কেতিদের বাড়ির চিৎকারে কান পাতা যাচ্ছে না । রেডিওর অনুষ্ঠানের মত বিরতিহীনভাবে চলছে তর্কাতর্কি । বিষয়টি হল ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে খালেক মিয়া দুইটা যাকাতের শাড়ী নিয়ে এসেছে । তার মালিকানা নিয়ে চলছে ঝগড়া । একটা বউয়ের জন্য আর একটা মায়ের জন্য এই কথা বলেই দিয়েছিল যাকাতদাতা শাড়ী দেবার সময় । কিন্তু খালেক মিয়ার মা যার বয়সের কোন হিসেব নেই, কেউ বলে নব্বই কেউ এক কাঠি বাড়িয়ে একেবারে একশ । সেই শয্যাশায়ী অন্ধ বুড়ো শাশুড়ির নতুন শাড়ীর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে না পারায় খালেক মিয়ার বউ সেই শাড়ী নিজের জন্য লুকিয়ে ফেলেছে । এই খবরটি জানাজানি হওয়ায় অন্যান্য ছেলের বউরা ভীষন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে । তাই চার ছেলের বউয়ের চেঁচামেচি বাড়ীটিকে ইতিমধ্যে বাজার করে তুলেছে । আক্কির মা চিল গলায় বলছে “ আমরা কি আর না বুঝা ! শাড়ীখান নিজের মায়ের জন্য তুইল্যা রাখছে । “ আর দুই বউ তাতে সায় দিয়ে বলে “ফকিরের ঘর থেকে আইছে আবার জমিদারের মাইয়ার মত ফুটানি করছে এদ্দিন । অর ভাইটাও চোর । “ নিতান্তই ধরা পড়ে গিয়ে খালেকের বউ অবশেষে শাড়ীটা বের করে শাশুড়ির পায়ের কাছে রেখে আসে । অন্য মহিলারাও শাড়ীটি এবার নেড়ে চেড়ে দেখে । কি সুন্দর নীল রঙ ! আঁচলে সোনালী কারুকাজ আর জমিন সাদা নীলে মেশানো । দেখে মনে হচ্ছে অন্যসব যাকাতের শাড়ীর মত কম দামী নয় । প্রায় সবারই সূক্ষ্ম ঈর্ষা হতে থাকে এত সুন্দর একটি শাড়ীর মালিক বিছানায় পড়া অন্ধ চন্দ্রভান বিবি বলে । তার কাছে নতুন শাড়ীই কি আর পুরনোই বা কি । সবই এক ।
শোনা যাচ্ছে কাল ঈদ হবে । চন্দ্রভান শুয়ে আছে সংকীর্ণ বারান্দায় । তেল চিটচিটে প্রাগৈতিহাসিক আমলের একটা কাঁথা তার গায়ে । খড়ের উপর আরেকটা কাঁথা বিছিয়ে গরম বিছানা করা । তবু তার শীত করতে থাকে । ইশারায় কাউকে ডাকে কিন্তু কেউ আসেনা । কারন সবাই ব্যস্ত । তাকে নিয়ে চার ছেলে, ছেলের বউ ঘরে আলোচনায় বসেছে । সবই শুনতে পাচ্ছে সে । মাঝ খানে তন্দ্রা এসে স্মৃতি ভ্রষ্ট করে দিলেও সে ছোট ছেলে আবুলের গলা শুনে জেগে উঠে , “ আমার সাত পোলাপান নিয়া নিজেই খাইতে পাইনা আবার মারে দেখি কি কইর্যার । এইডা একটা বিবেচনার কথা বলছ মিয়া ভাই !...... “ খালেক মিয়া রাগান্বিত কন্ঠে বলে “ আমার একার ঘাড়েই মারে ফেলবি ক্যান ? টানতে পারিনা বলে মহাজন আজকাল রিকশাও দিতে চায়না । আমি চলি ক্যামনে ? তার উপর কতদিন হইল পোলাডার অসুখ । ডাক্তারও দেখাইতে পারি নাই । “ চিলের মত গলায় মালেকের বউ চিৎকার করে বলে, “ মায়ের ভাগের সম্পত্তি তো খালেক আর আবুলই ছল চাতুরী কইরা নিয়া বিক্রি কইরা খাইছে । তাইলে এখন মা’রে দেখেনা ক্যান ? “ অন্য দুই ছেলে মালেক এবং আবু বকর কি বলে তা জানার আগেই সে আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যায় । পূর্ণচন্দ্রের মত রুপ ছিল বলে নাম হয়েছিল তার চন্দ্রভান । আশে পাশে দু-দশ গ্রামে তার রুপের খ্যাতি ছিল । এখন অবশ্য দেখে বুঝার উপায় নেই । ছানি পড়ে দুচোখ অন্ধ, ঝুলে পড়া চামড়ার চন্দ্রভানকে সবাই কানী বলেই ডাকে । পনের বছর বয়সেই মোটামুটি সচ্ছল গেরস্তের দ্বিতীয় পক্ষের বউ হয়ে অহংকার তার আরো বেড়ে গিয়েছিল । নতুন শাড়ী পরে পান খেয়ে টুকটুকে মুখ নিয়ে ধান ভানত ঢেঁকিতে আর ঝিনুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা কন্যাকে নিয়ে শ্লোক বলত, “ পান পাতা গো সোনার মেয়ে কাছে আসনা ......। নিজেই জবাব দিত “ না গো মা, না গো মা কাছে আসবনা ।“ সবাই প্রশংসা করে বলত বউয়ের রুপের সাথে গুনও আছে । আহ ! এমন একটা বউ যদি আমাগো থাকত ! এই পড়শীরাই পরে নিন্দা করে বলত, বউয়ের মনটা এত শক্ত ! এক মুঠো চাল কখনো ফকির মিসকিনদের দান করেনা ।
চাঁদ উঠেনি তবু তার মনে হচ্ছে আকাশ গলে বুঝি জোছনা পড়ছে । মেঘের পাহাড় কেমন যেন মৃত স্বজনদের মুখের আকার ধারন করছে । হাত ছানি দিয়ে তাকে কে যেন ডাকল । কিন্তু তার ভয় করছে । শীত, আরো শীত লাগছে । আবার জেগে উঠে শুনল সে বড় ছেলের সংক্ষিপ্ত উচ্চারণ, সবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাল ঈদের দিন ঈদগার গেটের সামনে মাকে বসিয়ে দেয়া হবে । গ্রামবাসীরা নামাজ শেষ করে দান করে যাবে তার সামনে রাখা টিনের থালায় । মান্য গণ্য ব্যক্তিরা ঈদ উপলক্ষে গ্রামে আসবে । তাঁরা কি আর কম পয়সা দিব ? সেই পয়সা দিয়েই মায়ের খরচ চলবে অনেকদিন । চন্দ্রভানের সারা গা কাঁটা দিয়ে উঠে লজ্জায় । প্রাণ কন্ঠের কাছে এসে থেমে যায় পরের দিনের কথা ভেবে । কেউ কখনো ভাবতে পেরেছিল সোনাবরণ বউ ভিখারিনি হবে ! মালেকের বাবা তো বড়াই করে বলত, আমার ঘর কখনো আন্ধার হয়না এই বউ আছে তাই ! তবু তার প্রাণ হয়তো বের হয়না এই আশায়, এতগুলি ছেলের কেউ না কেউ শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদ করে বলবেই “ কেউ না পারলে আমি আমার মা’রে দেখমু । লাগলে আমি নিজে ভিক্ষা করমু তবু মা’রে এই অপমান হইতে দিমুনা । মা’রে কিছুতেই ভিক্ষা করতে দিমুনা । “ সবাই চুপচাপ । কে যেন জিজ্ঞেস করে , “ যাকাতের নয়া শাড়ীটাই তাইলে পড়ায়া নিয়া যামু নে ? অন্যগুলি তো......। “ আবার সুনসান নিরবতা নেমে আসে তাদের ঘরে , আঙ্গিনায় ।
চন্দ্রভান অন্ধ চোখের দৃষ্টি নিয়ে ব্যাকুলভাবে আশা করে থাকে কোন এক সন্তানের একটি প্রতিবাদের । অন্যদিকে তীব্রভাবে সে প্রতীক্ষাও করে হাতছানি দিয়ে ডাকা সেই আগন্তুকের জন্য, যে তাকে চান্নিপসর রাতের সব রহস্য ভেদ করে নিয়ে যাবে মেঘের উপর দিয়ে অন্য জগতে । এদিকে নীল সাদায় মেশানো অপূর্ব শাড়ীটি তার পায়ের স্পর্শে খসখস করে উঠে অস্তিত্তের জানান দেয় । তারপর চন্দ্রভানের মতই পড়ে থাকে নিশ্চল অপেক্ষায় । তখনই আঙ্গিনায় নাতি নাতনীরা চিৎকার করে জানান দেয়, চাঁদ উঠেছে, চাঁদ । নতুন চাঁদ ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি
চন্দ্রভান অন্ধ চোখের দৃষ্টি নিয়ে ব্যাকুলভাবে আশা করে থাকে কোন এক সন্তানের একটি প্রতিবাদের । অন্যদিকে তীব্রভাবে সে প্রতীক্ষাও করে হাতছানি দিয়ে ডাকা সেই আগন্তুকের জন্য, যে তাকে চান্নিপসর রাতের সব রহস্য ভেদ করে নিয়ে যাবে মেঘের উপর দিয়ে অন্য জগতে । .....Osadharon.... vinno sader matra jog khub sundor.........akta man sommto lekha............dhonnobad rowshon apnake...........
রোদের ছায়া (select 198766*667891 from DUAL)
চন্দ্রভানের জন্য মন কেমন করা অনুভুতি হল গল্পটা পড়ে। এমন ঘটনা ও যে ঘটতে পারে সেটা অবশ্য চাই না । কিন্তু গল্পের জন্য কাহিনিটা চমৎকার ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।