জিমি স্যার মারা গেছে । নুরুর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছেনা । উল্টিয়ে পালটিয়ে, বুকের কাছে হাত রেখে অনেক ভাবেই নুরু চেষ্টা করছে তার ধারনা ভুল প্রমাণ করতে । কিন্তু না, আজ আর জিমি স্যার খেঁকিয়ে উঠল না । নিঃসাড় ভাবে পড়ে রইল সদ্য সমাপ্ত চৌবাচ্চাটির পাশে । বিষয়টি নিশ্চিন্ত হবার পর প্রথমেই নুরু পালিয়ে যাবার কথা ভাবল । অনেকদূরে চলে যাবে সে যেখানে তার খোঁজ কেউ পাবেনা । কিন্তু তার মন ঠিকই বুঝতে পারল যেকোন স্থান থেকেই হোক তাকে খুঁজে বের করার ক্ষমতা জিমি স্যারের প্রতিপালক রাখে । নুরুর দায়িত্ব ছিল জিমিকে দেখাশুনা করা । আজ জোহরের নামায পড়ে বাসায় ফিরে দেখে জিমি পানিভরা নতুন চৌবাচ্চাটির ভেতর ভেসে আছে । গায়ের ধবধবে সাদা রঙ চৌবাচ্চার সাথে মিশে গেছে । মুখটা হাঁ করে আছে । দেখে হাসি পেয়ে গেল তার । মনে মনে একটা অশ্লীল গালি দিল “ কুত্তার বাচ্চা ! “ পরক্ষনেই বুকের ভেতর ভয় আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠল । সত্যি মারা গেছে ! একটু পরেই বড় স্যার ম্যাডাম জিমিকে দেখতে আসার কথা । কল্পনা করল সে ম্যাডাম চিৎকার করে বিলাপ করছে । তারপর নুরুর উপর নজর পড়তেই বলবে , “ ওকে পানিতে চুবিয়ে রাখ দশ মিনিট ধরে । যতক্ষন আমার জিমি কষ্ট পেয়েছে ওকে ততক্ষন কষ্ট দে । “ বলা যায়না বেকুব ড্রাইভারটা আবার সে নির্দেশ পালন করতে ছুটেও আসতে পারে । স্যার হয়তো শোকে কথা হারিয়ে ফেলবে । জিমি বড় প্রিয় স্যার ম্যাডামের । নুরুর দুর্ভাগ্য এই প্রথম নয় । স্কুলে পড়ুয়া তার ছোট বোনটি সকাল বিকেল রাত টিউশনি করে তিন হাজার টাকা জমিয়েছিল । মা বোনকে বুঝিয়ে সে টাকা ডেসটিনিতে লগ্নি করেছিল নুরু এক বন্ধুর মাধ্যমে । মূল টাকা তো গেলই এক টাকার সুতো পর্যন্ত আনতে পারলনা । সে বছরই এস, এস, সি পরীক্ষা দেবার আগের দিন তার স্কুলের ড্রেসটি চুরি হয়ে গেল । নুরু কান পেতে আছে বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা যাবার আতঙ্ক নিয়ে । এক একটা দিন প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়ে রাখে অকৃপনভাবে । এবং নুরু লক্ষ্য করেছে তার জীবনের সংকটকালীন সময়েই এটা বেশি হয় । চিলেকোঠার জানালায় আজ নীল আকাশের ঝকঝকে ছায়া পড়ে আছে আঁকা ছবির মতন । ছাদের উপর করা ছোট চিড়িয়াখানার পাখিরা মাঝে মাঝে ডানা ঝাপটে উঠছে, বানর স্বভাব মত মুখ ভেংচে দিল তার দিকে তাকিয়ে । তিতির আর ময়ূর এই মুহূর্তে বন্ধুর মত পাশাপাশি বসে আছে আলস্যভরে । এত চমৎকার একটি দিনে নুরুর চোখে পানি চলে এল । জীবনে আর কতবার হারবে সে ! ঈশ্বরকে একটি জিজ্ঞাসাই তার , কেন তার ভাগ্য এত খারাপ । বাবার সাথে কথা বন্ধ আজ সাড়ে তিন বছর । ভাই বোন কে কোথায় আছে তা জানেনা অনেকদিন হল । এক দরদী মা আছে । নুরুর জন্য কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেললেও দেখা পান না । বিমানের উচ্চ শব্দে ভাবনায় বাধা পড়ল তার । এয়ারপোর্টের অতি নিকটে এই বাসাটিতে বিমান উঠা নামা দেখা যায় ছাদে দাঁড়িয়ে । এক একটা বিমান হংস মিথুনের মত উড়ে যায় । রাত নেমে এলে এই নগরীতে হাজার বাতিতে রানওয়ে আলোকিত হয় । তবু এই আলো কিছুতেই সেই আলোর মত নয় । যা সে দেখেছিল দুবাই থেকে ফিরে আসার পথে । বাবার শেষ সম্বল আড়াই লাখ টাকা সে অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে, কান্নাকাটি করে আদায় করেছিল দুবাই গিয়ে অবস্থা ফেরাবে বলে । তার অতি অপ্রসন্ন ভাগ্যটিও সাথেই গিয়েছিল অজান্তে । তারপর তিন মাস কাজ করার পর ভিসা জাল ধরা পড়ায় দেশে পাঠিয়ে দেয়া হল তাকে এক কাপড়ে নিঃস্ব অবস্থায় । মর্মান্তিক দুঃখে নুরুর যখন বুক জ্বালা করছিল কোম্পানির ম্যানেজার দয়াপরশ হয়ে বলেছিল নুরুকে সে আবার দুবাই আনার ব্যবস্থা করবে । সেটা যে সান্ত্বনার বাক্য ছোট শিশুও তা বুঝবে । ফেরার পথে বিমানে বসে ভাবছিল বাবার সামনে দাঁড়াবে কি করে । এত জীবন স্বপ্ন দেখেছে আর সব প্রবাসীর মত বাবা মা ভাই বোন ভাগ্নীদের জন্য কত কিছু সে নিয়ে যাবে দেশে যাবার সময় । সবার বিস্মিত, শ্রদ্ধাবনত দৃষ্টির সামনে সে প্রত্যেকের নাম লেখা উপহারের প্যাকেট বের করবে আর আনন্দের বন্যা বইবে পরিবারে । কিন্তু কি হল ! হায় খোদা, আমাকে তুমি এমন কষ্টে ফেললে কেন ? বিধাতার প্রতি অত্যন্ত অভিমান নিয়ে সে বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেছিল এক টুকরো স্বর্গ যেন নেমে এসেছে পৃথিবীতে । কোটি কোটি আলোর ঝলসানিতে মরুভূমির শহর দুবাই স্বর্গোদ্যান হয়ে উঠেছে । সব কিছু ভুলে গেলেও অনিন্দ্যসুন্দর এই দৃশ্য তার মনে আঁকা থাকবে সারাজীবন । হায় দুবাই ! জিমির মৃতদেহ নিয়ে কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল । এরই মাঝে পিয়ন এসে চিঠি দিয়ে গেল । অন্যদিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখলেও আজ সে প্রাপক বা প্রেরক কিছুই দেখলনা । চুপচাপ চিলেকোঠার কাচের জানালায় দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে দেখতে লাগল । গোধূলির লাল ধরা পড়া ক্যানভাসের মত সেখানে রঙের আনাগোনা । এক নিপুন শিল্পী ছবি এঁকে যাচ্ছে সেখানে । তার জীবনটা কেন ছবির মত সুন্দর আর নিশ্চিন্ত নয় ? সেদিকে তাকিয়ে থেকে থেকে হঠাত নুরুর মন প্রথমবারের মত কিছু অনুভব করল । তারও মানুষের মত বাঁচার অধিকার আছে । আজ স্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলবে একটা সন্মানজনক কাজ তার প্রাপ্য । দরিদ্র পরিবারে থেকে বিএ পাশ করে জিমি নামক কুকুরের দেখাশোনার বিনিময়ে মাসে তিন হাজার টাকা তার ভাগ্য হতে পারেনা । তা সে বিলিতি বা দেশি কুকুর যাই হোক । তার খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা মালিককে সরাসরি প্রশ্ন করবে একাত্তরে তারা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল এটা সেই দেশ কিনা । যে সন্মান এবং সম্মানী পেয়েছে বারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা মুক্তিযোদ্ধারা এটুকুই তারা চেয়েছিল কিনা । তাহলে কেন এত রক্ত দিল এই জাতি ? কতটুকু পেয়েছে সাধারণ মানুষ ? ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে সে বলবে এই দেশে অনেক অভাবী শিশু আছে যারা কুকুর বা বানরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ । একটি কুকুরের মৃত্যতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়না । কুকুরকে নাম ধরে বা সন্মান দিয়ে স্যার ডাকলেও সে আসলে কুকুরই থেকে যায় ।
জীবনে প্রথম সংকোচহীনতা এখন নুরুর চোখে । সত্য বলার সাহস তাকে কিছুক্ষনেই রুপান্তর করে দিয়েছে নতুন প্রজন্মের যোদ্ধায় । স্বাধীন দেশে মুক্তি কেন আসেনি এই সরল প্রশ্নের জবাব চাইবার ভাবনায় সে খেয়াল করেনি তার নামে দুবাই থেকে আসা চিঠিটি পড়ে আছে পাশে । সেখানে কোন এক কোম্পানির ম্যানেজার লিখেছে নুরুর জন্য সে জাল নয় সত্যিকারের ভিসা পাঠিয়েছে । স্বপ্নভাঙ্গা দেশটিতে সে এবার যেতে পারবে । কোম্পানী সব খরচ বহন করবে তার ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সেলিনা ইসলাম
'মুক্তিযোদ্ধা'কথাটি কারো কারো কাছে অনেক বেশী সম্মানের আবার জিমির প্রভুর কাছে এটা শুধুই খেতাব! হয়ত সমাজে একটা জায়গা দখল করার জন্য! একজন ফেক মুক্তিযোদ্ধা সেতো রাজাকারই! আমাদের সমাজে হাজারো নুরুর দেখা পাওয়া যেমন আশ্চর্যের কিছু নয় তেমনিভাবে তার স্যারের মত মুক্তিযোদ্ধাও আমাদেরকে বিস্মিত করে না। গল্পের মাঝে অনেক বেশী কাব্যিকতা গল্পকে কঠিন করে তুলেছে। সব মিলিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী গল্পটা বেশ ভাল লাগল । শুভকামনা
তাপসকিরণ রায়
যুদ্ধ বা যোদ্ধার কথা তেমন না থাকলেও--ভালো লেগেছে গল্পটি.ছোট গল্পের ভাবনাগুলি লেখক তাঁর সুন্দর ভাব ভাষায় ভরিয়ে তুলেছেন.গল্পের ধারাবাহিকতাও বেশ ভালো লাগলো.ধন্যবাদ জানাই লেখককে.
আহমেদ সাবের
গল্পকার না বললেও প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল, জিমি স্যার একটা কুকুর, বিশেষ করে জিমি নামের জন্য। গল্পটার ট্যুইষ্ট, নুরুর হঠাৎ করে মানুষ হয়ে উঠা। গল্পকার দেখাতে চেয়েছিলেন কি না জানি না, তবে গল্পটায় একটা অসাধারণ বক্তব্য আছে। নুরুর মত আমরা সবাই অমিত সম্ভাবনার সূর্যালোককে (দুবাই থেকে আসা চিঠিটি) অবহেলায় পাশে রেখে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে শুধু হা-হুতাশ করি। অনেকদিন পর আপনার গল্প পেলাম আবার। বেশ ভালো লাগলো গল্পটা।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।