হিমু আগামীকাল চলিয়া যাইবে।
কথাটি কে যেন পেছন হইতে বলিয়া দ্রুত সরিয়া পরিল। শৈবাল পিছন ফিরিয়া কাহারও ছায়া দেখিতে পাইল না। কেবল হিমু চলিয়া যাইবে, এ কথাটি বার বার কানে বাজিতে লাগিল। শৈবালের প্রতিবিম্বটি দর্পণে স্থির হইয়া রহিল। প্রত্যুত্তরে কিছু বলিতে পারিল না। শুধু এটুকু বুঝিতে পারিল যে, আমি একজনকে গভীর ভাবে ভালোবাসিয়াছি। যে কথাটি এতদিন মনের গভীরে অস্পষ্ট ছায়া ফেলিয়াছিল, আজ তাহায় যেন স্পষ্ট হইয়া ধরা দিল।
তাহাতে কি হইয়াছে। এই ভাবিয়া মন বিচলিত হইল। মনের গহীনে একটা ক্ষীণ আলোক শিখা প্রজ্বলিত হইয়া মুহূর্তেই নিভিয়া গেল। অর্ন্তনিহিত বেদনায় নিজেকে আড়াল করিবার চেষ্টা করিল। বুঝিতে পারিল না এই মুহূর্তে কি ঘটিল। মনে হইল বিরহের নিশি ভোর হইতে এখনও অনেক বাকী। এ রজনী কাটিবে কি করিয়া ?
স্বীয় কার্যে মনোনিবেশ করিতে কিঞ্চিত বিলম্ব হইল। শরতের মেঘের মত শুভ্র ফেনাগুলো মুখমণ্ডলে শুকাইয়া যৌবন হারাইল। ফ্যাকাসে মুখখানার উপর খুরের আঁচড় পড়িল। একখানি প্রশস্ত রাজপথ তৈরি হইল যেন। এই বুঝি দু’নয়নে অঝোর ধারায় বর্ষা নামিবে। নামিল না। মনের কোণে সাজিয়ে রাখা স্বপ্ন গুলো যেন কাল বৈশাখীর প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে কোন মূহুর্তে সব লন্ড ভন্ড করিয়া দিবে।
ইচ্ছা হইল, এখুনি টুটি চাপিয়া জিজ্ঞাসা করি- হিমু কোথায় যাইবে ? কেন যাইবে ? তার কিছুই করিল না। চক্ষু দুটি ছল ছল করিয়া উঠিল। আয়নায় ভালো ভাবে নিজেকে দেখিবার চেষ্টা করিল। চক্ষু ঝাপসা হইয়া আসিল। বাম গালে অনেকটা কাটিয়া গিয়াছে। লাল রক্তের ধারা নামিয়া অধরে মিশিল। বিস্মিত হইল না। ভাবিল অসংযত মুহূর্ত এমনটিই স্বাভাবিক।
মনের আয়নায় হিমুর পষ্ট ছায়া পড়িল অনেক্ষণ। ধীরে ধীরে তাহা সরিয়া আসিয়া দর্পণে আশ্রয় লইল। তাহাতে রংধনুর সাত রং মিশিল। জোৎস্নালোকিত ধরণীর কিঞ্চিৎ স্নিগ্ধতা আসিয়া ভর করিল। মুখশ্রী রক্তাভ। অধর রঞ্জিত করিয়া মৃদু হাসি ফুটিয়া উঠিল। শৈবালের মনে হইল - এই বুঝি সমুদ্রতটে নিঃসঙ্গ কোন পথহারা পথিককে কপাল কুন্ডলা বেশী কেউ পেছন থেকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিবে - পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ ? জিজ্ঞাসা করিল না।
শৈবাল আয়নায় নিজের চেহারা দেখিবার ব্যর্থ চেষ্টা করিল। যতই চেষ্টা চলিল আয়নার ভিতর সেই মুখশ্রী হাসিয়া খুন হইল। বলিতে লাগিল - তুমি বার বার আমাকে দেখিতেছ, তোমাকে নয়। আমি তোমার সবকিছু জয় করিয়া লইয়াছি।
শৈবাল জিজ্ঞাসা করিল - তুমি কি চলিয়া যাইতেছ ?
- হুঁ
- তবে কি আর ফিরিবে না?
- কি করিয়া বলিব?
- আমিও কি শূন্য হাতে ফিরিয়া যাইব?
হিমু চুপ করিয়া রহিল। চোখের ভাষা বিষাদে পরিপূর্ণ হইল। শৈবাল ডাকিল - হিমু।
তথাপি হিমু কথা বলিল না। দু’ফোটা অশ্রু গড়াইয়া পড়িল দু’গন্ড বেয়ে। তাহাতে দৃষ্টি কিছুটা পরিচ্ছন্ন হইল। শৈবাল অবারও বলিল-
- হিমু, আজ যে সত্য আমি উপলব্ধি করিয়াছি তাহা কি চিরতরে নিভিয়া যাইবে ? মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত হইবে ? আমি তোমাকে ভালোবাসিয়াছি। এ যে চির সত্য। শ্বাশত। কত রজনী ভাবিয়াছি তোমাকে সব কিছু খুলিয়া বলিব। বলা হয়নি। তবে আজ তোমার বিদায়ক্ষণে আমার হৃদয়ে এমন করিয়া ব্যথার সুর বাজিয়া উঠিল কেন ?
বড় ব্যাঙ্গ করিয়া হাসিল হিমু। বলিল-এখানে আমরা মানুষরা বড় অসহায়। আমাদের কামনা বাসনাগুলি নিমিষেই কর্পূরের মত মিলাইয়া যায়। প্রতি পদে পদে সমাজের সমালোচনার শিকল। অনিচ্ছায়ও এড়াইয়া চলিতে পারি না। সমাজ সংস্কার সব যেন মনের উপর পাথর চাপা দিয়া রাখিয়াছে। উপেক্ষা করিলে দ্বিধা দ্বন্দ্ব আসিয়া গতিরোধ করে।
হিমু থামিল। কান্নায় কণ্ঠ স্তব্ধ হইয়া আসিল। যাহা বলিতে চাহিল তাহাতে যেন আবেগের চাইতে ক্রোধ টায় বেশী। চোখের জলই যেন নারীদের প্রতিবাদের ভাষা। হিমু চোখের জলে প্রতিবাদ করিল। এ সমাজের নিষ্ঠুর কুসংস্কারের জন্য ব্যথিত হইল। তাহাতে সামাজিক কুসংস্কার কতটুকুই বা কমিবে। কিছুক্ষণ থামিয়া আবার বলিল - বিশ্বাস করো, আমি বড় অসহায়। কতবার কত কি বলিতে গিয়া পিছন ফিরিয়া ভয়ে ভয়ে তাকাইয়াছি, কেউ দেখিল কিনা ? অথচ কোন পাপের কথা বলিবার জন্য এত ভয় ছিল না। নিতান্ত সত্য কথাটায় বলিতে পারিতাম না। ভয় হইত। মনের আকর্ষণটা দুর্বল চিত্তে কান্না হইয়া বাজিত। আজ চলিয়া যাইতেছি বলিয়া ভাবিও না। আবার ফিরিয়া আসিব।
শৈবালের অন্তরে কত স্মৃতিই রোমন্থিত হইল। একটি মধু যামিনীর ছবি সহসা আসিয়া ধরা পড়িল স্মৃতির দুয়ারে। ভাবিল এরকম আর একটি রাত যেদিন আসিবে সেদিন নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করিয়া দিব। নিজের বলিয়া কিছুই রাখিব না। হিমুর মধ্যে আমার আমিকে খুঁজিয়া লইব। সব বলিতে গিয়া হয়তো সময় হইবে না। সব কিছু দিয়া সহসা নিজেকে নিঃস্ব করিয়া লইব। মুখে বলিল - তবে যাইতেছ যখন ক্ষণিক দাড়াও।
শৈবাল অধরের টলটলায়মান রক্ত বিন্দুটি অনামিকার অগ্রভাগে লইয়া রঞ্জিত করিল। তারপর শরৎ শশীর শূন্য ললাটে অনামিকার অগ্রভাগ স্পর্শ করিয়া বলিল - তবে এই দিলাম। হিমুর চোখে জল আসিল। হাসিবার চেষ্টা করিয়াও নিজের সহিত প্রতারিত হইল। মন যা ভাবিল মুখে তার ছায়া পড়িল। হিমু আয়না হইতে সরিয়া দাড়াইল বটে, শৈবালের মন থেকে মুছিয়া গেল না।
চপ্পল পড়িতে গিয়া গোলমাল বাঁধিল। এক পাটি কোথায় হারাইয়াছে। কিংবা মনের অজান্তে কোথায় যেন লুকাইয়া রহিল। অন্ন ব্যঞ্জনে বিষাদ মিশ্রিত হইল। খাইতে বসিয়া জলটুকু গলাধঃকরণ করিয়া উদর পূর্তি করিল। তাহাতে দেহের উপর একটা লঘু ভার উপস্থিত হইল। দেহ ও মনের কোন মিল খুঁজিয়া পাইল না। দু’টোই যেন অবশ। টেনে হিচঁড়ে কোন ভাবে দেহটাকে নিয়া যাওয়া হইতেছে।
বেলা দশটা বাজিল।
অফিস যাইতে বিলম্ব হইল। বড় বাবু চোখ কপালে তুলিয়া বলিল - অফিসটা মামার বাড়ী নয়। যখন খুশি আসিবেন, আবার চলিয়া যাইবেন। ভালো লাগে তো চাকরী করুন, নয়তো অন্য রাস্তা দেখুন। শৈবাল এ অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করিতে পারিল না। বিলম্বের নির্দিষ্ট কোন কারণ দর্শাইতে পারিল না। মাথা নিচু করিয়া নিজের আসনে গিয়া বসিল। ভয় হইল পাছে আবার চাকরীটা না হারাইতে হয়। কয়েকটা ফাইল এপিঠ ওপিঠ নাড়া চাড়া করিয়া বসিয়া রহিল।
অবনী বাবু পুরানো কর্মচারী। গলা উঁচু করিয়া জিজ্ঞাসা করিল - কি হে বাবু, কি ঘটিয়াছে। চেহারায় যে শ্রাবণের মেঘ জমিয়াছে। বলি এখনও বিয়ে থা করেন নি। মনোযোগ দিয়ে কাজ করিয়া যান। ভবিষ্যতে সুখ পাইবেন। আমাকে দেখছেন তো, একই চেয়ারে ত্রিশ বছর ধরিয়া আছি। আরও কিছু যেন বলিতে যাচ্ছিল। হেড ক্লার্ক ভুবন বাবু থামাইয়া দিয়া বলিল - অত জ্ঞান দিচ্ছেন কেন মশায়। পারলে নিজের ভাগ্যটা একবার ফিরাতে চেষ্টা করুন। এখন আর পাজামা পাঞ্জাবীর দিন নেই, পারলে গায়ে কোট প্যান্ট তুলুন। ভুবন বাবু বিদ্রূপের হাসি হাসিলেন। একটা ফাইল শৈবালকে দিয়া বলিলেন - এই মাসের সেলারী বিলটা আজই করিয়া দিন। কাল বেতন দিতে হইবে।
ফাইল খুলিয়া কাজে মনোনিবেশ করিতে চেষ্টা করিল। পারিল না। একটা হিমু যেন সব ওলট পালট করিয়া দিল। ভাবিল - হিমু, তুমি চলিয়া গেলে আমার বড় কষ্ট হইবে। তোমাকে কি করিয়া বুঝাইব। আমি যেদিন প্রথম শহরে আসিলাম, সেদিন তোমার কষ্ট আমি বুঝিয়াছি। অন্তর দিয়া তখন এতখানি অতলান্ত ভাবিবার শক্তি ছিল না। এত বড় সত্যটা সেদিন অনাবিষ্কৃত ছিল। কিঞ্চিৎ বুঝিতে পারিলেও তোমার কাছে প্রকাশ করিনি। শহরে চলিয়া আসিলাম। ভাবিলাম একদিন সময় করিয়া তোমাকে সব খুলিয়া বলিব।
সপ্তাহ পরে আবার দেখা হইল। তোমার কিভাবে কাটিল জানি না। আমার খুব কষ্ট হইল। কেবলই মনে হইতে লাগিল আগামী সপ্তাহ বুঝি আর আসিবে না। দু’কলম চিটিও লিখিয়াছিলাম। তুমি কি ভাবিবে মনে করিয়া আর দেওয়া হয় নাই। যেদিন দেখা হইল, তুমি কিছু না ভাবিয়া আমাকে জড়াইয়া ধরিলে। আনন্দে চক্ষু দুইটি ছল ছল করিয়া উঠিল। তোমার আবেগ আপ্লুত হৃদয়ে একটি নতুন বেদনা আবিষ্কার করিলাম। সে আমার ফিরিয়া যাইবার প্রতীক্ষা। সেই মুহূর্তে বিধাতা বুঝি পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য তোমার মাঝে সঁপিয়া দিয়াছিল।
তুমি বোধ হয় ভাবিয়াছিলে, শহরের সব নতুনত্বের মাঝে আমি সব ভুলিয়াছি। আসলে ভুলিতে পারিনি। সেদিন আমারও খুব কষ্ট হইল। চোখে জল আসিল। তা তোমার কাছে প্রকাশ করিলাম না। সংগোপনে মুছিয়া লইলাম। তুমি কষ্টের মাঝেও আমাকে হাসতে হাসতে বিদায় দিলে।
ভুবন বাবু আসিয়া আরেকবার কটাক্ষ করিয়া বলিয়া গেল - বড় সাহেবের হুকুম, বিলটা আজই তৈরি করিতে হইবে। নচেৎ সকলের চাকরী যাইবার সমূহ সম্ভাবনা। মিলের শ্রমিকরা বেতনের জন্য আন্দোলন শুরু করিয়াছে। শৈবাল মাথা নিচু করিয়া বলিল - আর বলিতে হইবে না। আজই কাজটা শেষ করিয়া দিব।
প্রাইভেট অফিসের চাকরী। শুরুটা যথাসময়ে ঘটিলেও শেষটা কতক্ষণে হইবে তা কেবল বড় কর্তাই জানেন। মানুষের দেহের উপর জোড় খাটানো যায়, মনের উপর নয়। শৈবাল যাহা করিল তাহাতে যোগ বিয়োগে কিঞ্চিত ভুল হইবার সম্ভাবনা বেশী। সুতরাং চাকরী যাইবার আশংকাও অতিমাত্রায় ঘনীভূত হইল।
রাত্রি নয়টা বাজিল।
শৈবাল বাহিরে আসিয়া খোলা আকাশের ছাদটা একবার ভালো করিয়া দেখিয়া লইল। হালকা মেঘ জমিয়াছে। বৃষ্টি আসিতে পারে। অন্ধকারটা অন্ধকার বলিয়া মনে হইল না। চারিদিকে বৈদ্যুতিক বাতির ঝিলিক। আলোয় আলোয় ভরিয়া গিয়াছে সারা শহর। শৈবালের অন্তরে শুধু নিশ্ছিদ্র জমাট বাঁধা অন্ধকার। ঘোর অমানিশা চিরজীবনের জন্য বুঝি আসন পাতিয়া বসিয়াছে। তাহাকে তাড়াইব কি করিয়া।
পথিমধ্যে বৃষ্টি আসিল। প্রবল বৃষ্টি।
শৈবাল নিরাপদ আশ্রয়ে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করিল না। উপরন্তু অবেক্ষণ সময় পায়ে হাঁটিয়া বৃষ্টিতে ভিজিয়া বাসায় ফিরিল। গা মুছিল। কাপড় পাল্টাইতে গিয়া শীতে সর্বাঙ্গ কাঁপিয়া উঠিল। মন ছুটিল হিমুর পিছনে। হিমু কোথায় যাইবে ? কেন যাইবে ?
হিমুর রক্তবর্ণ মুখখানির উপর একখন্ড সূর্যকিরণ আসিয়া লুকোচুরি খেলিতেছে। কাঁচের জানালা খোলা রাখিয়া বার কয়েক বাহিরে তাকাইল। তাহাতে মন ভরিল না। অন্য সময় হইলে বেশ লাগত। চুপ চাপ মুড়ির টিনটা হাতের কাছে লইয়া দীর্ঘ সময় ধরিয়া বৃষ্টির শব্দ শুনিত। আর ভাবিত কষ্ট সহ্য করিতে না পারিয়া আকাশটা বুঝি এইভাবে কাঁদিয়া বুক ভাসাইতেছে। হিমুর যাত্রা দ্রুত হইতে দ্রুততর হইল। একটা যন্ত্রদানব হিমুকে যেন কোথাও লইয়া যাইতেছে।
চৌকির উপরে একখানি আসন পাতিয়া শৈবাল ঘুমাইয়া পড়িল। কোথায় যেন রবীন্দ্র সংগীত বাজিয়া উঠিল-
আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস,
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস।
রাতে শরীর কাঁপিয়া প্রচন্ড জ্বর আসিল। ঘরে গরম কাপড়, কাঁথা কম্বল তেমন বিশেষ কিছু নেই, যা দিয়া শরীরের উষ্ণতা ফিরিয়া আসিবে। তবুও চেষ্টার ত্রুটি করিল না। সমস্ত জামা কাপড়গুলি এক এক করিয়া গায়ে জড়াইয়া দিল। তারপর মায়ের হাতে সেলাই করা ফুলের কাঁথাটায় সর্বাঙ্গ ঢাকিয়া শুইয়া পড়িল। তাহাতে মনের ভয়টা ভীষণ বাড়িয়া গেল। এই বুঝি মৃত্যু আসিয়া আলিঙ্গন করিবে। ভুবন বাবুও যেন মৃদু হাস্যে বলিয়া গেল - আপনার আর চাকুরী করিবার আবশ্যক নাই। বড় বাবু বড়ই মনঃক্ষুণ্ণ হইয়াছেন।
শৈবালের মনে একটা প্রশ্ন জাগিল। বড় বাবু কেন একবারও ভাবিলেন না যে, কেন এরকমটি হইল? মানুষের ভুল হয়। এবং তা অনিচ্ছাসত্ত্বেও হইয়া থাকে। নিত্যদিন যদি শৈবালের ভুল হইত, তবে তো পাঁচ বৎসর আগেই বিদায় লইতে হইত। তেমন ভুলতো কখনও হয় নাই। বরং যতদিন ছিল বড় বাবুর প্রিয়ভাজন হয়েই ছিল। আজ এই ভুলটা কি বড় বাবু ক্ষমা করিতে পারিতেন না?
যমদূত আসিয়া মাথার উপর হাতছানি দিয়া ডাকিল। শৈবাল অতি কষ্টে বার কয়েক যাবে না বলিয়া ক্ষান্ত হইল। যমদূত তো ফিরিবে না। যাহাকে পৃথিবী হইতে তুলিয়া নিবার আদেশ হইয়াছে তাহাকে নিতেই হইবে। নচেৎ যমরাজ ক্রুদ্ধ হইবেন এবং রাজসভা হইতে বিতাড়িত করিবেন।
মৃত্যু যন্ত্রণায় বড় কষ্ট হইতেছে। সারা শরীর ঘামে সিক্ত হইয়া উঠিল। এই বুঝি জ্বরটা ছাড়িল। ব্যাচেলর বাসা। পাশে মাও নেই। থাকলে হয়তো মাথায় জলপট্টি দিয়া কিঞ্চিত আরোগ্য করিয়া তুলিতে পারিত। কিংবা ছুটিয়া গিয়া নিবারণ কবিরাজকে ডাকিয়া আনিত। ব্যাকুল চিত্তে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করিত। মায়ের অস্থির চিত্তের একটা ছবি ভাসিয়া উঠিল মানসপঠে। শৈবাল ভাবিল আমি চলিয়া গেলে মা বাঁচিবে কি করিয়া। আমার মৃত্যু সংবাদ মাকে পাগল করিয়া তুলিবে। ব্যথিত করিয়া তুলিবে। হয়তো পুত্রশোকে তিনিও ইহধাম ছাড়িয়া যাইবেন। মায়ের কি ঘটিবে তাহা কি করিয়া জানিব ? আর কেউ তো মায়ের মত বিচলিত হইবে না।
হিমুর কথা মনে হইল। কি কষ্টটাই না হইবে? কেমন করিয়া সে নিজেকে সান্ত্বনা দিবে ? কিছুদিনের জন্য দূরে সরিয়া আমি হিমুর কষ্ট বুঝিয়াছি। আমার চিরবিদায়-এ হিমু কি পাগল হইয়া যাইবে ? কিভাবে কাটিবে হিমুর বাকী দিনগুলি ? আমার খুব জানিতে ইচ্ছা করিতেছে। বোকার মত সাত পাঁচ ভাবিয়া শৈবাল কিঞ্চিৎ পুলক লাভ করিল। মৃত্যু চিন্তা কিছুটা লাঘব হইল বটে, কিন্তু জ্বর কমিল না।
ক্রমে জ্বরের বেগ বাড়িতে লাগিল। বগলে থার্মোমিটার দিয়া জ্বর মাপিবার কেউ নাই। কয়েকটি ছারপোকা নির্বিঘ্নে ছুটাছুটি করিতেছে। দল বাঁধিয়া রান্নার হাড়ি পাতিলগুলো উপড়াইয়া ফেলিবার প্রচেষ্টায় বার বার ব্যর্থ হইয়া ফিরিতেছে। ধাড়ি ইঁদুরের দল আলোর সামনে আসিয়া উৎপাত করিবার সাহস পাইতেছে না। চৌকির নীচে আবর্জনাগুলো ছিঁড়িয়া খুঁড়িয়া খাইতে লাগিল। তার প্রতিক্রিয়া আসিয়া বাজিল শৈবালের কানে। খট্ ... খট্ ... খট্র ... খট্র ... ।
তাড়াইবার ইচ্ছা হইল না। সে শক্তিও নাই। ভাবিল ওরা মনের আনন্দে বিচরণ করিতেছে করুক। তাতে আমার কি যায় আসে ? জীবনের কত আবর্জনাইতো এভাবে পড়িয়া রহিয়াছে। তাহা সাফ করিবার লোক কোথায় ? সময়ের প্রয়োজনে এসব ক্ষুদ্র জঞ্জাল গুলিও নিঃসঙ্গ মানুষটির বড় আপন বলিয়া বোধ হইল। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর পার হইল। ইতিপূর্বে শরীরে ঘাম আসিয়া জ্বর কমিল। তন্দ্রার ঘোর লাগিল দু’টি চোখে। তাহাতে জীবনের সমস্ত চিন্তা ভাবনাগুলো মিলাইয়া গেল। বুঝিতে পারিল না কখন কি ঘটিয়াছে।
সবে ভোরের আলো ফুটিয়া উঠিয়াছে। বাহির হইতে দরজার কড়া নাড়িবার শব্দ শুনিয়া শৈবাল জিজ্ঞাসা করিল - কে ? কোন সাড়া না পাইয়া দরজা খুলিয়া দিল। একটি নারী মূর্তি ধীর পদে ভিতরে প্রবেশ করিয়া ক্ষীণ স্বরে কহিল, দরজা বন্ধ করিয়া দাও।
শৈবাল দরজা বন্ধ করিয়া নারী মুর্তির সামনে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল - কে তুমি ? কেন আসিয়াছ ? নারী মূর্তি উপুড় হইয়া প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাড়াইল। ঘোমটা সরাইয়া বলিল- আমি হিমু। আমি পলাইয়া আসিয়াছি। আমাকে ঠাঁই দাও। হঠাৎ হিমুর সান্নিধ্য শৈবালকে বিহ্বল করিয়া তুলিল। নিজেকে সংযত করিয়া বলিল - আসিয়াছ যখন থাক্। ক’দিন পর ফিরিয়া যাইও। কাকা বাবু শুনিলে মনে বড় ব্যথা পাইবেন।
হিমু প্রতিবাদ করিয়া বলিল-না। আমি ফিরিয়া যাইব না। তুমি না আমার সিঁথিতে সিঁদুর পরাইয়াছ ? আমি তোমার কাছে আসিয়াছি। ফিরিয়া যাইতে আসি নাই।
- কিন্তু পলাইয়া আসিয়াছ কেন ?
- সে কথা পরে বলিব।
- না এখনি বল।
- তবে শোন, বলিয়া হিমু সম্পূর্ণ অবগুণ্ঠন নিজের হাতে সরাইল। তুমিতো জান, কাকীমার ঘরে আমি বড় হইয়াছি। এতকাল জানিয়াছি কাকীমা-ই আমার মা। আজ সে ভুল ভাঙ্গিল। আমার কাকাতো বোন মিনুদি। বিবাহ যোগ্যা হইয়াছে। বাবাকে ভুলিয়াছি সেই কবে। কাকার আদরে বাবার দুঃখটা ভুলিয়াছি। সে যাকগে। হিমুর দু’গন্ড বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু ঝড়িয়া পরিল। হাতের তালুতে মুছিয়া লইয়া নিজেকে স্বাভাবিক করিবার চেষ্টা করিল।
- তারপর? জিজ্ঞাসা করিল শৈবাল।
- মিনুদিকে দেখিবার জন্য পাত্র আসিত। আবার কিছু না বলিয়া চলিয়া যাইত। এ সংসারে মেয়েদের হাতের পায়ের নখ পর্যন্ত খুঁটিয়া খুঁটিয়া দেখিয়া লইবার চেষ্টা করে পাত্র পক্ষ। পছন্দ হইলেও সন্দেহ থাকিয়া যায়, ঠকিলাম না তো ? অদৃশ্য কোন খুঁত থাকিয়া গেল কি না ? অথচ মনটা একবারও দেখিবার চেষ্টা করে না। এ যেন পুরুষের মনো রঞ্জনে মেয়েদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। মিনুদিকে বুঝি কাহারও পছন্দ হইল না। দু’একজন আমাকে বিবাহ করিবার প্রস্তাব করিয়া পাঠাইল। সবাই ভাবিল আমার জন্য মিনুদির বিবাহ হইতেছে না। মিনুদিকে দেখিতে আসিলে আমাকে গৃহবন্দী করিয়া রাখিত।
চোখের জল কাহারও বাঁধা মানে না। হিমু চোখের জল মুছিয়া বলিল-আর বলিতে পারিব না। আমাকে ক্ষমা করো।
- হিমু। শৈবাল ডাকিল।
- কি ?
- ওরা কি তোমার বিবাহ ঠিক করিয়াছিল ?
- হ্যাঁ। লোকটা মাতাল। আগের সংসারের একটা ছেলেও আছে।
- হিমু, কাকা বাবুকে বুঝাইয়া বলিলে তিনি এত নিষ্ঠুর হইতে পারিতেন না। আমি একবার বলিয়া দেখিব। তুমি অস্থির হইও না।
হিমু শৈবালের আরও কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল-
- না না। তার আবশ্যক নাই। তুমি ফিরাইয়া দিলে তবে ঐ মাতালের ঘর করিতে যাইব। শুধু তুমি অনুমতি দাও।
- আমার অনুমতি কেন ?
- জানি না। আমি জানি না বলিয়া হিমু শৈবালের বুকে লুটাইয়া পড়িল।
শৈবাল হস্ত দ্বারা চিবুক স্পর্শ করিল। আরও নিবিড় সান্নিধ্যে আসিয়া বলিল - অনুমতি দিব না। তুমি আমার হইয়া আমাকে সুখী করিও। আমার সত্যটা বাঁচিয়া থাকুক চিরকাল। ভগবানের চরণে এই মিনতি।
বেলা বাড়িয়াছে দেখিয়া প্রতিবেশী ক’জন অনেক ডাকা ডাকি করিল। কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অবশেষে স্থানীয় মান্য ব্যক্তিদের লইয়া দরজা ভাঙ্গিয়া শৈবালের ঘরে প্রবেশ করিল। আরশোলা গুলো দ্রুত সরিয়া পড়িল নিরাপদ আশ্রয়ে। ইঁদুরের দল চৌকির নীচে সরিয়া পড়িল। আলোটা জ্বলছে সারাক্ষণ। শৈবাল তেমনি ঘুমিয়ে আছে। পাশ থেকে আরও কয়েকটা আরশোলা দ্রুত পলাইল। গুরুজনদের একজন শৈবালের মাথার কাপড় সরাইয়া দেখিল। শৈবাল তেমনি নিশ্চল, নিথর। ঘুমিয়ে আছে গভীর ঘুমে। আর কখনও জাগিবে না।
থানার বড় কর্তা আসিয়া বিষণ্ণ বদনে আদেশ করিলেন-লাশ মর্গে লইয়া যাও। পোষ্ট মর্টেম রিপোর্ট তৈয়ার করিতে হইবে। টেবিলের উপর পড়িয়া আছে একটি আয়না। আয়নার মাঝখানে একটি আঙুলের ছাপ। রক্তের দাগটা শুকিয়ে কালচে হয়ে গিয়েছে। দারোগা বাবু আলামত হিসাবে আয়নাটি নিজের কাছে রাখিয়া দিলেন।
সাদা কাপড়ে ঢাকা শৈবাল যাত্রা করিল চির সত্যের সন্ধানে। শেষ গন্তব্যে। কেবল কাউকে বলিতে পারিল না - তবে চলি, বিদায়।
০৭ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১১৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪