“এক”
ঢাকার মোহাম্মদপুরের এক শান্ত নিবিড় গলি। ভেতরের শেষ মাথায় একটা তিনতলা বাড়ি। এরই প্রথম তলায় ছোট্ট একটা ফ্লাটে থাকেন মা সায়মা রহমান আর তার এমাত্র মেয়ে লিনা।
সায়মা রহমান, হাউজওয়াইফ। বয়স ৪৫ এর কাছাকাছি। স্বামী মারা গেছেন আজ প্রায় সাত বছর। একমাত্র মেয়ে লিনাকে নিয়েই তার ছোট্ট সংসার। তার সকল ব্যস্ততা মেয়ে লিনাকে ঘিরেই।
লিনা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। শান্ত, ভদ্র এবং পড়ুয়া স্বভাবের। স্কুলজীবন থেকেই তার তেমন কোন বন্ধু-বান্ধব নেই। মা-বাবা আর বই, এই নিয়েই ছিল তার জীবন। আজ হয়তো তার বাবা নেই। তারপরেও এই বয়সে তার সেরা বন্ধু বলতে কেবল মা সায়মা রহমান। পাশাপাশি ক্লাসের দু-একজন, যদিও কারো সঙ্গেই তার তেমন গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি কখনো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সে খুব একটা সক্রিয় না। আর সব ছেলে-মেয়ের মত তাকে ফোনেও খুব একটা কথা বলতে দেখা যায় না।
সেদিন সকালটাও ছিল খুবই সাধারণ। মা সায়মা রান্নাঘরে নাস্তা রেডী করছিলেন। আর লিনা নিজের ঘরে কিছু নোটস্ লিখছিল। সকাল ৯টার দিকে তারা একসাথে নাস্তা করল।
তারপর বাজারের ব্যগ হাতে সায়মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “মা লিনা, আমি বাজারে যাচ্ছি। তোর জন্য কিছু টাকা রেখে যাচ্ছি, তুই না নোটস প্রিন্ট করতে বাইরে যাবি বলেছিলি।”
“হ্যাঁ মা, থিসিসের খসড়া আজ জমা দিতে হবে। তারপর লাইব্রেরি যাবো। ফিরতে একটু দেরি হতে পারে।” লিনা দরোজার হাতলে হাত রেখে বললো।
“আচ্ছা মা। সাবধানে যাস।" সায়মা মেয়ের মুখে আদর দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মেয়েকে দরজা বন্ধ করতে দেখে তিনি রিকশায় চড়লেন।
বাজার করে প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে বাসায় ফিরলেন সায়মা। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন দারোয়ান ইউনুস। বয়স ষাটের কাছাকাছি। মুখে চিরচেনা ক্লান্তি আর কিছুটা কৌতূহল। সায়মা রহমান বিকশা ভাড়া মিটিয়ে গেটের দিকে ফিরতেই সে বলল, “আপা, মাইয়ারে তো আজকে বের হইতে দেখি নাই। আইজ কি হের ভার্সিটি বন্ধ?”
সায়মা রহমান অবাক হলেন। “ না তো। ওর তো এতক্ষণে বের হয়ে যাবার কথা। বলেছিল আজ থিসিস জমা দেবে।”
সায়মার মনে কেমন জানি খটকা লাগলো। তিনি দ্রুত পা চালালেন নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চাবি বের করে লক খুলতে গিয়ে আবিস্কার করলেন, ওটা খোলা।
ঘরের ভেতরে ঢুকেই মেয়েকে ডাকলেন, “লিনা? মা… আমি এসেছি, তুই কই রে?” কিন্তু, কোন সাড়া পেলেন না।
ডাইনিং রুম, রান্নাঘর সব খালি। টেবিলের উপর রাখা ভাত-তরকারি ছুঁয়েও দেখা হয়নি। ঘড়িতে তখন ১১টা ৩৫ মতন বাজে। ফ্যান ঘুরছে, বাতাসে হালকা একটা ঘামের গন্ধ, কিন্তু কোনোরকম সাড়া শব্দ নেই।
লিনার ঘরের দরজাটা ভেজানো। হালকা ঠেলা দিলেন। আর তখনই তার চোখে যা পড়ল, সেটা কোন মা’ই সয্য করতে পারবে না।
ঘরের মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে লিনা। চোখ দুটো নিথর, ছাদের দিকে ফেরানো। চুলগুলো এলোমেলো ছড়িয়ে আছে। একটা হাত পেটের উপর বিছানো। আর একটা হাত পাশেই মোবাইল ফোনটার উপর পড়ে আছে। তার ঘাড়ের পাশে কালচে দাগ। ঠোঁট হালকা ফোলা, যেন অভিমান করে আছে।
মা এক ঝটকায় ছুটে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন “লিনা মা, কি হয়েছে তোর? আমি এই তো এসেছি। উঠে বস মা।” শরীর ধরে ক্রমাগত ঝাঁকাতে লাগলেন।
কিন্তু লিনা নড়ল না। কোনো সাড়া নেই। শরীরটা একদম ঠান্ডা, শক্ত হয়ে গেছে। অনেক আগেই মারা গেছে সে।
প্রকৃত সত্যটা বুঝতে পেরে চিৎকার করে উঠলেন সায়মা রহমান। “না! লিনা, না! একি হলো আমার মেয়ের? আমার লিনারে কে মারলো? ”
চিৎকার শুনে পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন ছুটে এলো। তাদেরই কেউ ফোন করল পুলিশে। কেউ একজন ডাইনিং টেবিল থেকে পানির জগ নিয়ে এলো। লিনার মুখে পানি ছিটাল। বাড়িওয়ালার বউ এসে মা সায়মাকে ধরে উঠে বসাল।
পুলিশ আসে এক ঘণ্টার মধ্যে। লোকাল থানার ইন্সপেক্টর শামীম ও তার সাথে একজন কনষ্টেবল। খুন হয়েছে, এটা নিশ্চিত। কিন্তু কোথা থেকে, কীভাবে বুঝতে পারলেন না? দরজা বাইরে থেকে বন্ধ ছিল। জানালার গ্রিলও অক্ষত। ঘরের কোনো কিছু এলোমেলো নয়।
ইন্সপেক্টর শামীম জিজ্ঞেস করল, “ঘরে কি কেউ এসেছিল?”
সায়মা কাঁপা গলায় বললেন, “আমি তো বের হইছি সকাল ১০টায়। তখন মেয়ে বাসায়ই ছিল। দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল। তারপর আমি বাজার করে মাত্রই ফিরলাম। এসেই দেখি মেয়ে আমার, “ বলেই আবার চিৎকার করে উঠলেন। “লিনা রে, একি হলো তোর মা? কে আমার এতো বড় সর্বনাশ করলো?”
শামিম সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি দাঁড়োয়ানকে ডেকে আনতে বললেন। দারোয়ান ইউনুস আসলে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এর মধ্যে আর কেউ কি বিল্ডিংয়ে এসেছিল?”
“স্যার… আমি তো নিচেই ছিলাম… কাউরে দেখি নাই… কেউ ঢুকলে তো দেখতাম…” দাঁড়োয়ান শশব্যস্ত হয়ে উত্তর দিল।
ইন্সপেক্টর শামীম চারপাশ ঘুরে তাকিয়ে বললেন, “এটা কোন সহজ খুন না। খুনির কোন চিহ্ন নাই, হাতের ছাপ নাই, দরজা ভাঙা না, জানালা ভাঙা না… তার মানে এটা প্রি-প্ল্যানড খুন, যা কেবল খুব ঠান্ডা মাথার লোকই করতে পারে।”
তদন্ত শেষে বেরিয়ে যাচ্ছে পুলিশ, তখনই বাসার গেটের দঁড়োয়ান ইউনুস হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, “স্যার, আমি একটা কথা ভাবছিলাম… ওইদিন দুপুরের একটু আগে উপরের ফ্ল্যাটের ছেলেটা, ওই যে কি যেন নাম, ও স্যার মনে পড়ছে … রাফি, ও তো অনেকদিন বাসায় ছিলনা। কিন্তু, হেদিন হঠাৎ আসছিল। তারপর কিছুক্ষণ বাদেই চইলা গেছে ।“ শেষে মাথা ঝাঁকিয়ে যোগ করলো, “ আর তো বাসায় আসে নাই।”
শামিম সাহেব থেমে গেলেন। “ এই রাফিটা কে?” তার মনে হলো, ঘন অন্ধকারে একটু আলোর দেখা পেয়েছেন।
সায়মা বললেন, “ছেলেটা উপরের ২এ ফ্লাটে থাকে। খুব কম কথা বলে। কারো সংগে তেমন মেশে না। আমার মেয়ের সাথে কখনো কথা বলতেও দেখি নাই।”
ইন্সপেক্টর শামীম তাকালেন সিঁড়ির দিকে। পরমুহুর্তে হনহনিয়ে দু’তলায় উঠে এলেন। এগিয়ে গেলেন ২এ ফ্লাটের দিকে। কিন্তু আশাহত হলেন খুব। রাফির ফ্লাটের দরোজার দরোজার নবে হাত দিয়েই বুঝে গেলেন ওটা লক করা।
“দুই”
রাফির ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে পুলিশ। চারপাশ কেমন যেন থমথমে। কোন সাড়া-শব্দ নেই। দুইতলার করিডোরে মোট দুইটা ফ্ল্যাট। অপর পাশের ফ্লাটের দরোজা খোলা। ভেতর থেকে একজন মহিলার কৌতুহলী মুখ উঁকি দিচ্ছে।
প্যাসেজ জুরে নরম আলো ছড়িয়ে আছে। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী মুখে ২এ ফ্লাটের দিকে তাকিয়ে আছে কিছু মানুষ। তাদের চোখেও একি জিজ্ঞাসা, রাফি কোথায়?
রাফি ছেলেটা এই ২এ ফ্ল্যাটের একমাত্র বাসিন্দা। সেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। শান্ত, চুপচাপ স্বভাবের ছেলে। কারো সঙ্গে অযথা কথা বলে না। তেমন মেশেও না। নিজের মত থাকে। মাঝে মাঝে তার বাবা-মা আসে গ্রামের বাড়ি থেকে। ক’দিন থেকে আবার চলেও যায়। কারো বাসাতেই তাদের কিংবা রাফির যাওয়া-আসা নেই। পুরোই নির্বিবাদি চরিত্র। কিন্তু আজ কপাল দোষে তারই নাম জড়িয়ে গেছে খুনের মতো একটা জটিল ঘটনায়।
ইন্সপেক্টর শামীম দরজায় কড়া নাড়লেন। কোনো সাড়া পেলেন না। আবার ঠুক ঠুক করে দরজায় ধাক্কা দিলেন। ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ নেই।
দারোয়ান ইউনুস বলল, “স্যার, ও তো দুপুরের একটু আগেই আইছিল। আমি দেখি সিঁড়ির ধারে দাঁড়ায়া ফোনে কথা কইতেছিল। তারপর দেখি সিঁড়ি ধইরা উপরে উইঠা গেল। আবার কতক্ষণ পরেই বের হয়া গেল। আমি ভাবছিলাম হইতো ক্লাসে গেছে।”
শামীম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “এই ফ্লাটের ডুপ্লিকেট চাবি আছে?”
“ও তো সবসময় তালা মাইরা যায়। আরেকটা থাকলে হেইডা মনে হয় হের বাবা-মা’ইর কাছে আছে।” দাড়োয়ান ইউনুস উত্তর দেয়।
শামীম সাহেব পকেট থেকে মোবাইল বের করে বললেন। “আইসোটেক টিমরে খবর দাও। দরজার তালা খুলতে হবে।”
আইসোটেক টিম এল আধা ঘণ্টার মধ্যে। তারা প্রথমে দরজার হ্যান্ডল স্ক্যান করল। সেখানে একটা ফিঙ্গারপ্রিন্ট থাকার প্রমাণ পাওয়া গেল। তবে সেটা রাফির কিনা, বুঝা গেল না। সেটা জানতে হলে আগে অবশ্যই ওকে পেতে হবে।
তিন তলা থেকে বাড়িওয়ালাকে ডেকে আনা হলো। পুলিশ এসেছে শুনে নিজের ঘরে ভয়ে সেধিয়ে ছিলেন তিনি। তার অনুমতি নিয়ে ২এ ফ্লাটের দরজা খোলা হলো। ঘরের ভেতরে পরিবেশ আর সব ব্যাচেলর ছেলের রুমের মতোই। টেবিলে পড়ে আছে খোলা ল্যাপটপ, বিছানায় ছড়ানো জামা কাপড়, সাইড টেবিলে আধ খাওয়া পানির প্লাস্টিক বোতল।
তবে একটা জিনিস নজর কাড়লো ইনস্পেক্টরের । টেবিলের নিচে সযত্নে রাখা একটা গোল কৌটো। কৌটোটা গোল কিছুটা চ্যাপ্টা, মেয়েদের অর্ণামেন্টস রাখার বাক্সের মত। খুলে দেখা গেল ভেতরে একটা মেয়েলি চুড়ি! লাল রঙের ছোট চুড়ি।
ইনস্পেক্টর চুড়িটা হাতে নিয়ে বললেন, “এইটা কার? রাফির হবে না, এটা তো শিউর।”
সাথে সাথে সায়মা রহমান, যিনি এরই মধ্যে নিচ থেকে চলে এসেছেন, বললেন, “এইটা… এইটা তো লিনার চুড়ি! ওর এক জোড়া ছিল। একটা বেশ কিছুদিন হলো হারিয়ে গেছে। আরেকটা এখনো ওর হাতেই আছে!”
শামীম সাহেব চুপ করে গেলেন। লিনার চুড়ি কেন রাফির কাছে থাকবে ! যেখানে সবাই বলছে যে তার সঙ্গে লিনার কোনো সম্পর্ক ছিল না?
এর তার সাথে কথা বলে জানা গেল, রাফি কিছুদিন আগে হোস্টেলে থাকলেও গত এক সপ্তাহ ধরে টানা এই ফ্ল্যাটেই ছিল। আর আজকের দিন দুপুর ১২টার সময় অর্থাৎ লিনা খুন হবার সময় সে বাসায়ই ছিল।
২এ ফ্ল্যাটের উল্টোদিকে ২বি ফ্লাটে থাকেন সোহেল ভাই ও রুখসানা ভাবী দম্পত্তি। সোহেল ভাই এখনো অফিসে। বাসায় আছেন তার স্ত্রী রোকসানা ভাবী। তার দরোজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন এখন। তিনি বললেন, “ছেলেটা মোটামুটি ভদ্রই। তবে গত এক সপ্তাহ ধইরা দেখি একটু বেশীই বাইরে ঘোরাঘুরি করছে। খালি বাইরে যায় আবার ফিরেও আসে। সবসময় কানে এয়ার ফোন থাকে। কারো সাথে যেন কথা বলে আর বারান্দায় হাঁটে। মাঝে মাঝে দরজা বন্ধ করে জোরে গান চালায়। কেমন যেন একটু অস্থির।”
নীচতলার লিনাদের পাশের বাসার ভাড়াটে মহিলা বললেন, “ও মাঝে মাঝে লিনাদের দরজার সামনে দাঁড়ায়া থাকে, যেন ওদের জন্যই অপেক্ষা করছে। কিন্তু, সায়মা ভাবি বা লিনাকে দেখা মাত্রই সরে যায়। আমি একদিন জিজ্ঞেস করছি তুমি কি কাউরে খুঁজতেছ? সে হেসে বলছে — ‘না, এমনি’। আমি ভাবছি ওরা দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা নয়তো।”
ইন্সপেক্টর ভাবনায় পড়ে গেলেন। রাফি তাহলে লিনার প্রতি আগ্রহী ছিল। তবে সেটা লিনা জানত কি না, সেটা বুঝা যায়নি এখনো।
ইতিমধ্যে লিনার ফোনটা পুলিশ হেফাজতে নিয়ে গেছে। ফোন আনলক করে দেখা গেল, কললিস্টে শেষ কল এসেছে সকাল ১০টা ১৮ মিনিটে।
কিন্তু যে নাম্বার থেকে কলটা এসেছে ওটা কোনো নামে সেভ করা নেই। কেবল একটা নম্বর যেটার শুরু "01730…"।
ওই নাম্বারে কল ব্যাক করতেই ফোন বন্ধ পাওয়া গেল। মোবাইল সার্ভিস কোম্পানির অপারেরটরের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেল নাম্বারটা
রাফি হাসান নামে রেজিস্টার্ড করা ।
শামীম সাহেব এক ঝটকা খেলেন। “তার মানে? রাফি লিনাকে ফোন করছিল? তাও কিনা খুনের ঠিক আগে?”
ঠিক তখন, রাফির বিছানার নিচ থেকে আরেকটা জিনিস বের করে আনলেন আইসোটেক টিমের এক সদস্য। একটা ছোট্ট ডায়রি।
ডায়রির ভেতরের পাতা উল্টাতেই ইনস্পেক্টরের মুখ কেঁপে উঠল। ভেতরের পাতায় খসখসে হাতে লেখা, “ও আমাকে দেখেও দেখেনা। অথচ আমি ওকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছি।”
আরেক পাতায় লিখা, “ ও যদি আমার নাই হবে। তবে কখনোই আর কারো হবে না।”
আইসোটেক টিমের এক সদস্য নিশ্চিত করে বললো, শেষের লেখাটা লিখা হয়েছে আজ সকালেই।
“তিন”
রাত হয়ে এসেছে। ঘড়ির কাঁটা প্রায় ৯টা ছুঁই ছুঁই।
মোহাম্মদপুরের খুন হওয়া বাড়িটায় এক অদ্ভুত নিরবতা বিরাজ করছে।
একতলার সিড়ি ঘরের মাঝখানে অনেকগুলো চেয়ার পাতা। তার মাঝে বসে আছেন সায়মা রহমান। চারপাশে পুলিশ, তদন্তকারী অফিসার আর আশে-পাশের ফ্লাটের ক’জন প্রতিবেশীও যোগ দিয়েছে ।
তদন্ত চলছে। ইন্সপেক্টর শামিমের মাথা খারাপ হবার যোগার। সব কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। দাঁড়োয়ান ইউনুস বলছে, রাফি বেশ কিছুদিন বাসায় ছিল না। আজই সে বাসায় ফিরেছে এবং কিছুক্ষণ পর চলেও গেছে। আবার রাফির ফ্লাটের উল্টোদিকের বাসিন্দা বলছে, রাফি গত টানা এক সপ্তাহ ধরে এই ফ্ল্যাটেই ছিল।
দুজনের কথায় প্রচন্ড অমিল। তার মানে কেউ একজন মিথ্যে বলছে। কিন্তু, মিথ্যে বলে তাদের কি লাভ? এমন হতে পারে কেউ একজন ভুল দেখেছে। সামনের ফ্লাটের বাসিন্দার ভুল দেখার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। মহিলার আচরনেই বলে দিচ্ছে, ভীষন কৌতুহলী স্বভাবের মানুষ। ওদিকে দারোয়ান ইউনুস সাড়াক্ষণ গেটেই থাকে। কাজেই তার চোখ এড়িয়ে ফ্লাটের বাসিন্দাদের কারো পক্ষেই দীর্ঘদিন ঘরের বাইরে না যাওয়াটা একেবারেই অসম্ভব। যেহেতু, কে আসলো আর কে গেল- পুরো ব্যাপারটাই তার চোখের সামনে ঘটেছে।
তাহলে এখন প্রশ্ন হলো ভুলটা দেখেছে কে?
রাফির ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া লিনার চুড়ি, ডায়েরির লেখা, সবকিছু ঘিরে এক ব্যাপক জট পাকানো রহস্য তৈরি হয়েছে । কেউ জানে না রাফি এখন কোথায়। তার ফোন বন্ধ। ফ্ল্যাটও তালাবদ্ধ ছিল।
পুলিশ এখন পুরো বিল্ডিংয়ের সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই করছে। একটা একটা করে সময়ের হিসাব মেলাচ্ছে।
ফুটেজে দেখা গেল দুপুর ১১টা ০৫ মিনিটে রাফি গেট দিয়ে ঢুকছে। তার হাতে মোবাইল, কানে হেডফোন। খুব সাধারণ ভঙ্গিতে উঠে যাচ্ছে দোতলার দিকে। কোনো রকম তাড়াহুড়ো বা সন্দেহজনক আচরণ নেই।
এরপর ক্যামেরার ফ্রেমে আবার নাড়াচড়া ধরা পরে একেবারে ১১টা ২৭ মিনিটে। সে সময় রাফিকে আবার বেড়িয়ে যেতে দেখা যায়। এবারও তার আচরণ আগের মতই। কোন তাড়াহুড়া নেই।
ঠিক এই সময়েই দারোয়ান ইউনুসকে দেখা গেল গেটের বাইরে, পাশের রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে একজন মহিলার সঙ্গে। পরের মিনিটে সে আবার হেঁটে গেটের দিকে ফিরছে।
তদন্তকারী অফিসার বললেন, “এই সময়টায় ইউনুসও বাইরে ছিল। কাজেই বাড়িতে কেউ ঢুকলে বা বের হলে তার জানার কথা না। তার মানে, ঠিক এই ফাঁকে কেউ ঢুকেও যেতে পারে।”
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেউ ঢুকেছিল কি? না কি খুন আগেই হয়ে গিয়েছিল? যদি তাই হয়ে থাকে। তাহলে খুনী নিশ্চয়ই ভেতরের কেউ।
লিনার ফোন এখন পুলিশের হাতে। তাদের টেক টিম লাস্ট কল, মেসেজ, লোকেশন, সব চেক করে। সকাল ১০টা ১৮ মিনিটে রাফির নাম্বার থেকে একটা কল এসেছিল। ডিউরেশন খুব ছোট, মাত্র ৩১ সেকেন্ড।
পাশে বসা ইনস্পেক্টর শামীম বললেন, “৩১ সেকেন্ডে কী এমন কথা হলো, যে তা শেষ পর্যন্ত খুনের দিকে গড়ালো?” কোন উত্তর নেই।
আরেকটা তথ্য উঠে আসে, লিনার ফোনে রাফির নম্বর সেভ করা ছিল না। তার মানে, পরিচয় থাকলেও তাদের মধ্যে তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। তাই লিনা রাফির নাম্বারটা সেভ করার প্রয়োজন বোধ করেনি।
সামনের ফ্ল্যাটের রুখসানা ভাবী বলেন, “আমি দেখি, ছেলেটা মাঝে মাঝে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা কইত। কারো জন্য যেন অপেক্ষা করত। একদিন ওর চোখে পানিও দেখছিলাম।”
“লিনারে কি একতরফা ভালোবাসত?” ইন্সরপক্টর শামীম নিচের ঠোঁটে চিমটি কাঁটলেন।
“কে জানে! ছেলেটা তো খুব চুপচাপ ছিল। কোন কিছুই বুঝা যেত না।” জবাবে রোকসানা মাথা নাড়লেন।
মনে হচ্ছে ইউনুস কিছু লুকোচ্ছে। ইনস্পেক্টর নিচে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন দারোয়ান ইউনুসকে। প্রশ্ন করলেন, “তুমি বলছো, দুপুরে গেটের সামনে ছিলে। কিন্তু ক্যামেরায় দেখা গেল তুমি মোড়ে গেছিলে।”
ইউনুস কাঁপা গলায় বলল, “হ্যাঁ স্যার, আমি চা আনতে গেছিলাম। আর এক মহিলা রাস্তায় দাঁড়ায়া রাস্তা জিজ্ঞেস করছিল, ওর জন্য রিকশা ডাইকা দিছিলাম। আমি তো জানতাম না এমন কিছু হইবো?”
“তাহলে গেট কি খোলা ছিল?”
“জি স্যার। আমি বদ্ধ করি নাই।”
এই তথ্যটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ লিনার খুন হওয়ার সময় গেট খোলা, দারোয়ান গেটের বাইরে। এতে বোঝা যাচ্ছে, কেউ চাইলে অনায়াসে এসময় ভিতরে ঢুকতে পারত। এটা অবশ্যই একটা নতুন দিক যা তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
লিনাদের পাশের ফ্ল্যাটের বুয়া, রহিমা, হঠাৎ বলল, “স্যার, আমি একটা কথা বলি? আমি জানি না আপনাগো কাজে লাগবো কিনা।”
“বলো।”
“সেদিন দুপুরে, মানে ওই সময়টায়, আমি ছাদে গেছিলাম কাপড় নাড়তে। তখন দেখি ছাদের কিনারে কেউ একজন দেয়াল ঘেইসা দাঁড়ায়া আছে। হেয় পিছন ফিইরা সিগারেট টানতাছিল। সিগারেটের গন্ধে আমার বমি আসে, তাই আমি তাড়াতাাড়ি চইলা আসি।
ইনস্পেক্টর একটু চমকে গেলেন। “তুমি কি তার মুখ দেখছো?”
“না স্যার। কইলাম তো, হেয় পিছন ফিইরা আছিল। একবারো মুখ ঘুরায় নাই।”
এই তথ্য কেউই আগে দেয়নি। কেউ ছাদে গিয়েছিল, কিন্তু, কে সে? কেন গিয়েছিল? এতে সম্ভাবনা থেকে যায়, কেউ নিশ্চয়ই বিল্ডিংয়ে ঢুকেছিল। আবার সে এই ভবনেরও কেউ হতে পারে। তার মানে এই লোকটারও খুনী হবার সুযোগ আছে। সেক্ষেত্রে রাফি নিশ্চয়ই লিনাকে খুন করেনি। তার খুনী হবার জোড়ালো কোন কারণও নেই। কিন্ত, ডায়েরীতে লেখা তার সেদিনের নোটটা, “ ও যদি আমার নাই হবে। তবে কখনোই আর কারো হবে না।”
আবারও সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। ইন্সপেক্টর শামিম আলগোছে মাথার চুল ধরে টানতে লাগলেন।
“চার”
দুপুর ১১টা ৩০ মিনিট। সবাই একমনে সিসিটিভি ফুটেজ দেখছে।
রাফি বেরিয়ে যাবার ঠিক পরপরই একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়লো। দারোয়ান ইউনুস গলির মোড় থেকে ভবনের গেটের দিকে সবে ফিরছে, এমন সময় দেখা গেল একজন লোক খুব সাবধানে গেট দিয়ে ভবনের ভেতরে ঢুকছে। লোকটা মাঝবয়সী। মুখে চাপ দাড়ি। চুল কোকড়া। মুখটা স্পষ্ট বুঝা না গেলেও তার দেহ কাঠামো বেশ চওড়া এটা স্পষ্টতঃই ঠাহর করা গেল।
ইন্সপেক্টর শামিম চোখ চেপে বললেন, “এই লোকটা কে? একে তো এই বিল্ডিং এর কেউ বলে মনে হচ্ছে না।”
লোকটা একতলার করিডোরে না ঢুকে সোজা দোতলার সিড়ির দিকে চলে গেল। বাকিটা ক্যামেরার দৃষ্টির বাইরে থাকায় তাকে আর দেখা গেল না।
আর ঠিক তখনই কথা বলে উঠেন সায়মা রহমান। “স্যার… এই লোকটা… মানে আমি ঠিক নিশ্চিত না। কিন্তু, মনে হচ্ছে একে আমি আগেও একবার দেখেছি।”
“কোথায় বলুন তো?”
“মনে হচ্ছে আমাদের এই বিল্ডিংয়েই। তার হাঁটার ভঙ্গীটাও আমার চেনা মনে হচ্ছে। দেখেন কেমন পা টেনে টেনে হাঁটছে।”
ইন্সপেক্টর চোখ সরু করলেন। “আপনি নাম বলতে পারবেন?”
সায়মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন। “না তা পারবো না। কিন্তু, ইউনুস হয়তো চিনতে পারে।”
দারোয়ানকে আবার ডাকা হলো। ভিডিও রিওয়াইন্ড করে তাকে দেখানো হলো। সাথে সাথে সে চেঁচিয়ে উঠলো। “হ স্যার, ওরে চিনি তো। নাম রাজু। আমাগো বাড়িওয়ালার বাসায় কাজ করে যে মাইয়াটা শিরিন, হের কেমন জানি ভাই লাগে। শুনছি হেয় আগে জেলে আছিল। কদিন আগেই ছাড়া পাইছে। প্রতারণা মামলায় ধরা খাইছিল। ”
ইন্সপেক্টর সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে এক অফিসারকে নির্দেশ দিলেন —“রাজু নামের যাদের বিরুদ্ধে মিরপুরে প্রতারণা বা ভায়োলেন্সের মামলা আছে, খুঁজে বার করো। ছবি লাগবে।”
এদিকে একজন পুলিশ উপরে গিয়ে আবার লিনাদের সামনের বাসার ভাড়াটিয়ার কাজের মেয়ে রহিমাকে ডেকে আনলো। ভিডিও ফুটেজে রাজুর চওড়া কাঠামোর দেহ দেখেই সে চিনতে পারলো। “স্যার এই লোকটারেই আমি ছাদে দেখছি।”
“তুমি বলছো, দুপুর বেলায় কেউ ঢোকেনি। কিন্তু ক্যামেরায় তো দেখা গেল কেউ একজন ঠিকই ঢুকেছে।” ইউনুসকে বললেন ইন্সপেক্টর শামিম।
দারোয়ান মাথা নিচু করে ফেললো। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে হালকা স্বরে বলল, “স্যার, আমি তখন বাইরে একটা মেয়েরে রিকশা ধরাই দিছিলাম। তাই গেটের দিক খেয়াল করি নাই। হের লাইগাই বিষয়টা আমার চোখ এড়াইছে।”
ইন্সপেক্টর বললেন, “তাহলে দেখা যাচ্ছে তুমি পুরো সময় গেটে ছিলে না।”
“না স্যার। ছিলাম তো। খালি দুই-তিন মিনিটের জন্য সামনের মোড়ে গেছিলাম। আসলে চা খাইতে মন চাইছিলে তো।”
তার কথা শুনে সবার চোখ কপালে উঠল। “তার মানে খুনি ঠিক তখনই ঢুকতে পেরেছে, যখন তুমি বাইরে ছিলা!” ইন্সপেক্টরের চোখে রাগের আভাস। “ তাকে তুমি ঢুকতে দেখনি। কিন্তু, বের হতে নিশ্চয়ই দেখেছ?”
“জী স্যার। ভাবছি হের বইনের সাথে দেখা করতে আইছে।”
“কিন্তু, এই ব্যাপারটা তুমি কিন্তু আগে বলনি কেন?”
রাফির ঘর থেকে যে চুড়ি পাওয়া গিয়েছিল, সেটার ব্যাপারে তদন্তকারীরা জানাল, চুড়িটা সত্যি লিনার। কিন্তু ওটা কয়েকদিন আগে থেকেই লিনার কাছে ছিল না। তার বান্ধবী, তৃষা নামে এক মেয়ে, জানিয়েছে, গত সপ্তাহে সে লিনার বাসায় এসেছিল। তারপর তারা ছাদে গিয়েছিল। সেখানেই গল্প করার সময় এক ফাঁকে লিনা বাম হাতের চুড়িটা খুলে কার্ণিশে রেখেছিল। পরে হয়তো সেটা আর নিতে মনে ছিলনা তার।
তাহলে রাফি ডায়রিতে যা লিখেছে, সেটায় যা বুঝা গেল, ভাবনাটা হয়তো সত্যি। কিন্তু, সেটা বাস্তবে রুপ দেওয়া তার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। সে লিনাকে এক তরফা ভালোবাসত, কিন্তু কখনো বলতে পারেনি। সেও হয়তো সেদিনই ওরা নেমে যাবার পর ছাদে গিয়েছিল। কার্ণিশে পড়ে থাকা চুড়িটা দেখেই চিনতে পারে। আবেগের আতিশায্যে সেটা নিজের কাছে রেখে দেয়। পরে হয়তো সেটাই ফিরিয়ে দেবার জন্য লিনাকে ফোন করে। অবস্থাদৃষ্টে এটাই স্পষ্ট, লিনাকে সে খুন করেনি। খুন করলে লিনার চুড়ি নিজের কাছে রাখতো না। আসলে রাফি যে সময়টায় বাসায় ছিল, সে তখন জানেই না একতলায় লিনার বাসায় কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটছে।
ইন্সপেক্টর শামিম চুপচাপ বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “খুনি আমাদের চোখের সামনেই আছে। এখন কেবল তাকে ধরবার অপেক্ষা।”
একজন কনষ্টেবলকে পাঠালেন তিন তলায়। বাড়িওয়ালার কাজের মেয়ে শিরিনকে তার এখনি দরকার। একমাত্র সেই বলতে পারে তার ভাই রাজু এই মুহুর্তে কোথায়?
“পাঁচ”
একতলার সিড়ি ঘরের মাঝখানে পাতা চেয়ারগুলোয় গোল হয়ে বসে আছে আইসোটেক টিমের সদস্যরা। তাদের মাঝে চাপা ফিসফাস। পাশেই তদন্তকারী অফিসার ইন্সপেক্টর শামিম উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে সিড়ির দিকে। কন্সটেবল এসে জানালো শিরিন আজ দুপুরের পরেই বাসায় চলে গেছে।
শামীম সাহেব এবার নিজেই চলে গেলেন তিন তলায়, বাড়ির মালিক রাশেদ সাহেবের ফ্ল্যাটে। দরজা খুললেন রাশেদ সাহেবের স্ত্রী, হাফিজা বেগম।
প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, “হ্যাঁ, শিরিন আমার কাজের মেয়ে। কিন্তু, আজ এত বড় একটা ঘটনা ঘটার পর সে বেশ মুষরে পড়ে। লিনার অস্বাভাবিক খুনটা সে মেনে নিতে পারেনি। তাই অসুস্থতা ফীল করে। বাথরুমে যেয়ে কয়েকবার বমিও করে। তাই আমিই বাসায় চলে যেতে বলি। ”
“তার বাসা কোথায় জানেন?”
“না। শুনেছি মিরপুরের কড়াইল বস্তিতে থাকে।”
“তার কোন মোবাইল নাম্বার আছে?”
“না স্যার। অনেকদিনের পুরনো কাজের মেয়ে। কোনদিন কাজে ফাঁকি দেয় নাই। তবে খুব জরুরী ব্যপার হলে বা কোনদিন অসুস্থ থাকলে তার ভাইয়ের নাম্বার থেকে কল দিয়ে জানিয়ে দিত।”
“ওর ভাই কি রাজু?”
“জ্বী স্যার?”
“ও যে আজ দুপুরে শিরিনের সাথে দেখা করতে এখানে এসেছিল, সেটা কি আপনি জানেন?”
“কই নাতো!” বাড়িওয়ালী বেশ অবাক হলেন। “তবে খুনের ঘটনার কিছুক্ষণ আগে শিরিন বাইরে গিয়েছিল। বলেছিল লিনাদের বাসায় যাবে। তারপর ওই তো এসে খবর দিল, লিনা খুন হয়েছে।”
ইন্সপেক্টর শামিম অবাক হলেন। জানতে চাইলেন, “শিরিন কেন লিনাদের বাসায় যাবে? ও না আপনাদের কাজের মেয়ে!”
“স্যার লিনার মা মাঝে মাঝে ওকে ডেকে পাঠাতো। ওদের কাপড় ছাদে শুকোতে দেওয়া, বাসার টুকটাক কাজ করে দেওয়া বা ময়লা বাইরে ফেলে দেওয়ার কাজটাও মাঝে মাঝে করে দিত।”
“কাজের মেয়ে আপনাদের, তাহলে ওদের কাজ করে দিত কেন?”
“আসলে লিনা’রা আমাদের অনেক পুরনো ভাড়াটিয়া। ওদের বাবা মারা গেছে এই বাসাতেই, তাও সাত বছর আগে। উনার রেখে যাওয়া টাকাতেই অনেক কষ্টে-সৃষ্টে ওদের সংসার চলে। কিন্তু, বুয়া রাখার মত অবস্থা এখন আর ওদের নেই। এদিকে শিরিনও আমার পুরনো কাজের মেয়ে। তাই আমার অনুমতি নিয়েই ও মাঝে মাঝে লিনাদের কাজ করে দেয়।”
“হুমম, বুঝেছি। আপনার কাছে রাজুর নাম্বার আছে নিশ্চয়ই। ওটা যদি কাইন্ডলি দিতেন।”
“একটু ওয়েট করুন স্যার। আমি মোবাইলটা নিয়ে আসছি।” হাফিজা বেগম ভেতরে গেলেন।
নাম্বারটা মোবাইলে টুকেই কল দিলেন শামিম সাহেব। বন্ধ পাওয়া গেল। তখনি থানায় ফোন করে রাজুর শেষ অবস্থান সনাক্ত করতে বললেন।
তদন্তকারী অফিসার নিচে নেমে এসে আবার সায়মা রহমানের সঙ্গে কথা বললেন। সায়মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “শিরিন মাঝে মাঝে আসত, কিন্তু খুব একটা কথা বলত না। একরকম চুপচাপ। তবে খুনের তিন দিন আগে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল।”
“কি রকম?”
“একদিন দুপুরে দেখি, শিরিন আমার মেয়ের রুমের পায়ের কাছে বসে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে?’ ও কিছু না বলে সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেল।
পরে লিনাকে জিজ্ঞেস করায় বলে, “জানিনা মা। মনে হয় কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু, তোমাকে দেখে না বলেই চলে গেল।” আমি খেয়াল করেছি, আমার মেয়ের চোখে তখন কিছু একটা ছিল, কেমন যেন ভয়? কিংবা ঘৃণা? আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। যদিও পরে আমি তাকে এ বিষয়ে কোন চাপাচাপি করিনি।”
শামিম সাহেব বুঝে গেলেন, শিরিনও এখানে সন্দেহভাজন হয়ে উঠেছে। এমনি সময় ফোনটা বেজে উঠলো তার।
“স্যার রাজুর অবস্থান সনাক্ত করা গেছে।” মোবাইলটা কানে ঠেকাতেই শুনতে পেলেন।
“ছয়”
ইন্সপেক্টর শামিমের নেতৃত্বে পুলিশের একটা চৌকষ দল গেল মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনে, একটা পুরনো ভাঙাচোরা বাড়িতে। বাড়িটা তিনতলা, আধাপাকা। মানে কাঠামোটা সলিড হলেও, দেওয়ালগুলো টিনের বেড়া দেওয়া। পেছনের দিকটা গলির শেষ মাথায় আটকে আছে। এরপর আর কোন রাস্তা নেই। নিচতলায় এক কোণে ছোট্ট একটা রুম, ওখানেই রাজু ভাড়া থাকে।
বাড়ির মালিক এক মাঝ বয়সী মহিলা দরজায় এসে বললেন, “রাজু? ও তো মাস খানেক হইল জেল থাইকা ছাড়া পাইছে। আরও তো ঘরেও বেশী থাকে না। মাঝে মাঝে আসে আবার চইলাও যায়। আইজ সকালেও আছিল। দুপুরের একটু আগেই বাইর হয়া গেছে। আর ফেরত আসে নাই।
ইন্সপেক্টর শামীম জিজ্ঞেস করলেন, “কেন জেলে গেছিল? জানেন কিছু?”
“ও তো ঝামেলাবাজ মানুষ। নেশাখোরদের সাথে থাকে। পুলিশের হাতে ধরাও খাইছে অনেকবার। ছিনতাইও করছে নাকি শুনছি।”
“কাউরে ভয় দেখানো বা ব্ল্যাকমেইলের মতো কিছু করেছে কখনো?”
“অরে! ও তো এ কাজেই নাম কামাইছে। এক মহিলার ছবি তুলে ভয় দেখাইছিল। আরেকটা মেয়েরে কয়েক মাস সাথে সাথে লইয়া ঘুইরা ঘুইরা... শেষমেশ তো মেয়েটা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছিল!”
পুলিশ চুপ। এ লোকটা নিছক সাধারণ কেউ নয়।
পুলিশ ঘরে ঢুকলো। রাজুর ঘর তল্লাশি শুরু করলো। ঘরে ধুলোর আস্তরণ, বাতাসে পোড়া গন্ধ। বিছানার নিচে কয়েকটা পুরনো পত্রিকা, একটা ফাঁকা সিগারেটের প্যাকেট, আর একটা একটা খাম পাওয়া গেল, পুরনো ভাঁজ করা, তার মধ্যে কয়েকটা ছবি।
ছবি গুলো সবই মেয়েদের। তাদের মধ্যে একটাতে লিনাকে দেখা গেল, হয়তো বাসা থেকে বেরিয়ে সিএনজি ধরছে, পেছন থেকে তোলা ছবি।
আরেকটায় দেখা যায়, লিনা কোনো কফি শপে বসে আছে, একা। দূর থেকে তোলা, ঝাপসা।
ইন্সপেক্টর কপাল কুঁচকে বললেন, “রাজু তবে লিনার পেছনে লেগে ছিল? কিন্তু লিনা সেটা জানতো না।”
লিনার একমাত্র কাছের বান্ধবী ছিল তৃষা। তাকে থানায় ডেকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো।
তৃষা বলল, “আমি কিছুদিন আগে লিনার ফোনে একটা ম্যাসেজ দেখেছিলাম। সাথে লিনার বিভিন্ন জায়গায় তোলা কিছু ছবি ছিল। আর লেখা ছিল, “তোর সব খবর আমার কাছে আছে। আমি সব সময় তোরে চোখে চোখে রাখছি। আমার কথা যদি শুনিস, তোর ভালো হবে। না হলে তোর কপালে খারাবি আছে।”
“তুমি কিছু বলোনি?”
“বলেছিলাম। কিন্তু ও বলেছিল, এটা নিশ্চয়ই কেউ মজা করে লিখেছে। তাই আমি আর চাপাচাপি করিনি। পরে ও নিজেও কখনো এ বিষয়ে কিছু বলেনি।”
এবার পুলিশ নিশ্চিত, কেউ লিনাকে ব্ল্যাকমেইল করছিল। সম্ভবত রাজু।
মোবাইল ট্র্যাকিংয়ে দেখা গেল, রাজুর শেষ অবস্থান ছিল লিনাদের বাসার কাছেই, ঘটনার আগের রাত সাড়ে দশটায়। এরপর তার মোবাইল একেবারে অফ হয়ে যায়।
ইন্সপেক্টর বললেন, “তার মানে, খুনের আগের রাতেই সে ওই এলাকায় ঘোরাঘুরি করছিল। এখন দেখার বিষয়, সে পরদিন দুপুরে আবার এসেছিল কেন?”
নিশ্চয়ই লিনার সাথেই দেখা করতে।
পুরো ব্যপারটা এবার ছবির মত পরিস্কার। সে আসলে জানতো সকালে কোন এক সময় সায়মা রহমান বাসা থেকে বাজার করতে বেরিয়ে যাবেন। তার বোন শিরিন নিশ্চয়ই তাকে এই খবরটা জানায়। তারপরই সে বাসায় ঢুকে ছাদে যেয়ে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সে সময়ই নিচতলার লিনাদের পাশের বাসার বুয়া রহিমা তাকে দেখে ফেলে।
পরবর্তীতে শিরিন বাড়িওয়ালার বাসা থেকে বের হয়ে ছাদ থেকে তাকে ডেকে আনে। শিরিনের মাধ্যমেই সে লিনার বাসায় ঢুকে এবং খুন করে পালিয়ে যায়।
তার মানে এই খুনের সাথে শিরিনও জড়িত। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, তার ভাই রাজু কেন লিনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে যাবে? এতে তার কি লাভ? নাকি রাজুকে সেই এ কাজে নিযুক্ত করেছিল?
এখন কথা হলো কেন তারা লিনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে গেল? আবার খুনই বা করতে গেল কেন? নাকি খুনটা হঠাৎই হয়ে গেল?
সকল প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে তাকে এখন রাজুকে পেতে হবে। আর রাজুকে পেতে হলে পেতে হবে শিরিনকেও।
শামিম সাহেবের মাথাটা আবারো তালগোল পাকিয়ে গেল।
“সাত”
পুলিশ এখন শিরিনের ব্যাকগ্রাউন্ডের খোঁজ নিচ্ছে । জানা গেল, সে একসময় পুরনো ঢাকার এক বস্তিতে থাকত। তার ভাই বিভিন্ন ক্রাইমে জড়িত থাকার অভিযোগে জেল কেটেছে। তবে তার মধ্যে কোনটাই খুন ছিল না।
তবে শিরিন নিজে বছর চারেক আগে এক শিশুর মৃত্যু ঘটনার সময় সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশের ডাকে থানায় গিয়েছিল। যদিও পরে কোন
প্রমাণ মেলেনি বলে ছাড়া পেয়ে যায়।
ওর তখনকার এক প্রতিবেশী জানাল, “মাইয়াটা কেমন জানি। খুব চুপচাপ, কিন্তু ওর চরাফেরায় একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে। কথা কওনের সময় কারো দিকে সরাসরি তাকায় না। ঘাড় কাইত কইরা অন্য দিকে তাকাইয়া কথা কয়।”
“বিয়ে শাদি করে নাই?”
“করছিল। কিন্তুক, জামাই চইলা যাওনের পর আর করে নাই।”
“তার তো একটা ভাই আছে, রাজু নাম। চেনেন নাকি?” তদন্তকারী পুলিশ অফিসার জানতে চায়।
“রাজু তো হের আপন ভাই না। পাতানো ভাই। জামাই চইলা যাওনের পর রাজুই হেরে দেইখা রাখে।”
ইন্সপেক্টর ভ্রু কোঁচকালেন। এই তথ্যটা নতুন। যদি তারা ভাই-বোন নাই হবে, তাহলে সম্পর্কটা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক ছিলনা। কিন্তু, তাদের সম্পর্ক যাই থাক, এখানে লিনা আসে কিভাবে?
তদন্তকারী এক অফিসার বছর চারেক আগে এক শিশুর মৃত্যু ঘটনার রেকর্ড থেকে শিরিনের একটি ছবি উদ্ধার করেন। ছবিটা সাদা-কালো। অনেকটাই ময়লা হয়ে গেছে।
ছবিটা নিয়ে শামিম সাহেব আবার লিনাদের বাসায় আসেন। ওটা দেখে সায়মা রহমান অনেক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন, “হ্যা স্যার, এটাই শিরিন। চুলের বাঁধন আর মুখের গঠন একেবারে মিলে যাচ্ছে। “
উপরে বাড়িওয়ালার বাসায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়। সেদিনের পর শিরিন আর কাজে আসেনি। । এমন সময় পাশের ফ্ল্যাটের রহিমা বুয়া চুপচাপ এসে বলেন, “স্যার, আমি একদিন দেখছি... লিনার খুনের আগের দিন বিকেলে শিরিন ছাদের দিক থেইকা আসতেছিল। তার মুখ কেমন জানি ঘামছিল। চোখে-মুখে একটা ভয়ের ছাপ ছিল।”
ইন্সপেক্টর নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটলেন। লিনার খুনের সাথে শিরিনের সম্পৃক্ততা এখন আর হালকা রইলো না।
সন্ধ্যার পরে ফরেনসিক টিম লিনার ল্যাপটপ ঘেঁটে একটি ভিডিও ফাইল উদ্ধার করে। ভিডিওটি খুনের দিনের, দুপুর ১১টা ৫০ মিনিটের। সম্ভবত ওয়েবক্যাম ভুল করে অন ছিল।
ভিডিওতে দেখা যায়, লিনা বসে আছে টেবিলের সামনে। কেউ একজন ঢুকছে ঘরে, মুখ দেখা যায় না, কিন্তু তার গলা শোনা যায়।
মেয়েলি গলা। কিছুটা কেঁপে কেঁপে বলছে , “তোমারে আমার ভাই এত ভয় দেহাইলো, ভাবছি তুমি চুপ থাকবা। তুমি কেন বুঝনা, তুমি কইয়া দিলে আমি শেষ হইয়া যামু।” শেষের দিকে কন্ঠটা আর্ত হয়ে উঠলো।
“তুই একটা খারাপ মেয়ে। তোর কারণে আরো অনেক ছেলে নষ্ট হবে। কাজেই আমি আর চুপ থাকবো না। আমি আজই মাকে সব বলে দেব।” লিনার রাগী কন্ঠ শুনা যায়।
“তাহলে তোকে মরতে হবে।” কন্ঠটা এবার চেঁচিয়ে উঠে। পরক্ষনেই একটা হুটহাঁট শব্দ। তারপরেই ল্যাপটপটা অফ্ হয়ে যায়।
এই কণ্ঠ শুনেই সায়মা রহমান আঁতকে ওঠেন। তিনি চাপা গলায় বলেন, “এই কণ্ঠটা… শিরিনের মতো। আমি নিশ্চিত না, কিন্তু খুব মিলে যাচ্ছে।”
তদন্তকারী অফিসার উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরেন। তৎক্ষনাত ফোনে নির্দেশ দিলেন, “ আমাদের যত সোর্স আছে সবার মাঝে শিরিনের ছবিটা ছড়িয়ে দাও। ওকে আমাদের যে কোন মূল্যে পেতে হবে।”
শিরিনকে এবার পুলিশ খুঁজে বের করেছে। একটা ঝুপড়ি ঘর, কড়াইল বস্তির কোণে, বাঁশের বেড়া আর টিনের চালার নিচে লুকিয়ে ছিল সে। অন্ধকার ঘরের এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে। পুলিশের সামনে চুপ করে থাকে। চোখ নামিয়ে, দু-হাতের আঙুল ঘষটাতে থাকে।
ইন্সপেক্টর শামীম সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি লিনাকে খুন করলে কেন?”
“সত্যি কইতাছি স্যার, খুন আমি করি নাই।” তার কণ্ঠে অনুনয়ের সুর।
“তুমি কি কোন কারণে লিনাকে ভয় পেতে?”
শিরিন এবার চুপ। মুখ না তুলে বলল, “আমারে দেখলেই ও মুখ ঘুরাইয়া নিত। সবসময় এমন ভাব দেখাইতো, যেন আমি খারাপ মাইয়া।”
“তাই বলে তাকে তুমি মেরে ফেলবে?”
“স্যার আমি সত্যিই খুন করি নাই।” এবার সে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো।
“তাহলে নিশ্চয়ই তোমার ভাই রাজু করেছে?” শামিম সাহেব চেঁচিয়ে বললেন।
“না স্যার খুন রাজুও করে নাই।” এবার সে সরাসরি চোখ তুলে তাকালো, “ হেয় শুধু আমার কথামত লিনারে ভয় দেহাইছে।”
“কিন্তু, খুনের সময় তো সে ওখানে ছিল। ওইদিন ওই বিল্ডিংয়ের ছাদে তাকে দেখাও গেছে।“
শিরিন চোখ নামিয়ে ফেলে। পরক্ষণেই আবার চোখ তুলে আনত কণ্ঠে বলে, “ রাজু গেছিল আমার সাথে দেখা করতে। হের তোলা লিনার ছবিগুলা আমারে দিতে আইছিল। আমি সেইগুলা দেখাইয়া লিনারে ভয় দেখাইতে চাইছিলাম। আমারে ছবি দিয়াই রাজু চইলা যায়।”
পুলিশের কাছে সবদিক দিয়েই শিরিনকে খুনী হিসেবে নিশ্চিত সন্দেহের দিকে টেনে নিচ্ছে। ওর অতীত। আগের বাসায় এক শিশুর মৃত্যু ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে তার নাম আসা। লিনার ল্যাপটপে তার কন্ঠ শুনা যাওয়া, সবই খুঁনী হিসেবে তার দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করছে।
তদন্তকারী এক অফিসার ফিসফিস করে বলল, “স্যার, এইটা তো পিওর মার্ডার কেস। লিনা সম্ভবতঃ শিরিনের কোন কুকর্ম জেনে ফেলেছিল। তাই এই মেয়েটা রাগে, হিংসায় তাকে খুন করে ফেলছে। আর এখন চুপ করে আছে।”
ইন্সপেক্টরও তেমনি ভাবছেন। এমন সময় শিরিন আবার কথা বলে উঠলো, “ খুন কে করছে আমি জানি স্যার। “ কিন্তুক, তার নাম আমি নিতে পারুম না।” বলেই সে হুঁ-হুঁ করে কেঁদে দিল।
“আট”
তদন্তকারী অফিসার ভবন মালিকের ড্রাইভারের সাথে কথা বলেন। তার নাম সেলিম। সে জানায়, “সেদিন খুনের আগের সপ্তাহে এক সন্ধ্যায় ছাদে গিয়েছিলাম, সিগারেট খেতে। অন্ধকারে একজন মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আর তার সঙ্গে একটা লোক ছিল।”
“লোকটা কে, চিনতে পেরেছো কি?”
“দেখতে পাইনি স্যার। ছায়া ছায়া। কিন্তু শরীরের কাঠামো দেখে মনে হয়েছিল, উনি এখানেই থাকেন।”
“তুমি মুখ দেখোনি?”
“না স্যার। শুধু একটা কথা শুনছিলাম, মেয়েটা কাঁদছিল আর বলছিল, ‘ও তো দেখে ফেলছে, এখন কী হবে?’”
পুলিশ চমকে গেল। “মেয়েটি কে হতে পারে?”
সেলিম বলল, “আমার মনে হয় মেয়েটা শিরিন ছিল।”
থানায় ফিরে এলো তদন্ত টিম। ইন্সপেক্টর এবার শিরিনকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি কারো সাথে সম্পর্কে ছিলে?”
শিরিন চুপ।
“এই বিল্ডিংয়ের কারো সঙ্গে?”
তবুও চুপ।
শেষমেশ মাথা নিচু করে বলল, “আমি কাউরে ঝামেলায় ফেলতে চাইছিলাম না। আমি ভালো থাকতে চাইছিলাম। কিন্তুক, লিনা মাইয়াটা আমারে ঝামেলায় ফালাইয়া দিল।”
“তার মানে, লিনা কি তোমাদের দেখে ফেলেছিল?”
শিরিন এবার চোখ তুলে তাকাল। তার চোখে পানি এসে গেছে। তখনই সে ফিসফিস করে বলল, “সে জানত সবকিছু। একদিন আমারে ওর বাসা থাইকা বের হইতে দেইখা ফালাইছিল। আমি বলছিলাম, ‘তুমি কাউরে বলো না।’
সে বলল, ‘আমি চুপ থাকব না।’
আমি তখন ভয় পাইছি। তাই ওরে ভয় দেখাইয়া থামাতে চাইলাম। কিন্তু, খুন আমি করি নাই।”
“তুমি একা ছিলে?”
শিরিন এবার মাথা নাড়ল না, শুধু বলে উঠল, “আমি একা না। ও ছিল আমার সাথে।”
“কে ছিল?”
“সে… আমার ওই লোকটা।”
“সে কে?”
শিরিন শুধু বলে, “সে এখানেই থাকে। কিন্তু আমি তার নাম বললে সে শেষ হয়ে যাবে। ” বলেই সে কেঁদে ফেলে।
পুলিশ তখনই আরও গভীরে অনুসন্ধান শুরু করল। তার কথাতেই বুঝা গেল সে মাঝে মাঝেই ওই বিল্ডিংয়ের এক নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে রাত কাটিয়েছে।
ফ্ল্যাটটি এমন এক পুরুষের, যাকে সবাই একজন পরিচ্ছন্ন, ভালো মানুষ বলে জানে।
কিন্তু সে কি বিবাহিত?
নাকি একজন একা যুবক?
নাকি বাড়ির মালিক নিজেই?
সব নাম সামনে আসতে শুরু করে, রাশেদ সাহেব (বাড়িওয়ালা), দু’তলার ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া রাফি (যুবক), অথবা উল্টোদিকের বিবাহিত ভাড়াটিয়া সোহেল ভাই, যিনি সন্ধ্যায় ছাদে সিগারেট খেতেন।
কিন্তু কে আসল লোকটি? শিরিন এখনো মুখ খোলেনি ।
বাড়ির গেটের সামনে এক ছোট মুদির দোকানে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। পুলিশ এতদিন সেটা পায়নি, কারণ দোকানদার গ্রামে ছিল।
ফুটেজ খুলে দেখা গেল, লিনার খুনের আগের দিন সন্ধ্যায়, শিরিনকে দেখা যাচ্ছে এক পুরুষের সঙ্গে দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে গেটের দিকে যেতে।
ছবিতে মুখ স্পষ্ট না, কিন্তু শরীরের গঠন, চলার ভঙ্গি এগুলো দেখে অফিসাররা সন্দেহের চোখে তাকায়। তবে তারা নিশ্চিত হতে পারে না।
দোকানদারকে জিজ্ঞেস করতেই বলে, “চিনি তো। আমার দোকান থেকে প্রায়ই সিগারেট কিনে। এই বিল্ডিংয়েরই দু’তলায় থাকে।”
“মেয়েটারে চেনেন?”
“হ্যা চিনি স্যার। এই বাসার বাড়িওয়ালার বাসার কাজের মাইয়া। আমার দোকানের মোবাইল থাইক্যা প্রায়ই ফোন করে।”
“তাই নাকি। তা কোথা বা কোন নাম্বারটায় ফোন করে বলতে পারবেন?”
“কই করে তা জানিনা, তয় নাম্বারটা দিতে পারবো স্যার। সবসময় একটা নাম্বারেই কল করে দেইখা নাম্বারটা আমার চেনা হয়ে গেছে। মোবাইল ঘাটলেই পায়া যামু। তবে স্যার কথা বেশী কয়না। খুব আস্তে করে কথা কয়। বেশীক্ষণ না। এই ধরেন আট দশ সেকেন্ড। খালি জিগায়, আইজ আমু?” তারপর হু হ্যা করেই কল কেটে দেয়।
নাম্বারটি পাবার পর চেক করে দেখা যায় ওটা একটা গ্রামীন নাম্বার যা এই মুহুর্তে বন্ধ আছে। ইন্সপেক্টর সিমটি কার নামে নিবন্ধিত খোঁজে দেখার নির্দেশ দেন।
এমন সময় রাস্তার ওপাশে গেটের দিকে চোখ যায় তার। দাঁড়োয়ান ইউনুসের সাথে একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। সে এ পাশে তাদের দিকে আংগুল দেখিয়ে কি যেন বলছে।
ছেলেটাকে চিনতে পেরে ইন্সপেক্টর নিজেই এগিয়ে গেলেন।
“আপনি রাফি?”
“জ্বী। আমি আপনাদের কাছেই যেতে চাচ্ছিলাম।“
“তাই নাকি?” শামিম সাহেব কিছুটা অবাক। রাফিকে সন্দেহভাজনদের তালিকা থেকে অনেক আগেই বাদ দিয়েছেন তিন। “তা কি ব্যপার?”
“বিবেকের দংশনে প্রতি মুহুর্তে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি আমি। তাই নিজেকে আর চেপে রাখতে পারছিনা। সত্যি বলতে কি, লিনাকে আমিই খুন করেছি।” রাফির গলাটা কেঁপে উঠলেও বেশ সংযত কণ্ঠেই কথাগুলো বললো সে।
মনে হলো প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেলেন তিনি। এটা তিনি কিছুতেই আশা করেন নাই। তার মানে রাফিই শিরিনের গোপন প্রেমিক। হ্যা সব মিলে যাচ্ছে। রাফির ফ্লাটে একা থাকা। মাঝে মাঝে ছাদে যাওয়া। মনে হয় লিনা ব্যপারটা দেখে ফেলেছিল। তাই পথের কাঁটা সরাতেই ......! মুহুর্তেই রেগে গেলেন তিনি। সাথের কনস্টেবলদের নির্দেশ দিলেন, “টেক হীম কাষ্টোডি। রাইট নাও।”
নিমেষেই তার হাত চলে গেল মাথায়। এবার তিনি টেনে নিজের এক গোছা চুল ঠিকই তুলে ফেললেন।
“নয়”
তদন্ত টীম রাফিকে নিয়ে থানায় ফিরে এলো। তাকে দেখেই শিরিনের চোখ-মুখ গেল শুকিয়ে। উল্টোদিকে রাফির চোখে তখন আগুন। তার চোয়াল শক্ত হয়ে যাওয়াটা নজর এড়ালো না শামিম সাহেবের। তাকে নিয়ে তিনি আলাদা একটা ঘরে ঢুকলেন।
“আপনি বলছেন, লিনাকে আপনি খুন করছেন। তা মোটিভ কি?” সামনে রাখা একটা চেয়ারে বসতে বললেন রাফিকে। নিজেও আর একটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসলেন।
“না। আমি আসলে বলতে চাইছি। খুনটা আমি সরাসরি করিনি। কিন্তু, আমার কারণেই আজ লিনাকে প্রাণ দিতে হলো।” রাফির দৃষ্টি আনত।
“ফাজলামো করেন মিয়া?” ইন্সপেক্টর সাহেব রেগে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। “এখানে কি লুকোচুরি খেলা চলছে?” হাতটা আবার মাথায় চলে যাচ্ছিল। পরমুহুর্তে ওটাকে থামালেন। ধপ্ করে বসে পড়ে মাথাটা সামনের দিকে ঠেলে দিলেন। রাফির মুখের সামনে এসে ওর চোখের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর আবার পিছিয়ে এসে শরীরটা চেয়ারের ব্যাকরেস্টে এলিয়ে দিয়ে বললেন, “ঘটনাটা কি? এখানে আপনার ভূমিকাটা পুরো খুলে বলেন দেখি।”
এবার রাফিকে কিছুটা সুস্থির মনে হলো। “আমি মাঝে মাঝে পড়তে পড়তে মাথা ধরে এলে ছাদে যেতাম। একদিন সন্ধ্যেয় ছাদে যেয়ে দেখি দুজন মানুষ একজন আরেকজনকে জড়াজড়ি করে আছে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। তড়িৎ কোন শব্দ না করে নিচে নেমে এলাম। তারপর আমার ফ্লাটের দরোজার সামনে এমন ভাব করে দাঁড়িয়ে থাকলাম, যেন আমি তালা খুলতে যাচ্ছি।”
“তারপর?”
“বেশ কিছুক্ষণ পর মাথায় ওড়না চাপানো একটা মেয়ে উপর থেকে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। মেয়েটা শিরিন। আমাদের বাড়িওয়ালার কাজের মেয়ে। তারপরও আমার একটু সন্দেহ হয়। ভাবলাম, সে হয়তো তিনতলা থেকে আসছে। আমি অপেক্ষা করি, পুরুষ মানুষটা কে নামে, তা দেখার জন্য।” একটা জোরে শ্বাস নেয় রাফি। “দেখি যে মানুষটা নামছে, সে আর কেউ নয়। আমার ফ্লাটের উল্টোদিকের সোহেল ভাই। রোকসানা ভাবীর বর। উনার মুখ থেকে সিগারেটের কড়া গন্ধ আসছে। উনি আমাকে দেখে, ‘একটা বিড়ি টেনে এলাম’, বলে হেসে দিলেন। আমিও স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলাম, ’ও আচ্ছা’। বাসায় থাকলে উনি প্রায়ই ছাদে যেয়ে সিগারেট টানেন, এটা আমার জানা ছিল।” একটু থামলো রাফি।
শামিম সাহেবের উত্তেজনা তুঙ্গে। “তারপর কি হলো?”
সোহেল ভাই বাসায় ঢুকে যেতেই, আমি আবারো দৌড়ে ছাদে গেলাম। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না। বুঝে গেলাম, মেয়েটা শিরিনই ছিল।
“কিন্তু, এর সাথে লিনা কিভাবে জড়ালো?” ইন্সপেক্টর মাথা নাড়িয়ে জানতে চাইলেন।
“তারপর দিনই সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে লিনার সাথে দেখা। ওকে আমি পছন্দ করতাম। কিন্ত, কখনো সাহস করে বলতে পারিনি। সত্যি বলতে কি, ওর সাথে আমার কখনো কোন কথাই হয়নি। স্রেফ দেখা হলে চোখাচোখি, এই পর্যন্ত। ভাবলাম ওর সাথে কথা বলার এটাই সুযোগ। তাছাড়া শিরিন মাঝেমাঝে ওদের টুকটাক কাজ করে দিত, সেটা আমি দেখেছি। তাই বিন্দুমাত্র ভনিতা না করে, সোহেল ভাই-শিরিনের ব্যপারটা ওকে বলে দিলাম। ও খুব অবাক হলো। বললো, ‘প্রমাণ ছাড়া কিছু বলা ঠিক হবে না’। ওর নাম্বার দিল, বললো আবার তেমন কিছু দেখলে আমি যেন ওকে জানাই।”
“হুম্ম, লিনার নাম্বার আপনার কাছে কিভাবে এলো বুঝতে পারছি।” শামিম সাহেব ভ্রু উঁচু করে বললেন। “কিন্তু, এটা লিনার খুন পর্যন্ত গেল কিভাবে?”
“একদিন সন্ধ্যায় আমার ফ্লাটে ঢুকতে যাবো। এমনি সময় রোকসানা ভাবী বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখে বললেন, ’বাবার বাড়ি যাচ্ছি। কদিন থাকবো। মা’র শরীরটা ভালো না’। ভাবী দরজা লক করে নেমে যেতেই আমার মাথা খুলে গেল। তড়িৎ আমার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে আই হোলে চোখ রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখি সোহেল ভাই বাসায় ঢুকলেন। তার মিনিট খানেক পরেই শিরিন এলো উপর থেকে। উল্টোদিকের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক তাকালো। তারপর দরজাটা খুলতেই টুক করে ভেতরে ঢুকে গেল। পুরো ব্যপারটা বুঝে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। আমি দ্রুত লিনাকে ফোন দিলাম। সে তখনও বাসায় ফিরেনি। বললো আমাকে চোখে চোখে রাখতে। ফিরেই ব্যবস্থা নেবে।”
শামিম সাহেবের চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে। “বলে যান, তারপর কি হলো“
“ঘন্টা খানেক পর উল্টোদিকের দরোজা খুলে গেল। সোহেল ভাই বেরিয়ে আশপাশ তাকালো। তারপর উনার পেছন থেকে শিরিনকে বেরিয়ে নিচে চলে যেতে দেখলাম। ততক্ষণে সোহেল ভাই আবার দরোজা লাগিয়ে দিয়েছে। তখনও আমি জানতাম না, নিচে লিনা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। ফলে শিরিন লিনার মুখোমুখি পরে গেল। “
“পুরো ব্যপারটাই এবার বুঝলাম। কিন্ত, এর জন্য আপনি নিজেকে খুনী ভাবছেন কেন?”
“স্যার আমি যদি লিনাকে এই ব্যপারটা না বলতাম, তাহলে আজ তাকে মরতে হতো না।” একটা বড় করে দীর্ঘশ্বাস নিল রাফি। তার চোখ-মুখ আবারো আর্ত হয়ে উঠেছে। “ওর মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।”
হেসে দিলেন শামিম সাহেব। তার বুকটা অনেক হালকা হয়ে গেল। বুঝতে পারলেন, টিন-এজ আবেগের বশে ছেলেটা প্রেমিকার খুনের জন্য নিজেকে দোষী ভাবছে। রাফি খুনী নয়, এটা বুঝতে পেরে তিনি খুব স্বস্থি বোধ করলেন।
এমনি সময় কনষ্টেবল এসে জানালো, মুদি দোকানের মোবাইল থেকে নেওয়া নাম্বারটার হদিস পাওয়া গেছে। ওটা সোহেল আহম্মেদ নামে রেজিষ্টার্ড করা। “ওকে বয়। ইউ আর ফ্রী নাও। বাট মাইন্ড ইট, ইউ আর আওয়ার মেইন উইটনেস। সো নেভার লিভ দা টাউন উইদাওট মাই পারমিশন। ওকে?” রাফির উদ্দেশ্যে শেষ কথা ক’টি বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
সোহেল ভাইকে থানায় ডাকা হলো। সঙ্গে তার স্ত্রীও আছেন।
পুলিশ জিজ্ঞেস করল, “আপনি শিরিনকে চিনেন?”
সোহেল চমকে গেল। বলল, “মানে... ওকে দেখেছি, আমাদের সামনের ফ্লাটে মাঝে মাঝে আসত।”
“আপনার সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক ছিল?”
সোহেল এবার চুপ। ঘামতে লাগল। তার স্ত্রী তেড়ে উঠলেন, “কি বলছে ওরা? সম্পর্ক মানে?”
ইন্সপেক্টর এবার সব কিছু খুলে বললেন।
রোকসানা ভাবী চেঁচিয়ে উঠলেন, “ও, এ জন্যই বুঝি তোমার সিগারেট খাবার ব্যামো উঠলেই ছাদে চলে যেতে। অথচ এদ্দিন ভাবছি, আমি সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারিনা বলে তুমি ঘর থেকে বাইরে যেতে।” তিনি দু’হাতে মাথা চাপড়াতে লাগলেন।
সোহেল এবার আর চুপ থাকতে পারল না। সে মাথা নিচু করে বলল, “আমি ভুল করছি স্যার। আসলে আমাদের বাচ্চা হয়না। তাই শিরিনরে ফুঁসলাইছিলাম, যদি ও কনসিভ করে, তাহলে ওকে আমি বিয়ে করব।
কিন্তু ও ভয় পাইছিল। বলছিল, ‘মেয়েটা (লিনা) ওকে দেখে ফেলেছে’। আমি বলছিলাম কিছু হবে না। কিন্তু ও মানছিল না। তাই ওর ভায়েরে লাগাইছিল মেয়েটারে ব্ল্যাকমেইলিং করতে। কিন্তু, লিনা ভয় পায় নাই। ”
“তাহলে খুনের সময় আপনি ছিলেন কোথায়?”
সোহেল মুখ তুলল না। চোখে জল। “শিরিন যখন লিনাকে ভয় দেখাইতেছিল, আমি তখন বাইরের ঘরেই ছিলাম। ওইদিন আমি অফিসে যাই নাই। লিনা খুন হবার একটু আগেই বাসা থেকে বের হই সিগারেট খেতে। ছাদে যাবার পথে শিরিনের সাথে দেখা হয়। বলে, সে লিনার ছবিগুলো পাইছে। এখন যাইতাছে ওরে ভয় দেখাইতে। আমিও ওর পিছু নিলাম। লিনা দরোজা খুলতেই কিছু বুঝে উঠার আগেই শিরিন ঘরে ঢুকে গেল।”
“আপনি সঙ্গে গেলেন?”
“আমি প্রথম বাইরেই দাঁড়ায়া ছিলাম। পরে কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। শুনলাম শিরিন আর লিনা কথা কাটাকাটি করছে। পরমুহুর্তে একটা ধস্তাধস্তির শব্দ শুনে লিনার রুমে ঢুকে দেখি শিরিন পেছন থেকে লিনাকে জাপটে ধরে এক হাতে মুখ চেপে আছে। আমায় দেখেই বললো, ’হারামজাদির গলাটা চাইপ্পা ধরো, চিল্লাইলে তুমি-আমি দু’জনেই শেষ’।”
তখনি লিনার মুখ থেকে হাত সরে যায় শিরিনের। সেই সুযোগে সে চেঁচিয়ে উঠে, ‘আমি তোদের মুখোশ খুলে দিব’।”
“আমার তখন কি যে হয়। লাফিয়ে ওর সামনে চলে যাই। সর্বশক্তি দিয়ে ওর গলাটা চেপে ধরি। ও শ্বাস নেবার জন্য হাশপাশ করে উঠলো। কিন্তু, শিরিন ওকে পেছন থেকে জাপটে ধরায় সুবিধা করতে পারলো না। কতক্ষণ পর দেখি ওর চোখ উল্টে গেছে। আমি ভয় পেয়ে গলা ছেড়ে দেই। তখন বুঝিনি ও মরে গেছে। বিশ্বাস করেন স্যার, আমি তাকে মারতে চাইনি। শুধু ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম।”
উপস্থিত সবাই চুপ। সোহেলের কথা শুনে সবাই শ্বাস ফেলতেও ভুলে গেছে। রোকসানা ভাবী ফুপিয়ে উঠলেন, “এই জন্যই আমি বাবার বাড়ি গেলে তুমি যেতে চাওনা। এই ছিল তবে তোমার মনে। শয়তান, ধোঁকাবাজ, খুনী, আমি তোর ফাঁসি চাই।”
শিরিনকে আবার জেরা করা হয়। পুলিশ জিজ্ঞেস করে, “তুমি খুন করেছ?” শিরিন মাথা নাড়ায় না। চোখে জল।
সে শুধু বলে, “আমি জানতাম না, ও মারা যাবে। আমি চেয়েছিলাম ভয় দেখাতে। ও আমার জীবনটা ধ্বংস করে ফেলত।”
“তুমি কিন্তু একবারো বলনি, খুন তুমি করেছো। এখন কিন্তু, প্রমাণ হলো, এই খুনে তুমিও জড়িত।”
“আমি জানি স্যার, আমি দোষী। কিন্তু বিশ্বাস করেন। আমি চাইনি ও মরে যাক।”
সোহেল ও শিরিন দুজনেই গ্রেপ্তার হয়। তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও হত্যা মামলার চার্জশিট হয়। তদন্ত শেষে আদালত জানায়। শিরিন-লিনার গোপন প্রণয় প্রকাশ পাওয়ার ভয়ে করা এটা পরিকল্পিত হত্যা, যাতে
শিরিন ও সোহেল দু’জনেই সমান অপরাধী। সকল সাক্ষ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারের রায়ে তাদের ফাঁসির আদেশ হয়।
লিনার মা সায়মা রহমান বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মনে হলো আকাশ থেকে একটা তারা ঝরে গেল। তারপরেও আকাশটা আগের মতই ঝলমলে রইলো। একটা তারা নেই হয়ে যাবার পরেও আকাশের সৌন্দর্য এতটুকু ম্লান হয়নি। জল চলে এলো তার চোখে।
চেহারায় একটা বোবা যন্ত্রণা। তার বুকের ভেতর কেবল একটাই জিজ্ঞাসাঃ “আমার মেয়েটা শুধু একটা মিথ্যে সম্পর্কের আড়াল সরিয়ে সত্যটা প্রকাশ করতে চেয়েছিল। এজন্য কেন তাকে মরতে হবে? তবে তো প্রমাণ হলো, সত্যের চেয়ে মিথ্যাই শক্তিশালী।
(শেষ)