজের অসুস্থতা চেপে রাখতে চায় সে। মমতা হয়ত জানে না, রোগ মানুষের শরীরে চেপে থাকে না—পোষে থাকে। কয়েকটি প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনো প্রতিষেধক খাওয়া হয়নি তার। অফিস থেকে ফিরে স্ত্রীর এমন অবস্থা দেখে হোঁচট খায় আসিফ। তাড়াতাড়ি ফার্মেসি থেকে দু-বেলার ঔষুধ নিয়ে আসে।

রাত গভীর। দু-চোখে একফোঁটা ঘুম নেই মমতার। জ্বরটি মুকুল থেকে গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার শরীরে। থার্মোমিটারে জ্বরের মাত্রা দেখে সে। জ্বরটা নিরানব্বই ছাড়িয়ে একশো পার হয়েছে। জানালার ফাঁকে উঁকি মেরে মস্তবড় আকাশকে দেখে, আর প্রতীক্ষায় থাকে ভোরের, সকালের। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকায়। কাঁটাগুলোর জন্য প্রচুর মায়া হয় তার। কেনো যেন তার মনে হচ্ছে ঘড়ির কাঁটাগুলোরও প্রাণ আছে-তাদেরও আছে একটি নিজস্ব জগৎ ও জীবনযাপন প্রণালী। পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে অথচ ঘড়িটি ঠিক ঠিক ডিউটি করে যাচ্ছে যেন কোনো ক্লান্তি-অবসাদ নেই,নেই তাদের অভিধানে ঘুম শব্দটিও।

মমতার অবস্থা শোচনীয়। কয়েকবার বাথরুমে গিয়ে শরীরটা আরও দূর্বল হয়ে পড়েছে। পেটে ক্ষুধায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, অথচ এক গ্লাস পানি খেতেও অরুচি তার। খেলেই বমি হয়ে যায় সব। অবস্থা বেগতিক দেখে আসিফ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসায় ডাক্তার জানায়-ডোন্ট অরি, টাইফয়েড।

আতাউর রহমান চোখে অন্ধকার দেখে, একেবারে ঘুরঘুইট্টা অন্ধকার। এখন তার কাছে জীবনটা স্যাঁতসেঁতে যেন পালিয়ে বাঁচতে পারলে উদ্ধার।

মমতা আইসিইউতে। আসিফ আর আদনান হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসা। মমতার মা-বাবা এসেছেন তাকে দেখতে। আদনান বাবাকে জড়িয়ে আম্মু-আম্মু বলে কাঁদছে।

কান্নায় ছেলের পিঠ ফুলে ফুলে উঠতে থাকে।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু ভাল লাগা জানালাম।
ধন্যবাদ।
রেজওয়ানা আলী তনিমা বেশ লাগলো। অজস্র শুভেচ্ছা ও ভোট রেখে গেলাম।
ধন্যবাদ।
এফ, আই , জুয়েল #অনেক সুন্দর গল্প ।।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,ভোট রেখে গেলাম।পাতায় আমন্ত্রন রইল।
ধন্যবাদ ভাই।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি খুব ভাল গল্প .........
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
শামীম খান বেশ সুন্দর প্লট । সাবলীল কাহিনী । ভাষার টুকিটাকি চোখে পড়ে । শুভ কামনা আর ভোট রইল ।
অনেক ধন্যবাদ শামীম ভাই আপনাকে।
ওসমান মাহমুদ ভাষা চমতকার স্বীকার করতে হবে। সংসারে খুনসুটি নিইয়ে গল্প।ভাল লাগলো। ভোট রেখে গেলাম।
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
মোজাম্মেল কবির বার্ধক্যের ভারে জর্জরিত পরিবারের একজন সদস্যের সেবা করতে সুস্থ মানুষ গুলো কিভাবে রোগী হয়ে যায় লেখক মনে হয় গল্পে তাই বুঝাতে চেয়েছেন। তবে লেখকের কাছে লেখাটি আরও কিছু প্রত্যাশা করছিলো... শুভ কামনা ও ভোট রেখে গেলাম।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ গল্পটা ভাল লাগছিল, আরও একটু বাড়ালে মন্দ হতো না । সময় পেলে আমার “জালালের দুঃখ“ গল্পটা পড়বেন । ভাল থাকবেন ।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
নাঈমা ফয়সল গল্পটা পড়তে পড়তে হঠাৎ থেমে গেলাম,হোঁচট খেলাম। লেখক চাইলে আরো লিখতে পারত।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

১৩ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪