বৃষ্টিভেজা শৈশব

বর্ষা (আগষ্ট ২০১১)

মৃন্ময় মিজান
  • ৪৮
  • 0
  • ১৬
ঝুপ করে বৃষ্টি নামল। রিক্সা থেকে এক পা রেখেছি মাত্র। বিনা নোটিশে মুহুর্তেই ভিজিয়ে দিল শরীর। দু-তিন কদম ফেলে টিএসসির দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়ালাম। ভাড়া মিটিয়ে টের পেলাম এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। বৃষ্টির ছাঁট খুব বেশি। অগত্যা মেইন গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।

কথা ছিল চত্বরে অপেক্ষা করব। এ বৃষ্টিতে সে ইচ্ছা উবে গেল। মুঠোফোনে জানালাম অডিটোরিয়ামের সামনে আছি।ওরা আসবে, আমি বুঝে গেছি, বৃষ্টি শেষে। ইতিউতি তাকাচ্ছি চারপাশে। তুমুল আড্ডা চলছে এখানে। বাইরে আকাশ কালো করা ভারী বর্ষণের একটানা গ্রামজ শব্দ। কপোত-কপোতীর মেলার পাশে বেমানান কিছু আড্ডায় চলছে নাটক-আবৃত্তির মহড়া।

আমার পাশে জমে ওঠা আড্ডাটা বৃষ্টি-উৎসবের প্রাক-প্রস্তুতিমূলক। ওরা ছয়জন ঠিক করেছে একজনের বাড়ি বেড়াতে যাবে। সেখানে পুরো গ্রাম তলিয়ে আছে বর্ষার পানিতে। বড় রাস্তা আর বসতবাড়িগুলো ছাড়া সবই পানির নীচে। নৌকায় যাতায়াত করতে হয়। পুরো ট্যুরটায় কি কি করা হবে সে সম্পর্কে চলছে নানা বিতন্ডা। এক পর্যায়ে নিতু নামের একজন প্রস্তাব করল বৃষ্টি-স্মৃতি রোমন্থনের। যার স্মৃতি সবচেয়ে আকর্ষনীয় হবে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী হবে এবারের বর্ষা-উৎসব। কাগজ-কলম হাতে নিয়ে স্মৃতির জানালা খুলে সবাই দাঁড়িয়ে গেল যার যার মত। প্রত্যেকের স্মৃতি তাড়িত মন ফিরে যায় হারানো শৈশবের বেলাভূমিতে। বেঁধে দেয়া বিশ মিনিট পেরিয়ে প্রথমে শুরু করে সুমী-

"সেদিনের সকালটা ছিল অন্যরকম। আকাশে মেঘের গুড়ুম গুড়ুমের সাথে বিদ্যুচ্চমক। টিনের চালে একটানা বৃষ্টির শব্দ। বাইরে হাঁসের প্যাঁক প্যাঁক আর গরু-ছাগলের ডাক। বাড়ির সব ভাই-বোন মিলে কড়ি দিয়ে চার ঘুটি খেলছিলাম। খেলার ফাঁকে এক-আধটু চুরির চেষ্টা করছিলাম সবাই। এর মধ্যে বড় চাচী কতগুলো বাদাম ভেজে দিয়ে গেল। সেগুলো নিয়ে পড়ে যায় কাড়াকাড়ি। সুযোগ মনে করে বড় ধরনের চুরি করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়ে বাকী ভাই। সবার মাইর খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য দৌড়ে ঘরের বাইরে চলে যান। পিছু নিয়ে আমরা তাকে পানিতে ফেলি। ঝুম বৃষ্টিতে পুকুরে গোসলের মজাই আলাদা।"

- কেন আলাদা কেন ? নিতুর প্রশ্ন।
- বৃষ্টির সময় পুকুরের পানি গরম থাকে। শরীরের যে অংশটা পানির উপরে থাকে ওই অংশে ঠান্ডা লাগে আর পানির নীচের অংশে হালকা গরম। বেশ মজার অনুভূতি। আর যদি ডুব দেস তাইলে আরো মজার। কেমন একটা শব্দ কানে বাড়ি মারতে থাকে। আমার খুব ভাল লাগত।
- আচ্ছা তোর কাছে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে ভাল লাগত নাকি পানিতে ডুব দিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতে ভাল লাগত ? এবার কথা বলে ফরিদ।
- আমার সবচেয়ে ভাল লাগত গলা সমান পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে। শরীরে কোন ঠান্ডা লাগেনা আবার মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে থাকে। খুব এনজয় করতাম।
- তোর কি বলা শেষ ? তাহলে এবার নিতু বলবে। কথা বলে উৎসবের হোস্ট শাকিল।
- দাঁড়া আর একটু বাকি আছে; বলে আবার লেখার দিকে নজর দেয় সিমু-
"অনেকক্ষণ ছোঁওয়াছুঁয়ি খেললাম। হঠাৎ কে যেন আমাকে পানির নীচে জাপটে ধরে। আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠি। পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। একটু দুরে ভুস করে ভেসে ওঠে বাকী ভাই। আমার দিকে তাকায় কেমন ঘোলা দৃষ্টিতে। সেই আমার প্রথম প্রেম। সারাটা দিন অন্য রকম কাটে। বৃষ্টি এলেই বাকী ভাই আমার সারা উঠোন জুড়ে এখনো দাপিয়ে বেড়ায়।"

- তোর বাকী ভাই এখন কী করেরে ?
- বুয়েট থেকে বের হয়েছেন গত বছর। এখন আমেরিকায়।
- কবে বিয়ে করছিস তোরা।
- ধুর! ওনার সাথে আমার এখন কোন যোগাযোগই নেই!
- কি বলিস ? কেন ? কি হয়েছে তোদের ?
- বাদ দে ওসব! তোর কথা বল!
- আহা বলনা !
- বাদ দে ত।

বাদ দেয় নিতু। শুরু করে নিজের কথা-

"রাতে প্রচন্ড ঝড় হয়েছে। আমাদের ঘরটা ঝাঁকি খেয়েছিল কয়েকবার। পড়েনি ভাগ্যের জোর। সকালে সব জায়গায় ঝড়ের চিহ্ন। বাতাস আছে কিছু। বৃষ্টিও পড়ছে ঢিমেতালে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম ফাতেমার সাথে। ভিজে ভিজে সারা বাগান ঘুরে বেড়ালাম। সাথে আনা বস্তাটা ভরে গেল আম, তাল আর নাড়িকেলে। হঠাৎ বিলের ভেতর তালতলায় সাপ দেখে কী যে ভয় পেয়েছিলাম! আমার চিৎকার শুনে ঘর থেকে মা বের হয়ে আসেন। কান ধরে নিয়ে যান। সেই আমার শেষ শখ করে বৃষ্টিতে ভেজা।"

-তুই তো দেখছি খুব দস্যি মেয়ে ছিলিরে ছোটকালে ! প্রথমেই ফোড়ন কাটে মানিক। সায় জানিয়ে ফরিদ বলে,
-এখনো কি কম আছে নাকি ! দেখিসনি সেদিন বারী স্যারের মুখের উপর কেমন চটাস চটাস কথা বললো।
-ঠিক বলেছিস ওর মধ্যে একটা ডাইনী আছে। কিন্তু ওর স্মৃতিটা বেশি পানসে মনে হল। আরেকটু রসিয়ে বললে ভাল হত।
- কী ! আমি ডাইনী ? ডাইনীর কথায় আবার রস চাস !
-ছিঃ ছিঃ আমি কখন তোকে ডাইনী বল্লাম ? আর কথায় রস নেই এটাই বা বল্লাম কখন ?
-একটা থাবড়া খাবি কথা ঘুরাইলে। তুই বলিসনি আমার ভেতরে ডাইনী আছে! আরো রসিয়ে বললে ভাল হত!
-এই তোরা থামতো! সবাই মিলে পরিকল্পনা করছি একটা ট্যুরের আর তোরা আছিস ক্যাচাল নিয়ে।
-শাকিল, এই দুইটা যদি যায় তাহলে আমি যাবনা তোদের সাথে। ওরা সবসময় আমার পিছে লেগে থাকে। অসহ্য!
-মানিক! স্যরি বল নিতুর কাছে।
-আমি একা তো বলিনাই। ফরিদরেও স্যরি বলতে বল।
-তোরা দুজনেই স্যরি বলবি। তোরা কেমনে যে এত ক্যাচাল করতে পারিস আল্লা মালুম।
-স্যরি বলব ঠিকাছে। কিন্তু ফাতেমাটা কে ?
মুখ গোমড়া করে ফেলা নিতু কোন কথা বলেনা। মানিক আবার বলে, ফাতেমা কে এটা বললেই স্যরি বলব। কি বলিস ফরিদ !
ফরিদ সায় জানায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিতু বলে,
-ও আমার বাল্যবান্ধবী।

স্যরি পর্ব শেষে স্মৃতি রোমন্থণের ভার পড়ে মানিকের উপর।

"প্রথম ফোটাটা নাকে পড়ল। তারপরেরটা কানে। এরপর একে এক মাথা, পিঠ, চোখের পাতায়। ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেললাম আলাদা অনুভূতির সামর্থ্য। পুরো মাঠে সবাই যার যার মত ব্যস্ত। আমি ব্যস্ত শামুক কুড়াতে।

সেবার হাঁসের বাচ্চা মানুষ করছি কয়েকটা। সকাল হলেই বৃষ্টিতে ভিজে বেরিয়ে পড়তাম। শামুক কুড়াতে কুড়াতে চষে বেড়াতাম কয়েক মাইল। কখনো চষা ক্ষেত। কখনো ক্ষেতের আল। কখনো বাড়ির পাশের ডোবা-নালা। কখনো দীঘির পানিতে ডুব দিয়ে ঝিনুক কুড়ানো। বৃথা মুক্তা খোঁজা শেষে ঝিনুকগুলো হাঁসের মুখে তুলে দিতাম।

আচ্ছা, তোরা কি কখনো শামুক বা ঝিনুক খেয়েছিস? আমার খুব খেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু খাওয়া হয়নি কোনদিন।"

-থুঃ। শালা হাঁসের বাচ্চা পালত আর মনে মনে হাঁস হবার বাসনা করত। খাইতি কয়টা শামুক। কেউ তো দেখতো না। তুই আসলেই একটা রাবিশ! -এবার শাকিল নিজেই ফোঁড়ন কাটে।

নিতু বলে উঠে,
- নিজেরই হাঁস হবার জোগাড়, আবার হাঁসের বাচ্চা মানুষ করা! এ কথায় সবাই একসাথে হেসে উঠে। হঠাৎ মনে হল পুরো টিএসসি ওদের দেখে নিল এক নজর।
-আরে বাবা! এত খ্যাপার কি হল! আমার তখন খাইতে ইচ্ছে করত। তাই বল্লাম। একজন পানির নীচে ডুব সাঁতার কেটে প্রেম করত। আরেকজন মায়ের কান মলা খাইত। তাতে দোষ হয়নাই আর আমার শামুক খাইতে মন চাইছে তাতেই দোষ!
-মানিক! ফালতু কথা বলবি না। ডুব সাঁতার কেটে প্রেম করত কে ? গাধা কোথাকার! আমি কি বলছি আর তুই কি বুঝছস ! এই জন্যই বলে, ছেলেরা মেয়েদের কখনো ভাল বন্ধু হতে পারেনা।
-উনি যেন কোনদিন মায়ের মাইর খায় নাই। কান মলা খাওয়া আর শামুক খাওয়া কি এক নাকি ? গর্দভ কোথাকার!
-ধুর শালা! আমি বুঝলাম না সবাই মিলে আমার পিছনে লাগলি কেন! আমি সেন্সর করে বললে কি তোরা আসল জিনিস পাইতি ? আমি তখন যা ছিলাম হুবহু তা-ই বলতে চেয়েছি। আর তোরা সেই সুযোগ নিলি। আবার সবাই একসাথে আমার পিছে লাগলি! এসব কিন্তু ঠিকনা।

আরো কিছুক্ষণ ওদের ঝগড়া চলে। এক সময় সবাই নিজেদেরকে সংযত করলে আসে ফরিদের পর্ব।

"ধুর ! আমি তোদের মত লিখতে টিখতে পারিনা। আমার যা বলার আমি এমনিতেই বলছি-
আমার বর্ষার স্মৃতি মানেই তাল কুড়ানো আর ডাব চুরি করা। মনে কর, ঘরে বসে লুডু খেলছি। কিন্তু কান খাড়া। হঠাৎ তাল পড়ল। দৌড়ে সবার আগে গাছের নীচে। দুইজন সেইম টাইমে গেলে মারামারি করে তাল ছিনতাই করতাম। আবার মনে কর, বৃষ্টিতে রাতের অন্ধকারে অন্যের গাছ থেকে ডাব চুরি করতে হেভি মজা লাগত।"

-শালা চোর একটা! হলের ডাবগুলা মনে হয় তোর পেটেই বেশি যায়।
-আবার ঝগড়া শুরু করবি ? মানিক, সবাই মিলে তোরে যখন ধুইছে আমি কিন্তু কিছু বলিনাই। আমার মুখ ছুটাইসনা। তোরা সবগুলা মিল্যা কিন্তু আমার সাথে পারবিনা।
-ঠিক আছে বাবা আর একবার চোর বলে আর বলবনা।
-কি কইলি! ফাওখোর! ডাইলের ব্যবসা কর আর আমারে কও চোর !
- দোস্ত মাফ চাই। এইবারের মত মাফ কর। এই কানে ধরলাম। আর আগাইসনা। খোদার কসম আর কোনদিন তোরে চোর কমুনা।
-আবার !
-ভুল হইয়া গেছে। আর কমুনা। প্লিইজ !

এমন সময় আমার মুঠোফোনের শব্দে ওরা দু-তিনজন এদিকে তাকায়। আমি ওদের কথা শুনছি কিনা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কাটায় কিছু মুহুর্ত। অপরপ্রান্ত থেকে জানানো হয় বৈরী আবহাওয়ার কারণে আজকের মিটিং বাতিল করা হয়েছে। আমি উঠে যাবার বদলে, কেউ এস পড়ল বলে, এমন ভাব নিয়ে বসে থাকি। ওরাও আমাকে বাদ দিয়ে মগ্ন হয়ে পড়ে নিজেদের নিয়ে।

এবার আসে ট্যুরের হোস্ট শাকিলের পালা। হাতে ধরা লেখাটার দিকে একনজর বুলিয়ে শুরু করে-

"মাছ ধরছি। বড়শি হাতে। কেঁচো দিয়ে শিং, কৈ মাগুর ধরার আপ্রাণ চেষ্টা। মাছ না পেয়ে আল্লার উপর অভিমান। নানু বাড়ি থেকে শিখে আসা ‘সবার বড়ি কালাছালা আমার বড়ি হুইড্ডামালা টক্কস কইরা গিল্যা ফ্যালা’ মন্তর পড়ে বড়সিতে ঝাঁড়-ফুক। বৃষ্টিতে ভিজে একা দাঁড়িয়ে থাকা। উদোম আকাশের নীচে উদোম আদম ! এখনো চোখ বন্ধ করলে যেন দেখতে পাই বাড়ির পেছনের কাঁঠাল গাছ তলে একা দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোর।"

-এইবার তোর বাড়িতে গিয়ে মাছ ধরব। দেখি কে বেশি মাছ পায়। ওহ! আমার তো বলতে মনেই নাই শুধু ডাব না মাছ চুরিতেও আমি ছিলাম ওস্তাদ। আচ্ছা তুই কি রাতে মাছ মারতে বের হয়েছিলি কোনদিন ?
-কতদিন বের হইছি!
- আমি একবার আমার চেয়ে বড় একটা বোয়াল মাছ ধরছিলাম। কথাটা যখন উঠলোই গল্পটা শোন তাইলে-

-সেদিন ছিল হাটবার। সন্ধ্যার সময় মেঘের ডাক আর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। মেঘের ডাক মানেই হল সব মাছ পুকুর-খাল থেকে বিলে উঠে আসে।
-তোর বলতে হবেনা। সেটা আমরা জানি। বর্ষার শুরুর দিকে প্রথম প্রথম যখন বৃষ্টি হয় তখন মেঘের ডাকে সব মাছ উজানের দিকে লাফাতে লাফাতে চলতে থাকে- শাকিল যেন একটু বিরক্ত !
- ঠিক আছে ফরিদের গল্পটা বলতে দে- বলে মানিক।
-আচ্ছা বল তাইলে।
"আমি আর বড় ভাই মিলে একটা ছেনি, পলপা, তিন ব্যাটারির টর্চ লাইট নিয়া গায়ে একটা পলিথিন চাপাইয়া দিয়া বাইর হইছি।"
-পলপা কিরে ? সিমুর প্রশ্ন।
-পলপা হলো বাঁশ দিয়ে বানানো মাছ ধরার একটা জিনিস-ব্যাখ্যা করে ফরিদ। তারপর আবার শুরু করে-

"আমাগো বাড়ির পিছে যে বিলটা ওইটা থেকে একটা নালা দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ছিল খালে। সেই পানি ঠেলে, মনে কর, কয়েকটা বোয়াল মাছ উঠছিল বিলে।টের পেয়ে তাড়াতাড়ি নালার সামনে জাল পাতলাম। তারপর আর যায় কই। যেই ক্ষেতে উঠছিল সেই ক্ষেতে চারদিকে উঁচু আইল থাকায় কোথাও যেতে পারেনি। পাঁচটা বোয়াল মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম সেদিন। সবচেয়ে বড়টা আমার চেয়ে বড় ছিল।"

-এ্যাঁ চাপাবাজ! প্রথমে যা বললি তাতে তো জাল ছিলনা পরে জাল আসল কোত্থেকে ?
-ওহহো বলতে মনে ছিলনা।
-মনে ছিলনা নাকি চাপাবাজী ! আমি বাজী ধরে বলতে পারি তুই জীবনে মাছই ধরিসনি।
-ঠিক আছে বাজী। তোদের বাড়িতে এবার মাছ ধরার প্রতিযোগিতা হবে। তুই কেন, এখানকার কেউই আমার সাথে মাছ ধরায় পারবেনা।

-ভিজে ভিজে মাছ ধরলে ঠান্ডা লাগতনা।
-তুই যে ভিজে ভিজে আম কুড়াইতে গেছিলি তোর ঠান্ডা লাগছিল ?
-এখন কি আর মনে আছে অত ছোটবেলার কথা!
-তখন এসব অভ্যাস হয়ে গেছিল তাই কোন জ্বর হইতনা। আর তাছাড়া সেই দিন পেপারে পড়লাম বৃষ্টিতে ভেজার সাথে জ্বর হবার কোন সম্পর্ক নেই। এটা আমাদের মনে বাসা বেঁধে আছে বলেই জ্বর হয়। নাইলে হইতনা।
-তুই আবার মানসিক ডাক্তার হইলি কবে থেকে? আমি তো জানি তুই পড়িস ইতিহাসে। আজকাল কি তোদের স্যাররা ইতিহাস রেখে মনস্তত্ব পড়ানো শুরু করেছে নাকি!
-তোদের এই এক সমস্যা সব কিছুতেই খুঁত ধরতে হবে। গাধা! ওইটা পেপারে পড়ছি। কাটিং ও রাখছি সাথে। হলে চল এখনি দেখাবো।
-ওরে আমার নদুরে। চান্স পাইলেই খালি হলে দাওয়াত ! মেয়েদেরকে হলে নিতে পারলে কি ইমেজ বাড়ে নাকি !
-দ্যাখ নিতু! তুই কিন্তু বেশি বাড়ছিস। উল্টাসিধা কথা বললে কিন্তু নাক ফাটাইয়া দিমু।
-তোমার ক্যাডারবাজি রাখো! সব কিছুতে এত উগ্র হওয়া ভাল না। এমন ফাল পারলে কোন মেয়ে তোমার হলে কেন, বাড়িতেও যাবেনা। সারা জীবন বিয়া না কইরা ঠুন্ডা হইয়া থাকতে হবে।
-তোর মত মেয়েরে জীবনেও বিয়া করুমনা আমি। যেই ডাইনীর মত হাবভাব ! কোনদিন না আমারেই জবাই কইরা খাইয়া ফালাস।
- ভয় পাস তাইলে আমারে ? মনে রাখিস কিন্তু! আমারে নিয়া উল্টাপাল্টা কথা কইলে তোর কিন্তু সত্যি সত্যি খবর কইরা ছাইড়া দিমু। এমন চেঙ্গি দিমু সারা জীবন মেয়ে দেখলে খালি প্রলাপ বকতে থাকবি।
-হইছে আর ভয় দেখাইতে হইবেনা। আমি ভয়ে কাপড় নষ্ট কইরা ফালাইছি। এইবার জুয়েলেরটা শুনি। কিরে জুয়েল তুই তো বেশি কিছু লিখস নাই। আমি তো ভাবছিলাম তোর বর্ষার স্মৃতি হবে সবার চেয়ে আকর্ষনীয়। নদীর পাড়ের মানুষদের তো বর্ষার অভিজ্ঞতা অনেক দারুণ হবার কথা!
-আচ্ছা হইছে ! শাকিল বলে উঠে, সবাই এবার থাম জুয়েলরে বলতে দে-

পুরো আসরজুড়ে চুপ করে থাকা জুয়েল তার লেখার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে-

"বর্ষা নিয়ে বলার মত তেমন কোন স্মৃতি নেই আমার। শুধু মনে আছে, বৃষ্টিতে ভিজে পাড়ি দিচ্ছি জনম জনমের দুঃখ। ঘর-বাড়ি পেছনে ফেলে মালামাল নিয়ে চলে যাচ্ছি নতুন ঠিকানায়। নদী ভেঙ্গে নিচ্ছে বসতবাড়ি, বাপ-দাদার ভিটে মাটি, গরুর গোয়াল, ফসলের ক্ষেত। ভেঙ্গে নিচ্ছে আমার শৈশব। নদী ভাঙ্গা মানুষ আমি। শিকস্তি !"

- ও মাই গড! তোরা নদী ভাঙ্গা মানুষ ! প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে সিমু, তারপর কোথায় উঠলি ?
- বাবা কৃষি কাজ করতেন।এক বর্ষার মধ্যেই বাড়ির সাথে সাথে সব ধানী জমিও নদীর পেটে চলে যায়। নদী ভাঙ্গায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন বাবা। মাস দুয়েকের মধ্যে মারা যান। আমাদের হেড স্যার খুব ভাল মানুষ ছিলেন। তার বাড়িতে আমাকে আর মাকে থাকতে দিয়েছিলেন। মা স্যারের বাসায় কাজ করতো। আমি জমিতে। যেদিন এসএসসির রেজাল্ট হলো মা একটুও হাসেননি। টানা তিনদিন কিছু খেতে পারেননি। শুধু কেঁদেছেন। বারবার বলেছেন-তোর বাবা বেঁচে থাকলে কী যে খুশী হত!

সবার চেহারায় নেমে আসে সহানুভূতির করুণ চিত্র। জুয়েলের চোখে জমেছে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা। থেমে গেছে ওর কথা। সবাই নিরব। নিরবতা ভেঙ্গে নিতু বলে-
-তোর মা এখন কোথায় থাকে ?
-মা বেঁচে নেই রে! বলে দুহাতে মুখ ঢাকে । কান্নার দমকে কেঁপে উঠে শরীর। সবাই নিরব ভাষায় তাকিয়ে থাকে। নিতু আস্তে হাত রাখে জুয়েলের কাঁধে।

এমন সময় বৃষ্টি থেমে এলে অনেক আটকেপড়ার মত আমিও বের হয়ে আসি টিএসসি থেকে। আমার কখনো জানা হবেনা ওরা সেবার সত্যিই বৃষ্টিউৎসবে মেতে উঠেছিল কিনা। তবে আমি জানি, যে বর্ষা নদী আর বন্যার সাথে হাত মিলিয়ে এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহহীন করেছে তার আগমনে আমি কখনো হয়তো আর হেসে উঠতে পারবনা। বর্ষার এক পিঠে জীবনের জয়গান আরেক পিঠে মৃত্যুর হাহাকার। এ যেন এক নির্মম প্যারাডক্স!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আহমেদ সাবের রোজা এবং অসুস্থতার কারণে বর্ষা সংখ্যার বেশীর ভাগ লেখাই অপঠিত রয়ে গেছে। ক্ষুধা সংখ্যার সব লেখা শেষ করে বর্ষা সংখ্যার সেরা ২৫ লেখা পড়তে শুরু করলাম। আপনার লেখা সব সময়ই ভাল লাগে। এটাও ব্যতিক্রম নয়। যেন অনেকগুলো স্রোত ধারা মিশে একটা নদীর সৃষ্টি করেছে। আর জীবন তো প্যারাডক্সই। নদীর এপার ভাঙ্গে ওপার গড়ে, এইতো নদীর খেলা। আর জীবন তো বহতা নদীই।
ভালো লাগেনি ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১
ইরতিয়ায দস্তগীর দারুণ একটা গল্প!
মৃন্ময় মিজান বেচারা নিতু আরো কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে আমার মনেও।নিতু চরিত্রটা একটু স্টাডি করলেই আরো অনেক প্রশ্ন জমা হবে কিংবা আপনার প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন। @নাজমুল এবং প্রজ্ঞা ।
amar ami আমার বৃষ্টিতে আম কুড়ানো, বৃষ্টিতে ভিজে খেলা, নদীতে দাড়িয়ে বা ডুব দিয়ে বৃষ্টির শব্দ শোনার সৃতি আছে ...গল্প টি পরে সে সবই মনে পড়লো
নাজমুল হাসান নিরো প্রথম দিকটা একেবারেই কিন্তু নষ্টালজিক করে দেয়ার মত হয়েছিল। জুয়েলের বেলাতে অনুভূতিটাই একদম পাল্টে গেল। টুকরো টুকরো স্মৃতির ঝরঝরে বর্ণনা যথেষ্ট ভাল লেগেছে। কিন্তু দাদা ঐ নিতু এক সাথে আম আর তাল কুড়াল কেমনে? আম তো হয় জৈষ্ঠ মাসে, আর তাল তো হয় ভাদ্র মাসে। আহুম.................
খন্দকার নাহিদ হোসেন মিজান ভাই, গল্প আপনি বরাবরই ভালো লেখেন। এ গল্পটাও অনেক ভালো লাগলো। একজন গল্পকারের বর্ণনা যখন পাঠকেরা নিজেদের সাথে মেলাতে শুরু করে তখন তো বলতেই হয় গল্পকার স্বার্থক। ভালো থাকুন।
কৃষ্ণ কুমার গুপ্ত অনেক সুন্দর লিখেছেন। খুব ভাল লাগলো। ভাল থাকবেন। শুভ কামনা রইলো।
মৃন্ময় মিজান @ বিন আরফান, প্যারাডক্স মানে হল পরস্পরবিরোধী / আপাতবিরোধী সত্য।
Rahela chowdhury অসাধারণ প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।আমার শৈশবে দেখা বর্ষার চিত্রের মিল আমি আপনার লেখাতে পেয়েছি।
শায়ের আমান বড় লেখা, ভালো লেখা। ভালো লিখুন সবসময়।

১০ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী