কয়েকটি রাত কেটে গেল জেলখানাতে। যেকোন পরিস্থিতিতে মুকুটের মানিয়ে নেবার অসম্ভব ক্ষমতা আছে। পাশের তিনজন মানুষ শান্ত ভাবেই বসে আছে কিন্তু মুকুটের সময় আজ আর কাটছেনা । আজীবন স্বেচ্ছায় চলা নিজেকে বন্দী ভাবতেই অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। জেলখানার একটা জানালা দেয়া রুম হলেও...। রাত গভীর হচ্ছে। দিনের বেলা ঘড়ির কাঁটাটি হৃদপিণ্ডের সাথে তাল মিলিয়ে আস্তে চললেও এই নিশীথে তা টিকটিক করে ক্রমেই জোরালোভাবে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। অবশ্য না দিলেও হত। কারণ আবাল্য সঙ্গী এই ঘড়িটিকে মুকুট নিজের কোন প্রত্যঙ্গের চেয়ে আলাদা ভাবেননা । ঘড়িটির ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে যেদিন প্রথম ঘড়িটি হাতে দেয় সেদিনও তিনি অত্যন্ত অস্থিরতায় ভুগেছিলেন । তারপর শ্যামদেশে যুদ্ধ লাগলে মুকুট স্বাধীনতা ঘোষনা করা ছোট্ট দেশটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়। অস্থায়ী কার্যালয়ে সবাই সেখানকার সময় অনুযায়ী ঘড়ির কাঁটা পরিবর্তন করলেও মুকু্ট তাঁর দেশের সময় অনুযায়ী চলেছেন। ঘড়িটা শুধু হাত থেকে বুকপকেটে স্থান পেয়েছিল ফেলে আসা স্বদেশের মতই। বাড়ি থেকে চলে আসার সময় জোহরাকে বলে আসেননি। শুধু চিঠি লিখে এসেছিলেন স্বাধীন দেশে দেখা হবার আশ্বাস দিয়ে। তার অনুরোধ রেখে সাত কোটি জনতার সাথে জোহরা মিশে গিয়েছিল অভিমান না করেই । তারপর কাকতালীয়ভাবে যুদ্ধের সময় খুব কাছাকাছি অবস্থান করলেও তিনি দেখা করেননি তার সাথে। এ নিয়েও জোহরার কষ্ট নেই কারণ মানুষটার অদ্ভুত রকম দেশপ্রেম সে ভাল করেই উপলব্ধি করেছিল। মুকুট অত্যন্ত অভিমানী । বাইরে থেকে দেখলে ইস্পাত কঠিন কিন্তু ভেতরটা শিশুর মতই স্পর্শকাতর। তাই স্বাধীন দেশে নেতা যখন সুবিধাভোগী কিছু চাটুকারের কথায় চলতে লাগলেন মুকুট অভিমানে দূরে সরে গিয়েছিলেন । আর কাছে আসা হয়নি তাঁদের । নেতা মুকুটের অভিমান বুঝতে পারলে শ্যামদেশের ইতিহাস আরো অন্যরকম হতে পারত । যে ইতিহাস সফলতার ইতিহাস, যে ইতিহাস কৃতজ্ঞ এক জাতির ইতিহাস। নভেম্বর মাসেই এবার ভাল শীত পড়েছে । সঙ্গী তিনজন কুঁকড়ে শুয়ে আছেন জেলখানার মেঝেতে । মুকুট পাহাড়ী এলাকায় বেড়ে উঠেছে বলেই শীতে কাতর হননি। ভারী বুটের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । ক্রমেই এগিয়ে আসছে শব্দ । মুকুট জানেন কিছুক্ষনের মাঝেই তার ঘড়িটার টিকটিক ঢেকে যাবে মিলিটারী বুটের শব্দে । তারপর অনুরোধ, তর্জন গর্জন এবং হুমকির মাধ্যমে শেষ হবে নতুন সরকারে যোগ দেবার আহবান । একদা সদ্য স্বাধীন শ্যামদেশ সফরে এসেছিলেন ক্ষমতাধর দেশের এক মন্ত্রী যারা বিরোধিতা করেছিল যুদ্ধের সময় । মন্ত্রীর সাহায্য দিতে চাওয়ার জবাবে মুকুট শক্ত মুখে বলেছিলেন চাল, আটা বা কম্বল নয় যুদ্ধের সময় আমাদের গরুগুলি পালিয়ে গেছে তাই গরু বেঁধে রাখার দড়ি চাই আমাদের । বিদেশী মন্ত্রীর সাদা মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল এই অপমানে । এখনো তিনি রোজ রাতে মুখ শক্ত করে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন আর তাঁর দিকেই মিলিটারি অফিসাররা বেশী আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে । তাঁর যোগদানের মাধ্যমেই নেতাকে হত্যা করে তৈরী করা এই অবৈধ সরকার বৈধ হতে পারে । কিন্তু মুকুট এবং তার সঙ্গীরা ক্ষমতার লোভে নীতির সাথে দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না এই সত্যিটি এতদিনে সবাই বুঝে গেছে । দূরে কে যেন শব্দ করে কাঁদছে আজ । টর্চার অথবা হয়তো কোন প্রিয়জনের কথা মনে পড়ছে। অথবা অন্যকিছু । সেলের দরজা খুলে গেল গভীর রাতে। আজ আর পুরনো কেউ নয় প্রবেশ করল টি আহমেদ কয়েকজন অফিসার নিয়ে । অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র এই টি আহমেদ। লন্ডনে পড়া বাদ দিয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। আজ সে এসেছে দেশদ্রোহীর ভূমিকা নিয়ে । মুকুটের ঘড়ির টিকটিক কিছুক্ষণের জন্য ঢেকে গেল গুলির শব্দে। পানি পানি বলে কেউ একজন আর্তনাদ করছে । কে? কণ্ঠস্বরটি চেনার চেষ্টা করতে লাগলেন মুকুট। নজরুল ভাই নাকি কামরুজ্জামান? সমস্ত চেতনা বিলোপ হবার আগে একটিবার মাটি স্পর্শ করার চেষ্টা করলেন তিনি । একসময় সব নিরব হয়ে গেলেও ঘড়িটি থেমে যায়না । হারিয়ে যাওয়া দেশপ্রেমের মত ঘড়িটিও হয়তো কোন পরিত্যক্ত কোণ থেকে আজও ডেকে উঠে টিকটিক করে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।