সিরাম্যিক আড্ডা

বর্ষা (আগষ্ট ২০১১)

প্রজ্ঞা মৌসুমী
  • ৪০
  • 0
  • ৫০
-তোমারে আগে দেখছি বলে তো মনে হয়না বাপু। ডিজাইনটা কেমন নতুন ঠেকছে।
-জ্বী, একটু আগে শো-কেইস থেকে এলাম। ঐযে বেসিনের পাশে কাপগুলা, তারা আমার টিসেট-পরিবার।
-ওহ‌‌! তুমি মানে আপনি অতিথি কাপ। আমরা বলি 'তোলা কাপ'। শীত-বর্ষা আর বড় আয়োজন ছাড়া, বছরের বেশি দিন আলমারীতে তোলা থাকেন- তাই ঐ নাম। আবার শো-কেইস কাপও বলি। কি সৌভাগ্য আমার! কাছ থেকে কোনদিন দেখিনিতো; চিনতে পারিনি।
-এই আমাকে তুমি করে বলতে পার।
-তা হয় নাকি! আপনারা কত সম্মানী কাপ! কি সুন্দর চীনামাটি চেহারা! বাহারী ডিজাইন আর লেবেল দেখলেই চোখ জুড়ায়; মেইড ইন এদেশ... ওদেশ। এখানে বিদেশী কাপের কদর বেশি। শুধু কাপ না, সবকিছুতেই ওরকম। আহ্‌ একবার যদি বিদেশ যাইতে পারতাম, ভেঙেও টুকরাগুলা শান্তি পেত। আমরা ঘরোয়া তাও গরীব দেশী কাপ। নাম বলতেও লজ্জা লাগে। আমাদের তুমি কেন তুই করে বলবেন! আমরা বলি কিভাবে! এই অধমেরা আপনাদের পিরিচ-সেবা করবে। 'মানী কাপের মান দিতে হয়' মহাজ্ঞানী আইনস্টাইনের কাপ বলে গেছেন! কত বড় বড় স্পেশাল পার্টি আর আড্ডায় যান। সম্মান আর শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য আপনারাই। আর কি সুন্দর বিদেশী ভাষায় কথা বলেন! বাংলা ভাষা আবার ভাষা নাকি! টিনা আপার কফি-মগ এখন ইংরেজী কোর্স চালু করেছে। আমিও ভর্তি হবো। কেন যে আগে ভর্তি হলামনা! বাংলাতে কথা বলতে নিশ্চই অনেক কষ্ট হচ্ছে!

-কষ্ট হবে কেন? বাংলা অনেক চিনি ভাষা। ভাল লাগে বলেই তো প্লেটের কাছে বাংলা শিখেছি। আর সম্মানের কথা বলছ? তোমাদের যোগ্যতাই বা কম কি শুনি! নিজের কদর বুঝোনা বলেই কি কম মূল্যবান? ফ্যাক্টরীতে শুনতাম 'আজকের বাজারে কারো চাহিদা কম হলে, ভেবোনা সে খাটো। তার এমন কিছু আছে, যা তোমার নেই। তার মূল্য জেনে, পারলে সম্মান করো কিন্তু তাকে ছোট ভেবে অহংকার করোনা।' যদিও আমার দলের অনেকেই ইচ্ছে করে তা ভুলে থাকে। মাঝে মাঝে ভাবি দোষ তোমাদেরই। তোমরাই অতিরিক্ত সম্মান আর দাম দিয়ে আমাদের লোভী করে তুলো। অন্যকে সম্মান করতে চাও-এ তোমার মহানুভবতা। কিন্তু আত্নসম্মান খুইয়ে নয়। আর বাপু দেশ আর বিদেশ কি? না ভাঙলে মাটির উপর আর ভাঙলে মাটিতে মিশি-এইতো। একই পৃথিবীর সবাই। তাকে ভাগাভাগি করে আমরা নাম দেই দেশ।
-দশ কথার এক কথা! কিন্তু আপনার মত কি আর ভাবি? দেশ নিয়ে চলে ভয়াবহ সব ঝগড়া-ঝাটি। সেসব আমাদের বলে সকালের খবুরে কাপ আর ফ্লাস্ক চাচা। আমি আদার ব্যাপারীর কাপ, অতকিছু জানিনা। তবে এটা জানি, এদেশের মাটি ভাগ হয়ে হয় জেলা। এই বাড়িতে কুমিল্লা-সিলেটি, বরিশাল-নোয়াখালীর নিয়মিত মাসিক ঝগড়া দেখার মত। ঐ সময় আমরাও আলাদা হয়ে যাই। মৌসুমী ভাবী আমাকে এনেছে তাই আমি কুমিল্লার কাপ। তখন আমার সাথেও চলে দহরম মহরম। আর বিশ্বকাপ সিজনে তো কথাই নেই! ঝগড়া হয় মারাত্নক। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, ভারত-পাকিস্তান নিয়া সে যে কি কাণ্ড হয় শোকেইসে থেকে বুঝবেননা! মাঝে মাঝে হাতাহাতিও হয়ে যায়! যে টিম জিতে, তার সাপোর্টার টিসেটের কি দাপট; দেমাগ একেবারে কাপের মাথা ছাড়িয়ে যায়!

-হ্যাঁ, শোকেইস থেকে সেসব কত্ত দেখেছি আর অস্থির হয়েছি! হাতল কাত করে শোনার চেষ্টাও করেছি কিন্তু শব্দগুলো কাঁচ পেরিয়ে ততটা স্পষ্ট হয়ে আসেনি। মাঝে মাঝে খুব হিংসে হয়। কত হৈচৈ করে কাটাও। তোমরা অনেক সুখী।
-কি যে বলেন! গরীব কাপের আবার সুখ। আপনাদের হিংসে করেনা এমন কাপ এখানে কমই আছে। সেই ভোর থেকে খাটুনির পর, রাতের বেলা আপনাদের কথা ভেবে সবাই একবার করে নিজেদের সির‍্যামিক শরীরটাকে গাল পাড়ি। আগে আরো রাগ হতো। কলতলায় প্রতিটা দিন ছোবড়া আর ছালির ঘষায় রাতে শরীর অমন ম্যাজম্যাজ করত। কিন্তু কি করা- দেহটা তো সুস্থ রাখতে হবে। কাজ করতে না পারলে এই সংসারে কদর কি? ঐযে কোণার ঘরে থাকে দাদাজান। কেউ সারাদিন ভাল করে খুঁজও নেয়না। আমাদের অবস্থা উনার চেয়ে আরো বেগতিক হবে। আমি ভেঙে গেলে আমার জয়েন্ট-ছাড়া কোমর- পিরিচ, হবে বৌন-প্লেট। চিন্তা করেন চায়ের পিরিচে রাখা হবে হাড্ডি আর কাটাকুটা! বংশের মান-সম্মান ধুলায় মিশে যায়‌‌। এর চেয়ে 'আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়' ফেনার উপর লিখে আত্নভাঙাও ভাল! তখন কোমর শুদ্ধই আমাকে ছুঁড়ে ফেলবে ডাস্টবিনে। কেউ ভুলেও মনে করবেনা।

অথচ দেখুন আপনাদের এতটুকু অবহেলা হলে গুরুতর শাস্তি। এইতো গেল বর্ষায় শ্যামা- এবাড়ির কাজের বুয়াগো- ভেঙে ফেললে একটা তোলা কাপ। সে যে সে কাপ না! মেইড ইন ইউ.এস.এ! সাথীভাবীর সেকি চিৎকার। অমন দামী টিসেট উনার ভাই পাঠিয়েছেন। ভাবী রাগের চোটে এমন ধাক্কা দিল শ্যামাকে, টেবিলের কোণে লেগে ডান চোখটাই যাচ্ছিল আরকি। মেজভাই এসেও দিল বেদম মার। মেয়েটা চারদিন জ্বর নিয়ে পড়েছিল সেবার। ওর পিরিচ-ছাড়া হাতলভাঙা কাপটা কি কান্নাই না করল। ও কাপ নিচুতলার; আমাদের সাথে র‍্যাকে ঝুলবার সাহসই পায়না। খাঁ বাড়ি থেকে আসা খানদানী কাপ বলে, ওর সাথে মিশলে প্রেস্টিজ থাকেনা। বলি থাকবে কি করে? বাপ-মার পরিচয় নাই। তাকে একঘরে করে রাখাই উচিত। অমন বেজাতের কাপে, চায়ের যেতেও লজ্জা হয়।

-নাহ্‌ ভাই! অমন করে বলোনা। বংশ মর্যাদা, বাবা-মার পরিচয়টাই কি আসল? ওর নিজস্ব ভালোলাগা, জ্ঞানবুদ্ধির কি কোন মূল্য নেই? আর সে কাপ। এটাই তার বড় পরিচয়। চাপ্রেম তার কি কম! দেখা গেলো চাকে সেই আমাদের থেকে বেশি ভালবাসে!
-আপনি একেবারে সক্রেটিস কাপ। অবশ্য ল্যাংড়া কাপের এ নিয়ে কোন কষ্ট নাই। কি সুখেই না মিটশেলফের উপরে থাকে। রাতে মাকড়সা চাচীর কাছে সেলাই শেখে। বিকেলে শ্যামা তাকে বারান্দায় ঘুরতে নিয়ে যায়। দুটি মিলে আকাশ দেখে আর সিনেমার গান গায়। শ্যামার কি মায়া আর যত্ন কাপের জন্য। ল্যাংড়া কাপও হয়েছে অমন। আর কারো কাছে নেয়াই যায়না। এমনকি বস্তি থেকে শ্যামার বড় ভাই এলেওনা। দুজনের ভালবাসা দেখলে কাপ থেকে দুফোঁটা জল পিরিচে গিয়ে পড়ে। কত বড় সির‍্যামিক কপাল থাকলে, এমন ভালবাসা জোটে! আর সেই কাপ মেয়েটার অমন শরীরে মুখে একটু চাও দিতে পারলনা। তার কষ্ট আর কি বলব।

অন্য কাপেরা এই সুযোগে কত্ত মিছিল-মিটিঙ করেছিল। আমরা ছিলাম ভাবীর পক্ষে। বড় ভাই বিয়েতে যে টি-সেট পেল, সেই বিয়ে-কাপ বলেই বসে 'দামী কাপ বলে কথা! ক'টাকার বান্দি,শোকেইস কাপের মূল্য বুঝবি কি? তাও এমেরিকান কাপ!' যদিও তোলা কাপদের দেমাগে টেবিলে পিরিচই পড়েনা। সিঙ্কে কোনদিন আমাদের সাথে নামেনা। ছোবড়া-ছালি থাকতে তো নয়-ই। স্পঞ্জ আসার পরেওনা। আমাদের হাতল ঘাড়, বর্বরা হাতগুলা এমনভাবে ধরে যে ব্যথায় টনটন করে। ভয় হয় কবে না যেন ঘাড়ই মটকে দেয়। এখন অবশ্য স্পঞ্জ ছোকড়াটা ভাল মালিশ করে; খুব আরাম হয়। কি যেন বলে... ডির্টাজেন্ট দিয়ে, ভারী তার মিষ্টি গন্ধ। একটু মাখলেই শরীর ডুবে যায় সাদা ফেনায়। আহা্‌ মনে হয় মেঘে ভাসছি; ঐ যে বৃষ্টি না হলে জানলা থেকে দেখা যায় সাদা মেঘ। এতো আরাম তারপরো আপনাদের আলাদা ধোঁয়া হয়। ইগো কাপ তো বলেই 'ভারী তো কাপ-সেট, তা নিয়ে কি আদিখ্যেতা! ইচ্ছে করে মা কেটলিগুলার খোপা ভেঙে দেই।' তারপরো কাপ তো কাপই; মায়া লাগে। শ্যামার মুখে আমরা গরম চা ঢালতে চেয়েছিলাম।
-এটা ঠিক শোকেইস কাপ বলে আমারও খারাপ লাগছিল। তারপরো শ্যামাকে অমন মারা ঠিক হয়নি। এক্সিডেন্ট তো আর বলে কয়ে আসেনা। কাঁচ দিয়ে তো দেখি মেয়েটাকে। সারাদিন কাজ করে। এতটুকু অবসর নাই আর মেহমান এলে তো কাজ আরো বেড়ে যায়। বিশ্রাম কি বাড়ে? দুপুরে একটু চোখ লেগে এলে দুমাদুম কিলিয়ে তোলা হয়। কিছু করিনা তাও আমারই এত ঘুম পায়। ওই এতটুকুন মেয়েটার পাবেনা বুঝি! ওরকম দূর্বল শরীরে ধরার জোর কি আর থাকে...

-একটা হক কথা বললেন। আমাদের প্রতিও এ বাড়ির লোকদের নিশ্চিত অবহেলা ওর মতই। কারো মেজাজ খারাপ; চোখের সামনে আমরা কেউ। এক আছাড়ে ফেলে দিয়ে... উঠতি ছেলে-মেয়েগুলাও হয়েছে ওরকম। বাপ-মার উপর রাগ করে প্লেট, কাপ-গ্লাস সব ভেঙে ফেলে একাকার করে। আর শিখেছে তো বড়দের কাছ থেকেই; চায়ে চিনি কম-বেশি হলে রাগ করে আমাদের ফেলে দেয়। এতে নাকি উনাদের মেজাজ ঠাণ্ডা হয়। অন্যকে মেরে নিজেকে শান্ত করা-এ কেমন বিধান! দেখে আমার পিরিচ জ্বলে। রান্নাঘরে তো কোনদিন যেতে দেখিনা। এতই যখন খুত খুঁজ, নিজেই বানিয়ে খাওনা কেন? সেটি হবেনা। যত রাগ আমাদের উপরে। হারামী...কিছু মনে করবেননা। স্বজন হারাবার ব্যথা যে কি। আমরা উনাদের বলি 'শহিদ কাপ।' যেদিন আমরা একটা কাপ হারাই, সারারাত কান্না চলে র‍্যাক জুড়ে। বিশেষ করে টি-সেটের কান্না আর কি বলবো। আমার একটা জোড়া তো এভাবেই গেল...
ওকি কাঁদছ কাপ! তোমার দুঃখের কথা মনে করিয়ে দিলাম। আমি খুব দুঃখিত।
-না ভাই...তৈরি যখন হয়েছি, একদিন ভাঙব এটাই নিয়ম। তাই বলে ইচ্ছে করে আমাদের ধবংস করবে! সত্যি কথা তো আর বদনাম না। মায়া দরদ উঠেই যাচ্ছে সংসার থেকে। বাড়ির বৌরা শ্বশুর-শাশুড়ি একদম দেখতে পারেনা। সেঝবৌ তো আলাদা থাকার কথা দিনে-রাতে চব্বিশবার বলে। নিজের মেয়েকে দাদা-দাদীর কাছেও আসতে দেয়না। বলি, শিখবে কি করে মূল্যবোধ, নীতিকথা, ভালবাসা একে অপরের থেকে? আবার কোন ঘরে শাশুড়ি দেখতে পারেনা বৌ। চা খেতে খেতে চলে একে অন্যের দুর্নাম। কি যে যুগ পড়লো। কাপগুলাও শিখে ফেলেছে। সুযোগ পেলেই গুনুর-গুনুর চলে। এক পার্টির কাপ, আরেক পার্টির কাপদের দেখতেই পারেনা। এই যে আমি কথা বলছি আপনার সাথে, এই নিয়ে রাজনীতি শুরু হলো বলে।

-রাজনীতি শোকেইসেও চলে। বললে না এমেরিকান কাপ; শোকেইসেও ওদের কথাই আইন। শ্যামা যে কাপ ফেলে দিল, দোষ পড়ল আমাদের উপর। বড়মা আমাদের ইরাক থেকে এনেছে, তাই রাগ আমাদের উপরই বেশি। বলে নিমকি শয়তান- ঐ মুসলিম কাপগুলাই তাল দিয়েছে। ইংরেজীতে পটাস পটাস হুমকি দিত, শলা-পরামর্শ চলত। আর আমরা আরবীতে কথা বললেই মনে করত ষড়যন্ত্র করছি। রাজনীতি জিনিসটা খুব খারাপ। অবশ্য আরেকটা আমেরিকান টিসেট আছে। তারা খুব ভাল। আসলে ভাল-মন্দ মিলিয়েই তো কাপেরা।

-রাজনীতি আসলেই খারাপ। কিন্তু নেতা কাপ বলতেন, 'দেশের জন্য কিছু করতে হলে সংঘবদ্ধ হতে হয়। রাজনীতিই পারে আমাদের সংঘবদ্ধ করতে।' মরণ! সংঘবদ্ধ করতে পারছে কই? যদিও বা পারে সেটা কাজে লাগায় স্বার্থসিদ্ধির জন্য। নেতা কাপও শুনেয়েছিল, 'পক্ষ থাকলেই পক্ষপাতিত্ব বাড়ে। এতে স্বার্থ বড় হয়। রাজনীতিবিদ টাইটেলের চেয়ে রাজনীতির আদর্শ বড়। এ যুগে টাইটেল আছে কিন্তু আদর্শ নেই।' ঠিকি, কারে ঠেলে কে উপরে উঠবে এই প্রতিযোগিতা। নেতা কাপ শহিদ হন দেশ ভাগের সময়। তাঁর শেষ কথা ছিল 'শোষক দেখে অভ্যস্ত বাঙালীর শাসন ব্যবস্থা সেরকমই হয়েছে। তবে আশার কথা বাঙালীর চেতনাবোধও প্রবল। রাজনীতির বৃক্ষে যে পরগাছা গজেছে সেটা উপড়ে ফেলত হবে! এড়ালে আগাছা আরো বাড়বে। সচেতন আর আদর্শবান রাজনীতিবিদ প্রয়োজন।' কবে যে সেদিন আসবে। আগাছা কি আমি জানিনা। বজ্জাত তেলাপোকার মত কিছু একটা নিশ্চই... সে যাক, আপনি তো দেখছি মুসলমান কাপ! আসলালামু আলাইকুম।

-নেতাজী কাপের কথা শুনে যেন আশা পেলাম। তোমারও শান্তি হউক ভাই। তবে আমাদের আবার ধর্ম কি? মানুষের সেবা করাই আমাদের কাজ।
-কিন্তু কাঁসার থালার কাছে শুনেছি অনেক আগে এপাড় থেকে হিন্দুকাপদের তাড়িয়ে দেয়া হত। নিজের আলমারী ছেড়ে কত কাপযে ঝোলাতে করে ওপাড়ে চলে গেল। আর ওপাড় থেকে আসত মুসলমান কাপেরা। কেউ কাউকে দেখতেই পারতনা। কত পিরিচ কাটা, হাতল ভাঙা হলো...কত কাপযে শহিদ হলো। আমাদের সাথে তাদের পার্থক্য তেমন কিছুনা। হুজুর কাপ বলছে আমরা ডাকি আল্লাহ্‌; তারা বলে ভগবান। আর ওদের আছে চাপাতা আর জলদেবী। সকাল-সন্ধ্যায় পুজো দেয় কাপগুলা। এবাড়িতে এখন সব ধর্মের কাপই আছে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় খুব ভাব কিন্তু ভেতরে ভেতরে চলে রেশারেশি। এক ধর্মের ভেতরেও কত ভাগ। অবশ্য সেসব তো তুমিও ভাল জানো। দেখো দেখি সেই কখন থেকে বকবক করেই চলছি। আমি একটু বেশি কথাই বলি। একে বাঙালী, তার উপর আড্ডা কাপ। শুনিও বেশি, বলিও বেশি। এই দেখো তুমি করেই বলে ফেললাম। বাঙালী বদস্বভাব আর গেলোনা।

-সহজে আপন করে নেয়া বদস্বভাব হবে কেন? তুমি করেই তো বলতে বলছি! আজ থেকে তুমি আমার কাপ বন্ধু। কতদিন মন খুলে কথা বলিনা। সেই কবে থেকে শোকেইসে আটকা পড়ে আছি। সারাদিন তোমরা কত ব্যস্ত থাক। খুব বেশি শীত না পড়লে বের হতে পারিনা। সারাবছর বর্ষার জন্য অপেক্ষা করি। বর্ষা আমার লাকি সিজন। চা খাওয়ার মেলায় প্রায় বের হয় শোকেইস কাপেরা। মাঝে মাঝে বন্ধু, শোকেইস জীবনটা অসহ্য লাগে। এটা ঠিক, বড় বড় পার্টিতে যাওয়ার সুযোগ পাই; এনিয়ে আমাদের গৌরবও কম নয়। তারপরো খ্যাতির বিড়ম্বনা, আমাদের সহজ জীবন থেকে কেমন দূরে ঠেলে দেয়। তোমরা ভাই বেশ আছ!

-হয়তো তাই। কষ্টও আছে আবার ভাললাগার মুহুর্তও আছে। এইযে খেলা নিয়ে এত কাণ্ড। কিন্তু যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলে, তখন সবাই আবার এক হয়ে যাই। ভুলে যাই আর সব দেশ। সবাই একপক্ষ হয়ে তাকিয়ে থাকে টিভির পর্দায়। আমরাও কেউ আর রান্নাঘরে থাকতে চাইনা। টিভির ঘরে কার আগে কে যাবে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা। সবার মধ্যে এত্ত টেনশন যে চায়ে চুমুক দিতেই ভুলে যায়। চা ঠান্ডা হয় কিন্তু এ নিয়ে আমাদের আফসোস নেই। সির‍্যামিক হৃদয়টা কাঁপতে থাকে উত্তেজনায়। এক একটা চার-ছক্কা কিংবা বিপক্ষ দলের আউট আর সবার কি চিৎকার...তখন আমরাও চিৎকার করে উঠি। আবেগে আর আনন্দে সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরে। সিঙ্কে বসে কাপেরাও কোলাকুলি করি। ভুলে যাই কে কোন জেলার। ভাগকরা বিচ্ছিন্ন মাটিগুলো হয় একটাই লাল-সবুজের দেশ। লাল-সবুজ রঙ ছিটানো হয় সারা ঘরজুড়ে। টুপ করে এসে পড়ে রঙের ফোঁটা। যেন আনন্দের রঙটাই লাল আর সবুজ। আহ্‌ বাংলাদেশ! তখন আমারো গর্ব হয়! শরীর উঁচিয়ে বলি আমি বাংলাদেশী! এই আনন্দের সাথে অন্য কোন জেতার আনন্দের তুলনাই হয়না। নিজের যা আছে তাই নিয়েই আমরা প্রকৃত সুখী। আবার যখন বাংলাদেশ টিম হেরে যায়, সেও এক অদ্ভুত দৃশ্য। ঘরের এমন কেউ নেই যার চোখে পানি আসেনা। নিজের দেশকে আমরা যে কি পরিমান ভালবাসি তখন বুঝি। আমার সিরাম্যিক ফুসফুস শ্রদ্ধায় স্তব্ধ হয়ে যায়। ডুবে যাই ঠাণ্ডা মায়ায়। কি অদ্ভুতভাবে সবাই হয়ে যাই একদেশের...

একসাথে থাকলে নিজেকে আর দূর্বল লাগেনা; ভয়ও হয়না। র‍্যাকটা আমাদের সবার। এখানে সরকার বা বিরোধীদলের কাপরা ইচ্ছেমতো অন্যায়-শাসন শুরু করলে আমরাও চুপ করে থাকিনা; একসাথে প্রতিবাদ করি!। ঐযে র‍্যাকে ঝুলছে টিউশনি কাপ, যেদিন এসে বলল বুইড়া টিচার খালি ঘর পেয়ে মুনার গায়ে হাত... কত্ত বড় সাহস, আমাদের মেয়ের গায়ে হাত! সারারাত পরামর্শ চলে। বিকালে গরম পানি শুনে আরো গরম হয়। বেচারী শ্যামা আঁচ সামলাতে গিয়ে কাত করে একেবারে বুইড়ার উপর... চুপে চুপে বলি আসলে টিউশনি কাপটাই কাত হয়ে চা ফেলে দিল বজ্জাতটার গায়ে। দূর্বলতার খোলস ভেঙে মাথা উচুঁ করে দাঁড়ানো যে কি অদ্ভুত বিষ্ময়ের!

এমনি করেই ভালবাসা তৈরি হয়; হারানো ভালবাসা ফিরে আসে। ভুলে যাই হিন্দু-মুসলিম। ঝড়ো বৃষ্টিতে দখিনের জানলার কাছে টেবিলে ভাললাগার শুরু হয় সুবলদা আর মেঘলা আপার। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে ঘৃণা না, খাঁটি ভালবাসা নিয়ে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মেঘলা আপার দুচোখ ভিজে যায়। কখনো পানি গড়িয়ে একেবারে চায়ের কাপে! মানুষের ভালবাসার স্বাদ যে কি অপূর্ব; সেই ভালবাসায় কোন হিন্দু-মুসলিম ভেদ নেই! কখনো দেশ ভাসে বন্যায়। মানুষ ছুটে যায় ভালবাসার টানে মানুষের কাছে; বাড়িয়ে দেয় ভরসার হাত। সেই ছবি টিভি মামার চোখে দেখি আর মুগ্ধ হই। আমাদের শক্ত হৃদয়েই এমন লাগে। আর ওরা তো মানুষ; নরম হৃদয় নিয়ে ঘুরে। ভাবি কিসের ভেদাভেদ, কই ভেদাভেদ? কিছুই তো নেই। আমরা 'সৃষ্টি' এইতো আমাদের আসল পরিচয়!

শুনেছি পৃথিবীর অনেক দেশে নাকি বর্ষা নেই। বর্ষা যে কি এক অপূর্ব সৃষ্টি। এই এক বর্ষা আরো আমাদের কাছাকাছি করে! কদম বুকে জড়ায় বর্ষাকে। আর ভালবাসা জড়ায় আমাদের। কেউ গলা জড়িয়ে, কেউ আবার গলা ছেড়েই আড্ডা জমায় বৃষ্টির দিনে। চায়ের পর চলে চা। বের হয়ে আসে তোমার মত শোকেইসের বন্দী কাপেরা। এমনি করেই তো বাড়ে কাপবন্ধু। বাসার সবাই মিলে আড্ডা দেয়। চলে কতসব আনন্দ-বেদনার, সরল ঘরোয়া আলাপ মানুষের মধ্যে...আমাদের মধ্যেও। আড্ডা চলে মেঝেতে, বিছানায়, সোফায়, রান্নাঘরে, বারান্দায়, ছোট্ট চাদোকান ঘিরে, মুঠোফোনে, অন্তর্জালে... আড্ডায় তর্কও হয় কিন্তু তারপরো কেমন এক শান্তির ভাব! ভিজছে গাছের শরীর, ভিজছে অশান্ত সময় শান্ত জলে। বর্ষা একেবারে ভেতরটা নাড়িয়ে দেয়। আবার একলা কেউ হয়ত আড্ডা ছেড়ে দাঁড়ায় জানলার কাছে; হয়তো কারো অপেক্ষায়। পাশে আমিও টংদোকানের কাপের কথা ভেবে মন খারাপ করি। হঠাৎ বৃষ্টি চলে আসে- মনটাই ভালো হয়ে যায়! বৃষ্টির দুটো ফোঁটা এসে লাগে গায়ে, ভেতরের চায়ে। আহ কি নরম জল! চা যেন হয়ে যায় নদী। একা মানুষ বাড়িয়ে দেয় হাত বৃষ্টির দিকে; কেউ যেন আর একা নই। ভিজে হাত, খোলা জানালা, নীল পর্দা, সবুজ মেঠোঘাস... পুরো দেশ জুড়ে চলে বর্ষার গান...

'কেনো এ হিংসা দ্বেষ, কেনো এ ছদ্মবেশ, কেনো এ মান অভিমান!
বিতর বিতর প্রেম পাষাণ হৃদয়ে, জয় জয় হউক তোমারি!
বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি।'

আহ, শান্তির বারি! তখন কি আর মনে হিংসা-দ্বেষ থাকে? ভেদাভেদ ভুলে শুদ্ধ ভালবাসায় প্রার্থনা আসে- জগতের সকল সৃষ্টি সুখী হউক! প্রশান্ত হউক সকল সৃষ্টির জীবন। ভালো থেকো সবাই!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
হোসেন মোশাররফ একটি ভিন্ন স্বাদের গল্প, এর রূপক চরিত্র গুলোর রকমারি উপস্থাপন ভালই লাগল.....
amar ami এমন ভিন্ন সাদের গল্প এতদিনও অপঠিত ছিল দেখে খারাপি লাগলো ..... আর গল্প না পছন্দ করে উপায় কি !....
মোঃ শামছুল আরেফিন প্রতিকী গল্প। দুই চায়ের কাপের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের প্রতিনিয়ত সঙ্গাত, দন্ধ, বৈষম্য, হাঁসি, আনন্দ, দুঃখ- বেদনা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং শিক্ষা সব কিছুই তুলে এনেছেন। গল্পের মাঝে মাঝে এত আবেগ দিয়েছেন যে হৃদয়কে বারবার স্পর্শ করে যাচ্ছিল। অসাধারণ।
খন্দকার নাহিদ হোসেন ও বিষয়ের বৈচিত্র্যের জন্য আলাদা করে একটা ধন্যবাদ রইলো। আশা রাখি অনেকেই ব্যাপারটা থেকে শিখবে।
খন্দকার নাহিদ হোসেন আপু, কলম কামড়াই এরকম কোন গল্প পড়লে। আহারে, মানুষের লেখার ক্ষমতা দেখেও মনটা কেমন ভালো হয়ে যায়। তাই বলে অক্ষমতা জ্বালায় না তা কিন্তু বলছি না! আর মেজাজ গরম হয়(!) যখন দেখি আপনি যে গল্প লেখেন সে গল্পই পছন্দের তালিকায় নেয়া লাগে। কোন মানে হয়! অনেক ভালো থাকুন আর এমনই লিখুন এই কামনায় শেষ করছি।
আরিফ উদ্দিন বাহ! চমৎকার।
এফ, আই , জুয়েল # # # স্বাদে কটু মনে হলেও ভালবেসে বার বার এরকম উপকারী সরবত-ই প্রেরন করা হয়ে থাকে । যাতে উহা পান করে হালকা ভাবনাগুলোকে নিরিবিলিতে একটু গভীরভাবে ভাববার সুযোগ পাও । কিন্তু প্রথম চুমুকেই তুমি দিশেহারা হয়ে যাও । অবশ্য এটা তেমন দোষের না । তবে দোষের মত--- । // অনেক কথার ভীর হতে "ছলনা"-কে কাছে টেনে মাথার মধ্যে কুট কুট করার সুযোগ করে দিলে কেণ ? তোমাকে উদ্দেশ্য করে নয়তো কি ; জ্বীনের রাণীকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে নাকি ? কেন ,-- তোমাকে কি বলা যাবে না ? এটাও আর এক অন্যরকম ছলনা । ছলনা আর ঢং মিলে মনোরম শিল্প সৃষ্টি হতে পারে । ভাল ঢংগী হতে হলে কিন্তু সাধনার দরকার আছে । // প্রেমের দুঃখলীলা আর সুখলীলা,-- এই দুই লীলার মাঝখানে নিজেকে আড়াল করে ভাবছ ,- তুমি জিতে গেছ ! তাই না ? তোমাকে উপহাড় দিতে হবে । আবার এর যোগ্য করেও তুলতে হবে । একই সাথে এত চাওয়া পূরন করা অত সহজ নাকি ? // ঐযে একটা গান আছে না ,--- হাতেরও নিলু তুই , কোঁচারও নিলু । লোকের কথাতে বুঝি জাইত মারিলু ।।
মিজানুর রহমান রানা আহ, শান্তির বারি! তখন কি আর মনে হিংসা-দ্বেষ থাকে? ভেদাভেদ ভুলে শুদ্ধ ভালবাসায় প্রার্থনা আসে- জগতের সকল সৃষ্টি সুখী হউক! প্রশান্ত হউক সকল সৃষ্টির জীবন। ভালো থেকো সবাই!-------সুন্দর একটি গল্প উপহার দেয়ার জন্যে আপুকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। শুভ কামনা।

১০ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪