ঝড় পরবর্তী ভাগফল

ঝড় (এপ্রিল ২০১৯)

প্রজ্ঞা মৌসুমী
  • ১০২
একান্ন, বাহান্ন, তেপান্ন... আহসানের চিরকুট পড়া গুনতে, গুনতে, গুনতে কেমন এক ঝিম আসে চোখে, যেমন ঝিম লাগে পাটিতে স্থবির শুয়ে কৃষ্ণপক্ষের নক্ষত্ৰ গুনার কালে। সেই যে তখন থেকে চিরকুট হাতে বসে আছে মানুষটা, ঝড়ে পড়া একটা ন্যাতানো গাছ যেন। আর চিরকুটটা যেন এক ধাঁধা, মেলানোর চেষ্টা করে চলছে। মাঝেসাঝে ছোট্ট বিরতির মতো দেয়ালের সেতার বাজানো রিয়াকে চোখ দিয়ে দুলিয়ে দিচ্ছে এক কি দুটো বার। চিরকুট বলতে ধার করা প্ৰেসক্ৰিপশন প্যাডে লেখা একটা লিস্ট। হাতের লেখাটা ভাই দিহানের তবে জানানগুলো রিয়ার-
হীরের বাগদান আংটি
দুটো সরু হার
দাদীমার দেয়া সীতাহার
বালা এক জোড়া
জোড়া পাঁচেক সোনার দোল
দুজনের ছ’টা সোনার আংটি
কুড়ি হাজার টাকা- নীলগিরির জন্য, ফার্স্ট অ্যানিভার্সিরি।

আর মোটে দশ দিন, আট ঘন্টা, ঊনিশ মিনিট, আটান্ন সেকেণ্ড পর ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। কতো পরিকল্পনা আহসানের, গোছগাছ, কতো নামতা পড়া, রিয়া এখনও পাহাড় দেখেনি, কাঠখোট্টা বস ছুটি না দিলে এমনিই চলে যাবে, থোড়াই কেয়ার। সম্ভাব্য পরিকল্পনা বাদ দিয়েও আজকের দিনটা একটা গতানুগতিক রোমাঞ্চকর দিন হওয়ারই কথা ছিল। টেবিলে তিনশ পঞ্চান্নতম প্রেমপত্র কিংবা ছোট একটা কবিতা থাকার কথা ছিল, কথা ছিল আজও টিপটা আহসানই পড়িয়ে দেবে, শাড়ির কুচি ঠিক করে পেটের তিলে ছুঁয়ে দেবে খানিকটা ঘূৰ্ণিঝড়, বৃষ্টি হলে তুমুল ভিজে ঠাণ্ডা বাঁধাবে।

তিহানের হাতে কিছুটা ধাতস্ত হওয়া শোবার ঘরে কোথাও হয়তো এখনও ছিটকে আছে গোলাপী জামদানিটা, পায়ের জমিনে যার উপচে পড়া ফুল। সন্ধ্যায় শ্যামলের বউভাতে যাওয়ার কথা ছিল ওদের। বিয়ের আগে এইসব সামাজিকতা-আনুষ্ঠানিকতা বরাবর এড়িয়েই গেছে আহসান। এখন আর অমন পারে না বলে বড়ো ভাবী ওর এই বদলে যাওয়ায় খোঁচা দেয়- সুন্দরী বউ থাকলে সবারই অমন বদল হয়। লোককে সুন্দরী বউ দেখানোয় গর্ব আছে না?

আহসান ওসব চোরাকাটা গায়ে মাখে না। ভালোবাসাকে প্ৰশ্নবোধক চিহ্নের সামনে দাঁড় করানোর লোকের অভাব তো নেই। কাঠখোট্টা লেখকও কেমন ঢুকে পড়েছে ওর ঝড় ন্যাতানো ঘরে। অবশ্য আর সব ঘরের মতো এ ঘরে ঝড়ের জোড়ালো ছাপ নেই। এটা রিয়ার রেওয়াজের ঘর। এক জানলা রোদ, জ্যোৎস্না আর বেড়ালটা ছাড়া কে অমন হাতপা এলিয়ে বসেছে এখানে? ওদের ভালোবাসা? যে ভালোবাসাকে আহসান নিংড়ে নিতে চেয়েছে, শুষে নিতে চেয়েছে তার সমস্ত জলকণা। তিন শব্দের বিবাহকে ও করতে চেয়েছে প্রেমের পুরাণ। রিয়া ওর কোলে বাতাসে দোল খাওয়া ফুলের মতোন হেসে উঠে বলতো- তোমার ভালোবাসার একটা পরীক্ষা হওয়া উচিত। জয়ী হবে সে ভরসা নয় অহংকারই ছিল আহসানের। কেবল ঝড়ে আটকা পড়ে অফিস ক্যাফেটেরিয়ায় এক কাপ কফি খাওয়া অমন কিস্তি দিতে পারে না! হিমেল ফোঁড়ন কেটেছিল- ঝড় নয়, মিস আনিকা ম্যাডামাই আহসানের মতো বউ পাগলকেও একটা কফির অজুহাতে আটকে রাখতে পেরেছে।

আহসান তো বুঝে- ওসব মিথ্যে বাতাস, উড়িয়ে নিতে চায়। ও কি আর জানে না সমুদ্ৰকে ভালোবাসে যে নাবিক, সমুদ্রের ঝড়ের সাথেও তাকে বোঝাপড়া করতে হয়! সত্যি তো এই- রিয়ার তৃষ্ণায় বুক হয়ে গেছে সাত মরুভূমি। সত্যি তো এই- ঠিক এই মূহুর্তে একেকটা ফেসবুক নোটিফিকেশনের শব্দ শিলা বৃষ্টির মতো ঢেকে দিচ্ছে তার মগজ। ‘তুমি হয়ে গেছো আকাশ, আমি মেঘ জমাবো বলে’- ক্যাপশান জুড়ানো ওদের যুগল ছবিতে কতো লাইকস, ঈর্ষা পড়লো এবার? পাঁচশো, এক, দুই হাজার?

'কি করতেছে দামড়াটা বউয়ের কাছে না গিয়া? আমারে নিয়ে চল নাতবউয়ের কাছে। গজব পড়ুক, গজব পড়ুক, এত বড় ক্ষতি করলো আমার। আহারে আমার অমন কোমল বউটা।'- তিনতলা থেকে নেমে আসার ভারের সাথে আরও সব ভার নিয়ে বুড়ো দাদী চেঁচায়। আহসানও ভাবে কি করছে ও এখানে? অতল ঠোঁটের তৃষ্ণায় বুক তো তার হয়ে গেছে সাত মরুভূমি। রিয়ার বিড়াল- বাগদানটা সেই কখন থেকে নিথর পড়ে আছে, বোধকরি ওকেও ডক্টরের কাছে নিতে হবে। ডাকাতের ঘটনা, লোকগুলোর নিখুঁত বিবরণ, যা নিয়ে গেছে- সব পুলিশকে বলা হয়ে গেছে হাসপাতালে শুয়ে থাকা রিয়ার। রিয়া তো এমনই। আহসান যতটা উপচে পড়া, রিয়া ততটাই গভীর। তবু লিস্টে আর কিছু বাদ পড়লো কি না দেখে নিতে বলেছে রিয়া। সে বধুয়া কেমন করে বুঝে যায় পুরুষের ভেতর? কি করে বুঝে নিয়েছে ওদের সত্যি দীর্ঘ এক পাহাড় পাড়ি দেয়ার আছে!

রিয়া একদিন চিঠিতে লিখেছিল- "পুরান দিনে ভালোবাসা নামে সত্যি এক নারী ছিল। একদিন গুহায় দস্যুহাতে আটকা পড়েছে ও, ছুটে চলেছে তার যুবরাজ। ভালোবাসা তখন চিঠি লিখেছিল মেঘে- 'আমি অপেক্ষায়। তোমার পথে দ্বিধা, সন্দেহ, মোহ- বল্লম হাতে ওরা একেকটা যোদ্ধা। যদি ক্লান্ত হয়ে পড়ো, তুমি পাবে মৃত ভালোবাসা। যদি বড়ো বেশি দেরী করো, হয়ে যাব স্বাতী নক্ষত্রের আলো, জনম জনম সহস্ৰ করুণ ঝিনুকের সাথে উঠে আসতে হবে তোমাকে বৰ্ষার রাতে শুধু এক ফোঁটা আমাকে ছুঁবে বলে, আর যদি নির্বাসন দাও...'- জানো, এখানেই ছুটে যায় মেঘের বাকিটা চিঠি অনন্ত ধাঁধা রেখে।"

চিরকুটে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আহসান খুঁজে চলেছে কি নেই ওর। বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে আছে একেকটা প্রশ্ন, একেকটা যোদ্ধা। ওর যে মালা গাঁথার ছিল। কত যত্নের পরে থেমে দেখে কারা যেন চলে গেছে থালার শেষকটা ফুল নিয়ে। আহসান ক্ৰোধে, ক্ষোভে, বিপন্নতায় একটা আধুরা মালা নিয়ে ডুকরে উঠে- আমার খোয়া গেছে ফুল। ওরা আমার ফুল নিয়ে গেছে, ফুল.....

কিছু শেষ করুণ মিঞাও ডেকে ওঠে। আহসানও মৃত বেড়ালের পাশে ডুবে যাওয়ার কালে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় ঐটুকু মায়াবী সেতার। সেতার- সেও আজ এক ধারালো বল্লম।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Jamal Uddin Ahmed আরও কয়েকবার পড়ে মন্তব্য করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তবে কাব্যিক উপস্থাপনা ভীষণ মনে ধরেছে। শুভ কামনা।
মোঃ মোখলেছুর রহমান আপনার গল্পে বিশেষ করে উপমা গুলো বেশ কাব্যিক, এই স্টাইলের গল্পগুলো আমার ভীষন ভাল লাগে
হুমায়ূন কবির ভালোলাগা সহ শুভেচ্ছা রইল।
রঙ পেন্সিল আপনার লেখায় মন্তব্য করতে ভয় ভয় লাগে। শব্দের যে এতটা জোর সেটা আপনার লেখায়ই সবথেকে বেশি চোখে পড়ে।
সালাহ উদ্দিন শুভ মন্তব্য করতে গিয়ে বারবার আটকে যাচ্ছি। ভাষা এবং বর্ননা অসাধারণ মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। আর গল্পটা একেবারে ভেতরে আঘাত হেনেছে। এ গল্প অনেকগুলো বার্তা দেয় যা আপনি আমার থেকে ভাল জানেন। ভাল লেগেছে এমন একটা বিষয়কে টেনে নিয়ে লিখেছেন। তবে আশা রইল এমন ঝড় যেন কারো জীবনে না আসে, ভাগফলটা মেনে নেওয়া অসম্ভব। শুভকামনা রইল।
রণতূর্য ২ প্রজ্ঞা মৌসুমি আপনার গল্প বলার ভঙ্গী অনেক সুন্দর। ভোট ও শুভকামনা আপনার জন্য। আমার কবিতায় আমন্ত্রণ রইল।মন্তব্য করে ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন আশা করি।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

ঝড়ে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনা একটা সম্পর্কে কিভাবে ঝড় তুলে- সেটাই প্রকাশের চেষ্টায়।

১০ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "পদত্যাগ”
কবিতার বিষয় "পদত্যাগ”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জুন,২০২৫