পরগাছা থেকে মহীরুহ

পরগাছা (আগষ্ট ২০২৫)

বিষণ্ন সুমন
  • 0
  • ২১
শরতের শেষভাগ। আকাশে হালকা কুয়াশা। চারপাশের সবুজে যেন ধুয়াটে এক পর্দা টেনে দিয়েছে প্রকৃতি। সেই প্রকৃতির বুক চিরে নিঃশব্দে হাঁটছে এক কিশোর, নাম তার রুবেল। বয়স সতেরো। জন্ম থেকেই এক পা দুর্বল, হাঁটার সময় একটু টলে পড়ে। গ্রামের মানুষ তাকে দেখে হাসে, বন্ধুদের কেউ কেউ টিপ্পনী কাটে, পরিবারের মানুষজন চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। তার মা ছোটবেলাতেই মারা গেছে। বাবা সর্বক্ষণ রাগে ফুঁসে থাকে। বলে, “তুই একটা বোঝা, তোর জন্মটাই আমার জন্য অভিশাপ!”
এভাবেই দিনগুলো কাটে রুবেলের অসহায়, একা, বোঝা হয়ে বেঁচে থাকার দায়ে লজ্জিত। সে বুঝে গেছে, তার এই দেহে সমাজের কোন স্বপ্ন ফোটে না, পরিবারের কোনো গর্ব জাগে না। তার থাকা না থাকায় যেন কিছুই যায় আসে না কারো। সে যেন এক পরগাছা। নিজে কিছু দিতে পারে না, শুধু টিকে আছে অন্যের করুণায়।
রাতগুলো আরও কঠিন। ঘরের কোণে শুয়ে থেকে কখনও ভাবনা আসে, “আচ্ছা, আমি না থাকলে কি বাবা একটু হালকা বোধ করবে?”
এক রাতে, গভীর ক্লান্তি আর একাকীত্বে সে সিদ্ধান্ত নেয়, এই দুঃসহ জীবন আর নয়। পরদিন ভোরবেলা, যখন গোটা গ্রাম ঘুমিয়ে, তখন রুবেল হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছনের বাঁশবনের মাঝখানে একটা পুরনো গাছের কাছে যায়। হাতে দড়ি, চোখে জল, মনে একটাই চিন্তা- তার শেষ মুক্তি।
সে গাছে ওঠে। টালমাটাল শরীর নিয়ে একটা শক্ত ডাল খুঁজে পায়। দড়ির ফাঁসটা ঠিকঠাক গলায় ফিট করে। তখনই, তার চোখ আটকে যায় এক আশ্চর্য দৃশ্যে।
একটা পিপঁড়ে তার একটা পা ভাঙ্গা, চলাফেরায় খানিক খোঁড়ামি স্পষ্ট। পিঁপড়েটা এক সরু ডাল দিয়ে উপরে উঠছিল। হঠাৎ হাওয়া আসে, ডাল নড়ে ওঠে, পিঁপড়েটা পড়ে যেতে গিয়েও আঁকড়ে ধরে একটা পাতাকে। পড়ে না। দাঁতে কামড়ে, বাকী পাগুলোয় ভর দিয়ে, শরীর ঠেলে সে আবার ওঠে। বারবার পড়ে গিয়ে আবার উঠে পড়ে।
রুবেল এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি। সে তাকিয়ে থাকে অবাক হয়ে। মনে হয়, সেই পিঁপড়েটার জীবনের সঙ্গে তার নিজের এক অদৃশ্য যোগসূত্র রয়েছে। একটা ক্ষদ্র প্রাণীও যদি বাঁচতে চায় এতটা প্রবলভাবে, তবে সে কেন হার মেনে নিচ্ছে?
তার হাত কাঁপতে থাকে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। সে আস্তে আস্তে দড়িটা খুলে ফেলে। গাছ থেকে নেমে এসে মাটিতে বসে পড়ে। বুকের ভেতর যেন কিছু একটা হু হু করে ওঠে।
সে ভাবে, “না, আমাকেও বাঁচতে হবে। অন্য কোথাও গিয়ে, অন্যরকম ভাবে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। আমি আর কারো বোঝা হব না। পরগাছার জীবন আর না। আমি প্রমাণ করে দেব, সময়ে আমি নিজেই কারো আশ্রয় হয়ে উঠতে পারি।”
সেদিন দুপুরেই, কাউকে কিছু না জানিয়ে রুবেল বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। পেছনে পড়ে থাকে তার ছোট্ট ঘর, পরিচিত গ্রাম আর ঠান্ডা চোখের মানুষগুলো।
সে পৌঁছায় একটা দূর শহরে। ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন মানুষ। পরিচিত কেউ নেই, খাবার নেই, থাকার জায়গা নেই। কিন্তু ইচ্ছা আছে বাঁচার, হারের বদলে নিজেকে তৈরি করার।
দুই দিন না খেয়ে কাটানোর পর একদিন শহরের এক রিকশা গ্যারেজে গিয়ে দাঁড়ায়। তার সব কথা শুনে মালিক মাথা নাড়ে। অবিশ^াসের সুরে বলে, “তুই কোন কাজ করতে পারবিনা।”
রুবেল শুধু বলে, “আমাকে বাঁচতে হবে। তাই কাজ শিখতে চাই। আমাকে একটু সুযোগ দিন।”
অবশেষে মালিকের দয়া হয়। তাকে প্রথমে দেওয়া হয় ঝাড়– হাতে গ্যারেজ পরিস্কারের কাজ। তারপর তেল টানার, রিক্সার চাকা লাগানোর, ধাতব যন্ত্র খুলে আবার জোড়া লাগানোর। সে কোন কাজেই না করে না। ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়ে না। হাতের পেশি ব্যথা করে, তবুও সে থামে না। শরীর তার অর্ধেক, কিন্তু মনটা যেন এই ক’দিনে দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
দিন যায়, মাস পেরোয়। মালিক তাকে দেখে হাসে। এক বছর পর, একদিন গ্যারেজ মালিক নিজেই বলে, “তুই এখন আমার থেকেও ভাল চাকা লাগাতে পারিস রে!”
তখন থেকে সবাই তাকে ‘ছোট মেকানিক’ বলে ডাকে। পরের কয়েক বছরে সে হয়ে ওঠে শহরের সবচেয়ে চৌকস রিকশা মেকানিকদের একজন। গ্যারেজের মালিক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পুরো গ্যারেজের দায়িত্ব দিয়ে দেন।
বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর, মালিক মারা যান। তার কোনো পরিবার ছিল না। তাই মৃত্যুর আগে গ্যারেজটা তাকেই লিখে দিয়ে যান, কারণ ততদিনে রুবেল তার ছেলে হয়ে উঠেছে।
আজ দশ বছর পেরিয়ে গেছে। শহরের ব্যাস্ত রাস্তার প্রতিটা রিক্সার আস্থার জায়গা হয়ে উঠেছে “রুবেল অটোমোবাইলস, যার প্রতিটি চাকার পেছনে রয়েছে এক অসম্ভব ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের গল্প।”
রুবেল এখন সফল। কিন্তু একটুও বদলায়নি। সে এখনও ভুলে যায়নি বাঁশবনের গাছের ডালে পড়ে থাকা সেই পিঁপড়েটার কথা। এখনও প্রতিদিন গ্যারেজে আসার সময় নিজের আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নেয়। নিজের চোখে বলে, “তুই পেরেছিস রুবেল। নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছিস। তুই দেখিয়ে দিয়েছিস, ইচ্ছে থাকলে অক্ষমতাও একদিন সাফল্যের হাতিয়ার হতে পারে।”
একদিন সকালে, গ্যারেজের বাইরে একজন বৃদ্ধ এসে দাঁড়ায়। কাপড়চোপড় এলোমেলো, চোখে ক্লান্তি। রুবেলের সামনে গিয়ে বলে, “আমায় কিছু খেতে দেবে বাবা?”
রুবেল চিনতে পারে, লোকটা আর কেউ নয়,তারই জন্মদাতা বাবা। সে কাঁপা গলায় বলে, “বাবা? আমায় চিনতে পারছেন না? আমি আপনার ছেলে রুবেল।”
বৃদ্ধের মলিন মুখে হাসি ফোঁটে উঠে। চোখে পানি। কাাঁপা কন্ঠে বলে, “অনেক খোঁজ করেছি তোর। আমি ভুল করেছিলাম... তোকে বোঝা ভেবে ঘর ছাড়তে বাধ্য করেছিলাম। আজ আমি নিজেই সর্বস্বান্ত। আমায় তুই ক্ষমা করে দে বাবা।”
রুবেল কেবল তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চোখে জল জমে। তারপর হাসে। সামনে রাখা চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “বসুন বাবা। আজ থেকে আপনি আমার সাথেই থাকবেন। এই গ্যারেজে একসময় কেউ আমাকে থাকার সুযোগ দিয়েছিল। এখন আমার পালা।”
বৃদ্ধ লোকটা চেয়ারটায় বসে পড়ে। চারপাশে গ্যারেজের শব্দ, যন্ত্রপাতির টকটকে গ্রীজ আর তেলের গন্ধ, আর তার চোখে মুগ্ধতা মাখা বিস্ময়।
ততক্ষণে রুবেল আবার নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। পেছন থেকে সূর্যের আলো এসে পড়ে তার গায়ে।
তার দিকে তাকিয়ে আছেন বৃদ্ধ বাবা। ভাবছেন তার একপায়ে ভর দিয়ে কষ্ট করে চলা ছেলেটা এখন আর পরগাছা না, সে এখন নিজেই ছায়াদানকারী মহীরুহ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী বাহ্ চমৎকার কথামালা অসাধারণ প্রকাশ।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

শরতের শেষভাগ। আকাশে হালকা কুয়াশা।

২৪ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "প্লেন ক্র্যাশ”
কবিতার বিষয় "প্লেন ক্র্যাশ”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ আগষ্ট,২০২৫