দোকান-পোষা কেটলি

অন্ধ (মার্চ ২০১৮)

প্রজ্ঞা মৌসুমী
  • ১৬
  • ২০
কোন আগাম জানান ছাড়াই হঠাৎই একদিন শিমুল গাছটার নিচে উদয় হয়েছিল চায়ের দোকানটা। পাশের মুদি দোকানদারের দাড়ি-কমা ছাড়া গজগজানিতেই (এএ বৃত্তান্ত কিছুই জানলাম না গায়েবি দোকান আইস্যা বইছে) চায়ের দোকানের অস্তিত্ব টের পাই আমরা। আর ’গায়েবি’ শব্দটাই বোধকরি আমাদের মথিত করে বেশি। এই তো বছর খানেক আগেই পাশের উপজেলার গায়েবি পুকুর আলোড়িত করেছে আমাদের বোধ, বুদ্ধি। এক রাতেই আসবাব সমেত আধ-পাকা বাড়িটা উধাও। ভিটে হয়ে গেছে দিব্যি একটা পুকুর। কেউ বলে প্রকৃতির ভেলকিবাজি। চোরাবালি ছিল; বাড়িটা ডুবে গেছে। কেউ বলে খালটা ভরাটই হয়নি ভালো করে। আর গড়পড়তা আমরা- যারা এক ফোঁটা জমজম কুয়ার পানি মাটিতে পড়লে জায়গাটা সালাম করি কিংবা আল্লাহ বরাত লিখেন বিশ্বাসে এবাদতে পার করি পবিত্র রাত- ভেবেছি কুদরতি, অলৌকিক ঘটনা। তাই অনায়াসে ছুটে গেছি মাটি আর বোতলভর্তি পানির জন্য।

আসলে রহস্যকে মানুষ সমীহ করে। সারে সারে সেগুন আর এই বৈঁচি-শিমুল গাছে ছাওয়া জায়গাটারও রহস্য কম নয়। জমির মালিককে কখনো কেউ দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সীমানা ঘেঁষে দাঁড়ানো 'ইজাজত সেলুন’ মালিকের দ্বিতীয় পক্ষ প্রায়ই বলে “জমিটা দখল করো। মালিক এলে দাবড়ানি দিলেই পালাবে।” প্রথম পক্ষের স্ত্রীর মন- সে তো সবসময় শংকায় ভরা। ও বলে “পাওয়ারওয়ালা কেউ হইলে উল্টা তোমরাই ফাঁসবা।” রহস্যময় মানুষটার ক্ষমতা সম্পর্কে জানা হয় না। শুধু জোবেদা টেইলার্সের বুড়া মিঞার কাছে শুনেছি লোকটা চর এলাকায় থাকে। আর শুনেছি ক্রমাগত জমিটার রহস্যময়তা। ভরদুপুরে এদিকে যাবার পথে মানুষের গায়ে নাকি গাছ থেকে পানি ছিটকে পড়ে। পান দোকানের চাচীও সাক্ষী দিয়েছিল বাস মিস করে এখানে জিরুনোর সময় ঝিরঝির করে পানি পড়েছিল গায়ে। কেউ কেউ জিলেপীর গন্ধও নাকি পায়। অথচ পাড়ায় কোন জিলেপীর দোকানই নেই। এইসবে আয়াতুল কুরসী জানা লোকও জায়গাটা এড়িয়ে গেছে বরাবর। হয়তো তাই চায়ের দোকানের আয়োজন আমাদের চোখে পড়েনি। তাই হয়তো আন্দাজ ছাড়া বয়সী লোক আর ছ-সাত বছরের মেয়েকে হঠাৎ চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে বসতে দেখে মনে হয় গায়েবি।

সেদিন আমরাও উপলদ্ধি করি একটা চায়ের দোকানের আবশ্যকতা। এভাবেই চায়ের দোকানটা কেন্দ্রে নিয়ে বয়ে চলে এইসব দিনকাল। শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত আমরা দোকানের লোক দুটো নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। সূর্যমুখী তো নই। সূর্যের থেকে সূর্যের আলো নিয়ে আমাদের কাজকারবার। বুড়োকে তেমন খেয়াল করেছি বলে মনে পড়ে না। ব্যস্ততা না থাকলে কেটলির ধারেই বসে থাকতো চুপচাপ। হয়তো ভাবতো জীবনের কাছে হেরে যাওয়ার ইতিহাস। শুধু কখনো সখনো কিছু সত্য ভেসে আসতো। মনে হতো কেটলির সাথেই যেন কথা কয় ও। একদিন যেমন কেটলির দিকে তাকিয়েই বুড়ো বলেছিল- পুড়ে খাঁটি হয় সোনা, অভাগা কাগজ শুধুই ছাই হয়। আবার পাড়ায় কারো চণ্ডীদাস হওয়ার সম্ভাবনায় চায়ের কাপে ঝড় তুলার কালে বলেছিল- স্পর্শ আছে, তরঙ্গ নাই। সেদিন মনে হয়েছিল সব সম্পর্কের পরিণতি বুঝি এই।

তবু কখনো সখনো তাকাতে হয় বৈকি আলোর কারিগরের দিকে। হয়তো তাই একদিন মুখোমুখি হই আমরা। দু' বছরের ছেলেটা সেদিন মায়ের অজান্তে লজেন্স কিনতে এসেছিল। যখন জানি বজ্জাতটা লুকিয়ে টাকা নয় ডিভি ভিসা পাওয়া চাচার শখ করে দেয়া ডলার নিয়ে গেছে, ভিড়ে তখন জমে গেছে বারুদ। 'বুইড়া আড়াই ঠ্যাং কবরে গেছে ডলার মাইরা খাছ’। আমরা তখন গণপিটুনির মধ্যবিন্দুতে, বিবিয়ান এসে হাহাকার করে- ‘আমার দাদা আন্ধা। সন্দেহ হওয়ায় টাকা নেয় নাই। মাগনা দিছে। আপনারা খুঁজেন। পকেট থিকা পড়ছে কোথাও। আপনারা খুঁজেন।'

সেদিন আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম ডলার। কেবল নিজেদেরই যেন খুঁজে পাইনি আর। দম্ভও হয়তো এক গাঢ় অন্ধত্ব। তাই তো ভুল স্বীকার করতে এত দ্বিধা! ঈশ্বরকেই বিশ্বাস করি অথচ ভরসা করি না। সে তো মামুলি দোকানদার। কখনো তো মনে হয়নি লোকটা অন্ধ। আর যদি হয়েই থাকে কেন জানানো হয়নি! কে জানে ব্যস্ততার সুযোগে কত টাকা উলোট-পালট করেছে। কে জানে কি দিতে গিয়ে কি দিয়েছে- এইসব ভাবনায় কী ভীষণ প্রতারিত মনে হয় নিজেদের। আর এভাবেই বুড়োটা হয়ে উঠে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। টোপে ফেলতে
আমরা আনাগোনা বাড়াই, টাকার গড়মিল বাড়াই, বাড়াই নানা পদের চা আর অন্যান্য ফরমাশ। চেয়ারম্যান তো বলেই ফেলে ‘হাতে আপনার যশ আছে। একটা জিলাপীর দোকানও দেন।’ অনভ্যস্ত অন্ধ ময়রার গরম তেলে ঝলসানোর ভাবনায় পুলকিত হই আমরা।

অবশেষে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি অমীমাংসিত খেলার টাইব্রেকারে। একদিকে কেটলি হাতে এক অন্ধ গোলকীপার আর পেনাল্টি লাইনে বল নিয়ে দাঁড়িয়ে আমরা। সমূহ জয়ের সম্ভাবনা তবু উত্তেজনা, অনিশ্চিয়তা। প্রতিটা বিদীর্ণ গোধূলিতে বিবিয়ানের হাত না ধরেই বুড়োটা বাড়ির পথে হাঁটে। অসহায়ের মতো আমরা দেখি কী করে আমাদের গভীরেই ফিরে ফিরে আসে বল। ভয় হয়। একদিন বুঝিবা ও মুখলেসের ঊনষাট পদের চা’কেও হারিয়ে দেবে। হারিয়ে দেবে দম্ভের কাছে পরাজিত আমাদের।

এগুতে থাকে অন্ধ চাওয়ালা। হাতে তার অমোঘ কেটলি। সন্ধ্যার বাতাস ছুঁয়ে আসে জিলাপীর অথৈ ঘ্রাণ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
কাজল valo legesay. thanks.
মৌরি হক দোলা পুড়ে খাঁটি হয় সোনা, অভাগা কাগজ শুধুই ছাই হয়.....! আপনার লেখনীতে আলাদা এক ভাব আছে। এই ভাবটা বুঝিয়ে দেয় আপনার লেখালেখির ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতার উপস্থিতি... ভালোলাগা ও শুভকামনা রইল....
কাজী জাহাঙ্গীর গল্পটাতে ডীপ থট আছে, সরাসরি না বলে আকারে ইঙ্গিতে বোজানোর যে কষ্টকর পন্থা সেটা বেশ ভাল ভাবেই তুলে ধরেছেন উপমার ‍ধারালো অস্ত্রে। অনেক শুভকামনা আর ভোট রইল।
Farhana Shormin চমৎকার। ভিন্ন একটি অন্ধত্বকে তুলে এনেছেন দিদি। আমি পছন্দ না করে থাকি কিভাবে? পছন্দ, ভোট সবই দিদি আপনার।
Fahmida Bari Bipu ব্যতিক্রমী ভাবনা, অন্যরকম উপস্থাপনা। যদিও সেই একই কথা...একটু কঠিন লাগে পড়তে। তবে ধৈর্য নিয়ে পড়ে ফেলতে পারলে গল্পের ভাবনা মন ছুঁয়ে যায়। শুভেচ্ছা ও ভোট রইলো।
মোঃ গালিব মেহেদী খাঁন ভাবনার ভিন্নতা লেখায় নতুন মাত্রা যোগ করে, আমার তো মনে হয় লেখিকা তাঁর পাঠকদের বঞ্চিত করেছে! লেখাটি অনেক ভাল, চাইলে লেখিকা আরো বেশি কিছু দিতে পারতেন।
সাদিক ইসলাম পরাবাস্তববাদী চিন্তা আছে। Surrealism আমার ভালো লাগে শুভ কামনা।
ইফতেখার আহমেদ ভালো লেগেছে। অনেকদিন পর এসে আপনার গল্প প্রথমে আসলো। :) ভালো ছিল লেখা
আজাদ ইসলাম জনাব মোখলেছুর রহমান ভাই এরকম একটা মন্তব্য কেন করল বুঝলাম না। তবে কি আগে ভেজাল এখন খাঁটি? ঠিক বুঝলাম না; তবে আমার ভাল লেগেছে।
উনার মন্তব্য আমাকেও ভাবিত করলো। :)
নুরুন নাহার লিলিয়ান ভাল লাগল । অনেক শুভ কামনা রইল ।

১০ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪