অনন্ত আলো

বিজয় (ডিসেম্বর ২০১৪)

মিলন বনিক
  • ২১
শুভপুর গ্রামে পাক সেনারা ঢুকে পরেছে। শুভপুর গ্রামের উত্তরে মাইজ পাড়া প্রাইমারী স্কুলে ঘাঁটি গেড়েছে দলটা। রমিজ মুন্সী, মাইজ পাড়ার আবদুল মতিন, লিয়াকত মোল্লা, আলী আহাম্মদ সহ কয়েকজন ওদের বেশ খাতির যত্ন করছে। সারাক্ষণ ঘুর ঘুর করছে। স্থানীয় মেম্বার শমসের মিয়া এর মধ্যে ঘুরে গেছে। ক্যাপ্টেন মির্জা-র সাথে অনেক্ষণ কি যেন আলাপ করল। আর যাওয়ার সময় বলল ওরা থাকলো আপনাদের খেদমতের জন্য। লিয়াকত মোল্লা উর্দু বলতে পারে। বুঝেও ভালো। দোভাষীর কাজটা ভালোই চালিয়ে নিচ্ছে। মুখে ”রা” বলতেই যেন সব কিছু বুঝে ফেলছে। ক্যাপ্টেন মুখের সামনে বলে, শালা বাঙ্গালী ধুরন্ধর আদমি। তোদের বিশ্বাস নাই।
- না হুজুর। মেম্বার সাব আমাদের পাঠিয়েছে। আপনাদের খেদমতের যাতে কোন অসুবিধা না হয়। হুজুর যা যা দরকার, খালি বলবেন। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বলল আবদুল মতিন।
কালো কুচকুচে গোঁফ গুলো চিক চিক করছে। হৃষ্ট পুষ্ট শরীর। দু’আঙ্গুলে আলতো করে গোঁফে তা মেরে বলল-
- কাঁচা মাংস খেতে চাই।
- তাও আছে হুজুর। বলেন কয় সের খাবেন। হুজুর বুজি গরু খুব পছন্দ করেন।
- না। গরু খেলে গা গরম থাকে। এলার্জি হয়।
- তবে কি খাসী অথবা মুরগী?
- তাও না। তবে কি অন্য কোন বন্য জানোয়ারের মাংস।
- ঐ শালা মান্ধীর বাচ্চা আগে আগে সব বুজস, এইটা বুজস না। বুঝা গেল ক্যাপ্টেন রাগ করেছে।
- না হুজুর, একটু বুজাইয়া বলেন। আপনারা হলেন আমাদের মা বাপ। আর আমরা হলাম পাকিস্তান জিন্দাবাদ পার্টির লোক। যা বলবেন বুঝে শুনে সে’মত কাজ করব।
লিয়াকত মোল্লাও বুজতে পারছে না। কাঁচা মাংসটা কিসের মাংস। আর খাবেই বা কি করে। কাঁচা মাংস খায় জন্তু জানোয়াররা। মানুষ কাঁচা মাংস খায় না। এরা তো মানুষ। বাঙ্গালীদের মত। তবে একটু লম্বা কিসিমের। শক্ত পোক্ত শরীর। হতে পারে সৈনিক জীবন। জীবনের অনেক সময় বনে জঙ্গলে থাকতে হয়। হয়তো জন্তু জানোয়ারদের সাথে থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে। এরাও বোধ হয় বন্য জন্তু জানোয়ারের দলে পরে গছে। মুখোশটা হয়তো মানুষের। লিয়াকত মোল্লা ভাবছে কিসের মাংস হতে পারে।
দু’জন সৈন্য ক্যাপ্টেন এর দু’পাশে গার্ড দিচ্ছে। গোঁফ আছে। দাড়ি নেয়। কাঁধে অত্যাধুনিক রাইফেল। তারা মুচকি হাসছে। একজন কাত হয়ে ক্যাপ্টেনের কানে কানে কি যেন বলল। ক্যাপ্টেন হাত তুলে থামিয়ে দিল। তারপর যা বলল তা লিয়াকত মোল্লা বুজতে পেরেছে। বাংলা ভাষায় তা হলো ”শালাদের আগে মগজটা ধোলাই করে নিতে হবে, তারপর বোঝাতে হবে কাঁচা মাংস কি জিনিষ আর কিভাবে খেতে হয়”।
রমিজ মিয়া, আলী আহাম্মদ বাধ্য চাকরের মত হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসেছিল। রমিজ মুন্সীকে আঙ্গুল নির্দেশ করে দাঁড়াতে বলল। রমিজের পা দু’টো কেমন যেন কাঁপছে। শীতের রাত নয়। তবুও কাঁপছে। পাঞ্জাবীর উপড়ে দামী উলের শাল জড়ানো। রমিজ দাঁড়ায়। চোখ বড় করে তাকায় ক্যাপ্টেন। খুবই নিচু গলায় বলল-
- আমি যা বলব ঠিক ঠিক উত্তর দেবে। ঠিক আছে।
- জ্বী স্যার।
- এক প্রশ্ন দুইবার করব না।
- জ্বী স্যার।
- কি নাম।
- রমিজ মুন্সী।
- ছেলে মেয়ে কি।
- দুই ছেলে।
- মেয়ে।
- নাই।
- ছেলেরা কোথায়।
- সৌদি আরব থাকে।
- বিয়ে শাদী দিয়েছ।
- না।
লিয়াকত মোল্লাকে ডাকল।
- তোমার নাম।
- লিয়াকত মোল্লা।
- ওকে চেন। রমিজকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল ক্যাপ্টেন।
- জ্বী হুজুর। ওই মুন্সীইতো পাকিস্তানের হয়ে অনন্ত পাগলার সাথে বলী ধরছিল। তবে জিততে পারেনি।
ভ্রু কুচকালো ক্যাপ্টেন। কিসের যেন গন্ধ পেল। জিজ্ঞাসা করল-
- কোন পাগলা।
- অনন্ত পাগলা।
- কোথায় থাকে।
- বাজারে হুজুর, বাজারে। একটা বাছাইয়ে থাকে। তিন কুলে কেউ নাই। একা পরে থাকে। পাগল কিসিমের লোক।
বাদ দাও ওসব। কাল ওদিকে যাব। তখন দেখা যাবে। তোমার কথা বল।
- ছেলে মেয়ে।
- দুই মেয়ে, এক ছেলে।
- ছেলে মেয়েদের নাম আর বয়স কত।
- বড় মেয়ে নুরজাহান পনের বছর, পরের জন বিলকিস বার বছর, তার পর ছেলে মারুফ নয় বছর।
গর্বের সাথে হাসল লিয়াকত। ক্যাপ্টেন খুশী হয়। চোখে মুখে আনন্দের স্বাদ ঝিলিক মেরে উঠে। হাতে ইশারা করতেই পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন গার্ড একটা চেয়ার নিয়ে এলো। ক্যাপ্টেন সাহেব লিয়াকত মোল্লাকে বসতে বললেন। আলাদা মর্যাদা পেয়ে লিয়াকতের বুক গর্বে ভরে উঠে। ক্যাপ্টেন আবার জিজ্ঞাসা করল বাড়ী কতদূর। এইতো স্যার এই স্কুলের সামনে মসজিদ তার সামান্য উত্তরে। চেয়ারে বসতে বসতে বলল - সবই আপনার দয়া হুজুর। মাগরিবের নামাজ শুরু হয়েছে। আলী আর মতিনকে দাড়াতে বলল। জোয়ান বয়স। আলী আহম্মদ বিয়ে করেছে দু’বছর হলো। আবদুল মতিন এখনও বিয়ে করেনি। ক্ষেতে খামারে চাষ বাস করে। শক্ত পোক্ত শরীর। দু’জনে উঠে দাঁড়ায়। ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করল-
- প্রতিদিন নামাজ পড়।
- জ্বী হুজুর।
- মাগরিবের আজান হয়ে গেছে। আজ নামাজ পড়ার দরকার নাই। পরে একসময় ক্বাজা পড়ে নিও। নাম বল।
- জ¦ী হুজুর। আমি আলী আহাম্মদ, আমি আব্দুল মতিন।
- বিয়ে শাদী করেছ।
- আমি করিনি। বলল আব্দুল মতিন।
- আমি করেছি। বলল আলী আহাম্মদ।
- ছেলে মেয়ে।
- নাই।
- কাঁচা মাংস খেয়েছ। মতিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল ক্যাপ্টেন।
- না হুজুর। সে তো জন্তু জানোয়াররা খায়।
- ঠিক কথা বলেছ। আমি খুশী হয়েছি। আবার গোঁফে তা দিল ক্যাপ্টেন।
- কাঁচা মাংস খাবে।
- জ্বী না স্যার। আমরা রান্না করে খায়।
- ঠিক আছে। আজ তোমাকে কাঁচা মাংস খাওয়াবো।

গার্ডকে নির্দেশ দিল ক্যাপ্টেন। গার্ড ওদের সবাইকে স্কুল ঘরের একটা কক্ষে নিয়ে গেল। আব্দুল মতিন এই স্কুলে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পরেছে। স্কুলের কয়েকটা বেঞ্চ তেমনিই আছে। এটা ক্লাস ফোরের রুম। স্কুলের হেড মাষ্টার রথীকান্ত সেন আর ধর্ম শিক্ষক সোলায়মান হুজুরের কথা খুব করে মনে পরছে। একদিন ক্লাসে বসে ব্ল্যাক বোর্ডে রাবার দিয়ে গুলতি ছুড়েছিল। আর একটু হলে হেড মাষ্টারের টেকো মাথায় লেগে কি হতো কে জানে। সেদিন হেড মাষ্টার টেবিলের নীচে মাথা দিয়ে পাছায় কি বেতটায় না মেরেছিল। খুব ভালোবাসত মতিনকে। তারপর আবার প্যান্ট খুলে পাছায় জামবাক্ মালিশ করতে করতে বলেছিল - তোর ভালোর জন্যই মেরেছি। ক্লাসে দুষ্টামি করলে পড়া মনে থাকে না। মন দিয়ে পড়াশুনা কর। একদিন মানুষের মত মানুষ হবি। দ্যাশের জন্য তোদের লড়তে হবে। সবাই সম্মান করবে। মানুষের মত মাথা উঁচু করে বাঁচবি। কুকুর বেড়ালের মত বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। তারপর পকেট থেকে দু’টো মিষ্টি প্যারা হাতে দিয়ে বলল, এগুলো খেয়ে নে। বাড়ী গিয়ে মাকে বলিস একটু গরম স্যাঁক দিতে। ব্যাথা কমে যাবে। স্কুলের স্মৃতিগুলো মতিনের চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে ভেসে উঠে।

ভাবছে এখানে কি হবে। কত নৃশংস এই জানোয়ারগুলো। সামান্য ক’টা টাকার লোভে মেম্বারের কথায় কেন যে এখানে আসলাম। বেরিয়ে যাবারও উপায় নেয়। দু’জন পাক সেনা কাঁধে বন্ধুক নিয়ে দাড়িয়ে আছে। প্রশ্রাবের বেগে তলপেট ভারী হয়ে আসছে। লুঙ্গি ভিজে যাওয়ার অবস্থা। বাইরে যাওয়া দরকার। ফিস ফিস করে বলল লিয়াকত মোল্লাকে। চাচা অবস্থা খারাপ। লিয়াকত মোল্লার ভাবটা অন্যরকম। একজন সৈন্যকে লিয়াকত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল। সৈন্যটা মতিনকে পেছনে যেতে বলে স্কুলের বারান্দায় লুঙ্গি খুলতে বলল। লজ্জা পাচ্ছে মতিন। সৈন্যটা বলল-মুসলমানের ব্যাটা। লজ্জা কিসের। লুঙ্গিটা খুলে ঐ জমির আলে বসে যা করার করে নে। বাইরে যাবার নিয়ম নাই। না বলে কোন লাভ নেয়। মতিন তাই করল। বাইরে হালকা চাঁদের আলো। রাইফেল তাক করা আছে সৈন্যটার হাতে। পালিয়ে যাবার জো নেয়।


হেড মাষ্টারের রুমে ক্যাপ্টেন আরও ক’জন সৈন্যকে নিয়ে কি যেন আলাপ করছে। ফিরে এসে স্কুল মাষ্টারের চেয়ারে বসে পা দু’টো টেবিলের উপর তুলে দিল। লিয়াকত মোল্লাকে ডেকে পাশের টেবিলে বসতে বলল। ক্যাপ্টেন পা দুটো একটার সাথে একটা টুকছে। বেয়াদপের মত হাসছে। মুচকী হাসি। শয়তানরা যে রকম হাসে। মনে হচ্ছে কোন ফন্দি ফিকির করছে।

মতিনের মাথা ঝিম ঝিম করছে। স্যারের টেবিলে পা তুলে দেওয়ার মত বেয়াদপি আজ পর্যন্ত কেউ দেখানোর সাহস পায়নি। মাথা গরম হয়ে গেছে। ইচ্ছা হচ্ছে এই মুহুর্তে পাছায় জোড়ে একটা লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিতে। নতুবা হেড মাষ্টারের রুম থেকে বেতের গোছাটা এনে প্যান্ট খুলে ইচ্ছামত মারতে। যেমনটি মেরেছিল হেডমাষ্টার। রাগে ক্ষোভে মতিন মাথা নীচু করে রেখেছে। কিছু বলতে পারছে না।

একটা সিগারেট এগিয়ে দিল ক্যাপ্টেন। লিয়াকত মোল্লার লজ্জা হচ্ছে। হবেই তো। মনিব বলে কথা। কিছুক্ষন পর হয়তো ঘরের বৌ ঝি-কেও এনে দিতে হবে। লজ্জা করেও কোন লাভ নেয়। দিচ্ছে যখন নিতেই হবে। এমনিতেও খুব বিড়ি টানতে ইচ্ছা হচ্ছিল। আগুনটা জ্বালিয়ে দিল ক্যাপ্টেন নিজে। কাঁধে হাত রেখে বলল-
- আজ যে তোমার বিবি আর বেটির হাতের রান্না খাইতে চায়। কি খাওয়াবে যেন বলছিলে।
- স্যার রাত হয়েছে। বাইরে কিছুই পাওয়া যাবে না। ঘরে দুইটা মোরগ আছে। তাই জবাই করে দিতে বলি।
- ভালো বলছ। রান্না করে তোমার বড় মেয়েকে বলবে নিয়া আসতে।
- ঠিক আছে। তাহলে আমি যায়।
- যাওয়ার তো নিয়ম নাই।
আৎকে উঠে লিয়াকত মোল্লা। ভয় হচ্ছে। মেয়েটার উপর বদনজর পরেছে। বাপ হয়ে কিভাবে সহ্য করব। না পাঠাইয়াও উপায় নাই। জানে মেরে ফেলবে। এরা সবিই পারে।
- স্যার তাহলে খবরটা দেয় কি করে।
- তাই তো ভাবছি। শালা তোদের বাঙ্গালীদের বিশ্বাস নাই। হারামীর বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা। পাকিস্তানের নুন খেয়ে পাকিস্তানের সাথে নিমক হারামী করিস।

ক্যাপ্টেন লিয়াকত মোল্লার কানে কানে কি যেন বলছে। আর সমানে পা নেড়ে যাচ্ছে স্যারের টেবিলের উপর। লিয়াকত মোল্লা সবকিছুতে জ্বী হুজুর জ্বী হুজুর বলে সায় দিয়ে যাচ্ছে। খুব বিশ্বাসী ছেলে স্যাঁর। যা বলবেন নিজের জান কোরবান কইরা হলেও হেইডায় করবে। তাছাড়া আমাদের মেম্বার সাবতো আপনাদের খেদমতের জন্যই তো ওদের আমার সাথে পাঠিয়েছে। নতুন জায়গা। যদি কোন কাজে কামে লাগে। ওরা সব করে দেবে। এ গ্রামের সবকিছু ওরা জানে। মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন। এবার মতিনকে ডাকল লিয়াকত মোল্লা। পা দু’টো কাঁপছে। গায়ে ছোয়েটার আর মাফলার। ঠান্ডাটাও খুব তীব্র নয়। ভয়ে কাঁপছে। লিয়াকত মোল্লা মতিনকে বুঝিয়ে দিল কি করতে হবে। মুরগীগুলা জবাই করে টুকরা করে দিবা। পিসগুলা যেন একটু বড় হয়। নুরজাহানের মাকে বলবা গোশটা যেন একটু শুকনো ভূনার মত রান্না করে। স্যারের জন্য চালের রুটি বানাইতে বলবা। আসার সময় আমার নুরজাহান মা’রেও তোমার লগে নিয়া আসবা। মতিন শুধু মাথা নেড়ে সায় দিল-জ্বী আইচ্ছা, আমি পারব। আমি ঠিক এক ঘন্টার মধ্যে সব রেডি করে নিয়া আসবো। আমার উপর বিশ্বাস রাখেন।




সেই রাতে মতিন আর ফেরেনি।
লিয়াকত মোল্লার বউ গোলাপ বানু কথাটা শুনেই ঘৃণায় লজ্জায় মুখ থেকে এক দলা থুথু ছিটিয়ে বলল - ঐ হারামীর বাইচ্ছা আগে মরুক। তারপর আমরা মা-ঝি একলগে মরব। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। তুই আমাগোরে বাঁচাইলি মতিন। আল্লাহ যেন তরে কোন আপদ বালাই না দেয়। ল চল, অহনি চইলা যায়। বুকের মধ্যে ছেলে মেয়েদের চেপে ধরে। নূরজাহান আর বিলকিস ভয়ে কাঁপছে। গোলাপ বানু অনেকের কাছে শুনেছে জোয়ান মেয়েদের দিকে নাকি মিলিটারিদের কু-নজর বেশী। গায়ে কাপড় চোপড় রাখেনা। সারাক্ষন একের পর এক এসে যা খুশী তাই করে। চোখের সামনে তার দুই মেয়ের বীভৎস দৃশ্যটা ভেসে উঠে। একবার ভাবল ঘরে ধানের ঔষধ আছে। খাবারে মিশিয়ে দিয়ে সবাইকে মাইরা ফেলি। সে সাহস হয়নি। নিজেকে বাঁচতে হবে। ছেলে মেয়েগুলোকেও বাঁচাতে হবে। বাড়ীর আশে পাশের লোকজন আর কেউ কিছু জানলো না। দরকারী কিছু কাপড় চোপড় নিয়ে বাড়ীর পেছনের দরজা দিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে পালিয়ে গেল।

ক্যাপ্টেন সাহেবের তর সইছে না। রাতও অনেক হয়েছে। লিয়াকত মোল্লাকে ডেকে বলল-তোমার লোকতো ভাগছে। মোল্লা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। একটু সবুর করেন হুজুর। রান্না করতে হয়তো দেরী হচ্ছে। পাতার চুলা। ওরা ঠিকই আইসা পরবে। ক্যাপ্টেনের মাথায় অন্য চিন্তা ভর করেছে। তবে কি মতিন কি মুক্তির দলে কাজ করে। এই এলাকার মুক্তিদের তেমন কোন ষ্পষ্ট তথ্য দিতে পারেনি মেম্বার। ভিতরে ভিতরে কয়েকজন মিলে শান্তি কমিটি গঠনের কাজ চলছে। আর একটা দল আসবে কাল। একেতো সংখ্যায় কম। মাষ্টার বাবুর চেয়ারটার উপর এক পা দিয়ে দাড়িয়েছিল ক্যাপ্টেন। হঠাৎ পা নামিয়ে আদেশ করল – আমার সাথে চলো।

পাঁচ জনের একটা দল মোল্লাকে নিয়ে তাদের বাড়ীর দিকে রওয়ানা দিল। তীব্র টর্চের আলো ফেলে গ্রামের রাস্তা ধরে এগুচ্ছে। এত রাতে বাইরে কেউ জেগে নেয়। রমিজ মুন্সি আর আলী আহম্মদ অন্যান্য সৈন্যদের সাথে স্কুল ঘরেই আছে।

পশ্চিমের বিলের মাঝখানে পরীর দীঘি। চারপাশে ঘন জঙ্গল। দীঘির চারপাশে পানির উপর ঘন কচুরি পানা আর বেতস লতার আস্তর পরে আছে। মাঝখানে শুধু জলটুকু দেখা যায়। আস্তরের উপর দিব্যি মানুষ হাটতে পারে। যেন ভাসমান ভেলা। চারপাশে বিস্তির্ণ এলাকা জুড়ে সবুজ ধান ক্ষেত। জোৎ¯œা থাকলে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। তিন দিকে রাস্তা। দক্ষিণ পূর্ব দিকে শুভপুর খাল। দুটো গ্রামকে আলাদা করে রেখেছে। শুভপুর বাজার থেকে দক্ষিনে যে সদর রাস্তা তাও চোখে পরে। সবে ধানের কুড়ি মেলছে। না আজ পুর্নিমা নয়। তবুও ধানের শীষে হালকা শিশির কণাগুলো কেমন চিক চিক করছে।

ওই দীঘির পাড়ে একদল মুক্তিপাগল মানুষ জেগে থাকে সারারাত। সন্ধ্যা হলেই যে যার মত ধানের শীষে গা ছুঁইয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দলের সাথে মিলিত হয়। চারপাশে সকলের তীক্ষ দৃষ্টি। ঘোষ পাড়ার রমা চার মাসের অনাকাক্সিখত ভ্রæন পেটে নিয়ে এই দীঘির পাড়ে আম গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল। ভুতের ভয়ে কেউ এই দীঘির চার পাশ মাড়াত না। এই ছেলেগুলোর সেই ভয়ও নেই। কারও মুখে রা শব্দটি নেয়। কারও কাশি আসলে মুখ চেপে ধরে। ইশারা ইঙ্গিতে কথাবার্তা চলে। ট্রেনিং চলে। এত রাতে উত্তরের রাস্তা ধরে কয়েকটা টর্চের তীক্ষ আলো দেখে সবাই সজাগ হয়ে উঠে। তেমন কোন অস্ত্র সস্ত্র নেয়। তবে সবাই প্রস্তুত। চোখ কান খাড়া করে সবাই গতিবিধি লক্ষ্য করছে। এই দীঘিতে আসতে হলে জমির আইল ধরে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে আসতে হবে। খুব সরু জমির আইলগুলো।



মোল্লা বাড়ীর ভিতর টর্চের আলোগুলো মিলিয়ে গেল।
দলটি লিয়াকত মোল্লার ঘরে ঢুকে দেখল কেউ নেয়। কিছুটা ¯^স্তি পেল মোল্লা। শত হোক নিজের মেয়ে। প্রচন্ড ঘাম দিচ্ছে শরীরে। নিজের মনে শেষ কলেমা পরে নিচ্ছে। এরমধ্যে ক্যাপ্টেন একবার রাইফেলের খোঁচা মেরে জিজ্ঞাসা করল-কেয়া হুয়া তোমারা বেঠি। ঐ আদমী কেয়া হুয়া। শালা মাদারী ছোৎ। উস্কা ঘরমে কেয়া হুয়া। বোলাও উস্কো। লিয়াকত মোল্লার কাপড় ভিজে গেছে। তমিজ মোল্লা পাশের ঘরে। লিয়াকত মোল্লার ছোট ভাই। একটা মাত্র মেয়ে। বিলকিসের সমবয়সী। এত রাতে বুটের আওয়াজ শুনে ওরা চুপচাপ বিছানায় উঠে বসেছে। বেড়ার ঘর। কাঠের দরজাটা এক লাথি দিতেই ভেঙ্গে গেল। মেয়েটাকে কম্বল দিয়ে ডেকে রেখেছে। আর বার বার আল্লাহকে বলছে-হে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করো। শেষ রক্ষা হয়নি।

মেয়েটাকে টেনে নিল একজন সৈন্য। কালো, হ্যাংলা রোগা পাতলা শরীর। ক্যাপ্টেন বুকে হাত দিয়ে দেখল। কেঁদে উঠল মেয়েটা। মেয়েটাকে পছন্দ হয়নি। বলে উঠল ক্যাপ্টেন। ইয়েতো বহুত ছোটা লেড়কী হে। তমিজ আর তার বউ লুটিয়ে পরল ক্যাপ্টেনের পায়ের উপর। তুলে নিল তমিজের বউকে। ঠাঁই দাড়িয়ে আছে তমিজ আর লিয়াকত। তমিজের খুব হিংসা হচ্ছে গোলাপ বানুর উপর। এক বাড়ীতে তো আমরাই আছি। এই অবস্থায় বাড়ী ছেড়ে যাবার আগে একটু বলে গেলে কি হতো। আমরা কি কেউ নই। তমিজকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভাগে আনতে পারেনি বলে লিয়াকত মোল্লা খুবই নাখোশ। প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছে লিয়াকত মোল্লার উপর। মেয়েটা ভয়ে বাক্ শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। মায়ের শরীরে একটি সুতাও নেয়। একটা মাত্র ঘর। চোখ বন্ধ করে আছে দুই ভাই। এক কদমও পেছনে সরে আসতে পারছে না। দরজায় দাড়িয়ে আছে দু’জন সৈন্য। তমিজের বউয়ের মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। কেবল বুকের ভেতর থেকে একটা গোঙ্গানীর শব্দ কানে আসছে। ক্যাপ্টেন উঠে আসে। পর পর আরও চারজন। নির্বাক তমিজ মোল্লা। চোখ দু’টো যেন পাথর হয়ে গেছে। হঠাৎ ডান হাতটা নড়ে উঠল। জোড়ে একটা চড় বসিয়ে দিল লিয়াকত মোল্লার গালে। আর মুখে ছিটিয়ে দিল এক দলা থুথু। মেয়েটাকে শক্ত করে চেপে ধরল বুকে। পরক্ষনেই এলোপাতাড়ি কয়েকটা গুলির শব্দ। প্রতিবেশীদের কেউ আর ঘর থেকে বের হয়নি। আগাম বিপদ টের পেয়ে যে যার মত পালিয়েছে অনেকে। গুলির শব্দ কানে আসার কিছুক্ষন পর টর্চের আলোগুলো আবার উত্তরের রাস্তা দিয়ে ফিরে যাচ্ছে। খেয়াল করল পরীর দীঘির পাড়ে লুকিয়ে থাকা মুক্তির দল। মোল্লা বাড়ীর দিকে চোখ পরতেই দেখল দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। আগুনের লেলিহান শিখা কেবল উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। কোন জন মানুষের শব্দ নেয়। আগুন নেভাতেও কেউ এগিয়ে আসেনি। শুধু পরদিন জানা গেল লিয়াকত মোল্লাদের ঘরে আর কেউ বেঁচে নেয়।
শুধু মুক্তির দলটা অপেক্ষায় থাকে সেই দিনটির জন্য যেদিন বিজয় আসবে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ আক্তারুজ্জামান কাঁপন জাগানিয়া দিনের কথামালা। সাবলীল বর্ণনায় সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন।
জোহরা উম্মে হাসান মনে হল মুক্তি যুদ্ধের সেই সব বিভীষিকাময় দিনগুলোতে ফিরে গেছি। গল্পের ভাব , বিন্যাস , ভাষা অসাধারণ । ঝুলিতে বোধকরি আর একটা নুতুন পালক যোগ হোল বলে !
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ বাস্তবতার সাথে মিল রেখেই লেখা হয়েছে গল্পটা, তবে এমন পরিস্থিতিতে অনেক জায়গায় মুক্তিরা হামলা করেছিল শয়তানদের উপর। কারণ পরিস্থিতি মুক্তির পক্ষেই ছিল। তবু খুব ভাল লাগল।
সৃজন শারফিনুল বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। ভাল লাগলো... শ্রদ্ধা জানবেন।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি মিলনদা বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা সহ গল্পের জন্য শুভকামনা রইলোো,,,,,
সুগত সরকার অসাধারণ। অনেক ভাল লাগল। শুভেচ্ছা রইল। আমার কবিতাই আমন্ত্রন দিলাম।
আরমান আহমেদ খুব ভালো লাগলো .
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ প্রথম থেকে শেষ অবধি একটানে গেছে -- কোন পতন নেই ।। বিষয়বস্তু বেশ চিত্তাকর্ষক ---।। শুভেচ্ছা জানবেন সুপ্রিয় মিলন দা।
জুন আসিলেই তাই। খুবই সুন্দর একটি গল্প পড়লাম। শুভ কামনা রইলো।
ruma hamid একাত্তরের সেই জালিমদের প্রতি ঘৃণা স্মরণ করে বলছি- ''বাঙ্গালির উপর অত্যাচার জুলুম করে যে অভিশাপ পাকিস্তান বুকে নিয়েছিল, ফলাফল- আজ তারা নিজেরায় নিজেদের ক্ষতি করছে । কতটা ক্ষতি করছে তা বিশ্ববাসী সবাই দেখতে পাচ্ছি ।'' আপনার লেখাটি ভালো হয়েছে ।

০৭ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১১৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪