পাক্কা চার মাস পর মাসুমের আজ জ্ঞান ফিরেছে । মাসুম তাকিয়েই দেখতে পেলো চারিদিকে কেবল সারি সারি বেড । কোনটা উন্মুক্ত কোনটা মশারী দিয়ে চারদিক ঘেরা । মাঝে মাঝে অস্পষ্ট গোঙানীর শব্দ কানে আসছে । মাসুম খেয়াল করতে চেষ্টা করছে জায়গাটি কোথায় ? এর আগে কোন দিন এমন জায়গা দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না । মাসুম উঠে বসতে চাইলো । কিন্তু সে উঠতে পারছে না কেন ? সামনে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার দুটো পা’ই সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো । তার কি হয়েছে ? কখন হয়েছে কিছুই মনে পরছে না ।
দুর থেকে নার্স রোগীর নড়চড়া দেখতে পেয়ে দেৌড়ে কাছে এলো । হায় আল্লাহ আপনার জ্ঞান ফিরেছে ! আপনি কি আমায় চিনতে পারছেন ? মাসুম ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়াল না সে চিনতে পারছে না । কোথাও দেখেছে বলে তার মনে পড়ছে না । মাসুম বললো আমি কোথায় ? নার্স বললো –এটা ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট । আজ কয় তারিখ ? আজ ২৫শে মার্চ ২০১৪ইং । এখানে আপনি চারমাস যাবৎ অচেতন অবস্থায় ভর্তি আছেন । কেন আমার কি হয়েছে ? আপনি বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলেন কারা যেন আপনাকে বেওয়রিশ হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি করে রেখে গেছে । আজ প্রায় চার মাস । আমরাতো আপনার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম । কোন পূন্যের জোড়ে যে আপনি সেরে উঠেছেন তা কেবল আল্লাহ ই জানেন । এ কয়মাস যমে মানুষে টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত মানুষের জয় হলো । প্লিজ নড়বেন না আমি স্যারকে ডেকে আনছি । ডাক্তার এলেন স্টেটিসস্কোপ লাগিয়ে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে বললেন-গুড আপনি এখন শংকামুক্ত । মাসুম যেন বোবা হয়ে গিয়েছে সে কিছুই বলছে না । আপনি কি আমায় শুনতে পাচ্ছেন । মাসুম মাথা ঝাকিয়ে জানাল সে শুনতে পাচ্ছে । আপনার নাম কি ? মাসুম মনে করতে চেষ্টা করছে । বেশ কিছুক্ষন পর বললো- আমি মাসুম আলী , পিতা- আহমদ আলী, গ্রাম-ঝাড়কান্দি, থানা –দেওয়ানগঞ্জ, জেলা- জামালপুর । কি ভাবে কি ঘটে ছিল কিছু কি মনে আছে আপনার ? মাসুম বললো কিছুই মনে পড়ছে না । ঠিক আছে আপনি শুয়ে আরাম করুন আর আস্তে আস্তে মনে করতে চেষ্টা করুন । আমি কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি নার্স আপনাকে দিয়ে দিবে । একটু পর নার্স এসে মাসুমকে একটা ইনজেকশান দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে মাসুম ক্রমান্বয়ে ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেল ।
কি আশ্চর্য এই জীবন, এই প্রকৃতি । সামান্য একটা ঘটনায় পাল্টে যায় তাবৎ পৃথিবীর নিয়ম, গতি প্রকৃতি । সামান্য বর্ষনে পাথরের উচুউচু পাহাড় ধসে পড়ে । পাথরে পাথরে ঘর্ষনে সৃষ্টি হয় বালু কনায় । তা আবার স্রোতের টানে ছুটে চলে মাঠঘাট বন বনানী ছাড়িয়ে নদী বয়ে সাগর পানে । কখনো আটকে পড়ে সৃষ্টি হয় চরার । নতুন চরা রূপান্তরিত হয় আবাদী জমিতে । সেই ক্ষুদ্র বালুকনা আবার চুন সুরকির মিলনে গড়ে তুলে নতুন নতুন প্রাসাদ অট্টালিকার । মানুষের জীবনেও আছে আলাদা আলাদা গল্প, আর কল্প কাহিনীর । একএক জনের জন্মের আর বেড়ে উঠার কাহিনী এক এক রকম । কখনো সামান্য একটি ঘটনা মানুষের জীবনের স্বপ্নসাধ আহলাদ নিমেষেই ধুলোয মিশিয়ে দেয় ক্ষুদ্রক্ষুদ্র বালু কনার মত । যুদ্ধ, বিগ্রহ, মারামারি, হানাহানি অথবা প্রাকৃতিক সৃষ্ট বিপর্যয় কিংবা মানুষ্য সৃষ্ট ঘটনায় ।
মাসুমের জন্ম শান্ত স্নিগ্ধ এক নিবিড় পল্লীতে । যেখানে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে গ্রামের রূপ বদলায় প্রাকৃতিক নিয়মে । এখন বসন্তকাল । নতুন পত্রপল্লবে আর ফুলেফুলে ছেয়ে আছে গ্রামের প্রতিটি গাছপালা । আম্র মুকুলের মেৌ মেৌ ঘ্রান ছড়িয়ে আছে চারদিক । শিমুল আর পলাশের শাখে শাখে আগুন লেগেছে । গ্রামে গ্রামে যেন অগ্নির নাচন শুরু হয়েছে । ঝরে পড়া ছোট ছোট আমের কুড়ি ছড়িয়ে আছে পুরো আমবাগান । আর কয়দিন পরেই গাছের ডালে ডালে ঝুলে থাকবে কাঁচা পাঁকা আম । কালবোশেখী শুরু হলেই গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই নেমে আসবে গাছ তলায় আম কুড়াতে । গাছের মগডাল থেকে ভেসে আসবে কোকিলের কুহুকুহু তান । প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙ্গে দোয়েল কোয়েলের শীষে । উদাস করা জৈষ্ঠের দুপুরে ভেসে আসে ঘুঘুর ডাক ।
মাসুম স্থানীয় কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আশায় ঢাকা এসেছে । দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে পুরোদমে । তবুও বড় আশা নিয়ে ঢাকা এসেছে । ঢাকায় কোন আত্নীয় পরিজন না থাকায় উঠেছে এলাকার বড়ভাইয়ের সাথে হলে । রাতে নিচে বিছানা পেতে কোন রকমে চালিয়ে যাচ্ছে । বেশ ক’দিন হয়ে গেলো । দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে । সড়কপথ, রেলপথের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন । প্রতিদিন কোথাও না কোথাও রেল উপরে ফেলছে বড়বড় গাছ ফেলে রাস্তা বন্ধ করে রাখা হচ্ছে । কতদিন মা বাবা ছোট ভাই ও বোনটিকে দেখছেনা ভিতরটা কেমন যেন আনচান করে উঠছে । ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ মাসুম সাহস করে বাড়ীর উদ্দেশ্যে হল থেকে বেড়িয়ে পড়লো । বড় ভাই বেশ কবার বারন করেছে কিন্তু মাসুমের উতলা মনকে আটকাতে পারলো না । হল থেকে বেড়িয়েই কমলাপুর রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে একটা রিকসা নিলো । পথে পথে বিভিন্ন বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে রিকসা এগিয়ে চলেছে । মতিঝিল কলোনীর টিএন্ডটি স্কুলের সামনে যখন পেৌছালো হঠাৎ কলোনীর ভেতর থেকে একদল লোক হাতে বিভিন্ন প্রকার আগ্নেয়াশ্র নিয়ে এলোপাথারী রাস্তায় দাড়িয়ে থাকা গাড়ী ভাংচুর সহ আগুন লাগিয়ে দিতে দিতে বোমাছুড়ে চলছে । মুহুরমুহুর বোমার আওয়াজে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠলো । সারা এলাকা ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল । মাসুমের রিকসাটা একটু কাত হয়ে পড়লো এর পর কি ঘটলো মাসুমের আর কিছু মনে নেই ।
বাবা মা ভাই বোনকে ছেড়ে মাসুম এর আগে কোন দিন এতদিন বাড়ীর বাইরে থাকেনি । বারবার কেবল মাকে মনে পড়ে ভাই বোনের কথা মনে পড়ে । তাই রোজ অন্তত একবার মায়ের সাথে মোবাইলে কথা হয় । রেল ও সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় মাসুম বাড়ী ফিরতে পারছে না । আজ না কাল এমন করতে করতে প্রায় বিশ দিন হয়ে গেল । হাতের টাকাও ফুরিয়ে এসেছে । নতুন করে কেউ এখন আর ঢাকায় ঢুকতে বা বাইরে যেতে সাহস করে না । মাসুমের মা ফোনে কথা বলতে বলতে প্রায়ই কেঁদে ফেলে । ভেতর ভেতর মাসুমেরও কান্না পায় কিন্তু মাকে বুঝতে দিতে চায় না । মাসুম মনে মনে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেতো মা বাবাকে ছেড়ে থাকতেই হবে এখন না হয় তার মহড়া হয়ে যাচ্ছে ।
মাসুমের মন ছুটে চলে ব্রক্ষ্মপুত্রের পাড়ে । বন্ধুরা সবাই মিলে সাতার কাটছে । হেমন্ত কাল থেকে নদীটি হয়ে পড়ে নিশ্চল এক প্রকার বদ্ধ পুকুরের মত । দুই পাড় কাঁশফুলে চেয়ে যায় । তারা সাতার কেটে নদীর অপর পাড়ে চরের খোলা মাঠে ফুটবল খেলায় মেতে উঠে । চরের মাঠে গজিয়ে উঠা বিলাই চিমটি আর লজ্জাবতী কাটার আঘাতে পা রক্তে লাল হয়ে উঠে । কাঁশবনে সাড়ি সাড়ি সারস আর বক লুকুচুরি খেলে । হাজারো ফড়িঙ কাঁশবনে উড়ে বেড়ায় । রাখালের গরুর পাল খোলা মাঠে বিচরন করে নির্বিবাদে । মাসুমের পায়ে বল মাসুম একজন দুজন করে চারজনকে কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে । সামনে কেবল গোল কিপার । গোলে কিক নিতে যাবে পেছন থেকে কে যেন তাকে টেনে ধরছে । মাসুম পড়ে গেল ঘুম টুটে গেল । চোখ মেলে দেখে তার সামনে বাবা মা উৎসুক নয়নে ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মা নিচু হয়ে মাসুমকে জড়িয়ে ধরলো । মায়ের চোখের জলে মাসুমের সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে । মাসুম বললো- মা আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল । আমার আর একমহূর্ত তোমাদের ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না । বলেই মাসুম বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইলো কিন্তু সে উঠতে পারছে না । কি করে উঠবে মাসুমের যে একটা পা নেই । মাসুমের চোখ বেয়ে বৃষ্টির মত জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো । মাসুমের বাবা গামছা দিয়ে মুখ লুকিয়ে চোখের জল মুছছে । মা হু হু করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
মাসুম আর কোন দিন নিজের পায়ে একক ভাবে দাড়াতে পারবে না । নদীতে সাতার কাটতে পারবে না । সবাই মিলে খোলা মাঠে ছুটাছুটি করতে পারবে না, ফুটবল খেলতে পারবে না, ঝড়ের দিনে বাগান থেকে আম কুড়াতে পারবে না । বর্ষায় খড় স্রোতা ব্রক্ষ্মপুত্র যেমন শীতে শুকিয়ে যায় মাসুমের জীবনের সকল স্বপ্নসাধ ও তেমনি শুকিয়ে গেছে ।
একদল ক্ষমতা লিপ্সু রাজনৈতিক নেতাদের কারনে বলী হছ্ছে হাজারো মানুষ । তাদের জীবনে নেমে আসছে বিভীষিকার নিকষ কালো অন্ধকার । তারা হচ্ছে পঙ্গু অকালে হারাচ্ছে জীবন । কারো কারো পরিবারে নেমে আসছে চরম অনিশ্চয়ত
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আখতারুজ্জামান সোহাগ
সমসাময়িক বিষয় নিয়ে গল্প লেখা আমার কাছে কঠিন মনে হয়। আপনি সেই কঠিন কাজটি করেছেন বেশ অবলীলায়। কিছু ক্ষমতালিপ্সু মানুষের আঙ্গুলির ঈশারায় এভাবে শত শত মাসুমের প্রাণ লোপাট হয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর।
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন
....একদল ক্ষমতা লিপ্সু রাজনৈতিক নেতাদের কারনে বলী হছ্ছে হাজারো মানুষ ...। সত্যিই তাই, কিন্তু কত কোটি মানুষ কত জনের হাতে নাজেহাল হচ্ছে? কেন হচ্ছে? ভাল লিখেছেন।শুভেচ্ছা রইল।
হাবিব রহমান
আমার এবারের গল্পটাও নষ্ট রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা, আপনার টাও প্রেক্ষাপট মিলে যাওয়ায় আরো মজা করে পড়লাম। অনেক সুন্দর। পুরো গল্পটা সঠিক ভাবে আসিনি, মেইল দিয়ে পরিবর্তন করে নিতে পারেন।
জাকিয়া জেসমিন যূথী
পুনরায় পড়লাম। আসলে এ ধরনের ঘটনার পর একমাত্র ভূক্তভোগীই জানে তার কেমন লাগে, কেমন কাটবে তার ভবিষ্যৎ আর বর্তমান। যার গেলো সেই জানে সেই জ্বালা। আমাদের সহানুভূতিতে তার সেই জ্বালা জুড়বে না কখনোই। কষ্টকর বাস্তবতার ছবি দেখলে শুধু কান্না আসে।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।