সম্পর্ক

বন্ধু (জুলাই ২০১১)

বশির আহমেদ
  • ২৭
  • 0
  • ৫৮
ঢাকা ষ্টক এঙ্চেঞ্জ ভবন থেকে বের হয়ে শিশির বাইরে এসে দাঁড়াল। বেলা প্রায় পৌনে একটা। বাইরে প্রখড় রোদের তাপ। মতিঝিল বানিজ্য পাড়া কর্ম ব্যস্ত। কর্মব্যস্ত লোক জন যথাসম্ভব রোদের তাপ এড়িয়ে উচু ভবনের ছায়া ধরে হাটছে। শিশিরের সাথে পুরানো কলিগ নজরুল ভাই। তিনি দু বছর আগে অফিস থেকে অবসরে গেছেন। রাস্তায় নেমেই দুজন দুটো সিগারেট শলাকায় আগুন লাগিয়েছে মাত্র। গন্তব্য শাপলা চত্তরের দিকে। সামনে দিয়ে একজন লোক মাথা নিচু করে হনহন করে হেটে যাচ্ছে। পরনে ধুলো মলিন সার্টপ্যান্ট। মাথার সামনের অংশে চুল নেই। শিশিরদের অতিক্রম করে লোকটি এগিয়ে যেতেই হঠাৎ মনে হলো- লোকটা চেনা চেনা লাগছে: আরে আমার মনা না?
আরে মনা। ডাক শুনে লোকটি থমকে দাড়াল। শিশিরের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল। সম্বিত ফিরে পেয়ে দ্রুত এগিয়ে এল। আরে দোস্ত বলে জড়িয়ে ধরল।
বেশ কিছুক্ষন একজন আরেক জনকে জড়িয়ে ধরে থাকল। তার পর মনা বলে উঠল। কেমন আছ শিশির? তোমার কত খোঁজ করেছি?
আমিও তো তোমায় অনেক খুজেছি দোস্ত। ্#২৪৫৫;ত কয়েক বছর আগে তরু আপার সাথে দেখা। সে তোমার কোন নিদ্রর্িষ্ট ঠিকানা দিতে পারে নাই। তুমি এখন কোথায়? ঢাকায় কবে এলে?
মনা বলল আমি এখন নেত্রকোনার সুসং দূর্গাপুরে। তুমি কোথায় আছ?
আমিতো চাকুরী জীবনের শুরু থেকেই ঢাকায়। তুমি নাকি হবিগঞ্জের কোথায় ছিলে? নেত্রকোনায় গেলে কবে?
তা প্রায় বছর দুই হবে। শিশির তুমি কি এখনও মগবাজারেই আছ? তোমার পোষ্টিং কোথায়? এমন নানান প্রশ্ন করে শিশিরে বর্তমান অবস্থা, অবস্থান ইত্যাদি জেনে নিল। নজরুল ভাই নিরবে দুজনার কথাবার্তা লক্ষ্য করতে লাগলেন।
বিষয়টি বুঝতে পেরে মনা বলে উঠলো- কিছু মনে করবেন না। আমর দুজন সেই শৈশব কালের বন্ধুতো তাই।
না না আমি কিছু মনে করিনি। বলে নজরুল ভাই উভয় কে আশ্বস্থ করল। আমি বুঝতে পেরেছি আপনারা দুজন পিয়ারে দোস্ত। অনেক দিন পর দেখা। অনেক স্মৃতি, অনেক আনন্দ মনের মাঝে আকুলি বিকুলি করছে।
শিশির জানতে চাইল- কোথায় যাচ্ছিলে অমন হন হন করে। খুব তারা নাকি? চল সামনের রেষ্টুরেন্টে বসি।
না দোস্ত , ইত্তেফাক ভবনে জরুরী একটা কাজ আছে। এখনই যেতে হবে। নইলে ভীষন ক্ষতি হয়ে যাবে। তোমার ভিজিটিং কার্ড থাকলে দাও পরে কথা হবে।
পকেট থেকে কার্ড বের করে তার হাতে দিতে দিতে শিশির বলল ফোন করো।
আচ্ছা এখন যাই। বলে মনা পুনরায় মাথা নিচু করে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। পেছন থেকে তাকে দেখে কে বলবে তার মাথায় চুল নেই।

শিশিরেরও অনেক তারা। অফিসে বস কে বলে এসেছে একটার মধ্যে ফিরবে। কিন্তু এখানেই একটা বেজে গেছে। দ্রুত পা চালাল শাপলা চত্তরের দিকে। হাটতে হাটতে মনে পড়ছে কত স্মৃতি কত কথা।

শিশির নিভৃত পল্লীগায়ের এক কৃষক সন্তান। গায়ের স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে পাঁচ মাইল দূরে ছোট্ট মফস্বল শহরের কলেজে ভর্তি হয়েছে। প্রতি দিন পাঁচ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কলেজে পৌছায়। কিছুদুর পায়ে হেটে, কিছু ট্রেনে চড়ে যাতায়াত। সকাল সাতটায় বাড়ী থেকে রওয়ান হয়ে সাড়ে নটায় ক্লাস ধরতে হয়। কোন কোন দিন ট্রেন লেট হলে প্রথম ক্লাসটা মিস হয়ে যায়। শ্রেনী কক্ষেই মনার সাথে শিশিরের প্রথম পরিচয়।




মনা মানে মনোয়ার হোসেন। মনাদের বাড়ী শহরের পঞ্চবটিতে। রেল ষ্টেশন থেকে ২০০ গজ দক্ষিন পশ্চিমে। বাড়ীটির চারপাশ উঁচু পাঁচিল ঘেরা। বাড়ীর ভেতর আম, কাঁঠাল, জাম, লিচু গাছে ভরা। দুর থেকে বাড়ীটিকে ফল বাগান বলে ভ্রম হয়।

কলেজে সপ্তাহে তিন দিন বাংলা ক্লাস নেন এক ম্যাডাম। তার কড়া নির্দেশ তাকে ম্যাডাম বা স্যার বলা যাবে না। একদিন ম্যাডাম রবীন্দ্র নাথের কঙ্কাল গল্প থেকে লেকচার দিচ্ছেন।
মনা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল ম্যাডাম কঙ্কালটি কি নারী না পুরুষ?
মনার প্রশ্ন শুণে ও প্রশ্নের ধরন দেখে সারা ক্লাসের ছাত্ররা ফিক করে হেসে উঠলো।
একেতো ম্যাডাম সম্বোধন করা সেই সাথে উদ্ভট প্রশ্ন করায় আপা রেগেমেগে একসা। মনাকে বলল -এই ছেলে তুমি দাড়াও। তুমি কি এসএসসি পাশ করে এসেছ? নাকি নকল পাশ ? গতকাল তোমাদের কে বার বার করে বলে দিয়েছি। গল্পটা ভাল করে পড়ে আসবে। তুমি কি গল্পটা পড়েছ?
মনা মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে জবাব দিল না ম্যাডাম পড়িনি।
আবার ম্যাডাম। তোমাদের কে একদিনই বলেছি আমাকে ম্যাডাম বলবেনা। যাও ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যাও।
আপার রুদ্রমুর্তি দেখে মনার আত্মাখাচা ছাড়া। ক্লাসের সকল ছাত্ররা মিলে আপার কাছে ক্ষমা চেয়ে সে যাত্রা রক্ষা পাওয়া গেল।

মনা মানে আমাদের মনোয়ার দীর্ঘ দেহী,হ্যান্ডস্যাম। মাথা ভর্তি কোকরানো চুল। তার কথা বলার ভঙ্গি আর সবার চেয়ে ব্যক্রিম। পাঁচ মিনিটে যে কেউ তার কথার মুগ্ধতায় ভক্ত হতে বাধ্য। সে খুব রসিক এবং আড্ডা প্রিয়। কোন ক্লাসে শিক্ষক না থাকলে সারা কক্ষ মাতিয়ে রাখে। কলেজটি কো-এডুকেশন হলেও তখন ছাত্ররা এক দিকে ও ছাত্রীরা বেশ দুরত্ব নিয়ে আরএক দিকে বসত। এক একটি ক্লাস শেষ হবার সাথে সাথে মেয়েরা শিক্ষক এর পেছন পেছন কমন রুমে চলে যেত।

মনা একদিন সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল-আমরা বাঘ না ভল্লুক? মেয়েরা আমাদের এত ভয় পায় কেন? দাড়াও আমি তারা যাতে কক্ষ থেকে বেরুতে না পারে সে ব্যবস্থা করছি। সত্যি সত্যি সে পর দিন চুইনগাম চিবিয়ে মেয়েদের বসার বেঞ্চে লাগিয়ে রাখল। এমন ভাবে লাগাল যা আপত দৃষ্টিতে নজরে না পড়ে। মেয়েরা ক্লাস শেষে উঠতে যাবে। তাদের কাপড় বেঞ্চের সাথে আটকে গেল। এ নিয়ে ক্লাসে সে কি হৈচৈ।
প্রথম দিন থেকেই মনা শিশিরকে তার দোস্ত বানিয়ে নেয়। জানি না এর কারন কি? শিশির গাঁয়ের ছেলে বলে নাকি তার সরলতা তা আজও জানা হয়নি শিশিরের। প্রতি দিন মনা ক্লাসে আগে এলেই তার পাশের সীটটি শিশিরের জন্য বরাদ্দ করে রাখে। কখনো কখনো শিশির আগে এলে সেও তাই করে। মনা ছাড়াও আরো বেশ কজন এক বেঞ্চে বসত। তাদের মধ্যে অন্যতম মনসুর, মুজিব, কাজল। ক্লাস শেষ হলে সকলে দল বেধে রেল ষ্টেশন পর্যন্ত হেটে আসত। কথনো পাটক্ষেতের অাঁকাবাঁকা আইল ধরে। কিংবা প্রধান সড়কের কৃ্#৬১৬৮২;চুড়া গাছের ছায়ায় ছায়ায় মেঘনার বুক থেকে উঠে আসা বাতাসে নিশ্বাস নিতে নিতে। গল্পের আর শেষ নেই। শিশিরকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করত।






একদিন মনা বলল দোস্ত- আমাদের কলেজে সবচেয়ে সুন্দরী কে?
শিশির বলল কেন নীরা।
দ্বিতীয় সুন্দরী কে?
মহুয়া।
গুড দোস্ত গুড। এটাই তোমার কাছ থেকে জানতে চাই ছিলাম। নীরার বাবা কে তুমি কি তা জান?
শিশির বলল না।
সে এই শহরের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি তনাই মিয়া। আর মহুয়ার বাবা নদীর ওপারের বড় আড়ৎদার কালু সরদার। আমি এদের যে কোন একজনের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে চাই।
শিশির বলল কি করে। ওরাতো ক্লাসেই থাকেনা। এদের সাথে তো আমাদের কোন কথাই হয়না।
তুমি দেখেনিও দোস্ত। আমি ঠিক একদিন ওদের যে কোন একজনকে আমার কথার জালে জড়াবোই।
মাস খনেক পর। মাঝে কোন ক্লাস নেই। মনা বলল শিশির চল। বাজার থেকে ঘুরে আসি। মার্চ মাস শীত কেটে গিয়েছে। গাছপালা পত্র পল্লবে চারদিক ভরে উঠেছে। শিমুল আর কৃ্#৬১৬৮২;চুড়ায় রক্তিম চারিদিক। দক্ষিনা হাওয়া মেঘনার বুকচিড়ে উঠে আসছে। ফাগুনের আগুন হাওয়া মন কে পুলকিত করে যাচ্ছে বারেবার। আদরিনি পা ফেলে হেটে চলে যায় যেন রাধা চুড়ামনি কৃ্#৬১৬৮২;চুড়ার শাখে শাখে। বাইরে রোদ থাকলেও তার মিষ্টি পরশ যেন মন ছুয়ে যায়। মেয়েদের কমন রুমের সামনে এসে বলল শিশির তুমি এগোও। আমি আসছি। শিশির দোতলার সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতেই সে চলে এল। গেইট পেরিয়ে রাস্তায নেমে এল। লঞ্চ ঘাটের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল। একসময় শহরের অভিজাত রেষ্টুরেন্ট মাধবীলতার সামনে এসে মনা দাড়িয়ে পড়ল। ভেতরে ঢুক বলে সে কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

রেষ্টুরেন্টে নরম আলোর সি্নগ্ধতা। এক কোনের একটি টেবিলে এসে বসে পড়ল। হাতের ইশারায় শিশিরকে বসতে বলল। শিশির তাকে অনুসরন করল। পাঁচ কি সাত মিনিট পর কাচের দরজা ঠেলে রেষ্টুরেন্টে এসে ঢুকল নীরা আর মহুয়া। পায়ে পায়ে তারা মন আর শিশিরের দিকে এগিয়ে এল। নীরা বলে উঠলো মনোয়ার তোমরা অসময়ে এখানে? ভাবখানা এমন যেন তারা কিছুই জানেনা।
মনা বলল দাড়িয়ে থাকবে না বসবে?
তোমরা চাইলে বসতে পারি। বলেই দুজন দুটি চেয়ারে তাদের মুখোমুখি বসে পড়ল।
মনা জি্ে#৬১৬৩৩;স করল কি খাবে? স্যুপ, না চা /কফি?
মহুয়া বলল- চা/কফি এখন খাওয়া যাবেনা। স্যুপ খাওয়া যেতে পারে। বলেই মেনুটা হাতে তুলে নিল। এটেন্ডারকে ডেকে উন্থন আর স্যুপের অর্ডার দিল। সবাই চুপচাপ। পিন পতন নিরবতা । এক জন যেন অপর জনকে চিনে নিতে চেষ্ঠা করছে। নিয়ন আলোর সি্নগ্ধতায় যেন দয়িতার সতেজ মুখ ভেসে উঠছে অপার আবেগে পরম মমতায়। মন যেন বলে উঠছে- এতদিন কোথায় ছিলে? মনের অর্গল কেউ খুলতে চাচ্ছেনা।
নিরবতা ভঙ্গ করে শিশির বলে উঠল- কি ব্যাপার কেউ কিছু বলছনা কেন? কি মনা তোমার রসের হাড়ি কি নীরা আর মহুয়ার রূপের বেদীতলে তলিয়ে গেছে?
নীরা মুখ খুলল কি যে বল শিশির আমি আবার রূপসী হলাম কোথায়।
মহুয়া বলে উঠল-বলতে দে। তাদের চোখে আমরা যদি সুন্দরী রূপসী, উর্বশী হয়ে উঠি তবেতো ভালই।
শুনতে ভালই লাগছে শিশির। তোমার দোস্ত তো দেখি বোবা হয়ে গেছে। কথায় কথায় পরিবেশটা হালকা হয়ে এল। গল্প আর কল্পনার জাল বুনতে বুনতে খাওয়া শেষ হল। মহুয়া খাবার বিল চুকিয়ে নীরা কে নিয়ে বেড়িয়ে গেল। দু বন্ধু তাদের গমন পথের দিকে অবাক বিষ্ময়ে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকল।




ক্রমান্বয়ে মহুয়া আর মনার মাঝে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব থেকে দেখা সাক্ষাত, ঘোরা ফেরা একসময় ভাল লাগা ভাল বাসা। মেঘনার বালু চরে, ব্রক্ষ্রপুত্রনদের পাড়ে, কিংবা শান্ত সি্নগ্ধ পল্লী গাঁয়ের মেঠোপথে। কখনো বোটে চড়ে ব্রক্ষ্রপুত্র, মেঘনা আর তিতাস নদীর মোহনায় জল তরঙ্গ অবলোকন করেছে মুগ্ধ নয়নে। মিষ্টি আলু, খিরাই, তরমুজ, বাঙ্গি ক্ষেতের আইল ধরে হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়িয়েছে সকাল সন্ধ্যা দুপুর। মটরসুটি আর কলাই ক্ষেতে বসে নকসী কাথার সাজু আর রূপা একাকার হয়ে গেছে স্বপ্ন জাল বুনে।

এইচ,এসসি পরীক্ষা শেষ। গ্রামেই থাকে শিশির। পনর বিশ দিন পর পর শহরে যায়। সারা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসে। সংসারে বাবা ভাইদের কাজে সাহায্য করে। তিন মাসের মাথায় পরীক্ষার ফল বের হলো। মনসুর ছাড়া সবাই পরীক্ষায় কৃত কার্য হয়।

এবার উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি হবার পালা। সবার আশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। শিশির গ্রামে থাকে দৈনিক খবর পায় না। মনাকে বলে এসেছে বিশ্ববিদ্যালযে ভর্তির খবর হলে সে যেন তাকে জানায়। বেশ কিছুদিন হয়ে গেল শহরে যাওয়া হয়না। সে দিন সকালের ট্রেনে করে শহরে এসে নামল। নেমেই অবাক। মনা একখানা দৈনিক পত্রিকা হাতে শিশিরের দিকে ছুটে এল। কি ব্যাপার শিশির তোমার কোন খবর নেই? তুমি কি অসুস্থ ছিলে? তুমি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করেছ? নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিঞ্জপ্তি হয়েছে কিনা তাইতো জানি না বলে জবাব দিল শিশির।
এক সপ্তাহ যাবৎ আমি রোজ ষ্টেশনে তোমার জন্য অপেক্ষা করি। এই বুঝি তুমি এলে। এই নাও পত্রিকা। কালই আবেদনের শেষ তারিখ। আমি কাজল ,মুজিব, মুর্শেদ আবেদন করেছি। তুমি এখনই ঢাকা চলে যাও।
শিশির ভাবনায় পড়ে গেল। কি করবে কখন যাবে। সাথে টাকা পয়সাও দরকার। বাড়ীতে বাবা মাকে বলে যাওয়া প্রয়োজন।
কি ভাবছ? টাকা লাগলে নাও। এখনই গ্রীন এ্যারোতে চলে যাও।
না টাকার কথা ভাবছি না। বাড়ীতে বাবা মাকে বলে যেতে হবে। নইলে তারা দুঃচিন্তা করবেন।
এখনই বাড়ী গিয়ে বিকাল আড়াইটার ট্রেনে চলে যাও। হেটে বাড়ী যেতে কতক্ষন লাগবে? শিশিরের জন্য সকল দুঃচিন্তা যেন তার।

পত্রিকাটি হাতে নিয়ে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ী এল শিশির। বাবা বাড়ীতে নেই। মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ছুটল ষ্টেশনের দিকে। আড়াইটার ট্রেনটা পাওয়া গেল। তেজগাঁও ষ্টেশনে যখন নামল তখন রাত আটটা। মগবাজারে বড় ভাইয়ের বসায় এসে পৌছাল রাত নটায়। ব্যাগটা রেখে ছুটে গেল মগবাজার চৌরাস্তায়। ষ্টুডিওতে অনেক আগে একবার ছবি তোলা ছিল। দোকান বন্ধ। পাশের দোকান থেকে জানা গেল তিন দিন যাবৎ দোকান খোলা হচ্ছে না। কবে খুলবে তারা জানেনা। নতুন একটা ষ্টুডিওতে যোগাযোগ করল। আগামী কাল সন্ধ্যার আগে ছবি ডেলিভাড়ি দেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিল। ব্যর্থ হয়ে বাসায় ফিরে এসে ভাবীর এ্যালবামে খুজে একটা ছবি পাওয়া গেল। প্রতি বিষয়ে দুটো করে ছবি প্রয়োজন। অগত্যা আশাহীন মরিচিকার সন্ধানে পর দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দ্যেশে রওয়ানা হল শিশির।

সকাল বেলা এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতি নির্মল সতেজ। জীবনে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে প্রবেশ। বুকটা দুরু দুরু কাঁপছে। কলা ভবনের মূল ফটক দিয়ে রিকশাটা প্রবেশ করে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে




এসে থামল। কোথায় কোন বিভাগ কিছুই জানা নেই। গেইটে দাড়ানো দাড়োয়ানের কাছে জেনে নিয়ে দোতলায় অর্থনীতি বিভাগের অফিসের সামনে এসে দাড়াল। অফিস কক্ষে প্রচুর ভীড়। সবার হাতে ভর্তি ফরম। কেউ ফরম
পুরনে ব্যস্ত কেউ জমা দানে ব্যস্ত। কথা বলার ফুরসত নেই। কাউন্টারে গিয়ে ফরম চাইল ও তার কাছে একটি মাত্র ছবি আছে তা জানাল। একটি ছবিতে চলবেনা বলে ফরম দিতে অপারগত প্রকাশ করলেন। ছুটে গেল সমাজ বিঞ্জান বিভাগে। সেখানেও ব্যর্থ হল। ভগ্ন মনোরথে ফিরে যাওয়ার পথে দর্শন বিভাগের অফিসের সামনে এসে দাড়াল। অফিসটা একেবারে ফাঁকা। দুজন লোক কাউন্টারে বসে আছে। অফিসে ঢুকে পড়ল। কাউন্টারে বসা লোকটির কাছে একটি ছবির বিষয়টি খুলে বলল। তিনি শিশিরকে আগামী পড়শু প্রবেশ পত্র গ্রহন ও ছবি দেবার শর্তে ফরম দিলেন।

তারাতারি ফরম ফিলাপ করে জমা দেবার তাগিদ দিলেন। একটার পর জমা নেয়া বন্ধ হয়ে যাবে। শিশির দ্রুত গতিতে কাউন্টারে দাড়িয়ে ফরম ফিলাপ করে জমা দিল। লোকটি ফরমটি জমা নিয়ে তার হাতে ছোট্র একটি স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে আগামী পরশু ছবিসহ আসতে বললেন। যারপর নাই শিশির খুশি মনে কলা ভবন থেকে বেরিয়ে এল। বাসায় ফেরার পথে মগবাজারে ষ্টুডিওতে নূতন ছবির অর্ডার দিয়ে এল।

বন্ধুদের মাঝে শিশির আর মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনাসর্ কোসে ভর্তি হল। মনা, কাজল, মুর্শেদ, মহুয়া, নীরা সহ অন্যরা সেই কলেজে বি এ ক্লাসে ভর্তি হল।

মনা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। মনার বাবার চাকুরীর সুবাদে মনারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছে। সর্বশেষ মনা নারায়নগঞ্জের আইটি স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে তার বাবা অবসর নেয়ায় পৈত্রিক ভিটা পঞ্চবটিতে ফিরে এসেছে। মনারা দুভাই এক বোন। মনা সবার ছোট। বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কঙ্বাজারে চাকরী করেন। বোন আর মা বাবা কে নিয়ে মনাদের সংসার। সংসারে মনাদের সুখের কমতি নেই। মনার বোন তরু আপা ডিগ্রি পাশ করে ঘরে বৃদ্বা মা বাবাকে দেখা শুনা করে। তরু আপার বিয়ের কথা চলছে। মনাদের বাড়ীতে শিশির, কাজল, মনসুর দের অবাধ যাতায়াত। তরু আপাও কেন জানি শিশিরকে অন্যদের চাইতে একটু বেশী আদর করে। শিশির বাড়ীতে গেলেই তরু আপা শিশির কে ডেকে নিয়ে গাছ থেকে ফল পেরে নিজে হাতে কেটে তাকে খাওয়ায়।

মনা ডিগ্রী পাশ করার পর পরই তরু আপার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়েতে সকল বন্ধুরা মিলে অনেক আনন্দ করেছে। মহুয়া, নীরাসহ অনেকেই বিয়েতে হাজির হয়ে ছিল। শিশির একদিন খবর পেল নীরা এক আমলাকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। মনা চাকরীর চেষ্টা করছে। মনার ইচ্ছা একটা চাকরী পেলেই মহুয়াকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে। বেশ কিছু দিন হল শিশির পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত । মনাদের কোন খবর জানে না। তিন মাস পর খবর এল মহুয়া কানাডা প্রবাসী একজনকে বিয়ে করে কানাডা পাড়ি জমিয়েছে।

মনার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সেই হাসিখুশি মনা কেমন জানি ছন্নছাড়া হয়ে গেল। সংসারে মন নেই বাবা মায়ের দিকে খেয়াল নেই। সন্তানের এ হাল দেখে চিন্তায় চিন্তায় অল্প কিছু দিনের ব্যবধানে মনার বাবা মা দুজনই মৃত্যুবরন করেন। মনার জীবনে ঘন কালো আধার নেমে আসে। কোন রকম একটা চাকরী জুটিয়ে কাউকে না জানিয়ে সুনামগঞ্জের তাহির পুর এলাকায় নির্বাসনে চলে যায়। সকল যোগাযোগ হয় ছিন্ন।



গত পাঁচ বছর আগে সেই ষ্টেশনে শিশির ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। পেছন থেকে মহিলা কন্ঠের ডাক- শিশির শিশির এই শিশির।
শিশির পেছন ফিরে তাকাল। দেখতে পেল মাঝ বয়সী এক মহিলা তাকে কাছে ডাকছে। শিশির এগিয়ে গেল। কিছুক্ষন নিবিড় ভাবে তাকিয়ে থেকে চিনতে পারল। একি এযে আমার তরু আপা। আপা কেমন আছেন?
আপা জবাব দিল আমি ভাল আছি। এখন তোমার কথা বল। তুমি কেমন আছ? কোথায় থাক? কি কর? তোমার ছেলে মেয়ে কজন ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করে শিশিরের সকল অবস্থান জেনে নিল।
আপা মনা কেমন আছে? সে এখন কোথায়?
আপা বলল সে মুটামুটি ভাল আছে। এখন হবিগঞ্জের দিরাই না কোথায় যেন থাকে। সঠিক ঠিকানা জানি না।
শিশির বলল তার ছেলে মেয়ে কজন?
প্রশ্ন শুনে আপার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। না ভাই সে আর বিয়ে করেনি। বছরে দুই বছরে ঈদে চান্দে আসে। একদুদিন থেকে চলে যায়। কারো সাথে মেশেনা। না জানতে চাইলে নিজে থেকে কিছু বলে না।
ট্রেন এসে গেল। শিশির আপার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল। তরু আপা এক দৃষ্টে শিশিরের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল।

আজ দীর্ঘ প্রায় বত্রিশ বছর পর আকষ্মিক মনার সাথে ক্ষনিকের দেখা। জানা হলোনা শিশিরের পরম প্রিয় বন্ধু হিতাকাংখী মনার ফেলে আসা অতীত, বর্তমান ভবিষ্যত দিনের কথা। চৈত্র মাস ঝাঁ ঝাঁ রোদ। আকাশ ফেটে যেন বেড়িয়ে আসছে তীব্র অগি্ন কুন্ড। সমস্ত শহর জুড়ে যানজট। গাড়ীর বিষাক্ত কালো ধোঁযা ছেয়ে আছে আকাশ বাতাস। অনেক উপরে আকাশে সাদা মেঘের খন্ড গুলি ধীর গতিতে উড়ে যাচ্ছে। নগরবাসী ঘর্মাক্ত শরীরে ছুটে চলছে নিজ নিজ কর্ম সম্পাদনে। ব্যস্ত মহানগরী ব্যস্ত সমস্ত মানুষ। শিশির ছুটে চলছে তার কর্ম ক্ষেত্রে। তার কানে কানে কে যেন বার বার বলছে- খাওদাও আর অতীতকে ভুলে যাও। অতীত হচ্ছে ভাঙ্গা ঘাটের স্বচ্ছ সিঁড়ির মতন।
নিষ্ঠুর বাস্তবতা আর স্বার্থের বেদীতলে পদ দলিত হয় প্রেম প্রিতি ভালবাসা আর বন্ধুত্তের।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রওশন জাহান অনেক ভালো একটা গল্প, যদিও আরো গভীর ভাবে মনার জীবন উঠে আসতে পারত. আরো সময় আশা করছি দিবেন পরের লেখায়.
আহমাদ মুকুল বয়োজ্যেষ্ঠ লেখকের গল্প, তাইতো অনেক পুরনো জিনিস আসবেই। গ্রীন আ্যরো ট্রেন, জমজমাট লঞ্চঘাট, ছবি তোলার ঝঞ্ঝাট- এগুলো এখন অতীত। বেশ নস্টালজিক হলাম। বেশ ভাল লাগল।
উপকুল দেহলভি খুব ভালো লাগলো, এগিয়ে যান আলোকিত আগামীর পথে, শুভ কামনা রইলো.
মোঃ আক্তারুজ্জামান খুব ভালো লাগলো| তাই অনেক অনেক শুভ কামনা|
তানভীর আহমেদ গল্পের প্লটটি খুবই ভালো এবং আকর্ষণীয়। লেখকের সৃজনশীল মানসিকতার পরিচয় এখানে পাওয়া যাবে। তবে, গল্পের ক্ষেত্রে আরো প্রাণবন্ত ও প্রাঞ্জল ভাষার গতিময় ব্যবহার বাঞ্ছনীয়। ডায়লগগুলোকে ধারাবাহিকভাবে কোটেশনের ভেতর সাজালে আরো ভালো হতো। বাহ্যিক বর্ণনাভঙ্গির চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এ ধরনের স্মৃতিকাতরতা মূলক গল্পের ক্ষেত্রে অধিক ফলপ্রসূ ও সার্থক হয়। মধ্য বয়সে এসে হঠাৎ পুরোনো ও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে দেখা হলে শত ব্যস্ততাও মানুষ ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। না পারলে তার জন্যে যে আক্ষেপ ও কাতর অনুভূতি তার প্রকাশে আরো জীবন-ঘনিষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন ছিল। তারপরেও সব মিলিয়ে খুব ভালো হয়েছে। উন্নতির ধারা উত্তোরত্তর ঊর্ব্ধগামী হবে বলে আস্থা পোষণ করলাম।
কনিকা কনা অনেক ভালো।
দীপক সাহা 'অতীত হচ্ছে ভাঙ্গা ঘাটের স্বচ্ছ সিঁড়ির মতন........।' গল্পটা সুন্দর। বর্নণাভঙ্গি আর একটু কাব্যিক হলে আরও ভালো লাগতো। অনেক শুভকামনা।
বশির আহমেদ জনাব সূর্য এর অবগতির জন্য জানাচ্ছি ভৈরব শহরের পশ্চিমাংসে একটি পাড়ার নাম পঞ্চবটি যা পুরাতন ব্রক্ষপুত্র নদের পারে অবস্থিত। আর দিরাই সুনামগঞ্জের একটি উপজেলা। আমার লেখার সময় তা ভুল বশত: হবিগঞ্জে লিখা হয়েছে ।
junaidal এগিয়ে যাও বন্ধু ।

০৭ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪